লরেঞ্জো বার্নিনি
আজকে চলুন আরেক বিখ্যাত মানুষের সাথে পরিচয় হোক। একাধারে চিত্রকর, ভাস্করবিদ আর আর্কিটেক্ট লরেঞ্জো বার্নিনির জন্ম ইতালীর দক্ষিনে মাফিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে আমাদের পরিচিত নেপলস্ এ ১৫৯৮ সালে। বার্নিনির পিতা ছিলেন আরেক বিখ্যাত ভাস্করবিদ এবং এসেছিলেন ফ্লোরেন্স থেকে। বার্নিনির বয়স যখন সাত বছর সেসময় তার পিতা তাকে নিয়ে স্থায়ী হন রোমে। ছোট বেলা থেকেই বার্নিনি পিতার কাজে সহায়তা করতে করতে শিল্পের প্রতি তার দক্ষতা প্রমাণ করেন এবং পোপ পঞ্চম পল এর সুনজরে আসেন। এই পোপের ভাগিনা ছিলেন রোমের কার্ডিনাল, তার মাধ্যমেই বার্নিনি একটার পর একটা কাজ করতে থাকেন যার বেশীর ভাগই ছিল প্রাচীন গ্রিক স্থাপত্যের সাথে রেঁনেসা আর পরবর্তি ম্যানারিস্ট যুগের অদ্ভুত এক মিশেল।
সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় বার্নিনির কিছু অদ্ভুত কাজ দেখেছি, তাছাড়া রোমে আরেকটি ফোয়ারা দেখেছি বার্নিনির গড়া, এ লেখার পরবর্তি অংশে তার কিছুটা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। শেষ বয়সে বার্নিনি প্যারিস সফর করেন এবং সেখানে তার কিছু কাজ যেগুলো প্রায় বাতিলের পর্যায়ে চলে এসেছিলো সেসবের অসম্ভব সমাদৃত হতে দেখে স্থায়ীভাবে সেখানেই রেখে দেন যা এখন প্যারিসের বিভিন্ন যাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। শুরুতে বলেছিলাম বার্নিনি পোপ পঞ্চম পল এর সুনজরে ছিলেন , এবং এই সুনজর পরবর্তি পোপ দের সময়ও বহাল থাকে। এমনকি ১৬৪৪ সালে পোপ অষ্টম আরভানের মৃত্যুর পর বার্নিনির বিরুদ্ধ্ব পক্ষ শক্তিশালী হয়ে উঠলে কিছুদিন সেইন্টস পিটার্স ব্যাসিলিকায় তার কাজ বন্ধ থাকে এবং পরবর্তি পোপ দশম ইনোসেন্ট তাকে পুনরায় সেখানে ফিরিয়ে আনেন।
১৬৮০ সালে তার মৃত্যুর পর আরো অনেক খ্যাতনামা চিত্রকরদের মত তাকেও সান্তা মারিয়া ব্যাসিলিকায় সমাহিত করা হয়। সুইডেনের রানী ক্রিস্টিনা ছিলেন বার্নিনির গুনমুগ্ধ, সেসময় রোমে বাস করা এই রানীর আগ্রহেই দুবছর পর বার্নিনির জীবনী লেখা হয় এবং তার কাজের তালিকা তৈরী করা হয় যা এই সেদিন ১৯৯৬ সালে ইংরেজীতে অনুবাদ (The life of Bernini )করা হয়।
দ্যা রেপ অব প্রসেরপিনা
এই কাজ বার্নিনির প্রথমদিককার কাজ গুলোর অন্যতম। রোমের কার্ডিনালের অনুরোধে তিনি তৈরী করেন এটা। বহুল প্রচলিত এক পূরাকাহিনী জড়িয়ে আছে এই মূর্তি গড়ার পেছনে।
প্রসেরপিনা (গ্রীক প্রস্পেন) সেসব দেবীদের অন্তর্ভূক্ত যারা মৃত্যুর পর পুনরজন্ম লাভ করেছিলেন। দেবরাজ জুপিটার (গ্রীক জিউস) আর দেবী সেরেস এর ঘরে জন্ম সুন্দরী প্রসেরপিনার। দেবী সেরেস ছিলেন প্রকৃতির (ফসল, উর্বরতা, ঋতু চক্র, দূর্ভিক্ষ) দেবী। আরেক দেবী ভেনাস একদিন তার সন্তান কিউপিড কে দেবতা প্লুটোর প্রতি ভালোবাসার তীর ছুড়েমারার জন্য প্রেরন করেন। প্লুটো সম্পদের, রত্ন মনি মানিক্য আর ধাতুর দেবতা। পুরাকালে যেহেতু সেসবের অবস্থান ছিল মাটির নীচে তাই প্লুটোকে মাটির নীচের দেবতাও বলা হয়, প্লুটো আবার দেবরাজ জুপিটারের ভাই। জুপিটার নিয়ন্ত্রন করতেন আকাশ আর বিদ্যুত, তাদের আরেক ভাই নেপচুনের নিয়ন্ত্রনে ছিল সমুদ্র। কিউপিড যখন খুঁজে পেলেন প্লুটোকে তিনি সেসময় সিসিলি দ্বীপের মাউন্ট ইটনার জ্বালামূখ থেকে চার কালো ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে মর্তে এসেছেন। কিউপিডের তীরে প্রেমের জন্ম নেয় প্লুটোর ভেতর আর তিনি সামনে দেখেন প্রসেরপিনাকে। সুন্দরী বালিকা প্রসেরপিনা সেসময় সিসিলিতে, খেলছিলেন সেরেসের মন্দিরের পাশে ছোট্ট একটি লেকে, ফুল তুলছিলেন, গান গাচ্ছিলেন, সাথে ছিলো কিছু নিম্ফ।
কাল বিলম্ব না করে প্রসেরপিনার সম্পর্কে চাচা প্লুটো তুলে নেন তাকে। নিয়ে যান ভুমি তলে। বাড়ী ফিরে আদুরে কন্যাকে না দেখে অস্থির সেরেস খুঁজতে থাকেন প্রসেরপিনাকে। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে ফেলেন সেরেস। হঠাৎ দেখতে পান লেকের উপর একটা লেস যা তৈরী হয়েছিলো নিম্ফদের চোখের পানিতে, সব যেনে ক্রোধে অগ্নিশর্মা সেরেস ফসলের উৎপাদনে হস্তক্ষেপ করেন, শুকিয়ে যেতে থাকে মাঠঘাট, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় চারদিক। দেবতাদের স্বর্গে ফিরে আসার অনুরোধ প্রত্যাক্ষান করে সেরেস হাঁটতে থাকেন, তার পায়ের ছাপ যেখানেই পড়েছে একে একে মরুভুমি তৈরী হতে থাকে সেখানে। এসব দেখে দেবরাজ জুপিটার মার্কারীকে (গ্রিক হার্মেস) দূত হিসাবে প্রেরণ করেন প্লুটোর কাছে। অনুরোধ করেন প্রসেরপিনাকে ছেড়ে দিতে। প্লুটো অনুরোধ রক্ষা করেন, কিন্তু তার আগে প্রসেরপিনাকে ছয়টি ডালিমের বিচি খাইয়ে দেন, আর এই খাদ্য ভক্ষণের কারনেই শর্ত হিসাবে ছয় মাস প্রসেরপিনাকে প্লুটোর সাথে থাকতে হয়। সেই ছয়মাস সেরেসের মন থাকে খারাপ, পৃথিবীতে নেমে আসে ঠান্ডা। আবার প্রসেরপিনা ফিরে আসার সময় হলে সেরেস নেমে আসেন মর্তে তাকে গ্রহণ করার জন্য, বসন্ত ফিরে আসে পৃথিবীতে, ফুলে ফলে ভরে যায় এ ধরা।
প্রসেরপিনা আর প্লুটোর এ মূর্তির দিকে তাকালে যেনো জীবন্ত হয়ে উঠে ছোটবেলায় শোনা পুরো কাহিনী। এরকম কাহিনীর এত বাস্তব রূপ আমি কোথাও দেখিনি। প্লুটো ধরে আছে প্রসেরপিনাকে, তার আঙ্গুল চেপে আছে প্রসেরপিনার শরীরে, প্রসেরপিনা এক হাতে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী প্লুটোকে, তার চোখ বেয়ে নেমে আসছে অশ্রু সবই কেমন যেনো জীবন্ত।
চলবে।
মন্তব্য
মাঝে মধ্যে নিজেকে সেরেস মনে হয়!
লেখাটার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ছোট বেলায় বেশী বেশী সিরিয়াল খেলে এমনই মনে হয় (সিরিয়াল কথাটা এই সেরেস থেকেই এসেছে)।
...........................
Every Picture Tells a Story
লেখা সুন্দর হয়েছে ।
অসাধারণ লাগল ভাষ্করের কাজ । দেহের প্রতিটা পেশীর বক্রতা পাথরে ফুটিয়ে তুলেছেন !
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
ধন্যবাদ
পাথরে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা আসলেই সহজ কিছু নয়।
...........................
Every Picture Tells a Story
মূর্তিটা কী জীবন্ত!
দারুন লেখা। অনেক কিছু জানা গেল। চলুক।
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
আপনার পোস্টে বারবার একই কমেন্ট করতে হয়। কিন্তু কি করবো এছাড়া তো উপায় দেখি না .................
দারুন ছবি ! অসাধারন লেখা !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
আর আমিও ধন্যবাদ ছাড়া আর কি উত্তর দিতে পারি?
...........................
Every Picture Tells a Story
এখন পয়সা দ্যান
...........................
Every Picture Tells a Story
শ্রদ্ধেয় মুস্তাফিজ ভাই :
এটার কি কোনো রঙিন ছবি তোলা হয়েছিলো? সাদাকালো সবগুলো ছবি?
আর কিউপিড ব্যাটার আসলেই কোনো কাজ ছিলো না সবাইকে গিয়ে প্রেমের (অথবা কামের) তীর ছুঁড়ে মারা ছাড়া!
জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা
আমার ক্যামেরায় কার্ড ছিলোনা, অন্যের ক্যামেরায় তোলা, বেটা আবার ডিস্কালার সেট করে রাখছিলো
...........................
Every Picture Tells a Story
নতুন মন্তব্য করুন