একদিনের ভেনিস

মুস্তাফিজ এর ছবি
লিখেছেন মুস্তাফিজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/০১/২০০৯ - ৪:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoসবাই বলে সুন্দর শহর ভেনিস, আমার কাছে মনে হলো নোংরা, ছোট গলি আর পানি পথের এ শহরের রাস্তা ঘাটে মানুষের বিষ্ঠা পড়ে আছে, অত্যধিক পর্যটকের কারনেই কিনা যানিনা হিসুর গন্ধ যত্রতত্র। একদিনের ভেনিস আমার কাছে এটাই ছিল দৃশ্যমান। তবে যা দেখেছি তার তুলনা বইয়ে লেখার চাইতে বেশী।

আগের দিন পিসা থেকে মেস্‌রীতে পৌঁছাই, ভেনিসের মেইন ল্যান্ড এটা, এখান থেকে ব্রিজ পেরিয়ে ভেনিসে যেতে হয়, ২০ মিনিটের রাস্তা, হোটেলের দাম তুলনামূলক কম মেস্‌রীতে। কাউন্টারে সুন্দরী মেয়েটার পাশে বসা লোকটি সালাম দিয়ে জানালো বাঙ্গালী। আমাদের ফ্রি কফি খাইয়েছিলেন সুন্দরীর দৃষ্টি এড়িয়ে। পরে রাতের খাবারের জন্য চাইনীজ রেস্তোরার সন্ধান উনার থেকেই পেয়েছিলাম। সে খাবারে মন ভরেনি, পেট ও না।

auto
পরদিন ভোরে হোটেলে নাস্তা সেরে ভেনিস রওনা দিলাম, গাড়ীতে জিপিএস থাকায় ড্রাইভার খুব সহজেই পার্কিং খুঁজে নিয়ে নামিয়ে দিল ষ্টিমার ঘাটে, বললো সন্ধায় এসে নিয়ে যাবে, তখনই খেয়াল হলো গাইড ছাড়াই চলে এসেছি, হিসাব মত গাইড এসে হোটেল থেকে তুলে নিয়ে এখানে আরেক গাইডের হাতে তুলে দেবার কথা আমাদের । ষ্টিমার ঘাটের নাম সম্ভবত সান্তা ক্রুজ, ঘাটে ২০টার মত স্যুভেনির শপ, প্রায় সবই বাঙ্গালীদের, মালিক বাঙ্গালী, কর্মচারী বাঙ্গালী, ইতালিয়ান ভাষায় ভালো দখল, জার্মান আর ফ্রেঞ্চ ও জানে অনেকে। কিছুক্ষণ গল্প করে সারাদিনের জন্য টিকিট কাটলাম ১১ইউরো জনপ্রতি, লন্ডনে আমাদের ট্রাভেল এজেন্টকে ভুল বোঝাবুঝির কথা এস,এম,এস করে জানিয়ে সেন্ট মার্কস্‌ স্কোয়ারের উদ্দেশে ফেরীতে চড়লাম, আমরা চোদ্দ জন সেখানেই গাইডের অপেক্ষায় থাকবো।
ছোট্ট একটা ক্যানেলের মাঝ দিয়ে একবার এপাড় আরেকবার অন্যপাড় এই করে ১১ নাম্বার স্টেশন এই সেন্ট মার্কস্‌ স্কোয়ার, ভেনিসের প্রাণ। ফেরীর ঠান্ডা বাতাসে জড়োসড়ো হয়ে বসে থেকে নীচে নেমে মিষ্টি রোদে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। হেঁটে হেঁটে চলে এলাম ডজেস্‌ প্যালেসের সামনে। গথিক স্টাইলের এ বাড়ীটি ৬৯৭ থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত ভেনিস শাসন করেছে, একটা মাষ্টার পিস, পুরো বাড়ীতেই অসম্ভব সুন্দর কারুকাজ মন জুড়িয়ে যায়। বিখ্যাত ইতালীয়ান শিল্পীদের ছোঁয়া লেগে আছে বাড়ীর পুরোটা জুড়ে। এখন মিউজিয়াম। ঢুকতে লাগে ২০ ইউরো। মোটামুটি ঘন্টা দুয়েক লাগবে যদি দৌঁড়ের উপর দেখতে চান। বাড়ীর সামনে আর পাশে খোলা চত্বর, হাজারে হাজারে কবুতর, ৩ ইউরো খরচ করে এক মুঠ বুট কিনে কবুতর খাওয়ানোর লোকের অভাব আমাদের মাঝেও ছিলোনা। এবাড়ীটার পেছনেই বিখ্যাত সেন্ট মার্কস্‌ গীর্জা, ইতালিয়ান ভাষায় ব্যাসিলিকা। দূর থেকে ডজেস্‌ প্যালেসের চূড়া ছাড়িয়ে এর পাঁচ গম্বুজ দেখা যায়। আফ্রিকায় জন্ম নেয়া সেন্ট মার্কস্‌ গত হয়েছেন সেই কবে, বিশ্বাস করা হয় তাঁর দেহ সংরক্ষিত ছিল আলেকজান্দ্রীয়ায়, ৮২৮ সালে দুই ব্যবসায়ী মাথা ছাড়া তাঁর দেহ সেখান থেকে চুরি করে ভেনিসে নিয়ে আসে, তারও প্রায় আড়াইশো বছর পর ১০৯৪ সালে এ ব্যাসিলিকা তৈরী হলে তাঁকে এখানে সমাহিত করা হয়। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন এখানে সমাহিত ব্যক্তিটি আসলে আলেকজান্দার দ্যা গ্রেট। বাইজেন্টাইন আর্কিটেকচারে তৈরী এ ব্যাসিলিকা সমৃদ্ধ হয় আরো পরে ১২০৪ সালে তৎকালীন কনস্তানটিনোপল বিজয়ে লুটের মাল হিসাবে প্রাপ্ত মার্বেল দিয়ে। ভেতরে ঢুকলেই যা হবে প্রথমেই চোখ ধাঁধিয়ে যাবে এর সৌন্দর্যে, মেঝেতে মার্বেল, দেয়ালে মার্বেল এমনকি ছাদেও মার্বেল পাথরে সোনালী কাজ, দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে আলো আসার চমৎকার ব্যবস্থা, তাতে সৌন্দর্য ফুটে আসে অদ্ভুত ভাবে। আরো আছে ইতালীয়ান ফ্রেস্‌কো। অদ্ভুত এ দেয়াল পেইন্টিং গুলো আজো অমলিন। যে কেউ ইচ্ছা করলে এর ভেতর দিয়ে হেঁটে উপরে ছাদে চলে যেতে পারে, কিংবা সামনের ৯৯ মিটার উঁচু বেল টাওয়ারে উঠে দেখতে পারে ভেনিসের রূপ যা অবশ্যই নীচে থেকে দেখার চাইতে ভিন্ন।

auto
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি আর চমৎকৃত হচ্ছি। দেখতে দেখতে দু ঘন্টা পেরিয়ে গেলো, আমাদের গাইডও চলে এসেছে এরই মাঝে।
ভেনিসের চিপা গলিতে হাঁটতে হাঁটতে বার্গারের দোকানে ঢুকে খেয়ে নিলাম। এর পর বেরুলাম শহর দেখতে।

auto
নিচু গলায় গাইড বিবরন দিয়ে যাচ্ছে ভেনিসের আর হেঁটে হেঁটে দেখাচ্ছে শহরটাকে, ঘন্টাখানেক ঘুরে পুরোনো জেলের সামনে এসে যাত্রা বিরতি, এরপর আবার অন্য রাস্তায় ঘুরে ফিরতি পথে সেন্ট মার্কস্‌ স্কোয়ার। এ দ্বীপে গাড়ী-ঘোড়া নেই, হাঁটাই সম্বল, আর আছে ক্যানো, প্রতি ঘন্টার ভাড়া ১২০ ইউরো, পয়সা থাকলে ঘোরা যায়। ক্যানো যারা চালায় জেব্রার মত ডোরাকাটা পোষাক তাঁদের, মাথায় হ্যাট, ক্লাউন ক্লাউন লাগে। পুরোনো ভেনিসের অনেক কিছুই জানলাম, দেখলাম কিভাবে এ দ্বীপে খাবার পানি জমিয়ে রাখা হতো মাটির নীচে, দিনে দুবার মাত্র খুলে দেয়া হতো ঢাকনার মুখ।

auto
দুঘন্টার মত এখানে থেকে চলে এলাম মুরানো দ্বীপে, কাঁচ দিয়ে বানানো কারুকাজময় শোপিসের জন্য মুরানো দ্বীপের নাম আগেই শুনেছি, এবারে দেখলাম কিভাবে তৈরী হয় এসব। অদ্ভুত দক্ষতায় কাঁচগুলিয়ে লম্বা পাইপের মাথায় লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে দিয়ে তৈরী হচ্ছে হাতি, ঘোড়া, দেব-দেবী, কানের দুল, মাথার তাজ, ঝাড়বাতি, প্লেট, চামিচ আরো কত কি। আর দাম? না জানাই ভালো, ইউনিক জিনিষ্পত্রের দাম সম্পর্কে যাদের ধারনা আছে অনুমান শুধু উনারাই করতে পারবেন।

auto
দেখতে দেখতে সূর্য ঢলে আসছে পশ্চিমে, ফেরার জন্য ফেরীতে উঠলাম, ৩০ মিনিটের মাথায় চলে এলাম বাঙ্গালী পাড়ায়। হাতে সময় আছে তখনো, জমে উঠলো আড্ডা বাঙ্গালী ভাইদের সাথে। ড্রাইভার যখন এলো উঠে আসতে মন চাইছিলোনা কারও।


মন্তব্য

মুস্তাফিজ এর ছবি

আমারতো এখন পিজা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

কল্পনা আক্তার এর ছবি

আমি গিয়েছিলাম ১৯৯৮ সালে, শিক্ষা সফর হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম ভেনিসকে। বাসে চেপে তুরিন থেকে ভেনিসে গিয়েছিলাম কিন্তু তখন মনে হয় এতো নোংরা ছিলনা বা কম বয়সে ভেনিস দেখার উত্তেজনায় মনে হয় খেয়াল করিনি দেঁতো হাসি

সেখানে মুরানো এলাকায় একটি বিখ্যাত ক্রিষ্টাল কারখানা ও বিক্রয় ছিল এবং আমি একটি ক্রিষ্টালের দোয়েল সদৃশ্য পাখি কিনেছিলাম (কিন্তু ওটা ভেঙ্গে গেছে মন খারাপ )

তবে, আমি সাতজনম চেষ্টা করলেও আপনার মতো সুন্দর ও সাবলীল বর্নণা দিতে পারবোনা দেঁতো হাসি

লেখায় জাঝা

.........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা


........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভালো লেগেছে জেনে খুশী হলাম। মুরানোর কারখানা থেকে আমিও কিছু কিনেছিলাম, অনেক দাম।

...........................
Every Picture Tells a Story

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

কয়েক টুকরো ভেনিস দেখলাম।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মুস্তাফিজ এর ছবি

আমার আবার দেখার ইচ্ছা আছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

মুস্তাফিজ ভাই, বর্ণনা কোন সময়কার? এক টুকরা ভেনিস দেখা হলো। ধন্যবাদ।

মুস্তাফিজ এর ছবি

গত বছর মার্চে গিয়েছিলাম

...........................
Every Picture Tells a Story

রণদীপম বসু এর ছবি

আহ্, কী চমৎকার ছবি ও লেখা !
মুস্তাফিজ ভাই, আশা করছি এটা একটা সিরিজ আপনার। সামনে আরো আসবে....

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মুস্তাফিজ এর ছবি

আশা রাখি, দেখা যাক।

...........................
Every Picture Tells a Story

তানভীর এর ছবি

গন্ডোলায় চড়েন নি?

মুস্তাফিজ এর ছবি

পানির দেশের মানুষ আমরা, এক ঘন্টায় ১২০ ইউরো কে খরচ করে। তাই চড়া হয়নি, আফশোস ও নাই।

...........................
Every Picture Tells a Story

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আপনার বর্ণনা বড়োই আকর্ষণীয়।

এই তো কিছুদিন আগে ভেনিসের কী দশা হয়েছিল, দেখুন

পুনশ্চ. ব্যানারটা দুর্দান্ত!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

মুস্তাফিজ এর ছবি

ধন্যবাদ

...........................
Every Picture Tells a Story

মুস্তাফিজ এর ছবি

ধন্যবাদ

...........................
Every Picture Tells a Story

দ্রোহী এর ছবি

অতি চমৎকার বর্ণনা আপনার। ছবিগুলো হাই-রেজোল্যুশনে ফ্লিকারেই দেখতে ভাল দেখাচ্ছে।


গরীবের আবার সিগনেচার!!!

মুস্তাফিজ এর ছবি

আমিতো ভাবি আধাখেচড়া লেখা।

...........................
Every Picture Tells a Story

রানা মেহের এর ছবি

আহারে!
আমার কত শখ ভেনিস যাবার
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

মুস্তাফিজ এর ছবি

আমিও বলি আহারে, আরো দিন দুই যদি থাকা যেত।

...........................
Every Picture Tells a Story

s-s এর ছবি

চমতকার ভাই! শ্রদ্ধেয় তীরন্দাজের পর আপনার এই লেখা বিশ্বভ্রমণের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। মুরানোর বেশ কিছু জিনিস ছিলো এখানে এক বন্ধুর বাড়িতে, অনেক দামী আর সুন্দর, তাই না? কিছু ছবি দেবেন ওগুলোর?

ভালো লাগলো লেখা!

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

মুস্তাফিজ এর ছবি

মুরানো থেকে কিনিনি কিছু, শুধু কয়েকটা কানের দুল আর একটা ঘোড়া, দুল সম্ভবত বউএর পছন্দ হয়নি, যদি কোনদিন কানে লাগায় সেই আশায় ছবি তুলিনি।

...........................
Every Picture Tells a Story

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।