হাঁটছিলাম। কিংস ক্রস থেকে টাউন হল। প্রতি উইক এন্ডেই এমন হয়। কাজ শেষ হতে হতে বেশ দেরি হয়ে যায়। ট্রেন থাকে না। হেঁটে টাউন হলে গিয়ে নাইট রাইডার বাসে চড়তে হয়। ট্যাক্সিতে অবশ্য যাওয়া যায়। তবে সামন্য এই পথটুকুর জন্য বিশ ডলার খরচ করতে মন চায় না।
কিংস ক্রস থেকে টাউন হলে যাবার রাস্তাটা উইক এন্ডের দুই রাতে বেশ জমজমাট থাকে। তরুণ তরণীরা সেজেগুজে চকচকে জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়, দেদারসে মদ খেয়ে মাতলামো করে, হুল্লোড় করে গান গেয়ে জীবনটাকে আতশবাজির মতো উড়ায়। এই দিনে কলগার্লেরাও বাড়তি মেক আপ নিয়ে হাজির হয়। নানা রকম উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি করে ইশারায় ডাকে। কেউ কেউ আবার আরেকটু এগিয়ে গায়ে এলিয়ে পড়ে শুধায়, মজা হবে নাকী এক রাউন্ড?
আগে বিব্রত লাগলেও এখন এসবে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মাঝেসাঝে মজা করতে খারাপ লাগে না। পশ্চিমে এটাই জীবন। খেটে টাকা কামাও। তারপর খাও দাও, পান করো, মজা করো- জীবনতো একটাই। এই জীবনের অনেকটা সময়ইতো এখানে পার করলাম। সেই কবে দেশ ছেড়েছি। সালটা মনে করার চেষ্টা করছি এমন সময় পাশে একটি মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, তোমার পাশে একটু হাঁটতে পারি?
অবশ্যই। আমি ইচ্ছা করেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেই। এই মুহূর্তে কোন হুকারের পাল্লায় পড়তে চাই না। তাড়াতাড়ি বাসায় যেয়ে ঘুম দিতে হবে।
তুমি নিশ্চয়ই আমাকে হুকার ভেবেছো, তাই না? আমার সাথে সাথে মেয়েটিও হাঁটার তাল বাড়িয়ে দেয়।
মনের কথাটা ঝট করে বুঝে ফেলায় কিছুট ভ্যাবাচাকা খেলেও পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলি, অবশ্যই না।
মেয়েটা হাসে, থ্যাংকস।
হাসলে মেয়েটিকে বেশ সুন্দরী লাগে। আমি ভালো করে তাকে খেয়াল করি। ছিপছিপে শরীর, কপাল ঢেকে দেয়া কোঁকড়ানো সোনালি চুল, নীল চোখ, খাড়া নাক- চেহারায় গ্রীক দেশের ছাপ স্পষ্ট। মেয়েটার পরণে কালো রংয়ের আঁটসাট ফ্রক,ঠোঁটে টকটকে লাল লিপিস্টিক, চোখের কোণে সোনালি জরির কারুকাজ; ভালোই মানিয়েছে, যেন একটা জ্যান্ত পুতুল্।
আমি আসলে বন্ধুদের সাথে এখানে এসেছিলাম। এখন বাসায় ফিরবো। একা একা হাঁটলে সবাই হুকার ভেবে জ্বালাতন করে। তাই তোমার সাথে হাঁটতে চেয়েছিলাম,মেয়েটা কৈফিয়তের সুরে বলে। তোমার সত্যিই কোন অসুবিধা নেই তো?
ইটস ওকে, মেয়েটাকে অভয় দেই। কোন অসুবিধা নেই, আমি টাউন হলের বাস স্টপ পর্যন্ত যাবো। তুমি?
আমি মোড় পর্যন্ত গেলেই হবে। ওখানে আমার গাড়ি আছে।
তুমি গাড়ি চালাতে পারবে? মেয়াটাকে টলতে দেখে আমার সন্দেহ হয়। তোমাকে তো ড্রাংক মনে হচ্ছে!
না না , আমি ঠিক আছি। আচ্ছা, তুমি ঠিক আছো তো? মেয়েটা সন্নিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে।
হ্যা,কেঁপে ওঠা গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি। মনে মনে ভাবি,অন্যদিনের তুলনায় মদ আজকে একটু বেশিই খেয়েছি বটে তবে নিজের ওপর আমার আস্থা আছে। মাতাল কখনো হবো না।
গুড, মেয়েটা আমার পিঠ চাপড়ে দেয়। পরক্ষণেই চোখ মটকে জিজ্ঞেসা করে, আমাকে একা পেয়ে আবার রেপ করার চিন্তা করছো নাতো?
বলো কী! আমাকে পাগল পেয়েছো নাকী! বলে মেয়েটা থেকে একটু দূরে সরে যাই। যদিও ওর গা ঘেঁষে হাঁটতে আমার ভালোই লাগছিলো। পারফিউমের কড়া ঘ্রাণ রক্তে ক্রমশ উত্তাপ ছড়াচ্ছিলো।
আমি দুঃখিত, মেয়েটা আমার আড়ষ্ট ভাব খেয়াল করে বলে। অন্যভাবে নিয়ো না, বেশির ভাগ ছেলেই এমন হয়। যাই হোক তোমাকে দেখে আমার ভালো লোক মনে হচ্ছে। চাইলে তোমাকে আমি বাসা পর্যন্ত লিফট দিতে পারি।
এই সব দেশে অপরিচিত মানুষের সাথে চলাফেরা খুবই বিপদজনক। কী থেকে কী হয়ে যায় বলা যায় না। ভেতর থেকে কে যেন আমাকে সতর্ক করে। কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের আহ্বান উপেক্ষা করাটা যে কোন বয়সী পুরুষের জন্যই খুব কঠিন কাজ। টাউন হল মোড়ের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি। একবার ভাবলাম মেয়েটার সাথেই যাই। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বলি, তোমার প্রস্তাবের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি বাসেই যেতে চাই, সরি।
প্লিজ রাজ, সিনক্রিয়েট করো না। তোমাকে আমার সাথেই যেতে হবে। মেয়েটার কণ্ঠস্বরে হঠাৎ করেই আদেশ ফুটে ওঠে।
প্রতিত্তুরে কড়া কিছু বলতে গিয়েও, আমার মুখে কথা আটকে যায়। মেয়েটা আমার নাম জানলো কী করে! আতঙ্কে আমি জায়গায় জমে যাই। ভয়ের একটা শিহরণ আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ক্রমাগত ওঠানামা করতে থাকে। অবিশ্বাস ভরা চোখে মেয়েটির দিকে তাকাই।
আমার ভয়ার্ত চাহনি দেখে মেয়েটা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসে। এবার তোমার পালা, মাই বয়। বলেই সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই খপ করে আমার হাত ধরে টানতে টানতে গাড়ি ভর্তি রাস্তায় নেমে পড়ে।
পরদিন পত্রিকায় পাতায়, “রাস্তা পার হতে গিয়ে আরো এক মাতালের মৃত্যু” শিরোনামে খবরটা আমার আর পড়া হয় না।
২৪/০৮/২০১১
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
মন্তব্য
ভাল লাগল।
যদিও গল্প, তবু বেশ কয়েকবছর আগের কথা মনে পড়ে গেল। রাতের বেলা আমিও কাজ শেষ করে সিটি থেকে অক্সফোর্ড স্ট্রীট দিয়ে হেঁটে হেঁটে সারে হিলসে বাসায় ফিরতাম। কত অভিজ্ঞতা সেই সময়ের!
এখন জীবন পালটে গেছে, সকাল ৮টায় ফুলবাবু সেজে অফিস যাই, সন্ধ্যা ৬টায় বাসায় ফিরি। রাতের সিডনী এখন আর আমার জন্য না।
লেখালেখি চলুক।
নীল সমুদ্র
ধন্যবাদ। তবে রাতের সিডনীর কিন্তু আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। সেটা দেখার জন্য হলেও মাঝে মাঝে বের হওয়া উচিত- কী বলেন?
মূর্তালা রামাত
শেষের টুইস্টটা ভালো হয়েছে।
দারুণ
ধন্যবাদ।
মূর্তালা রামাত
ধন্যবাদ।
মূর্তালা রামাত
ভালোই লাগল।
_________________
[খোমাখাতা]
উৎসাহ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মূর্তালা রামাত
ভালো। কিন্তু শেষের দিকে এসে এভাবে কেন শেষ করে দিলেন। যদি ভৌতিক কিছু দেখাতে গিয়ে করে থাকেন তাহলে ঠিক আছে। আর না হলে গল্পটা একটু অন্যদিকে টার্ন করলে ভালো লাগতো।
তবে ওভারঅল আমার ভালো লেগেছে
অন্যদিকে টার্ন করার চিন্তা করেছিলাম। শেষে হরর টাইপের কিছু করার জন্যই মন টানলো- কী আর করা।আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
মূর্তালা রামাত
একটু ভিন্নতর ভাবনা। বেশ লাগলো আমার। বর্ণনা আর ছোট ছোট সংলাপ দিয়ে এগিয়ে নিলেন সুন্দর ভাবে। আমার মনে হল, শেষের বাক্যটা বরং একটা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। ভালো থাকুন।
আপনিও ভাল থাকুন। ভাল লাগা জানানোয় কৃতজ্ঞতা।
মূর্তালা রামাত
লেখা ভালো লাগলো। যখন একটু-আধটু মদ্যপানের অভ্যেস ছিলো, একবার এক ডিস্কোর ডান্স ফ্লোরে একটা অপকর্ম করেছিলাম।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
মাতাল হয়ে রাস্তাঘাটে রাতবিরাতে হাঁটাহাঁটি করার খায়েশ ছিলো মনে। দিলেন তো ভয় পাওয়াইয়া!
লেখা ভালু পাইছি।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন