আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক তার সামনেই প্রজ্বলিত আগুনের শিখা, দুপাশে মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে দুজন সৈনিক, ইতালিয়ান। পেছনের দেয়াল প্রায় ৮০ফিটের মত উঁচু তাতে গ্রিক দেবীর বিশাল এক ভাস্কর্য। প্রথম বিশ্বযুদ্বে নিহত ইতালিয়ান সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে মুসোলিনীর নৈবেদ্দ। প্রথম বিশ্বযুদ্বে অংশ নেয়া ইতালিয়ান জেনারেল জিওলিও ড্যুয়েট এর মাথায় প্রথম এই ‘প্রজ্বলিত আগুনের শিখা’ তৈরীর ধারনা আসে, এরপর সংগ্রিহীত ১১জন অজানা মৃত সৈনিকের সাথে আরো একজন সৈনিকের দেহাবশেষ এখানে সমাহিত করা হয়। সাদা শ্বেত পাথরের তৈরী এই স্থাপনা সারা বছর পর্যটকদের আনাগোনায় ভরপুর থাকলেও স্থানীয় লোকদের বেশ অনীহা এই স্থাপত্যকে ঘিরে।
রোমে শেষদিন দুপুরে ফ্লাইট, সেখান থেকে যাবো ফ্রাঙ্কফ্রুট তারপর আবুধাবী হয়ে ঢাকায়। সকালে তাই তাড়াহুড়ো নাস্তা সেরে নিলাম, শেষ রাত ছিলাম হোটেল রোমাতে, পুরনো আমলের বিল্ডিং, স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ, সামনের রাস্তা সরু একমুখি। সুন্দরী রিসেপশনিষ্ট জাতে আমেরিকান, পর্যটক আকৃষ্ট করার জন্যই ভালো ইংরেজী জানা আমেরিকানকে চাকরীতে রেখেছে ইতালিয়ান মালিক। ভালো বুদ্ধি। এখানে মজার জিনিষ দেখলাম, মাত্র দুজনের লিফট্। পুরনো বিল্ডিং বলে সিড়ির মাঝখানে অল্প জায়গায় লিফট বসিয়েছে, তিন দিকে খোলা, দুদিকে সিড়ির দেয়াল, পেছনে কপিকলের শেকল কাঁচের দেয়ালে ঢাকা, তাতে আবার দরোজা নেই, সিড়িমুখে লোহারগেট ভেতর থেকে খুলতে হয়, কোন এক ছবিতে এমন লিফট্ দেখেছিলাম মনে করতে পারছিনা। নাস্তার পর কেউ কেউ শেষ মিনিটের কেনাকাটা সারতে ষ্টেশনে গেল, ষ্টেশনকে ঘিরে বিশাল মার্কেট সেখানে, প্রচুর বাঙ্গালীর আনাগোনা আর ব্যবসা এই ষ্টেশনকে ঘিরে। আমরা চারজন সেদিকে না যেয়ে উলটা দিকে হাঁটা দিলাম, উদ্দেশ্য কিছু ফোয়ারা দেখবো আর অবশ্যই “টাইপরাইটার বিল্ডিং”।
পুরাতন রোমে যে কয়টা উঁচু স্থাপনা আছে সম্ভবত এটাই সবচাইতে বড়। একত্রিত ইতালির প্রথম রাজা “ভিক্টর ইমান্যুয়েল টু” এর স্মৃতির উদ্দেশ্যেই মূলত এর পরিকল্পনা করা হয় ১৮৯৫সালে। মূল পরিকল্পনা জোসেফ সাচ্চীনি নামের ইতালিয়ান আর্কিট্যাক্ট এর, যদিও মৃত্যুর আগে উনি এটা দেখে যেতে পারেননি। উনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ সেইন্ট লরেটো ব্যাসিলিকার আধুনিকায়ন। সেইন্ট লরেটো ব্যাসিলিকা এই মনুমেন্টের পাশেই, এটার কথা আগে শুনিনি আমি, যদিও ছবি তুলেছিলাম কিন্ত উৎসাহ পাইনি তেমন। ঢাকায় ফেরার পর একদিন হঠাৎ করেই মেইল পেয়েছিলাম, আইফোনে যে ম্যাপ ব্যবহার করা হয় সেখানে আমার তোলা এই ছবিটি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে এপল থেকে (নীচের গম্বুজ ওয়ালা ছবিটি)। যাক্ সে কথা, মনুমেন্টে ফিরে আসি।
সাদা ধবধবে মার্বেলে তৈরী পুরো বিল্ডিং, মার্বেলের রাজকীয় সিড়ি পেরিয়ে উপরের দিকে উঠলে দুপাশের গ্রীক যোদ্ধ্বা দের মূর্তি পেরিয়ে আপনাকে পৌঁছে দেবে নিহত সৈনিকদের স্মরণে তৈরী প্রজ্বলিত আলোকশিখায় (এটা পরে সংযুক্ত হয়েছে), এটা পেরিয়ে উপরে উঠতে থাকলে পেয়ে যাবেন ব্রোঞ্জে তৈরী ঘোড়ায় চড়া বিশাল ভিক্টর ইমান্যুয়েলের মূর্তির কাছে। এক পা উঁচু করে গর্বিত ভংগীতে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘোড়া। ঘোড়ায় চড়া মূর্তির বানানোর ব্যাপারে সাধারণত একটা নিয়ম মানা হয়, এখানে ঘোড়া হলো প্রতীক, যদি ঘোড়ার সামনের দু’পা উঁচু থাকে ভাববেন উপরে যার মূর্তি তিনি যুদ্ধ্বে নিহত হয়েছেন, যদি এক’পা উঁচু থাকে তার মানে উপরের ব্যক্তি যুদ্ধ্বে আহত হয়েছিলেন এবং পরে এই আঘাত জনিত কারনে তার মৃত্যু হয়েছিলো, আর যদি শান্ত ঘোড়ার চার পা মাটিতে থাকে তাহলে ধরে নেয়া হয় ঘোরসওয়ারের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিলো। ভিক্টর ইমান্যুয়েলের মূর্তির পর কোরিয়েন্থিয়ান স্টাইলের বিশাল বিশাল কলাম, এগুলোও মার্বেলের। এসবের পর সবার উঁচুতে বিল্ডিং এর দুপাশে দুটি রোমান যুদ্ধ্বের দেবী ভিক্টোরিয়ার ঘোড়ার গাড়ীতে চড়া বিশাল মুর্তি। নীচ থেকে অত ভালোভাবে দেখা না গেলেও অনুমান করতে কষ্ট হয়নি যে দেবী ভিক্টোরিয়া সমস্ত রোমান দেবীদের চাইতেও বেশী সুন্দরী ছিলেন। প্রাচীন রোমে প্রতি বছর এলাকার সবচাইতে সুন্দর বালকটিকে বলি দেয়া হতো দেবী ভিক্টোরিয়ার মন্দিরে। রোমানদের শৌর্য বির্যের প্রতিক দেবী ভিক্টরিয়া। দেবী ভিক্টরিয়া রোমান স্বর্ণ্ম মুদ্রা, অলঙ্গকার ইত্যাদিতে জায়গা করে নিলেও ঘোড়ার গাড়ীতে (chariot মানে দুঘোড়ায় টানা গাড়ী, এখানকার দুটো quadrigas মানে চার ঘোড়ায় টানা) চড়া দেবীর মুর্তি বিরল।
আমরা এক এক করে সবাই “ভিক্টর ইমান্যুয়েল টু”র মূর্তিকে পেছনে রেখে ছবি তুললাম, এখান থেকে সামনে, পাশে রোমের অনেকটুকুই দেখা যায়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে একদা মুসোলিনী তার জ্বালাময়ী ভাষনে ফ্যাসিজমের সুচনা করেছিলেন, আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ্বের ঘোষনাও এসেছিলো এখান থেকে। পুরো বিল্ডিং পাশে ৪৯০ফুট আর উচ্চতা ২৩০ফুট, যদি দেবীর গাড়ী আর পাখাকে ধরা হয় তাহলে উচ্চতা ২৩০ফুট।
সাধারন ইতালিয়ানদের সাথে আলাপ করে কোন সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যায়না যে কেন ওরা এই মনুমেন্ট তৈরী হবার প্রায় একশ বছর পরেও এটাকে ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারেনি। তবে আমার কাছে যে দুটো কারন প্রধান মনে হয়েছে তার মধ্যে প্রথমটি হলো এখানে একদা মুসোলিনী বাস করতেন, এখান থেকেই অনেক বিখ্যাত আর কুখ্যাত বক্তৃতা দিয়েছিলেন উনি। আর অন্যটা হলো এ স্থাপনার আশেপাশেই এমনকি এ জায়গাটাও প্রাচীন রোমের কেন্দ্রে, এবং প্রাচীন রোমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে সেসবের জিনিষ্পত্র বিশেষ করে মার্বেল দিয়ে তৈরী এটা (যদিও ভ্যাটিকানের ক্ষেত্রেও এ লুন্ঠনের অভিযোগ আরো বেশী)। অফিসিয়াল নাম “ন্যাশনাল মনুমেন্ট অব ভিক্টর ইমান্যুয়েল টু” ছাড়াও স্থানীয় ইতালিয়ানরা ঘ্রীণাভরে এটাকে “টাইপরাইটার বিল্ডিং” বা “বিয়ের কেক” নামেও ডেকে থেকে।
একদম উঁচুতে উঠতে গেলে লিফট্ আছে, ৭ ইউরো খরচ করে লিফটে উপরে উঠতে পারেন, কিংবা আমাদের মত হেঁটেও উঠা যায়। প্রায় মিনিট চল্লিশেক এখানে থেকে ফিরতি পথ ধরলাম, হোটেলে বাস আসার সময় হয়েছে, আমাদের এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবে।
মন্তব্য
মুস্তাফিজ ভাই, আপনার ভ্রমন্থন পড়ে আপনাকে ইদানিং বেশ ইর্ষা করতেছি। পৃথিবীর কতো জায়গায় আপনি গেছেন? আর আমি ঘরের কুনো ব্যাঙ হয়েই কাটিয়ে দিচ্ছি জীবন।
গতকাল আজিজে গেছিলাম। শুদ্ধস্বরে গিয়ে টুটুল ভাইয়ের সাথে আলাপে আপনার ভূ-পরিব্রাজনের কথা উঠতো। সত্যি বলছি, ইর্ষাটা আরো একটু বেড়েছিল বৈকি!
০২.
ইতালিয়ান স্থাপত্য আমার এমনিতেই ভালো লাগে। আপনার ছবি-লেখা পড়ে ভালো লাগাটা আরো একধাপ প্রশস্ত হলো।
ধন্যবাদ, এবিশাল পৃথিবীর মাত্র ১০ভাগ দেখেছি
...........................
Every Picture Tells a Story
আমি ০.০০১% ও দেখেছি কী'না সন্দেহ।
হয়ে যাবে
...........................
Every Picture Tells a Story
লা জওয়াব !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
...........................
Every Picture Tells a Story
বঙ্কিম চন্দ্রের আমলে কী জানি কী কারণে ছবি আঁকাকে ছবি আঁকা বলত না
বলত ছবি লেখা
অন্ত বঙ্কিম সাহিত্যে তাই ছিল- সে গাছের ছবি লিখিল- তাহার পরে পাতা লিখিল
(হয়তো তখন আঁকা শব্দটা আবিষ্কার হয়নি)
সেই সূত্রে আমার কিন্তু আপনাকে ফটোলেখকই মনে হয়
(বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেখা পড়ি না। খালি ছবি দেখি। আমরা ফটো লিখতে পারি না বলেই না অতো বকবক করি)
মনে ব্যথা পাইলাম।
আমার ছবি লেখা পছন্দ করেন কিন্তু পাতা লেখা পড়েন না।
মনে ব্যথা পাইলাম।
...........................
Every Picture Tells a Story
এতো ঘুরাঘুরি করা ঠিক না।
পায়ে ব্যথা হইতে পারে।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ঘরে থাকলে কোমড়ে ব্যাথা হবে
...........................
Every Picture Tells a Story
ইটালীতে যাবার ইচ্ছা আছে... কিন্তু সময় আর পাত্তি নাই
_______________
এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।
_______________
::সহজ উবুন্টু শিক্ষা::
দারুণ একটা তথ্য জানা গেলো; ঘোড়ার পা বিষয়ক।
কোন এক মজলিশে নিশ্চয় ভাব নেয়া যাবে ... ...
বরাবরের মতই চমৎকার লেখা আর দারুণ দারুণ সব ছবি। আর হ্যাঁ, আইফোনের ছবিটার জন্য অভিনন্দন, মুস্তাফিজ ভাই।
কোন দেবী ? মনে দেখে শুনে মনে হচ্ছে এথিনা, রোমানরা বলত মিনার্ভা । যুদ্ধজয় এবং জ্ঞানের দেবী ।
আচ্ছা, রোমে তো রোমান দেব-দেবী হবে । অবশ্য রোমানদের সাথে গ্রীক মিথের প্যান্থিয়নে খুব বেশি পার্থক্য নেই ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
রোমানদের বিজয়ের দেবী (শান্তিতে কিংবা যুদ্ধ্বে) ভিক্টোরিয়া। দেবতা জিউস যখন টাইটান যুদ্ধ্বের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেসময় সায়েক্স তার চার সন্তান কে জিউসের সেবায় প্রেরণ করেন, ভিক্টোরিয়া তাদেরই একজন। একই গল্প প্রচলিত আছে গ্রিক নাইকের বেলাতেও। মনে করা হয় নাইক আর ভিক্টোরিয়া একই, একটা গ্রিক অন্যটা রোমান।
আর এথেনা, যার জন্ম হয়েছিলো দেবতা জিউসের মাথা থেকে, যাকে অলিম্পিকের দেবী হিসাবে চিনি তাকে অনেক সময় নাইকের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, যদিওএথেনার ভ্বতর কোমলতা আছে, শিল্পকলার আর গানবাজনা আর সুন্দরের প্রতি আগ্রহই এথেনার বৈশিষ্ট।
মিনার্ভা হলো এথেনার রোমান সংস্করন সম্ভবত একই মিথের দুই রূপ।
এখানে আগুনের পেছনে যে দেবীর মূর্তি দেখা যায় খেয়াল করে দেখবেন তার পাখা আছে। যতটুকু জানি মিনার্ভার পাখা ছিলোনা, ভিক্টোরিয়ার ছিলো। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই যে এটাও ভিক্টোরিয়া, তবে মিনার্ভা বা এথেনা নয় তা বলা যায়।
...........................
Every Picture Tells a Story
হাঁ আপনার কথাই ঠিক । নাইকের সাথে এথিনাকে গুলিয়ে একটা ভুল করেছি ।
বিজয়ের দেবী নাইক । ক্রীড়াসামগ্রী বানায় যে nike তারাও এই কারনেই এই নামটা ব্যবহার করে, বিজয়ের জন্য । আর নাইকের পাখাছিল । ছবির পাখাটাও খেয়াল করিনি, আপনি বলার পর খেয়াল করলাম । এটা নাইক, রোমান নাম ভিক্টরিয়া ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
আপনি নিজে যেমন দারুন গল্প বলেন, বলে আপনার ছবিগুলোও। সুন্দরী সেই রিসেপশনিস্টের কোনো ফটো নাই?
আপনি কি ইজিপ্টে গেছেন? তাহলে পিরামিড, স্ফিংক্স-এর উপর কিছু লেখেন, সচিত্র।
রিসেপশনিস্টের ছবি তুলিনাই।
কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া আর লুক্সার গিয়েছি। সচিত্র দেয়া যাবেনা, সেসময় ভাব নিয়ে ছবি তুলতাম, স্ফিংক্সএর গোড়ায় ভাব নিয়ে বসে আছি কিংবা নীল নদের পাড়ে, টাইটেল না দিলে মনে হবে ভাঙ্গা ছাদে কিংবা বাথটাবে বসে আছি।
...........................
Every Picture Tells a Story
নাহ। এত ঘোরাঘুরি করা একদম ঠিক্না!
বাদ দিতে বলেন? কোমড় ব্যথা হবে যে!
...........................
Every Picture Tells a Story
নতুন মন্তব্য করুন