সেবারে বেইজিং থেকে ফেরার পথে কুনমিং এ দলছুট হয়ে অতিরিক্ত ৩ রাত থেকেছি পরিবার সমেত। দ্বিতীয়দিন ভোরে গাইডকে যখন জানালাম ‘স্টোন ফরেস্ট’ যাবার সময় ইউয়ান্তং মন্দির দেখে যাবো খুশী হয়েছিলো খুব। ওর খুশীর কারন ছিলো অন্য। আমার জানামতে চীনে যতগুলো খোলা মন্দির আছে তারমধ্যে ইউয়ান্তং এর বৌদ্ধ মন্দির অন্যতম। কুনমিং ইউনান প্রদেশের রাজধানী, শুধুমাত্র ইউনানের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র বলেই নয়, সারা দেশ এমনকি দেশের বাইরে থেকে প্রচুর তীর্থ যাত্রীর সমাগম ঘটে এখানে। কোথাও যাত্রা শুরুর আগে এখানে ঘুরে যাওয়া আমাদের গাইডের কাছে পূন্য এবং সফলতার রক্ষাকবচ হতে পারে এটা ভেবে তার খুশী হওয়াটাই তাই স্বাভাবিক।
আগে যত বৌদ্ধ মন্দির দেখেছি সেগুলোর চাইতে এ মন্দিরের ঢোকার রাস্তাটা একটু অন্যরকম। সামনের বিশাল কারুকার্যময় লাল রংয়ের গেটে ১০টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকেই টের পেলাম সেটা। গেটের পরেই বাগানের মাঝ দিয়ে অল্প একটু পথ পেরিয়ে বিশাল সাইপ্রাস গাছের গোড়া ধরে এগিয়ে গেলে সামনে দেখতে পাবেন বিশাল এক আর্চওয়ে, তাতে চার অক্ষরের চাইনীজ ক্যারেক্টারে লেখা “ইউয়ান্তং শেংজিং”, শেংজিং এর ইংরেজী মানে ওয়ান্ডারল্যান্ড। অন্যরকম বলার কারনটা হলো সব মন্দিরে দেখেছি হেঁটে হেঁটে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে মন্দিরে ঢুকতে হয় আর এখানে মূল গেট দিয়ে ঢোকার পর থেকে আপনি আস্তে আস্তে নীচের দিকে নামতে থাকবেন। আর্চওয়েতে এসে একটু দাড়ালাম, পুরো মন্দির খুব সুন্দর দেখা যায় এখান থেকে।
মন্দির কমপ্লেক্স তৈরী হয়েছে ‘মহাবীর হল’কে ঘিরে। এ হল কে পদ্মফুলও বলা হয় কারন এর চারদিকে আছে বিশাল এক নীল পুকুর, তাতে অসংখ্য মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে ঢুকতে এই পুকুর পেরুনোর জন্য আছে সুন্দর এক পাথরের ব্রীজ। দুপাশের অন্যান্য ঘর গুলো হয় ছোট ছোট ব্রীজ কিংবা কাঠের রাস্তা দিয়ে মহাবীরের সাথে যুক্ত।
কুনমিং এর উত্তরে ইউয়ান্তং পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল এই মন্দিরের ইতিহাস বারশো বছরের পুরনো। অষ্টম শতকের শেষদিকে পুতুল মন্দিরের বর্ধিতাংশ হিসাবে রাজা ইমোয়ান এটা তৈরী করলেও কিন্ রাজত্যের সময়কালেই এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সম্রাটের রাজত্যকালে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি হওয়ায় এর স্থাপত্যরীতিতে তাই বহুমূখিতার প্রতিফলন দেখা যায়।
ব্রীজ পেরিয়ে মহাবীর হলে উঁকি দিলাম, গৌতম বুদ্ধের তিনরূপ শাক্যমুনি, অমিতাভ, ধ্যানী (Medicine Buddha) এই তিন মূর্তির সবকয়টাই এই মহাবীর হলে আছে, প্রায় শ’পাচেক মুনির কাঠের (সম্ভবত) কাজ করা মুর্তি পুরো দেয়াল জুড়ে ঘিরে আছে তাঁদের দেখলাম। এই সব মূর্তিই ইয়ান রাজত্যের সময়কালে তৈরী। মন্দিরের মাঝে মিং রাজত্যের সময়কালে তৈরী দশ মিটার উঁচু দুইটি বিশাল পিলারে দুই ড্রাগন, হলুদ আর সবুজ রংয়ের, এমন ভাবে থাবা বের করে জড়িয়ে আছে যেন যে কোন মুহুর্তে আদেশ পাওয়া মাত্রই ছুটে বেড়িয়ে যাবে। ভিন্ন শতাব্দীতে তৈরী হলেও ড্রাগন আর মুনীদের ভঙ্গিমা একই রকম।
ঘুরে ঘুরে দেখছি আর চমৎকৃত হচ্ছি এর কারুকাজ দেখে। কালো কালো জামা পড়া শ’য়ে শ’য়ে মুনীরা ধর্মীয় শ্লোক আউড়ে চক্কর দিচ্ছে মন্দির জুড়ে। স্থানীয় পূন্যার্থীরা আগরবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এসে সেজ্বদা করে যাচ্ছে। চারদিক ধুপের ধোঁয়া আর ধর্মীয় শ্লোকের শব্দে কেমন মায়াবী পরিবেশ।
ঘুরতে ঘুরতে মন্দিরের পেছনে চলে এলাম, অসম্ভব সুন্দর কিছু পাথরের সিড়ি, এমন ভাবে বানানো যাতে বয়ে যাওয়া বাতাস ঘুরে মন্দিরের ভেতর চলে আসে, বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি দেখলাম এখানে।
এর পাশেই ‘কপার হল’। ১৯৮২ সালে শুভেচ্ছার নিদর্শন সরূপ থাইল্যান্ড থেকে পাওয়া চারটন ওজনের গৌতমের মূর্তি রাখার জন্যই ১৯৮৫ সালে এ ‘কপার হল’ তৈরী করা হয়।
এ মন্দিরের গর্ব একসময় বুদ্ধের দাঁতের আগমন ঘটেছিলো এখানে, সালটা এখন আর মনে করতে পারছিনা। কিছুদিন ছিলো এ মন্দিরে। মন্দির সংলগ্ন মিউজিয়ামে এ সংক্রান্ত অনেক ছবি দেখলাম। তবে মিউজিয়ামের সবচাইতে আকর্ষনীয় মনে হলো ফরাসী সৈনিক ফ্রান্সিসকো’র (Auguste de Francois) তোলা কিছু ফটোগ্রাফ যা তোলা হয়েছিল ১৮৯৬-১৯০৪ সালের মাঝামাঝি।
এ কমপ্লেক্স এ আরো আছে স্যুভেনিউর এর দোকান, ক্যালিগ্রাফী স্টুডিও, খাবার দোকান।
দেড় ঘন্টার মন্দির দর্শন খুব একটা খারাপ লাগেনি আমার কাছে।
মন্তব্য
মুস্তাফিজ ভাই বর্ননা ও ছবি বরাবরের মতোই অসাধারন । শুধু একটাই অভিযোগ পড়তে গেলে এত্ত তাড়াতাড়ি শেষ হযে যায় কেনো ?????
ফন্টের সাইজ বড় করে পড়েন, লেখা অনেক বড় হবে, কিংবা দুবার পড়তে পারেন।
আশাকরি আগামীতে বেশী বড় লেখার চেষ্টা করবো। আসলে পেটে বিদ্যাকম তাই বড় লেখা লেখা হয়না।
...........................
Every Picture Tells a Story
এইসব বলে পার পাওয়া যাবেনা আর "বিদ্যা" প্রসংগ আমার কাছে তুলে লাভ নাই কারন তা হলে আমি তো কমেন্টই করতে পারবোনা
আপনার বদৌলতে অনেক নতুন নতুন জায়গায় বেড়ানো হচ্ছে
"স্টোন ফরেস্ট" নিয়ে লিখবেন নাকি পরে? কিছুদিন আগে আমার কলিগ চীন থেকে ঘুরে আসল। ওর কাছে শুনলাম স্টোন ফরেস্ট নাকি অসম্ভব সুন্দর।
ভাইজান কী ওইসময় এসএলআর ব্যবহার করতেন না?
স্টোন ফরেস্ট নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে। সেখানে গিয়েছিলাম ধারকরা ৩এমপি'র ডিজিটাল নিয়ে।
আমি সিরিয়াসলী ছবি তুলি ২০০৭ এর ডিসেম্বর থেকে।
...........................
Every Picture Tells a Story
মুস্তাফিজ ভাই, এতো সুন্দর জায়গায় গেলেন, আর মাত্র ৬টি ছবি দিলেন ! কিপ্টেমীটা একটু বেশি হয়ে গেলো না !
আচ্ছা আপনার এই পোস্টে ঢুকতেই লাল জমিনে একটা ব্যতিক্রমী ম্যাসেজ এসে বসে আছে, এটা কী ?
* Problem retrieving user's photos
* Problem retrieving user's photos
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
সম্ভবত ছবি আপলোড সংক্রান্ত সমস্যায় ঐ মেসেজ দেখাচ্ছিলো।
আর নূতন বেড়ানোর জায়গাগুলোয় অবশ্যই ছবি বেশী বেশী পাবেন। সেসময় কিপ্টেমী করতাম ছবি তুলতে, এখন করিনা।
এনিয়ে মজার ঘটনা বলি, এটা দার্জিলিং এ ২০০৩ এর ঘটনা। ফ্লিম ক্যামেরায় ফটাফট ছবি তুলছি, ২ ঘন্টায় গংগামায়ায় ৯টা রীল শেষ, আমার পাশে কলকাতার এক ভদ্রলোক, ছবি তোলা দেখে বললেন "দাদা কটা খিচ্লেন?" আমি উত্তর দিলাম ৯টার মত। ঊনি হেসে উত্তর দিলেন "মাত্র ন"টা? আমি তো দাদা ২০টা তুলে ফেলেছি, এখনও রীলে ১৬টার মত আছে, ভাবছি রকগার্ডেনের জন্য রেখে দেব"।
...........................
Every Picture Tells a Story
ভদ্রলোক কি তবে আপনাকে কিপটেই ভাবলেন ! হা হা হা ! মজার কথা শুনাইলেন..!
এখন অবশ্য মেসেজটা আর নেই।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
কে যেন বলেছেন, ছবির জন্য প্রয়োজনে সুদূর চিন পর্যন্ত যাও...
---------------------------------------------
রাজাকার আলবদর নিপাত যাক!
জয় বাংলা আমার থাক!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
মুস্তাফিজ ভাই।
বেশী বেশী ছবি চাই ।
......................................................
কোকিলের ঘরে কাক হয়ে বাঁচি
চীনাদের আমার ভীষণ ভয়। সে গল্প পরে একদিন শোনানো যাবে।
মুস্তাফিজ ভাই, আপনার লেখা ও ছবি বরাবরের মতই মুগ্ধতাজাগানিয়া।
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
মুস্তাফিজ ভাই, এবারের বই মেলায় আপনার ভ্রমন কাহিনী বিষয়ক সচীত্র বই বের করা যেত। এত কাহিনী নিয়া বইসা আছেন ক্যান বুঝি না।
আমার এক দফা এক দাবী -
সচিত্র ভ্রমন কাহিনীর বই চাই, চাই, চাই!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
অত ফুলাইয়েননা, তাইলে আমার লেখা বন্ধ হইয়া যাইব
...........................
Every Picture Tells a Story
ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়লে মন দিল খারাপ হয় খালি। খালি ছবি দেখি আর আফসোস করি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
একবার কোন রকমে বেড়িয়ে যান এরপর আর আফসোস করতে হবেনা
...........................
Every Picture Tells a Story
সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ।
একটা তথ্য না জানিয়ে পারছি না। অমিতাভ বুদ্ধ গৌতম বুদ্ধের রূপ না; অমিতাভ বুদ্ধ এ পর্যন্ত জন্ম নেয়া আটাশ জন বুদ্ধের একজন। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন শেষ (আটাশতম) বুদ্ধ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ নব্য আমার ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য। আসলে আমরা অনেক কম জানি। শাক্যমুনি'র ব্যাপারটাও কি তেমন?
আসলে এ কম জানার কারনেই অনেক জায়গা ঘুরে এলেও লিখতে হাত কাঁপে কোথাও ভুল হলো বলে। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
...........................
Every Picture Tells a Story
গৌতম বুদ্ধ ছিলেন শাক্যবংশের রাজা, পরবর্তীতে মুনি। এজন্য এই নাম।
সবাই সব জানবে এমন কোনো কথা নেই। একটু এদিক ওদিক হতেই পারে। ব্লগগুলো একারণে উপকারি- জানার পরিধিটাকে বাড়িয়ে দেয়।
আর যেটা মেডিসিন বুদ্ধা (Medicine Buddha) বলে?
...........................
Every Picture Tells a Story
Medicine Buddha বলে কিছু আছে বলে জানা নেই। তবে ধ্যানী বুদ্ধ বা comtemplative Buddha বলতে যে বুদ্ধ ধ্যান বা meditation করছে সেটা বুঝায়। যদি sculpture টা গৌতম বুদ্ধের comtemplativeধরণের কিছু represent করে তাহলে সেটাকে ধ্যানী বুদ্ধ বলা যেতে পারে।
আমি সেটাই ভেবেছিলাম। যদিও গাইড স্পষ্টতই Medicine Buddha বলেছিলো কিন্তু ধরে নিয়েছিলাম মeditation Buddha ই হবে।
...........................
Every Picture Tells a Story
দারুণ লেখনী সাথে বোনাস ছবি
কিছু তথ্য পাওয়া গেল ... ...
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
আপনাদের ভ্রমন কাহিনী গুলোর কল্যানে আশা করি পৃথিবীর কোন জায়গাই আর অপরিচিত থাকবেনা । আপনার লেখা পড়ে খুব লোভ হচ্ছে ইউয়ান্তং মন্দির টা দেখে আসতে...আপাততঃ আপনার চোখেই না হয় দেখে নিলাম ।আপনার গাইডের খুশির কারণটা জানলাম না । আর ওখানে কি টাকায় হিসেব হয়?.........
( জয়িতা )
জয়িতা, গাইড বৌদ্ধ ধর্মের অনূসারী ছিলেন, চীনের অন্যান্য মন্দিরের মত ইউয়ান্তং মন্দির বন্ধ নয়, নিয়মিত আচার অনুষ্ঠান হয়। শহরের বাইরে গেলে ওখানকার লোকজন চেষ্টা করে একবার এ মন্দির হয়ে যাবার। গাইডের খুশী হবার কারন সেটাই।
টাকা বলতে ওদের মুদ্রা বুঝিয়েছি।
...........................
Every Picture Tells a Story
নতুন মন্তব্য করুন