মনি। পুরোনাম মনিরুল কুদ্দুস। ওর সাথে যখন পরিচয় হাফ প্যান্ট পড়ে ঘুরে বেড়ায়, প্রায়ই যেতাম ওদের বাসায়, পুরো পরিবারের সবাই রাজনীতির সাথে জড়িত সেসময়। ওর নানা আলতাব আলী জাঁদরেল ন্যাপ কর্মী ছিলেন, আমরা যখন ছোট সেসময় মনে আছে মিছিলের পেছনে শ্লোগান দিতাম “আলতাব আলীর কুঁড়ে ঘর, ভাইংগা চূইড়া নৌকা’ত ভর”, নির্বাচনী স্লোগান। মনি’র বাবা কুদ্দুস সাহেব ছিলেন বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক। ভালো লোক। ৯০এর আন্দোলনের পর সব পেয়েছি এমন ভাব নিয়ে রাজনীতি থেকে সরে এসে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টায় অনেককিছু থেকে দূরে চলে আসাতে ওদের সাথেও তেমন একটা যোগাযোগ ছিলোনা। হঠাত্ মাঝে মাঝে হয়ত দেখা হতো চলতি পথে, হাত তোলা আর ক্যামন আছেন, এ পর্যন্তই।
সেই মনি এবছর মার্চের মাঝামাঝি ফোন দিলো আমাকে, ভাই ক্যামন আছেন।
ভালো।
আপনার এখানে আস্তে চাইছিলাম, অফিসের ঠিকানা বলেন।
ঠিকানা বলার এক ঘন্টার মধ্যে অফিসে হাজির, সাথে এক ভদ্রলোক, কুয়াকাটা হোটেল মালিক সমিতির নেতা, আর মনি ঐ সমিতির সম্পাদক। আশ্চর্য হয়ে বললাম তুমি?
ক্যান আপনি জানেন না আমি হোটেল দিসি কূয়াকাটায়।
আমি সত্যই জানতামনা। খুশী হলাম শুনে। তো ওরা কূয়াকাটায় সাগর উত্সব করতে যাচ্ছে, সিডরের পর ভাঙ্গা হাটে প্রাণের সঞ্চার যদি ঘটে তাতে। উদ্দ্যেশ্য মহত্ সন্দেহ নেই। এজন্য কিছু পরামর্শ নিতেই আসা। ফিরে যাবার আগে বার বার বলে গেলো কূয়াকাটা ঘুরে আসার জন্য, ভালো লাগবে সেটাও জানালো।
বাসায় ফিরে রিতা’র (আমার স্ত্রী) সাথে কথা বললাম, সামনে স্বাধীনতা দিবসের বন্ধ আছে সেটাও স্মরণ করিয়ে দিলাম, ফোনে কথা বললাম আমার পার্টনারের সাথে, সেও রাজী হলো, কিন্ত সমস্যা হলো ড্রাইভার নিয়ে। দু’মহিলারই অনাগ্রহ আমার ড্রাইভিং এ। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বেশ কিছু শর্তের বেড়াজালে শেষ পর্যন্ত দু’জন রাজী, অবশ্য রাজী করানোতে বাচ্চাদের ভূমিকা যেমন ছিলো তেমন ছিলো মনি’র। সুন্দর করে মিথ্যা কথায় ভোলালো দুজনকে। আপা, অত্যন্ত চমত্কার রাস্তা, ভাই গাড়ী চালালে ৫/৬ ঘন্টাতে পৌঁছে যাবেন, এত সুন্দর রাস্তা বাংলাদেশে কোথাও নেই, আপনাদের তো ভারী গাড়ী টেরই পাবেননা, আর রাস্তায় ভীর বলতে নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কিছুটা হলেও বিশ্বাস করেছিলাম ওর কথায়।
ছাব্বিশ তারিখ সকাল সাড়ে আটে ঢাকা ছেড়েছি, মোট সাত জনের মাঝে তিন বাচ্চা, এ রাস্তা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই আমার, যতবার গিয়েছি রাতের বেলা, বাসে, আধা ঘুম আধা জাগরণে। অবশ্য বাংলাদেশে রাস্তা চেনা কোন সমস্যা না, যে কোন যায়গায় দাঁড়িয়ে কাউকে না কাউকে পাবেন উত্তরের জন্য, শুধু দূরত্বের কথা জানতে চাইলে সঠিক উত্তর পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। খুব তাড়াতাড়িই মাওয়া ঘাটে পৌঁছালাম, বন্ধের দিন বলে রাস্তায় গাড়ী কম। মাওয়াতে বিশাল জ্যাম হয়, মনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে মাওয়া ঘাটে ব্যাক্তিগত গাড়ী মানে ট্রাক বাস ছাড়া অন্য গাড়ীর কোন সিরিয়াল নেই, ফেরী খালি পেলে উঠে গেলেই হলো, ওর কথামত উঠেও গেলাম, ফেরী ভর্তি কিছুক্ষণের মাঝেই, কিন্ত ছাড়বার নাম নেই, আমরা গাড়ীর ভেতরে বসে গল্প করছি, দেখতে দেখতে চল্লিশ মিনিট পেরুলেও ফেরী যখন ছাড়ছেনা গাড়ী থেকে নামলাম, নেমে কথাশুনে আক্কেল গুড়ুম, একটা গাড়ী ফেরী ভাড়া না দিয়েই উঠে গেছে আর ওরা তা খুঁজছে, মাইকেও ঘোষনা আসছে, জানালা বন্ধ থাকাতে শুনতে পাইনি। দৌঁড়ে যেয়ে টিকিট নিয়ে ফেরার আগেই ছেড়ে দিলো, শেষমেষ সেই দৌঁড়ের উপরই শেষ লাফ দিয়ে আমি ফেরীতে, শেষ মূহূর্তে ফেরী ছেড়ে দেয়াটা ওদের ইচ্ছাকৃত, আমার উপর ক্ষোভ।
রাস্তা এপাড়ে সুন্দর, মোড়ে মোড়ে নির্দেশনা দেয়া আছে, পথ ভুলের সম্ভাবনা কম, গাড়ী চলছে ১২০/৩০ কিমি স্পীডে, ৩০০০ সিসির স্পেইস গীয়ার, ভেতরে হাতল দেয়া রিভলবিং চেয়ার, ডাবল এসি বাইরের কিছুই বোঝা যায়না। আমিও চালাচ্ছি আরামে, অনেকদিন পর হাইওয়েতে। বরিশাল যখন পৌঁছালাম বেলা তখন বারোটা, সাড়ে তিন ঘন্টা লাগলো, কথা ছিলো বরিশালে এসে দুপুরের খাবার খাবো, তেমন ইচ্ছাও দেখালোনা কেউ, ফোনে মনি বললো ভাই তাহলে পটুয়াখালী চলে আসেন, দুপুরের খাবারটা সেখানেই সেরে নিয়েন, খুব ভালো হোটেল আছে। আর পটুয়াখালী থেকে রওনা দেবার সময় গাড়ীতে তেল নিবেন, পরে এদিকে আর পাম্প পাওয়া যাবেনা। এসব বলতে বলতেই ঘন্টা খানিকের মাথায় পটুয়াখালীতে আমরা, মোড়ের ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করে সবচাইতে ভালো রেষ্টুরেন্টে গেলাম, খাবার রুচী হলোনা, টেবিলের উপর কয়েক মিমি পুরু ময়লার আস্তর, ভন ভন করছে মাছি, টিনের প্লেটের রঙ যে একসময় সাদা ছিলো বোঝাযায় না, এখন হলুদ, তরকারীতেও হলুদের পরিমান বেশী। সেই তরকারীর হলুদ মনে হয় এখনও হাতে লেগে আছে, আমার পছন্দ হয়নি।
রাস্তা টেরপেলাম পটুয়াখালীর পর, পটুয়াখালী থেকে কূয়াকাটা সম্ভবত ছিষট্টি কিমি, ঘন্টা খানিকের বেশী লাগার কথা নয়, শেষ বাইশ কিমি ভয়াভহ, শুধুমাত্র এখানে একসময় রাস্তা ছিলো অনুমান করা যায়, কার্পেটিং তো দূরের কথা, ইট পর্যন্ত নেই, ছোট বড় গর্ত অগুনতি, বড় গর্তগুলো এমন যে অনেকদূর ঘুরে নেমে মূল রাস্তায় উঠতে হয়, আক্ষরিক অর্থে বুক সমান। ছোট গাড়ী তো প্রশ্নই উঠেনা, রাস্তায় আটকে থাকা পটুয়াখালীর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোকে টেনে তুলতে হয়েছে আমাদের গাড়ীর পেছনে বেঁধে, ভয়াবহ। সিডরের পর বড় গাছ সব পড়ে যাওয়াতে রাস্তা না ক্ষেত দিয়ে যাচ্ছি বোঝা কঠিন। ফেরীতে উঠেছি সাতবার, সম্ভবত পটুয়াখালীর পরেই তিন কি চার বার। শেষ দিকের ফেরী গুলো ছোট, শেষ ফেরীটা (জায়গাটার নাম সম্ভবত মহীপুর আর আলীপুর) এত ছোট যে শুধুমাত্র মুখঘুরিয়েই আমাদের নামিয়ে দিলো। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি, পটুয়াখালীর পর সবগুলো ফেরীতে শুধুমাত্র যাবার সময় টোল দিতে হয়। রাস্তার এ দূরাবস্থা ছাড়া যাত্রা খারাপ লাগবেনা। আশে পাশের গ্রামের দৃশ্য অসম্ভব সুন্দর, বিশেষ করে নদী, মোহনার কাছাকাছি বলে এদিকেও জোয়ার ভাটা হয়, আন্ধারমানিক নদীর পাড়ে নৌকা বানানো হচ্ছে দেখলাম, পানি নীল, যতগুলো দেখেছি এ নদীটাই বেশী সুন্দর । প্রথম এবং শেষ দূর্ঘটনা ঘটলো এই ফেরী পেরুনোর পর পরই। মাতিস (আমার ছেলে) বললো ‘বাবা খারাপ লাগছে’, সাথে সাথে সামনেই এক মসজিদের পাশে দাঁড়ানো মাত্রই বমি করে দিলো, দুপুরে খাবার পরপরই ভাঙ্গা রাস্তায় লাফানো ওর ছোট্ট শরীরে সয়নি। আশে পাশে পানির কল থাকলেও স্থানীয় কারো কাছে এর খোঁজ পাইনি, ওরা প্রথমে ভেবেছিলো সিডর আক্রান্তদের সাহায্য দিতে এসেছি, পানি নাই বলে যদি একটা কলের পয়সা পাওয়া যায়। পরে অবশ্য আমাদের কাছে থাকা অল্প খাবার পানিতে মাতিসকে যখন পরিষ্কার করা হচ্ছিলো সে সময় দয়াপরবশ হয়ে একজন কলের খোঁজ দিলেও প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়াতে সেদিকে যাইনি। সেখান থেকে হোটেল দশ মিনিটের রাস্তা। গাড়ী যখন হোটেলের সামনে দাঁড়ালো ঘড়িতে সময় সোয়া চার। খুব বেশী সময় লাগেনি।
হোটেলের নাম ‘সাগর কন্যা’, সুন্দর নাম। সাগরের পাড় বেয়ে যে বাঁধ দেয়া আছে ঠিক তার ওপারেই, সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়, বাতাস অনূভব করা যায়, দৃষ্টিতেও আসে। হোটেলটি তিন তলা, সম্ভবত চব্বিশটি রুম, রুম গুলো পরিষ্কার, দুজনের জন্য যথেষ্ঠ পরিমান জায়গা, সাথে লাগোয়া বাথরুম। ঢুকেই ভালো লাগলো আমার। মালিকের পরিচিত বলে হোটেলের সবার অতিরিক্ত নজর আমাদের দিকে। ব্যাগ রেখে নীচে নামতেই গরম চা পেলাম, বাচ্চাদের জন্য দূধ। এরই মাঝে দুজন পাইপ দিয়ে গাড়ী ধুয়ে দিচ্ছে। দেখা হলো হোটেলের কয়েকজন বাসিন্দার সাথে, আমার পরিচিত একজনকেও দেখলাম, ওয়ারিদে কাজ করে, সখের ছবিয়াল, বউকে নিয়ে এসেছে সাথে, গত রাতে রওনা দিয়ে পৌঁছেছে দুপুরের পর। সে তুলনায় ভাগ্যবান আমরা।
হোটেল থেকে নেমে বাঁধ পেরুতেই সমুদ্র, তখন জোয়ার, আমাকে রেখেই বাচ্চারা দৌঁড়ে গেলো পানিতে, এক এক করে সবাই পানিতে। আমি ক্যামেরা হাতে পশ্চিমে তাকিয়ে। সূর্য তখন লাল কাঁথা বিছিয়ে ঘুমিয়ে যাবার প্রস্তূতি নিচ্ছে, মাছ ধরা নৌকা গুলো ফিরে আসছে তীরে। যেগুলো ফিরেছে সেগুলোর নীচে চাকা লাগিয়ে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে বাঁধের কাছে, সেদিকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলাম ওটা একটা জেলে পাড়া, সারাদিন রোদে শুকানো মাছ ততক্ষণে গুছিয়ে ফেলা হয়েছে, বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড় এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে, কয়েকটা আবার আমাদের দেখে দৌঁড়ে এসে ঝাঁপ দিলো পানিতে। সামুদ্রিক প্রকৃতির মাঝে বেমানান কয়েকটি মটর সাইকেল নরম বালুতে দাগ কেটে ফিরে গেলো। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক, সবাই উঠে গেছে পানি থেকে, বালুর উপর বসে আছি আমরা, সমুদ্রের স্রোতে স্রোতে বাড়ি খাওয়া আর তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নাই, হঠাত্ করেই এ নিরবতা ভেঙ্গে মাইকের আওয়াজ, স্বাধীনতা দিবস আর সাগর উত্সবের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রন। আমরাও উঠে ফিরে এলাম হোটেলে।
গোসল সেরে সবাইকে নিয়ে সাগর উৎসবের মঞ্চের কাছাকাছি গেলাম, গান হচ্ছে, শেষে সিনেমা “ওরা এগার জন”, অবশ্য ছবি শুরু হবার আগেই ফিরেছি আমরা, পরে শুনেছি প্রজেকশনের সমস্যায় ছবিটা দেখাতে পারেনি সেদিন।
রাতের খাবার সেরেছি হোটেলের রেস্তোরায়, পাকা ঘর কিন্তু জানালা আর ছাঁদ নেই, ত্রিপল দিয়ে ঢাকা, বাতাস পেয়ে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে সেখান থেকে। খাবারের মান ভালো, রূপচাঁদা ভাজা, চিংড়ি দোপেয়াজা, ঝাল মুরগী, সব্জী আর সালাদ। অনেক্ষণ ধরে তৃপ্তি মিটিয়ে খেয়ে ঘুমাতে গেলাম।
খুব ভোরে ঊঠেছি, বারান্দার দরোজা খুলে দিতেই সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাস মন জুড়িয়ে দিয়ে গেল। বাইরে তখন অন্ধকার। আমি আর কামরুল নীচে নেমে দেখি আমাদের জন্য দূটো মটরসাইকেল তৈরী, নিয়ে যাবে সূর্যোদ্বয় দেখাতে, যেতে হবে পূবে প্রায় পাঁচ কিমি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো অন্যরকম, কিছুদূর গাড়ীতে যেয়ে এরপর হাঁটবো। সেইমত বের হয়ে পাশের ঝাঁউ বাগানে গাড়ী রেখে ভেঁজা বালুতে হাঁটতে ত্থাকলাম, আমাদের পাশ দিয়ে নিস্তব্দতা ভেঙ্গে ছুটে যাচ্ছে মটরসাইকেল, যাত্রী নামিয়ে ফিরে আসছে, আবার যাচ্ছে, হেঁটেও যাচ্ছে অনেকে। সামনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মশারীর কাপড় দিয়ে তৈরী জাল দিয়ে চিংড়ি রেনু ধরছে। কিছু জেলেকে দেখলাম বালুর উপর কাঁথা বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে। পাড়ে একটা চায়ের দোকানে যেয়ে বসলাম, চা কফি দূটোই বেশ ভালো বানায় এখানে। পরবর্তী একঘন্টা এর আশেপাশে কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে।
বাচ্চারা ততক্ষণে জেগেছে, ওদের নিয়ে নাস্তা করতে বের হলাম। হোটেলে নাস্তা হবেনা আজ, সবার ধারনা বাইরেই ভালো। কূয়াকাটায় এই একটা বিষয়ে পরিচিত সবার আক্ষেপ আছে, কোন ভালো খাবারের দোকান পাবেননা, সবই প্রায় কারওয়ান বাজার টাইপের, অখাদ্য। বছরের তিন মাস ছাড়া বাবুর্চী গুলো সবই হয় মাছ ধরে বা অন্য কাজ করে। হোটেল বয় গুলোও তেমন, প্রতিদিনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে যোগাড় করা। এ নিয়ে মনি’র সাথে কথা বলেছিলাম, ওর কথা সারা বছর রেখে পোষায়না বলে কেউ সেদিকে যায়না। আবাসিক হোটেল গুলোর নিজস্ব রেস্তোরার মান সে তুলনায় কিছুটা ভালো, এখানেও প্রতিযোগিতা আছে, কেউ ভালো একজন বাবুর্চী নিয়ে এলে কিছুদিন পর অন্য হোটেল বেশী পয়সায় তাকে নিয়ে যাবে, সেখান থেকে অন্যজন, এরপর আরেকজনের থেকে এড্ভান্স নিয়ে হাওয়া, এভাবেই চলছে। আমার ধারনা চার তারা মানের নিদেন পক্ষে তিন তারা মানের হোটেল এখানে ভালো ব্যবসা পাবে। এছাড়া কর্পোরেট ক্লায়েন্টদের জন্য একশ জনের কনফারেন্স হলও ভালো চলার কথা।
নাস্তা সেরে গাড়ী নিয়ে বীচে নেমে এলাম, সমুদ্রের পাড় ঘেষে চলে গেলাম পশ্চিমে, সেখান থেকে ফাতরার চর সাঁতার দিয়ে যাওয়া যাবে, সিডরে এ চর মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এপাড় থেকে স্পষ্ট সে চিহ্ন দেখা যায়। লোকজন এদিকে কম আসে। মাঝে দুটো জেলে পাড়া, সকালে এ সময়টা শান্ত, শুটকী শুকাতে দেয়া হয়েছে, টুকটাক ঘরকন্যার কাজ ছাড়া সময়টা অলস ওদের কাছে। সুর্য যখন পশ্চিমে হেলে যাবে ঘরে ফিরবে জেলেরা একে একে, ব্যস্ততা বেড়ে যাবে এদের, মাছ বাছা, কাটা, আলাদা করা, কিছু বিক্রির জন্য রেখে বাকিটা পরের দিন ভোরে শুকাতে দেয়া। গাড়ীতেই ঘুরে ঘুরে দেখছি, বালুর উপর কাকঁড়া, মরা ডলফিন, ভেসে আসা গাছের গুঁড়ি, বাচ্চাদের খেলা, মাঝে মাঝে ছুটে যাওয়া মটরসাইকেল। ঘন্টা খানিক এভাবে পুবে পশ্চিমে ঘুরে সমুদ্রে নামলাম। তখন জোয়ার, কক্সবাজারের মত এখানেও পানিতে বালু বেশী, নদীর মোহনায় বলে ময়লাও সেরকম। জোয়ারের ঢেউ তুলনামূলক বেশী। সমুদ্রে নামলেই মনটা যেন কেমন হয়ে যায়, দু ঘন্টার মত পানিতে থেকে উপরে উঠলাম, হোটেলে ফেরার আগেই পানি শুকিয়ে বালু চটচট করতে লাগলো। রোদের তেজও বেশ। সুন্দর একটা সমুদ্র স্নানের পর সবার মন ফুরফুরে।
দুপুরের খাবার সেরে মিশ্রী পাড়া গিয়েছিলাম, বুদ্ধাকে দেখতে, মটর সাইকেলের পেছনে চড়ে। কুয়াকাটার অন্যতম বাহন এই মটরসাইকেল, ভাড়ায় চলে, কারো কারো ৫/৬টা পর্যন্ত আছে। মিশ্রী পাড়ায় যেতে পাকা রাস্তা নেই, মাটির আইল ধরে যেতে হয়, উচুঁ নিচু রাস্তা, চলছিলো খুব জোরে, পেছনে বসে ক্যামেরা আর নিজেকে সামলাতেই ব্যস্ত আমি, আমার বাহক একে একে বিবরন দিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের, খুব কমই কানে ঢুকছে আমার, ভাত খাবার পরই বের হওয়াটা উচিৎ হয়নি বোধহয়। ওখানে যেয়ে দেখলাম নুতন রাস্তা তৈরী হচ্ছে মন্দিরে যাবার। প্রায় তিন তলা উঁচু মন্দিরের উপরে টিনের ছাউনি, তখন বন্ধ ছিল, আমাদের বাহক দৌড়ে যেয়ে চাবি নিয়ে এলো। শুনেছিলাম বসা অবস্থায় বুদ্ধের বৃহত্তম মূর্তি এটা, আমি জানিনা, তবে প্রায় ৩০ ফিটের মত হবে, চমৎকার আলো আসছিল উপরের টিনের চালের ফাঁক দিয়ে, ঘুরে ঘুরে দেখলাম, মঙ্গোলিয়ান চেহারা, রাখাইনদের মতই। বুদ্ধা যেখানেই যান সেখানকার মানুষের ছাপ থাকে চেহারায়। বিকেল ধরে আসার আগেই ফিরে এলাম, সবার আবদার আবারো বিচ ড্রাইভ। ভালো লাগে। সন্ধার আগে আগেই গাড়ী রেখে ক্যামেরা হাতে নেমে এলাম বালুতে। আগামীকাল সকালেই ঢাকার দিকে রওনা দিব, সূর্যাস্থ্বের ছবি তোলা মিস্ হোক চাইনা। এদিন বেশ অনেক সময় বীচে ছিলাম।
শেষ দিন খুব সকালে একেবারে তৈরী হয়ে হোটেল ছেড়েছি, সবাইকে নাস্তার টেবিলে বসিয়ে গেলাম মাছের বাজারে, নিশ্চয়ই তাজা কিছু পাওয়া যাবে সেই আশায়। আসলে ধারনা ছিলোনা আমার, কুয়াকাটায় ক্রেতা কম বলে রূপচাঁদা বা এজাতীয় সামুদ্রিক মাছ বাজারে বিরল, যাও আছে বরফ দেয়া আর ঢাকার চাইতে দাম বেশীই মনে হলো। তারপরও কিনলাম সখের কেনা।
ফিরতি পথে সকাল ৯টায় যাত্রা শুরু করেছিলাম, এ যাত্রা সুখকর ছিলনা, প্রতিটা ফেরীতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো বেশ খানিকটা সময়, বাসায় যখন এসেছি ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে দশ। অনেক সময়। তারপরও ইচ্ছা আছে যাবার আবারো।
আজ খেয়াল করলাম নামের শেষে অতিথি নেই। সবাইকে ধন্যবাদ নিজেদের করে নেবার জন্য।
কূয়াকাটার আরো ছবি দেখতে চাইলে এখানে ঘুরে আসুন।
মন্তব্য
সূর্যাস্তের ছবিটা অসাধারণ।
এমন শহরে আমি ঘুরি , নাকি শহরটাই ভবঘুরে?
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না এক কে করি দুই৷
সচলত্বের অভিনন্দন...
আর ঈর্ষা... কুয়াকাটায় এই জীবনে যাইতে পারলাম না... দুক্ষ রয়ে গেলো বিরাট...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
- নজু ভাই, কয়েকটা দিন ওয়েটান। এতোদিন যখন যান নাই, এখন আর যাইয়েন না। আমি আইসা লই। একবারেই যামুনে। মাথায় লুঙ্গি বাইন্ধা নদীতে ডুবাইতে নামুমনে আমরা ভায়রা ভাইয়েরা!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
সচল হওয়ার জন্য অভিনন্দন।
লেখা পরে পড়ব
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
লেখাটা অনেক বড় হলেও অসম্ভব এনজয় করলাম। খুব ভাল লাগল। দুর্দান্ত বর্ণনা, যেন আপনার সাথেই ঘুরে আসলাম আর চোখের সামনে সব দেখলাম!
এরপর যেখানেই বেড়াতে যাই না কেন, যাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে যাব।
দুইটা ছবিই খুবই সুন্দর। তবে আরো কয়'টা ছবি দিলেও পারতেন।
পূর্ণ সচল হওয়ার জন্য (আরেকবার) অভিনন্দন।
A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?
আমার সব কিছুই দেখা যাচ্ছে আপনার কাছে ভালো লাগে, ব্যাপারটা সন্দেহজনক!
ছবি দেইনাই বড় হয়ে যাবে বলে, ফ্লিকারের লিঙ্ক আছে নীচে, দেখতে পারেন
...........................
Every Picture Tells a Story
ফ্লীকারে ছবিগুলা দেখসি লেখাটা পড়ার পরপরই। যদি কই যে ছবিগুলা অসম্ভব ঈর্ষাজাগানিয়া মনে হইসে, তাইলে তো আবার "সন্দেহজনক" কিছু মনে করবেন, তাই কিছুই বলব না
A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?
লাগলে নিবেন, অসুবিধা নাই
...........................
Every Picture Tells a Story
আপনার সব কিছুই দেখা যাচ্ছে আমাকে নিতে বলছেন, ব্যাপারটা সন্দেহজনক! মুহাহাহা...
মজাক করলাম। ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই। তবে এভাবে যে সবার জন্য ছবি উন্মুক্ত করে দেন, কখনো কপিরাইট ভাঙেনি কেউ, মানে মিসইউজ করেনি?
A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?
হে হে, ঐটা কি আর বলতে। আমাদের দেশের নামী দামী সব পত্রিকাই ভালোবেসে ছবি ছাপায়, এত ভালোবাসা যে নাম পর্যন্ত দেয়না। বায়তুল মোকাররম গেলে পাওয়া যায় ক্যালেন্ডার, সেটাও ভালোবেসে ছাপানো। এক ট্যুর কোম্পানী ওদের ব্রুশিয়ার করেছে আমার তোলা দার্জিলিং এর ছবি দিয়ে। এমন উদাহারন অনেক, এখন আর এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনা।
...........................
Every Picture Tells a Story
খাইছে! কিন্তু এভাবে ছেড়ে দেয়াটা কি ঠিক? আমাদের দেশে আসলেই কপিরাইটের কোন বালাই নাই। আপনাদের ফটোগ্রাফারদের কোন সমিতি নাই? সবাই একসাথে কিছু করেন, যাতে এভাবে মিসইউজ না হয়। ভালবেসে ছবি ছাপালে ছাপাক, অন্তত ফটোগ্রাফারের নাম উল্লেখ করার মত ভদ্রতাটুকু যেন ভুলে না যায়।
একটা কথা জানায়া রাখি, আমি ভালবেসে আপনার ছবি নিলেও খুব বড়জোর সেটা আমার ল্যাপটপের ওয়ালপেপার বানাব (এখন যেমন সোনারগাঁও-য়ের ছবিটা ব্যবহার করছি)
A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?
ও ভাই মনে হচ্ছে সচলত্বের সাথে অমরত্বের মিল আছে
বিরাট দুঃখ ছোট করেন, চলেন ঘুরে আসি
...........................
Every Picture Tells a Story
অভিনন্দন। লিখুন আরও বেশি বেশি ভ্রমণ কাহিনী, দেখান বেশি বেশি ছবি।
=============================
অসাধারন ছবি !
সচলত্বের অভিনন্দন
-----------------------------------------
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
দারূণ লেখা, দারূণ ছবি ...
সচল হওয়ায় অভিনন্দন ...
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
সচল হবার অভিনন্দন নিন
ছবি মার্কায় ভোট দিন
দেশে এখন নির্বাচনের জোয়ার তাই স্লোগান মাইরা দিলাম
লেখা ছবি দুইটাই দুর্দান্ত হইছে।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
পূর্ণ সচল হবার জন্য অভিনন্দন।
তামান্না কাজী
সচল অভিনন্দন।
আর কুয়াকাটায় যখন গিয়েছিলাম, পথের কষ্ট ভুলে শেষ পর্যন্ত বিমোহিত হয়েছিলাম এতোটাই যে, দোকানপাড়ের বালুতে বসে সূর্যাস্ত দেখেছি। রাতে গোসল করে একবারে সমুদ্র থেকে ফিরেছি।
তবে দ্বিতীয়বার যাবার সাহস আর করি নি ওই রাস্তার কারণে। ২৫ কিলোমিটার যেতে সময় লেগেছিলো আড়াই ঘণ্টা।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
যেমন সুন্দর লেখনী তেমনি সুন্দর ছবিগূলো। কুয়াকাটা যাবার সখ অনেকদিনের। সূর্যদয় আর সূর্যাস্তের একি জায়গায় নাকি অভ্যুদয় ঘটে, এই ব্যপারটা সবসময় অবাক লাগে কল্পনাতে। কিন্তু রাস্তার অবস্থা কবে ঠিক হবে
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আরে! সচল হয়া গেসেন! অভিনন্দন! অভিনন্দন! অভিনন্দন!
সত্যি ভাল্লাগতেসে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
অনেক শখ ছিল জীবনে অন্তত একবার কুয়াকাটা যাবো; এখনও হয়ে উঠেনি
লেখাটা পড়ে কিছুটা স্বাদ পেলাম ... ...
লোভ বেড়ে গেল ... ...
দেখি, একদিন ...
কূয়াকাটা বেড়ানোর ভালো সময় এখন
...........................
Every Picture Tells a Story
নতুন মন্তব্য করুন