ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে বাংলাদেশি মানুষ নিগৃহিত হবার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশীদের ভেতর এখন ভারত বিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ মার্চ পালিত হলো ভারত বনধ্। আসছে ১৫ মার্চ আবারও ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছে।
দেশের অনেক বড় বড় মানুষ এবং বড় বড় রাজনৈতিক দল নানা টক শো আর সভা সমাবেশ, সেমিনারে ভারতের আগ্রাসী আচরণকে তুলাধুনা করে ছাড়লেও ভারতীয় পণ্য বর্জন ডাকের ব্যাপারে তারা একদম চুপ। ভারতীয় পণ্য বর্জনের চেয়ে বরং ভারতের প্রতি নতজানু বাংলাদেশ সরকারকে হঠাতেই তাদের আগ্রহ বেশি।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার বদল হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। জনগণের পছন্দ হলো না তো নির্বাচনে ভোট দিয়ে তারা সরকার বদলে দিলো। বিগত বিশ বছর ধরে আমাদের দেশে সরকার এভাবেই বদল হয়ে আসছে। ভারতমুখী সরকার পরিবর্তিত হয়ে ভারত বিরাধী সরকার এসেছে। কিন্তু তাতে কী ভারতের আগ্রাসন কমেছে? কমেনি, বরঞ্চ সব সরকারই কম বেশি ভারতকে ছাড় দিয়ে চলেছে। এর মূল কারণ হলো বাণিজ্যিক স্বার্থ।
বর্তমান বাণিজ্য সর্বস্ব এই যুগে রাজনৈতিক দল গুলো খেটে খাওয়া রাজনৈতিক নয় বরং ব্যবসায়ীদের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ প্রতিবেশি রাষ্ট্র হলো ভারত সেহেতু এদেশের ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ ব্যবসাই ভারত কেন্দ্রীক। ফলে এসব ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই নামে ভারতবিরোধী হলেও কাজে ভারতমুখী। তারা তাদের ব্যাবসায়িক স্বার্থ চুল পরিমাণ ক্ষুন্ন করতে নারাজ। আর তাই মোল্লার দৌঁড় মসজিদ পর্যন্ত এ নিয়ম মেনেই এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভারতবিরোধীতাও কেবল কাগজে কলমে ।
মূলত ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই আমাদের দেশটা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে ভারতের বাজারে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বলুন আর মননশীলতার খোরাক বলুন সবকিছুতেই ভারত। আর তাই আমরা যারা দেশের বাইরে আছি তাদের জন্য ভারতীয় পণ্য বর্জন করাটা যত সহজ, দেশের ভেতরকার মানুষগুলোর জন্য তত সহজ নয়।
গত ১ মার্চ ভারতীয় পণ্য বর্জনের দিন আমি বাংলাদেশে ছিলাম। দোকানদারদের সাথে কথা বলে দেখেছি তারা বলে, বাংলাদেশের মাল দেন ভারতীয় জিনিস আর বেচুম না। রিক্সাওয়ালা, সিএনজি মালিক, ট্যাক্সি ড্রাইভার, বাসওয়ালাদের দাবীও এক- টায়ার টুয়ার, যন্ত্রপাতি যা লাগে দেশে তৈরি হউক আমরা ইন্ডিয়ার জিনিস আর নিমু না। বাচ্চাদের বাবা মাদেরও এক কথা- ডোরেমন হিন্দিতে কথা বলে বাচ্চারাতো হিন্দি শিখবেই। কার্টুনটার বাংলা ডাবিং করে চালাক তাহলেইতো হয়। ভারতীয় সিরিয়াল গোগ্রাসে গেলা দর্শকদেরও একই ভাষ্য- দেশের চ্যানেলগুলো এমন কিছু অনুষ্ঠান বানাক, আমরা আর ভারতীয় সিরিয়াল দেখবো না। গ্রামের মানুষেরাতো আরেক কাঠি সরেস, তাদের কথা- বীজ নাই, সার পাই না, কারেন্ট নাই সেচ দিবার পারি না, কোল্ড স্টোরে যায়গা নাই। আলু, পিয়াজ বুনমু কেমনে?
আমরা যদি তাদের এই চাহিদার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে কিন্তু ভারতীয় পণ্য বর্জনের আগে আমাদের বাংলাদেশী বা অন্যদেশী পণ্যের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এই যোগান নিশ্চিত করতে না পারলে যতোই ভারত বিরোধী মনোভাব থাক ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন সফল হবে না।
এখন প্রশ্ন হলো এই যোগানটুকু কী রাতারাতি দেয়া সম্ভব? উত্তর হলো- অবশ্যই না। এরপরের প্রশ্ন হলো, তাহলে কী ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন বন্ধ করে দেয়া উচিত। উত্তর হবে- না। তাহলে? আমি মনে করি পরিস্থিতির কারণে এই মুহূর্তে ভারতীয় পণ্য বর্জন হয়ত তেমন একটা সফল হবে না কিন্তু ভারতের কার্যকলাপ কতোটই অসহনীয় সে সম্বন্ধে চিন্তাশীল সবার কাছে এটি একটি জোরালো মেসেজ পাঠাবে। যা অন্য কোথাও না হলেও আমাদের চিন্তা জগতে ভারতের একপেশে কার্যকলাপ সম্পর্কিত যে গা সওয়া নিস্ক্রিয়তা তৈরি হয়েছে সেখানে খানিকটা বুদ্বুদের সৃষ্টি করবে।
খুব ছোট থেকেই বড় কোন কিছুর সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যেই বিদেশী পত্রপত্রিকাগুলো এবং বড় বড় মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিএসএফ এর মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোও ভারতের অবন্ধুসুলভ বাংলাদেশ নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ভারত বিষয়ে নতজানু বাংলাদেশ সরকারও ভারতের কাছে নিজেদের খানিকটা কঠোর অবস্থান তুলে ধরেছে। আপাতদৃষ্টিতে এটাই ভারতীয় পণ্য বর্জন ডাকের সাফল্য।
এই ডাকের কারণেই হয়ত আগামীতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোন বিষয় লিপিবদ্ধ করার সাহস দেখাবে। আজকের তরুণ একটি ছেলে আগামীতে যে দেশের হাল ধরবে হয়ত এই ডাকই তার হৃদয়ে দেশপ্রেমের সবুজ চারা বুনে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রায় সবদিক দিয়ে ভারতের উপর নির্ভরশীল হবার পরও ভারতের বিরুদ্ধে এ ধরনের একটি সাহসী কর্মসূচী দিয়ে আমরা আমাদের সচেতনার স্থানটি তুলে ধরতে পেরেছি। এই সচেতনতা যদি এখন একজনকেও স্পর্শ করে তবে এই আন্দোলন সফল। কারণ একজনই দশজনকে বদলায়, আর দশজন একসময় পুরো দেশকে বদলে দেয়....
১২/০৩/২০১২
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
মন্তব্য
আপনার সাথে শতভাগ সহমত কিন্তু কষ্ট লাগে দেশের সরকারী কর্মকর্তাদের উদাসীনতা আর ভারত তোষণ নীতি। এই যে, ভারত আচমকা গত সপ্তাহে তুলা রপ্তানী বন্ধ করেদিল, আবার বন্ডের বিপরীতে সুতা আমদানীতে বাংলাদেশকে অনেকটা বাধ্য করছে, এই বিষয়ে কেউই কিছু বলছে না।
নতুন মন্তব্য করুন