গত কদিনে বেশ কয়েকজনকে শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে দেখলাম।এদের অনেকেই প্রথম থেকে এই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। এখন তারা প্রশ্ন তুলছেন আন্দোলনের লাগাম কার হাতে এবং আন্দোলনে লাভটা হচ্ছে কী, এর গন্তব্য কোথায়?
গুটিকয়েক তরুণের স্লোগানের মাধ্যমে এই আন্দোলন যখন শুরু হয় তখনও অনেকে এই আন্দোলনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলেন। তারুণ্যের শক্তিকে তারা বিশ্বাস করতে পারেন নি। কিন্তু দিন যতই গেছে তরুনেরা ততোই মানুষকে অবাক করেছে। সবার ভুল ভেঙ্গে এই আন্দোলন রূপ নিয়েছে গণ আন্দোলনে। সুর্নির্দিষ্ট কোন নেতা নেই বলে এই আন্দোলন দুই দিনও টিকবে না বলে যারা রায় দিয়েছিলেন তাদের চোখের সামনেই গত ১৪ দিন ধরে হাজার হাজার মানুষ রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে শাহবাগে আছেতো আছেই।
এইস অভূতপূর্ব ঘটনা কাকে না অবাক করেনি? যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের দল জামায়াত ইসলাম যারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাদের নেতাদের রক্ষার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেছে তারা পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা আদৌ তাদের হিসাবের ভেতর ছিল না। তৃতীয় শক্তি যারা রষ্ট্র ক্ষমতা হাতানোর নীল নকশায় ব্যস্ত ছিল এই আন্দোলনে তাদের পাশার দানও উল্টে গেছে। এই আন্দোলন প্রধান বিরোধী দলকে কতোটা বিমূঢ় করে দিয়েছে তা দলটির নেতাদের স্ববিরোধী কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়। আর ক্ষমতাসীন দলকে এই আন্দোলন বিশাল একে চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।একটু উনিশ বিশ হলেই এই আন্দোলন যে সরকারকে একে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে তা তারা ভালোমতোই জানে।
শাহবাগ আন্দোলনকে যারা ক্ষমতাসীন দলের বানানো নাটক বলতে চান তারাও বোঝেন যে নাটক বানানো খুবই সহজ কিন্তু ভাড়া করে দিনের পর দিন নাটকের দর্শক জমানো যায় না। এ কারণে পর্দার আড়ালে নানা উপায়ে এই আন্দোলনকে ঘায়েল করার কারসাজি শুরু হয়ে গেছে। আন্দোলনকারীদের বন্ধু সেজে তাদের পিঠে ছুরি মারার চেষ্টা করার লোকজন তো আগে থেকেই আছে। এখন তাদেরর সাথে যোগ দিয়েছে এতোদিন চুপ মেরে দূর থেকে বাতাসের দিক চেনার চেষ্টা করা সুবিধাবাদীরা। দলে দলে তারা আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করছে।আন্দোলন থেকে যতটুকু ফায়দা লোটা যায় সেটাই তাদের লাভ। ।ক্ষমতাসীনেরা আছে কীভাবে আন্দোলনকে বাগে রাখা যায় সেই চেষ্টায় আর আন্দোলন বিরোধীরা ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে নিত্য নতুন কূট কৌশলে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে।
এতসব বাধা ডিঙ্গিয়ে আন্দোলন কি স্বমহিমায় টিকে থাকতে পারবে? যারা এই প্রশ্নটি করেন তাদের কাছে এই আন্দোলনের বয়স মাত্র ১৪ দিন। কিন্তু যারা এই আন্দোলনের সৃষ্টিকর্তা সেই সব তরুণেরা জাননে এই আন্দোলন এক দিনে শুরু হয় নি। বছরের পর বছর ধরে এই আন্দোলনের বীজ বোনার কাজ চলে আসছে। যারা এই বীজ বুনেছেন সেইসব তরুণেরা কেউ আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে আসেন নি; কেউই তাদেরকে যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে, জামাত-শিবিরের মতো ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল দলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য ডেকে আনেনি- তারা স্বেচ্ছায় নিজের বিবেকের তাড়নায় এই পথে এসেছেন।গত ৪২ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেটি করার সাহস করেনি এই তরুণেরা সেই কাজটি করার জন্যই স্বেচ্ছায় মাঠে নেমে এসেছেন।মূলত এদের চাপেই আওয়ামী লীগ তাদরে নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে বাধ্য হয়, এদের চাপে পড়েই জামাতের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে, এদের কাছেই মাথা নত করে বিএনপি বলতে বাধ্য হচ্ছে ক্ষমতায় গেলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে আগ্রহী।
এই সব দুর্বার তরুণের কাছে শাহবাগ আন্দোলন নিছক কোন আন্দোলন নয় এটি একটা যুদ্ধের শেষ প্রান্ত। এখান থেকে পেছনে হটার কোন উপায় নেই।এবং এই ধারনাটি তারা ক্রমশ জনমানুষের ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। দুদিন বাদেই তারুণ্যের এই ইমোশন কমে যাবে এমন ধরনা করে যারা বসে আছেন তাদের অজান্তেই এই আন্দোলন তরুণদের একার যুদ্ধ থেকে পরিণত হয়েছে আপামর জনসাধারণের চেতনার প্লাটফর্মে। একে দমিয়ে রাখার চিন্তা পুরো মাত্রায় অবাস্তব। এ কারণেই এই কদিন আগেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবীতে ডাকা হরতালে কুঁকড়ে থাকা মানুষগুলোকে আজ দেখুন, তারা কেমন দৃঢ়তার সাথে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হুট করে একটা বিদ্যুত তরঙ্গ যেন শাহবাগ থেকে আমাদের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিক্ষুক তার সারাবেলার উপার্জন দিয়ে খাবার কিনে আন্দোলনকারীদের খওয়াচ্ছে, স্কুলের বাচ্চা টিফিন নিয়ে এসে শাহবাগে বিলিয়ে দিচ্ছে, রিক্সায়ালারা বিনা ভাড়ায় লোকজনকে শাহবাগে পৌঁছে দিচ্ছে,শাহবাগের এক ডাকে পুরো দেশ স্থবির দাঁড়িয়ে পড়ছে-- অপরাজনীতির মারপ্যাচে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া হতাশ জনতাকে বিনিসুতোর মালায় গাঁথা এই আন্দোলনকে রোখে কে?
পৃথিবীর তাবৎ সফল বিপ্লব, আন্দোলনের দিকে নজর দিলে দেখা যায় সেখানে প্রতি বিপ্লবীরা ছিল,সুবধাবাদীরা ছিল, রাজনীতি ছিল, প্রতিপক্ষ ছিল- এগুলো বড় কোন আন্দোলনের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ। কিন্তু গণমানুষের উপস্থিতি থাকলে এসবের কোন কিছুই আন্দোলনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। শাহবাগকেও তাই ঠেকানো যাবে না। খুন করে, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে,লোভের ফাঁদে ফেলে, দলীয় পরিচয় দেখিয়ে কতিপয় দোনোমোনো মানুষের মনে ভয়, সন্দেহ ধরিয়ে তাদরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা সম্ভব কিন্তু লাখ লাখ জেগে ওঠা মানুষকে ঘুম পাড়ানো কখনোই সম্ভব নয়।
আর তাই আপনার যখন আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, গন্তব্য নিয়ে সন্দেহ হয় তখন আপনি চারপাশে তাকান, দেশের আনাচে কানাচে থেকে সারা বিশ্বে শাহবাগের সমর্থনে জড়ো বাঙালিদের মুখগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখুন--দেখবেন তারা সবাই আপনার আমার মতোই সাধারণ মানুষ। তারা কোন রাজনৈতিক দলের কথা বলতে আসেনি, কোন রাজনৈতিক দাবী নিয়েও তারা স্লোগান দিচ্ছে না।তাদের কারো বুকে বাবার বুলেটবিদ্ধ লাশ, কারো বুকে মায়ের লাঞ্ছনা, কারো চোখে ভাই হারানোর বেদনা, কারো হাতে স্বজনের কুড়িয়ে পাওয়া অস্থি....যতোদিন নিজের চারপাশে ভেতরে ভেতরে ক্ষত পুষে রাখা এ্সইসব ধারণ মানুষকে দেখতে পাবেন ততোদিন জেনে রাখুন আপানার কোন নেতা দরকার নেই, আপনার পথ হারাবার কোন ভয় নেই, আমার আপনার ইচ্ছাই আন্দোলনের গন্তব্য;চলমান যুদ্ধের জয় পরাজয়ের নির্ধারক।
১৯/০২/২০১৩
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
মন্তব্য
চমৎকার। ঘুম চোখে পড়া ও মন্তব্য। পরে আরেকবার পড়তে হবে। আপাতত শেয়ার করলাম। তবে গতিপ্রকৃতি সত্যি গুরুত্বপূর্ণ। অন্ততপক্ষে নিজস্ব একটা বিশ্লেষণ থাকাটা জরুরী। গন্তব্য বাছাই ও অধিকারে তা সহজ হয়।
স্বয়ম
চমৎকার লেখা। শেয়ার করলাম।
এ আন্দোলনকে
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
সেটাই।
আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং স্বপ্নগুলো যখন বিভেদের সব দেয়াল ভেঙে একটা সামগ্রিক রূপ পাবে সেদিন হবে সর্বাত্মক জয়!
বুঝলাম।।।
আমাদের তরুণদের এই আন্দোলনটা অনেকটাই জীবনীশক্তি দান করেছে আমাদের,,,,,
কিন্তু, আমাদের এই যে সহজ সরল কর্মসূচীগুলো, এগুলোর কি কোন ভবিষ্যৎ আছে?
সরকার একটার পর একটা, বিচারে কালক্ষেপণ করছে।।।।।
আমরা এই মুহুরতে কর্মসূচী দিচ্ছি, আন্দোলন এর সময়সীমা সীমিত করে, যা একটুআগে আমি চ্যানেলগুলোতে পেলাম।।।।।।।।।।। এগুলো কি আমাদের জন্য হতাশাজনক নয়?
কঠোর কর্মসূচী কবে পাবো আমরা?
আশা করি এর সদুত্তর পাবো
নতুন মন্তব্য করুন