আমি তখন ছোট জেলা সদরে মিশনারী স্কুলে পড়ি, তখনও কিন্টারগার্ডেন নামের স্কুলের প্রচলন হয়নাই। হাতে খড়ি দেবার স্কুল হিসাবে এ স্কুলের পরিচিতি ছিল বেশ। মেয়েদের স্কুল হলেও তৃতীয় শ্রেনী পর্যন্ত ছেলেদেরও ভর্তি করা হতো। মধুপুর অঞ্চলের ধর্মান্তরিত খৃষ্টান মহিলারাই মূলত পাঠদান করতেন, এছাড়াও সাদা চামড়ার বৃদ্ধা মিশনারী কয়েকজনও ক্লাশ নিতেন আমাদের। তখন সবে মাত্র ময়মনসিংহে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট চালু হয়েছে, আমরা সেখানেই থাকতাম, পাশেই তৈরী হচ্ছিলো চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, পরে এ দু প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে এ স্কুলটি পছন্দের তালিকায় প্রথম হিসাবে চলে আসে। ছেলেদের সিংহ ভাগ দ্বিতীয় শ্রেনী পাশ করার পর ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে এসে তৃতীয় শ্রেনীতে ভর্তি হত। স্কুল হিসাবে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল শহরের সেরা, তবে ভর্তি পরীক্ষায় এ মিশনারী স্কুলের কেউ অকৃতকার্য হয়েছিল তেমন নজির ছোট বেলায় দেখিনি।
আমাদের গ্রামের বাড়ী শহর থেকে ৩২ কিমি দূরে, বাড়ীর ঠিক পেছনেই মধুপুর বন শুরু, সে হিসাবে গারো শিক্ষিকাদের সাথে পারিবারিক যোগাযোগ ছিল আর সেই সূত্রে মিশনারী স্কুলের সাদা চামড়াওয়ালীদের সাথেও। প্রি-স্কুলে পড়ার সময় আমার ডিপথেরিয়া হয়েছিল একবার, ময়মনসিংহ মেডিক্যালে তেমন সুবিধা না থাকায় আমাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল ব্রহ্মপূত্র নদের পাড়ে সূর্যকান্ত হাসপাতালে। মহারাজা সূর্যকান্ত ছিলেন মুক্তাগাছার জমিদারের পালক পুত্র, তার নামে জমিদারদের পয়সায় স্থাপিত এ হাসপাতাল একসময় এ অঞ্চলের একমাত্র চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র ছিল। সংক্রামক ব্যাধি বলেই ঐ হাসপাতালের নির্জন এক ঘরে ঠাঁই হয়েছিল আমার। দর্শনার্থীও ছিল নিয়ন্ত্রিত।
নিয়ন্ত্রিত দর্শনার্থীদের মধ্যে দুজনের নিয়মিত উপস্থিতি ৬ বছর বয়সী আমাকে পরবর্তী জীবনে দারুন ভাবে প্রভাবিত করেছে, উনাদের প্রতিটি কথা বালক বয়সে আমার মনে এমনভাবে দাগ কেটেছিল যে আজ এখনও তার রেশ মনে গেঁথে আছে।
এঁদের একজন আমার বড়মামা, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কলকাতা বোর্ডে নাম করেছিলেন, গান করতেন, গান, কবিতা আর নাটক ও লিখতেন, ছবি আঁকতেন অসম্ভব সুন্দর। আব্বাস উদ্দিন ছিলেন উনার বন্ধু মানুষ, মামার লেখা বেশ কিছুগান উনার কন্ঠে তোলা ছিল। রিক্সা থেকে হাসপাতালের গেটে নেমেই একঝাঁক বাবড়ি চুল দুলিয়ে ভরাট গলায় গেয়ে উঠতেন ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই... দূরে থেকেই বুঝতাম মামা এসেছেন। তখন পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন দেয়া হতো আমাকে, মাত্রা ছিল ১৫+১৫ ৩০লাখ প্রতিবার, কাপড় খুলে পাছার নরম মাংশে ইঞ্জেকশন দিলে পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় ব্যাথায় কুচকে থাকতাম। সে সময়টা মামা গান শুনাতেন, ছবি আঁকা শেখাতেন, প্লাস্টিকের খেলনা পুতুল নিয়ে আসতেন তাই নিয়ে গল্প বানাতাম আমরা।
আরেকজন ছিলেন মিশনারী স্কুলের পাদ্রী, সাদা চামড়ার এ মহিলাও আসতেন নিয়মিত, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় গল্প শুনাতেন আমাকে, ক্রুসেডের গল্প, সেইন্ট পিটার, পল, মার্ক্স আর ভ্যারোনিকার গল্প, ভ্যাটিকানের কাহিনী। উনি সম্ভবত ভ্যাটিকানে ছিলেন কিছুদিন, ভ্যাটিকানের বিবরন এমন ভাবে দিতেন যেন মনে হত উনার সাথে ঘুরতে বেরিয়েছি। ভ্যাটিকান অলংকরণের পেছনে যেসব বিখ্যাত চিত্রকর জড়িয়ে আছেন আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকের কথা বলেছিলেন আমাকে। মনে আছে। বছর দুয়েক আগে যখন রোমে গেলাম পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল, দেখলাম গল্পের মতই আছে সব, খুব মনে পড়ছিলো সেই পাদ্রীর কথা, জানিনা উনি কোথায় আছেন, নামটাও মনে নেই আমার।
আমার এ দীর্ঘ ভুমিকার কারন হলো সেই মিশনারীর কাছে গল্পে শোনা বিষয় গুলো বাস্তবে দেখে আসার অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করা।
প্রথমেই আসি জিওভান্নি বাতিস্তা পিরানেসি’র কথায়। পিরানেসি ইতালীর বিখ্যাত চিত্রকর, ১৭২০ সালে ভেনিসের কাছাকাছি এক শহরে জন্ম, পেশায় ছিলেন আর্কিটেক্ট আর নেশায় চিত্রকর, জেলখানা নিয়ে তাঁর কিছু এচিং আর এনগ্রেভিং এর কাজ আজো শিল্প রসিকদের রসের যোগান দেয়। রোমে ফ্রাঞ্চ আকাডেমীতে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে আঁকা তৎকালীন রোমের কিছু চিত্র তাঁকে অমর করে রাখবে সন্দেহ নেই। উনার সবচাইতে সফল কাজ ছিলো অতীত রোমের সব স্থাপনার মাপজোঁক ম্যাপ আর লিস্ট তৈরী করে রাখা। এ ভদ্রলোকের অনেক কাজ বিশ্বের নামকরা সব মিউজিয়ামে ছড়িয়ে আছে, এর মাঝে প্রায় ৯ফুট উঁচু একটি ফুলদানী যা পিরানসি ভাস্ নামে বিখ্যাত। ১৭৬২ সালের দিকে তৎকালীন পোপ তাঁকে সেইন্ট জন ল্যাটার্ন ক্যাথিড্রালের পূনর্গঠনের কাজের দায়িত্ব দেন কিন্তু কাজ পছন্দ না হওয়াতে সেটা ছেড়ে ‘নাইটস্ অফ মাল্টা’ নামের মিশনারী গ্রুপে যোগ দেন।
‘নাইটস্ অফ মাল্টা’ একটা খৃষ্টান মার্সেনারী গ্রুপ। ক্রুসেড এর সময় জেরুযালেমে এদের উৎপত্তি, সে সময় থেকে বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গাড়লেও ওদের কিছু অবিবেচক কাজের জন্য সবজায়গা থেকেই বিতাড়িত হতে থাকে। সবশেষ রোডস্ দ্বীপ থেকে বিতারিত হয়ে ১৫৩০ সালে ওরা মাল্টাতে অনেকদিন ছিলো এবং এনামেই পরিচিতি পায়। পরে নেপোলিয়ান ১৫৭৮ সালে সেখান থেকেও এদের তাড়িয়ে দেয়। রোমে এদের শাখা যেখানে ছিল সেখানে ১৮৩৪ সালে এসে স্থায়ী আস্তানা গাড়ে।
পোপের কাজ ছেড়ে দিয়ে পিরানেসি এই মিশনারী গ্রুপের আস্তানার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করা শুরু করেন। সম্ভবত উনার মূল পেশার সাথে সম্পকৃত অন্যতম কাজ এটা। ১৭৭৮ সালে মারা যাবার পর এখানেই কবর দেয়া হয় পিরানেসিকে।
পিরানেসি সম্পর্কে আমার আগ্রহ যত, তারচাইতে বেশী এই আস্তানা দেখা, এবং তারও চাইতে বেশী ছোট বেলায় সেই খৃষ্টান পাদ্রীর শোনা আস্তানার মূল দরোজার আকর্ষন।
ভ্যাটিকানে যাবার পথে ভারতীয় বংশদ্ভুত গাইডকে একথা জানাতেই আমার আগ্রহের কথা বিবেচনা করে পাঁচ মিনিট সময় বরাদ্দ করলো এজন্য, জানালো মাত্র পাঁচ মিনিট। দেখতে দেখতে চলে এলাম ‘নাইটস্ অফ মাল্টা’র আস্তানায়, পাহাড়ে একটু ঘুরপথে এসেই বেশ চওড়া একটা চত্ত্বর, তার ওপাড়ে ওদের আস্তানা বেশ উঁচু দেয়ালদিয়ে ঘেরা, মাঝখানে সবুজ রংয়ের বিশাল দরোজা, দরোজা বন্ধ, একটা মাত্র ছিদ্র, চাবি ঢোকানোর, এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে ছিদ্র দিয়ে তাকাতেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। দেখলাম গেটের পরই পায়ে চলা পথ পাহাড়ের শেষ মাথা পর্যন্ত, দুপাশে সুন্দর করে ছাটা পুরনো ঝাঁউ গাছের সারি বাতাসে দুলছে, এরপর আকাশ, আরো প্রায় ৯কিমি দূরে ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকার চূড়া পরিষ্কার দেখা যায়। ঠিক একথাটাই শুনেছিলাম অসুস্থ অবস্থায় আজ থেকে প্রায় আটত্রিশ বছর আগে।
মন্তব্য
ভ্যাটিকানে গিয়েছিলাম একবার। তবে কি কারণে যেনো দর্শনার্থীদের জন্যে ভ্যাটিকান সিটির অনেক কিছুই বন্ধ ছিল।
আপনার বর্ণনা পড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আবার। অবশ্যই যাব।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ঘুরতে তো ভালো লাগে আমারও, কিন্তু পয়সার জন্য পারিনা।
...........................
Every Picture Tells a Story
আর আমার সেজন্যেই পয়সা হলোনা। সব ঘুরতেই খরচ করে ফেলি ভাই।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
লেখা পড়ে মুগ্ধ হলাম। ছবিতে তো কথাই নেই।
আবারো দাবী জানিয়ে গেলাম -
বই ছাপান দাদা !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
...........................
Every Picture Tells a Story
৩৮ বছর আগের গল্প+ ৬ বছরের অসুখের গল্প= ৪৪ বছর।
আপনেরতো অনেক বয়েস দেখা যায় মুস্তাফিজ ভাই। তবে বুড়া বলবো না।
ছবি, লেখা উপাদেয় হইছে।
ঐটা ৪০ হবে, তার মানে আরো ২ বছর বেশী
...........................
Every Picture Tells a Story
দেইখেন
একদিন আমরাও...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
একদিন আমরাও কি?
বুড়ি হবেন না বেড়াতে যাবেন?
...........................
Every Picture Tells a Story
বুড়ি !!!
বালাই ষাট। অখনো দেরি আছে মুস্তাফিজ ভাই।
আপাতত বেড়াইতে যাইতে চাই।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
চলেন
...........................
Every Picture Tells a Story
চাবি ঢুকানোর ছিদ্র দিয়া ব্যাসিলিকার চূঁড়া দেখা যাওয়ার ফটোটা তো আমার বুকটাই ছেঁদা করে দিয়েছে মুস্তাফিজ ভাই..! অদ্ভুত....!!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আসলেই।
আমিও ছবিটা ধরতে পেরেখুশী হয়েছিলাম ।
...........................
Every Picture Tells a Story
ইতালী বিষয়ক আমার এলার্জি আছে; সাধারণত ইতালী সংক্রান্ত বিষয় আমি এড়িয়ে চলি।
কিন্তু এই লেখাটা দুর্দান্ত হয়েছে। সাথে ছবিগুলো ও ফাটানো।
বিশেষ করে চাবির ফুটো দিয়ে ৯ কিমি দুরের সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকার চূড়া আমাকে শিহরিত করেছে ... ... ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই
হুম
...........................
Every Picture Tells a Story
সেলিম ভাই, সচলায়তনে মাঝে মাঝে আসি। আপনি যে এখানে সচল হয়ে বসেছেন সেটা জানা ছিল না। কিছু ছবি তো আগেই দেখেছিলাম আপনার কাছে, ছবির সাথে গল্প গুলো দারুন লাগছে!
নতুন মন্তব্য করুন