২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। আমি তখন ঢাবির কেন্দ্রীয় পাঠাগারে তিনতলায় বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় খবর আসলো পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে বোমা হামলা হয়েছে। অনেক লোক নিহত, আহত। তাদের মধ্যে খুব সম্ভবত শেখ হাসিনাও আছেন।
এ খবর চাউর হওয়া মাত্র পুরো লাইব্রেরি ফাঁকা হয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে দেখি ক্যাম্পাস কেমন যেন নিশ্চুপ, থমথমে। বন্ধুদের সাথে আমিও হলের দিকে রওনা হলাম। হল গেটে দেখি ছাত্রদল নেতা মিজান ভাই মোটর সাইকেলে বসে আছেন। তাকে ঘিরে ছাত্রদের জটলা। জটলার কাছাকাছি হতেই শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন- "এইডা আওয়ামী লীগ নিজেরাই ঘটাইছে। রমনা বটমূলে, সিপিবির জনসভায় যেইভাবে হেরা গোপনে বোমা হামলা করছিল, এইবারও তারা নিজেগোরে মাইরা অন্যের উপরে দোষ চাপাইতে চাইতাছে।"
তার এ কথা পরবর্তীতে বিএনপির অনেক বড় বড় নেতা নেত্রীর মুখে শোনা গেছে। গ্রেনেড হামলার এ তত্ত্বটিকে সত্য বানাতে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামাত জোট তখন উঠে পড়ে লেগেছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর, স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক, এনএসআই প্রধান, পুলিশ প্রধান থেকে শুরু করে প্রশাসনের সবাই তখন আকার ইঙ্গিতে একই ঢোল বাজাতে শুরু করেছিলেন। এমনকি পাকিস্তানের তৎকালীন হাইকমিশনারও এই তত্ত্বটির সাথে সুর মেলান (সূত্র:প্রথম আলো)। তখনকার জোটপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এবং জোট সমর্থিত মিডিয়াগুলোও তাতে তাল মেলায়। এ ঘটনা তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রধান, বিচারপতি জয়নুল আবেদীনও এই ঘটনার সাথে পাশের একটি দেশ জড়িত আছে বলে রিপোর্ট দিয়ে জোট সরকারকে প্রকারন্তরে দায় মুক্ত করেন। এই সুযোগে জোট সরকারও পার্থ প্রতিম সাহা, জজ মিয়া-র মত নিরীহ লোকদের গ্রেপ্তার করে পাশের দেশ কর্তৃক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মনগড়া কাহিনী বানিয়ে বগল বাজাতে থাকে।
কিন্তু এখন এটা প্রায় পরিষ্কার যে নৃশংস এই হামলার পেছনে তৎকালীন সরকারের মদদ ছিল। হামলার সরাসরি অংশ নেয়া হুজি, জেএমবি বা হরকাতুল জিহাদের মত ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলোর ঘাড়ে বন্দুক রেখে সে সময় গুলি করেছিল অন্য কেউ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর, তৎকালীন পুলিশ প্রধান, এনএসআই প্রধান, ডিজিআইএফ প্রধান, হামলার পরিকল্পনাকারী জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মুফতি হান্নানসহ অন্যসব আসামীদের বক্তব্যে এটা জোরালোভাবে উঠে এসেছে যে তৎকালীন সরকারের উপর মহলের অনেকেই এই হামলার কথা জানত। হামলায় শেখ হাসিনা নিহত না হওয়ায় ঘটনার মাস্টামাইন্ডদের তোপের মুখেও পড়ে হামলাকারীরা। এমনকি সেসময়কার প্রশাসন হামলায় গ্রেনেড সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দীনকে ভুয়া পসপোর্ট বানিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল তা প্রমাণিত সত্য। এসব কারণেই আওয়ামী লীগ নেতারা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখন সরাসরি বলতে পারছেন যে ওই হামলার সাথে বিএনপি সরাসরি জড়িত ছিল।
২০০৪ সালেই চারিদকে কানাঘুষা ছিল যে হাওয়া ভবন ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত এই হামলার পেছনে রয়েছে। এবং সে সময় দেশ জুড়ে হাওয়া ভবনের যে গাছের পাতা নড়লেও খবর জানি টাইপের বাদশাহী দাপট ছিল তাতে মানুষের মনে এ ধারনা হওয়াটা অমূলক নয়। এবং এটি যদি সত্যি বলে প্রমাণিত হয় তবে ভবিষ্যত বিএনপির জন্য তা হবে একটি বড় ধরনের আঘাত। বিশেষ করে তাদের নেতা তারেক রহমানের যেটুকু জনপ্রিয়তা অবশিষ্ট আছে সেটিও ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
বিএনপি তাই ২১ আগস্টের বর্তমান তদন্তকে আগেভাগেই প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিচ্ছে। এবং আমি নিশ্চিত পরবর্তীতে তারা যদি ক্ষমতায় যায় তবে এই বিচারের মোড়টি তারা আবার ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। তাতে কি তাদের লাভ হবে? আমার মনে হয় হবে না। কারণ তারেক রহমানের দুর্নীতির মতোই এই গ্রেনেড হামলার কলঙ্কের দাগ বিএনপির গায়ে লেগে গেছে। অতি কট্টর দু'একজন বিএনপিমনা এবং খোন্দকার দেলোয়ারের মত খালি মাথার কেউ কেউ ছাড়া আর সবার কাছেই এটি ফকফকা।
২০০৪ সালেই বেগম জিয়ার উচিৎ ছিল ঘটনাটির সুষ্ঠ তদন্ত নিশ্চিত করা। যেহেতু বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই বিরোধী দলের ওপর এমন হামলা হয়েছিল সেহেতু দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই তাদের দায়িত্ব ছিল ঘটনাটির যথাযথ সুরাহা করা। এটি করলে বিএনপিই বাহবা পেত, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় বেগম জিয়ার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকত। বেগম জিয়া সেই সুযোগ নষ্ট করেছেন। এবং ফলশ্রুতিতে সে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং দেশের গণতন্ত্র ছদ্মবেশী সামরিক অপশাসনের হাতে দুই বছরের জন্য কুক্ষিগত হয় তার দায় দায়িত্ব তিনি কখনোই এড়াতে পারবেন না।
বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস ঘাটলে যা দেখা যায় সে অনুযায়ী সত্য কখনো চাপা থাকবেনা। ২১ আগস্ট, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যাত্রাপথে একটি লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে। তাই বিএনপির উচিৎ হবে তাদের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যত স্বার্থে এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত এবং প্রকৃত দোষীদের শাস্তিতে সহায়তা করা। আওয়ামী লীগেরও উচিত হবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে থেকে ঘটনাটির তদন্ত ও বিচার কাজ সমুন্নত রাখা। তা না হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আবার ঘটতে বাধ্য। যা শুভ বুদ্ধির কোন বিবেকবান মানুষেরই কাম্য নয়।
২১/০৮/২০১০
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
মন্তব্য
চমৎকার লেখা। কিছু তথ্যসুত্র সংযোজন লেখার ধারকে আরো বাড়িয়ে দিত।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ধন্যবাদ। আমি আপনার সাথে একমত তথ্যসূত্র থাকলে ভাল হতো। আমার তথ্যসূত্র বেশির ভাগই আসে পত্রিকা, ম্যাগাজিন থেকে.....কিন্তু কোন তথ্য যে কোথা থেকে নিয়েছি তা খুজেঁ বের করা সময়সাপেক্ষ....এবং এই বিদেশে আমার সময়ের বড় অভাব তাই তথ্যসূত্র ছাড়াই কাজ চালাতে হয়....তবে ভবিষ্যতে এটি দেয়ার আপ্রান চেষ্টা করব...
মূর্তালা রামাত
আমার মনে হয় না তারেক রহমানের "জনপ্রিয়তা" এই কুকামের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ধ্বসের মুখে পড়বে। তারেক রহমান জনপ্রিয় হালুয়া-রুটির সুযোগ করে দেয়ার জন্য। রিকশা চালিয়ে পেট চালানোর যোগ্যতাও নাই, এরকম কিছু লোকজন তারেকের গায়ে গা ঘষে কোটিপতি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তারেকের জনপ্রিয়তা এদের কাছেই। যারা মুজিব হত্যাকে ব্যঙ্গ করে বলে "এক নেতার এক দ্যাশ এক রাইতে কাম শ্যাষ", তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার চেষ্টাকে নিন্দা করবে, এ কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না।
যেটা বলেছেন তা ফেলে দেয়া যায় না তবে আশা করতে দোষ দেখি না।
মূর্তালা রামাত
আসলেই এই ঘটনার একটা সুষ্ঠু সুরাহা হওয়া দরকার। বি এন পি'র লাফাঙ্গা গুলারে পাব্লিকের সামনে ধইরা লেঙ্গটা কইরা দিতে মঞ্চায় ... ...
===============================================
ভাষা হোক উন্মুক্ত
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
সুষ্ঠ সুরাহা হওয়া উচিত..তবে হবে কি?
মূর্তালা রামাত
এইটা কী বললেন ! নিজেরাই যদি এর মদদদাতা এবং উদ্যোগগ্রহণকারী হয় তাহলে সুষ্ঠু তদন্ত করবে তারা ! ঘটনার সুরাহা তো করতেই চেয়েছিলো পার্থ, জজ মিয়াদের শিখণ্ডি বানিয়ে ! শেষপর্যন্ত রক্ষা হয় নি।
তবে এখন এর সুষ্ঠু সুরাহা দরকার। রাজনীতি ও সমাজনীতির প্রয়োজনেই। নইলে সবার জন্যেই এটা একটা অন্ধকূপ হয়ে থাকবে।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান-এর ভাষ্যমতে ঘটনার পরপরই তিনি যখন বেগম জিয়ার সাথে দেখা করতে যান তখন তাকে খুব বিচলিত এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল, তিন বারবার সম্পাদক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করছিলেন যে এ ঘটনা কারা ঘটাতে পারে?
অর্থাৎ যেটা আমার মনে হয় খালেদা জিয়াকে অন্ধকারে রেখেই হাওয়া ভবন পন্থী তরুণ গ্রুপটি এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে.......এবং কেঁচো খুড়তে সাপ বের হবার ভয়ে বেগম জিয়া যখন হামলাটির দায়ভার তৃতীয় পক্ষের ঘাড়ে চাপাতে গেলেন তখনই তিনি একটা রাজনৈতিক ভুল করলেন যার খেসারত ১/১১ তে বিএনপিকে দিতে হল.....এবং দলটির ভবিষ্যতও বড় একটা হুমকির মুখে পড়ে গেল
মূর্তালা রামাত
রণদীপম দা'
আমি রাজনীতি বুঝি না। এই জঘন্য অপকর্মের বিচারকার্য ধীরগতির হয়ে যাবে বলে মনে হয়। মোটামুটি অনেকগুলো শয়তানকে আইডেন্টিফাই করা গেছে। এদের রামধোলাই দিলে কি সবটা বের করা যায় না? বাংলাদেশের তদন্তকারীরা কি বিদেশী ছবি দেখে একটু চালাক হতে পারে না। আমার কথা হয়ত সিলি মনে হবে। কিন্তু আমার বিরক্ত লাগছে, দেরী সহ্য হচ্ছে না।
কিন্তু আমরা যত যাই বলি না কেন দেরি হবেই...এটাই বাংলাদেশের রীতি...
মূর্তালা রামাত
সত্যি কথা হলো, তিনি নিজেই মারাত্মকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। আর সবসময় বেষ্টিতও হয়ে থাকেন কতোগুলো স্বনামধন্য চোর-ছ্যাচর দ্বারা। খালেদা জিয়া সুষ্ঠু তদন্ত/বিচার করবেন, এই ধারণা কোনো কট্টর বিএনপিপন্থী পাগলও তার স্বপ্নে চিন্তা করতে পারবে না।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনার মন্তব্যের রসবোধে না হেসে পারলাম না...
মূর্তালা রামাত
আমরা সবাই সব কিছু জানি, আবার কেউ কিছু জানি না! আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করার পর যখন এটাকে জামাতের বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র বলে প্রচার করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি এই হামলার সাথে BNP জড়িত থাকার অকাট্যপ্রমান দেখানোর পর আমরাই মানে সমর্থকরাই দলের বিরুদ্ধে বা তারেকের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার প্রয়াস বলে উলটো প্রচার চালাবে!
--- থাবা বাবা!
১০০% সহমত...
মূর্তালা রামাত
নতুন মন্তব্য করুন