সম্প্রতি বাংলাদেশে খুব আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটে গেলো। আমাদের অতি পরিচিত শাহবাগ মোড়ে এক জন দু'জন করে সমবেত হলো হাজার হাজার মানুষ। কে তাদেরকে ডেকে আনলো? দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পল্টনে জনসমাবেশ ডাকে- আমরা দেখি। সেখানে দলীয় ব্যনার হাতে, দলীয় শ্লোগান মুখে অনেক লোক হাজির হয়। তাদের ডাক ছাড়া এতো লোক একসাথে হতে পারে- ভাবাই যায় না।অথচ শাহবাগে সবার চোখের সামনে সেটাই ঘটলো।আমাদের দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। রাজনৈতিক দলের ডাকে যারা যায় তারা কেউ নেত্রীকে দেখতে যায়, কেউ নেত্রীর গলার স্বর নিজের কানে শুনতে যায়, কেউ পেটের দায়ে ভাড়া খাটতে সেখানে যায়। তাই নেত্রীর বক্তব্য শেষ হতে না হতেই এসব জনসভার অর্ধেক লোককে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ শাহবাগে টানা ১৭ দিন ধরে মানুষ নাওয়া খাওয়া ভুলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো! তাদের মূল দাবী একটাই, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি।
এমন নয় যে এই দাবী পূরণ হলে তাদের সবাইকে একটা করে নতুন ফ্ল্যাট দেয়া হবে বা সিঙ্গাপুরে ৫স্টার হোটেলে তিন রাত দুইদিন তারা বিনা খরচে থাকতে পারবে। এমনও না যে, এই দাবী পূরণ হলে সন্ত্রাস, চাদাবাজি, দুর্নীতি, রাহাজানি, গুম-খুন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সহ আরো আরো যে সমস্যার ভেতরে তারা দিন যাপন করছে সেগুলো থেকে তারা চোখের নিমেষে মুক্তি পাবে--তাহলে কীসের আশায়, কীসের লোভে পড়ে মানুষগুলো নিজেদের অমূল্য সময় শাহবাগে নষ্ট করলো?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের সম্বন্ধে জানাটা জরুরী। কারাগারে আটক এইসব লোকেরা ১৯৭১ এ পাক বাহিনীর মূল দোসর হিসেবে কাজ করেছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে খুন, লুট, গুম, ধর্ষণ মানবতা বিরোধী হেন কাজ নেই যা তারা করেনি। পরবর্তীতে এরাই আবার ধর্মের লেবাস পরে পীর পয়গম্বর সেজে বসেছে। বসলে কী হবে, মানুষতো এদের চেনে, জানে। এখন প্রযুক্তির যুগ। ইন্টারনেট খুললেই এসব লোকদের কুকীর্তির বস্তা বস্তা খতিয়ান পাওয়া যায়। যারা আগে লোকগুলোর কথা বিশ্বাস করতো প্রযুক্তির কল্যাণে তাদের কাছেও এখন লোকগুলোর আসল চেহারা স্পষ্ট। খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন- কদিন আগে বিশ্বজিৎ নামের একটা ছেলেকে ছাত্রলীগ নামধারীরা প্রকাশ্যে দিবালোকে পিটিয়ে মারলো, মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে এ্রটা খুবই জঘন্য একটি ঘটনা। সভ্য মানুষ হিসেবে বিশ্বজিৎের খুনীদের উপযু্ক্ত সাজা হোক সেটা আমরা চাই। তাহলে একটা নয় দুটো নয় বিশ্বজিৎের মত ত্রিশ লক্ষ লোককে যারা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, জ্যান্ত কবর দিয়ে,গরুর মতো জবাই করে, পুড়িয়ে, হাত পা বেধে গুলি করে পাখির মতো মারতে সাহায্য করলো, নিজেরাও মারলো- তাদের বেলায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত? জামাত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে পূর্ণিমা নামের এক চৌদ্দ বছর বয়সী কিশোরীর কথা মনে আছে? যাকে তার বাবা মায়ের সামনে একে একে গণধর্ষণ করা হয়েছিল আর তার বাবা ধর্ষণকারীদের হাতে পায়ে ধরে এ্ই বলে মিনতি করেছিল যে "বাবারা আমার মেয়েটা ছোট তোমরা একজন একজন করে এসো"! এ্ই ঘটনা শুনে আমাদের বিবেক দংশিত হয়, অনেকের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে, সেই ধর্ষণকারীদের আমরা অভিশাপ দেই। তাহলে দুই লক্ষ মা বোনকে যারা গণিমতের মাল হিসেবে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিল এবং সুযোগ পেয়ে নিজেরাও ভোগ করলো-- তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী না করে আমরা কীভাবে থাকতে পারি, কীভাবে নিজেকে মানুষ দাবী করতে পারি?
আমাদের বিবেক আমাদেরকে এক সুতোয় বেধেছিল। আমরা এক হয়ে শাহবাগে জড়ো হয়েছিলাম।এখানে ধনীর আদুরে দুলালী ছিল, দিনের উপার্জন বিলিয়ে দেয়া ভিখিরি ছিল, নবজাতকেরা ছিল, বৃদ্ধেরা ছিল, মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান, চাকমা, মারমা,মুরং সাঁওতাল, মুচি মেথর ডোম গোরখোদক নাস্তিক এমনকী নিজেকে মানুষ না মানা মানুষও ছিল। তোমাকে যারা বোঝালো শাহবাগে কেবল নাস্তিকদের নৃত্য হচ্ছে, চিন্তা করে দেখো তারা কী ভুলটাই না তোমাকে বোঝালো, কী মিথ্যাটাই না তোমাকে জানালো! আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে কি শুধু একটা ধর্মের অনুসারী মানুষেরাই গিয়েছিল? তাহলেতো সেটা ধর্মযুদ্ধ হতো, স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। সত্যি হলো, এসব নানা জাতের মানুষ মিলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছিল। এসব নানা জাতের মানুষের রক্ত মিশেই তৈরি হয়েছে আমাদের মানচিত্র। স্বাধীনতাকে বুকে ধারণ করা সেই মানষগুলোই শাহবাগে জড়ো হয়েছিল। তোমারা যারা শাহবাগে এলে না তারা স্বাধীনতার সেই অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত হলে। ইতিহাসের অংশ হওয়ার সুযোগ হারালে।
ইতিহাসের অংশ হবার সুযোগ হারালে কী হয়? ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের আপামর জনসাধারণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কারণ এই যুদ্ধ ছিল তাদের অস্বিস্তের সংগ্রাম, জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার সংগ্রাম। মায়ের প্রশ্নে কি কোন আপোষ হতে পারে? প্রতিটি বিবেকবান মানুষ সেসময় পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। কেবেল গুটি কয়েকজন মানুষ এই সংগ্রামে যোগ দেয় নি। স্বাধীন বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের হাতে পরাধীন থাকাটাই তাদের কাছে স্বস্তির ব্যাপার ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, নতুন ইতিহাস গড়েছে কিন্তু ওইসব মানুষেরা কোনদিন পাকিস্তানিদের দোসর পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ভুল ত্রুটির ফাঁক গলে তারা প্রতিষ্ঠা পেলেও ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি।ইতিহাসের ক্ষমা না পাওয়া ওইসব মানুষদের পক্ষ নিয়ে তোমরা যারা শাহবাগকে অস্বীকার করলে—ইতিহাস তোমাদেরও ছেড়ে দেবে, এটা ভাবা ভুল। ইতিহাসের প্রতিশোধ কতো নির্মম হতে পারে তা পকিস্তানের জনক কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদাহরণ দিয়ে তুলো ধরা যাক ।পূর্ব পাকিস্তানে এসে বাংলা ভাষা বিদ্বেষী জিন্নাহ বলেছিলেন, উর্দু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। সেই জিন্নাহ যখন মারা যান তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ছিল দুটি- বাংলা এবং উর্দু। তাই দুই ভাষাতেই কবর ফলক লিখে তার শিয়রে টাঙ্গিয়ে দেয় হয়। বাংলা ভাষাকে আজীবন নিচু চোখে দেখা জিন্নাহ এখন সেই বাংলা ভাষাকেই মাথার কাছে নিয়ে শুয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
অতএব ইতিহাস স্বাক্ষী, সত্য এবং ন্যায়ের বিপক্ষে থেকে অর্জনের কিছুই নেই। এ জন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে“ অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন, যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়।এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। [সুরা শামস:৮,৯, ১০] কোরানের এই বাণী জেনেও তোমরা যারা চোখ বন্ধ করে শাহবাগের গণজাগরণকে সাজানো নাটক ভেবেছো তাদের জন্য এই আন্দোলনের সমস্ত অর্জনগুলো কি মিথ্য হয়ে যাবে? টানা ১৭ দিন ধরে হরতাল অবরোধ ছাড়াই অহিংস পদ্ধতিতে যে আন্দোলন চললো তা কি বাংলাদেশের ইতিহাসে নজির বিহীন নয়? গুটি কয়েক তরুণের হাত ধরে গড়ে ওঠা এই শাহবাগ আন্দোলনই কিন্তু মৌলবাদী ধ্বংসাত্মক আস্ফলনে ক্রমাগত অসাড়, অসহায় হতে থাকা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরূদ্ধে ছড়িয়ে দিলো গণসচেতনতার ঢেউ। শাহবাগ জানান দিয়ে গেলো মানুষের ভেতরকার কথা, নাড়িয়ে দিলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ। শাহবাগ হাতে ধরে চিনিয়ে দিলো মুখোশের আড়ালের মুখগুলো আর বুঝিয়ে দিলো তরুণরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যত, তরুণরাই বাংলাদেশের ভাগ্যবিধাতা।
তোমরা যারা তরুণ অথচ শাহবাগ থেকে যোজন যোজন দূরে থাকলে তারা বাংলাদেশের প্রাণস্পন্দন টের পেলে না। আফসোস! শাহবাগের তরুণেরা যেভাবে প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশকে ভালোবেসে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গাইতে গাইতে গভির মমতায় চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে ফেলে, বাংলার আলো হাওয়া জলে বেড়ে উঠেও তোমরা তা কখনোই অনুভব করতে পারবে না। এইসব তরুণদের পূর্বসূরীরা জীবন দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিলো, তাদের পথ অনুসরণ করে প্রয়োজনে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এরাই আবার দেশকে রক্ষার যুদ্ধে নামবে। শাহবাগ হাতে ধরে তাদের সেটাই শিখিয়ে গেলো।তোমরা যারা এলে না, পুরাতন সেই বৃদ্ধ কসাইয়ের মতো, তারা কেবলই শিখলে অন্ধকারে পেছন থেকে কীভাবে আঘাত হানতে হয়।আফসোস!
উৎসর্গঃ
আমার বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী, অনুজ এবং অন্যান্য পরিচিত অপরিচিতজন, তোমরা যারা শাহবাগে এলে না !
২২/০২/২০১৩
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
মন্তব্য
- বিজন শাহরিয়ার।
অসাধারণ
খুব ইচ্ছা থাকা সত্তেও শাহবাগ যাওয়া হয়নাই, প্রতিনিয়ত মনে হয় আমি পঙ্গু, আমার এই শহরটাতে যতটুকু আন্দোলন হয়েছে তার ভেতরেই আমি শাহবাগকে খুঁজতে চেয়েছি, তবু বারবার সরাক্ষন মনে হয় আমি স্রোত দেখিনি,, বদ্ধ জলাশয় দেখেছি কেবল,।।।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
দেবাশীষ চৌধুরী দেব।
অসাধারণ লেখা। ছড়িয়ে দিলাম কিছু পরিচিতের বৃত্তে।
>> সুরথ সরকার।
শাহবাগ আমাদের বোধের মাঝে এমন একটি নাড়া দিতে পেরেছে । জাগরিত মানুষ সেই প্ররিস্ফুটিত আলোর সত্তা। >> সুরথ সরকার।
নতুন মন্তব্য করুন