প্যানারোমা সিটি ট্যুর মানে গাড়ীতে করে শহর ঘুরে আসা, মোটামুটি চার/পাঁচ ঘন্টার ট্রিপ থাকে, মাঝে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু যায়গায় ঘুরে দেখার বিরতি দেয়া হয়। সাধারণ পর্যটকদের কাছে অনাকর্ষনীয় কিছু জিনিষ শুধুমাত্র জানালা দিয়ে দেখিয়ে আর বিবরন শুনিয়ে পার করা হয়। রোমে এরকম একটা প্যানারোমা সিটি ট্যুর নিয়েছিলাম। সেদিন সকালে যাত্রার শুরুতে ছিলো টেভরী ফাউন্টেইন, এই ফাউন্টেইনের কথা আগে জানিয়েছি আপনাদের, সেখানে যাত্রা পথে আরেকটি ফাউন্টেইন দেখতে পাবেন যা লরেঞ্জো বার্নিনির তৈরী প্রথম ফাউন্টেইন, আর তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ম্যাফিয়ো বারবেরিনি যিনি পরে পোপ অষ্টম আরবান নামে পরিচিত ছিলেন তার পৃষ্ঠপোষকতায় বার্নিনির শেষ কাজ (এখানে একটা ছোট্ট কথা জানিয়ে রাখি যে আমাদের পোপ গণ অভিষিক্ত হবার পর নূতন নাম নিয়ে থাকেন)। সার্বক্ষণিক গাইড ইতিমধ্যেই আমার আগ্রহের বিষয় গুলো জেনে গেছে। সে যখন যাত্রা পথের বিবরন দিচ্ছিলো আমার দিকে তাকিয়ে (সম্ভবত আমিই একমাত্র মনযোগ দিয়ে শুঞ্ছিলাম) চোখে ইশারা করলাম তাকে, বুদ্ধিমতি গাইড ঠিকই ধরতে পেরেছিলো আর তাই গাড়ী বারবেরিনির মোড়ে আসতেই একটু স্লো করতেই সহযাত্রীরা কিছু বোঝার আগেই টুপ করে নেমে পড়লাম, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে গাইড বললো মোড় ঘুরে আসতে আমাদের দুই মিনিট সময় লাগবে, তোমার যা করবার এই দুই মিনিটের ভেতর। কোন উত্তর না দিয়ে ছুটলাম গতরাতে অন্ধকারে এসে একবার ঘুরে যাওয়া ট্রিটন ফাউন্টেইনের কাছে।
ট্রিটন গ্রিক দেবতা। গ্রিক সমুদ্র দেবতা পসাইডন আর সমুদ্র দেবী এম্ফিত্রিতির সন্তান, এই পসাইডনকে রোমানরা বলে নেপচুন। ছোট বেলায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম “দ্যা পসাইডন এডভেঞ্চার” নামে, পানিতে ডুবে যাওয়া যাত্রীদের বাঁচার কাহিনী নিয়ে, সেই পসাইডন নামটি এই দেবতা পসাইডনের নাম। নিজের মেয়ে পাল্লাস আর পালিত মেয়ে এথেনাকে নিয়ে ছিলো ট্রিটনের সংসার, এক দৈরথে এথেনার হাতে নিহত হন পাল্লাস, যদিও পাল্লাসের জয়ী হবার সম্ভাবনা ছিলো কিন্ত এথেনার আসল পিতা দেবরাজ জিউস দৈব ক্ষমতায় তাকে রক্ষা করেছিলেন। এখনও প্রতি বছর লিবিয়ার সমুদ্রপাড়ে এই পাল্লাস বন্দনা হয়। গ্রিক উপকথানুযায়ী লিবিয়ার এই উপকুলের কাছাকাছি সমুদ্রের গভীরে এক স্বর্ণপ্রাসাদে বাস করতেন দেবতা ট্রিটন। দেবতা ট্রিটন তার পিতা পসাইডনের মত সাথে একটা ত্রিশুল নিয়ে ঘুরতেন। তবে ট্রিটনকে আমরা চিনি তার দেহ বল্লরীতে, উপরের দিক মানুষের আর নীচের দিক মাছের, হাতে বাকানো শাখ, যেখানে ফুঁ দিয়ে তীক্ষ্ণ সুর তুলে ঢেউ নিয়ন্ত্রন করতেন ট্রিটন। গ্রিকদের মত সমভাবে ট্রিটন একই নামে রোমান উপকথায় বিরাজমান। ট্রয় রাজবংশের যুবরাজ এনিয়াস (হোমারের ইলিয়ডে একে পাবেন) আর দেবী ভেনাসের সন্তান গ্রিক বীর একবার ট্রিটনকে শাখ বাজানোর প্রতিযোগিতায় ডাকাতে ক্রোধে ট্রিটন তাকে সমুদ্রের গভীরে নিক্ষেপ করেন, গ্রিক আর রোমানদের ধারনা গভীর সমুদ্রে হঠাৎ উঠে যাওয়া ঝড়ের কারন এই গ্রিক বীরের শাখের শব্দ।
এত সব কাহিনী যেই ট্রিটনকে ঘিরে তার নামে তৈরী ফোয়ারার প্রতি আমার আগ্রহ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। দৌড়ে গেলাম ফোয়ারার কাছাকাছি, স্বল্প সময়ে দেখা আর পাশাপাশি ঝটপট কয়টা ছবি তোলা। সূর্যের আলো তখন তির্যক ভাবে নেমে আসছে। সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম, ভালোভাবে খেয়াল করলাম ফোয়ারাটা। বিশাল একটা খোলা ঝিনুকের উপর হাঁটু ভেঙ্গে বসে আছে ট্রিটন, ঘাড় সামান্য কাত করে দুহাতে ধরে রাখা শাখে ফুঁ দিচ্ছে। এই বিশাল ঝিনুক আবার তিনধাপের মুকুট আর এক্স শেপের চাবির উপর (এটা আসলে সেইন্টস পিটারের চাবি, বর্তমানে ভ্যাটিকানের প্রতিক) চারটা বিশালাকৃতির ডলফিন লেজ দিয়ে ঝিনুক সহ ট্রিটনকে উঁচু করে ধরে আছে। কয়েকটা মৌমাছিও আছে ডলফিনের লেজের কাছাকাছি। ট্রেভেরটাইন নামে একধরনের সামুদ্রিক কোরাল টাইপের জিনিষের উপর সম্ভবত ব্রোঞ্জের প্রলেপ দিয়ে বানানো। খুব ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে দৌড়ে রাস্তার এপাড়ে যখন এসেছি গাড়ী প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। মনে মনে ইতালীর ট্রাফিক জ্যামকে ধন্যবাদ দিলাম কারন প্রায় তিনমিনিট কাটিয়েছি সেখানে।
মন্তব্য
লিখতে থাকেন ওস্তাদ!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
স্টক যতদিন আছে।
...........................
Every Picture Tells a Story
এই না হলে জীবন!
---------------------------------
বিষণ্ণতা, তোমার হাতটা একটু ধরি?
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
আসলেই, এই না হলে জীবন।
...........................
Every Picture Tells a Story
বুদ্ধিমতী গাইডের প্রশংসা করতেই হয়, ইশারা বুঝে একটা কাজের কাজ করেছিল সে, না হলে তো এই ছবিগুলো হয়ত পেতাম না আমরা। তবে ইতালি না হয়ে দেশটা বাংলাদেশ হলে আপনি নিশ্চিতভাবেই আরো কয়েক মিনিট বেশি সময় পেতেন
আপনি মনে হয় '৭২ এর "দ্য পসাইডন অ্যাডভেঞ্চার" দেখেছিলেন, আমি অবশ্য '০৬ এর ভার্সন "পসাইডন" দেখেছি। খুব একটা সুবিধার লাগেনি।
পরে কি আবার গিয়েছিলেন নাকি ফোয়ারার কাছে? কারণ একেবারে নিচের ছবি দুটো মনে হচ্ছে রাতে তোলা।
বাই দ্য ওয়ে, পিরামিডের কথা মনে আছে তো? পোস্ট চাই কিন্তু পিরামিড, স্ফিংক্সের উপর।
হু, আমি ৭২ এর "দ্য পসাইডন অ্যাডভেঞ্চার" দেখেছিলাম।
রাতে গিয়েছিলাম আগেরদিন যখন ত্রয়ী ফোয়ারা দেখতে গেলাম সেসময়।
...........................
Every Picture Tells a Story
হুম! ছবিতে না, এইসব জায়গা স্বচক্ষে দেখতে মন চাই।
...........................
Every Picture Tells a Story
আপনাকে হিংসা হয় ভাই। কত্ত কত্ত জায়গায় আপনি ঘুরেন। ইসসসসসসসসসসস কেন আমি পারিনা?
রাতের ছবিটাই তো মারাত্মক মনে হচ্ছে !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
চেষ্টা ছিল
...........................
Every Picture Tells a Story
শান্ত ভাইয়ের তো হিংসা লাগে,আমার তো মেজাজ গরম লাগে।
শুধু গ্রীকদের কাহিনী নিয়ে একটা লেখা নামানো যায় না বস্? আপনার হাত দিয়ে খাসা হতো।
নতুন মন্তব্য করুন