" নির্ঘুম রাত, সমুদ্র যাত্রা আর স্কুবা ডাইভ" আমার মালয়েশিয়া ঘুরে আসার দ্বিতীয় দিন
ডিনার সেরে বাসায় যেতে যেতে রাত বারোটার উপর। চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু। বাসায় ফিরেই অরূপ কম্পিউটার নিয়ে বসে গেলো সচলে ছবি পোস্ট দিতে, কি মজা, আমাদের এখানে নেটের স্পীড ঝামেলা হলেও ওদের তা কম। একটু পরেই রওয়ানা দেবো মার্সিং এর উদ্দেশ্যে, মার্সিং এখান থেকে প্রায় সাড়ে চারশো কিমি, ওর ধারনা সময় লাগবে ৪ ঘন্টার মত, সেখান থেকে সাড়ে দশটার ফেরিতে তিওমেন। আসার আগে কথা ছিলো ভোর চারটার দিকে যাত্রা শুরু করবো, দুজনে কথা বলে সময় চেঞ্জ করলাম, অল্প ঘুমিয়ে গাড়ী চালানোর চাইতে এখন না ঘুমিয়ে চলে যাওয়াটাই ভালো। মাশীদ কফি বানিয়ে দিয়ে ঘুমাতে চলে গেলো, সকালে ওর কী যেন একটা মিটিং আছে। আমরা কিছুক্ষণ কম্পিউটার আর টিভি গুঁতাগুতি করে নীচে নামলাম।
রাত অনেক, মাঝে মাঝে হুস করে গাড়ী যাচ্ছে, এত রাতেও লাল বাতি দেখে থেমে যাচ্ছে গাড়ী। আমরাও বের হলাম। হাইওয়েতে উঠে ছোট্ট গাড়ীর আরেক রূপ, চার হাজার আর পি এম এ একশ ত্রিশ/চল্লিশ কিমি স্পিডে চলছে। কোন ঝাঁকি নাই, গাড়ির হর্ন নাই। আমাদের মত আরো অনেককেই দেখলাম দুরদুরান্তে যাবার জন্য রাস্তায়, জানলাম বেশির ভাগই সিংগাপুরের দিকের যাত্রী। কুয়ালালাম্পুর থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়া সহজ। ড্রাইভ করেই যাওয়া যায়। অরূপের গানের কালেকশন ভালো, হাল জমানার মিলা থেকে শুরু করে পুরনো দিনের বাংলা গান সবই আছে। এম পি থ্রি সেট বলে চালানোও সুবিধা, সিডি রাখার ঝামেলা নেই।
রাত জেগে থাকলে আমার আবার একটু পর পর চা খাবার বাতিক। এই হাইওয়েতে বিশ্রাম, হাত মুখ ধোয়া, হাল্কা নাস্তা করার অনেকগুলো জায়গা আছে। তেমন একটা জায়গায় দাঁড়ালাম, মাঝ রাতে অল্প কিছু মানুষ বসে আছে, দুজন টেবিলে মাথা রেখে ঢুলছে। টিভিতে আগ্রহ নিয়ে বাকিরা ফুটবল দেখছে। মিনিট দশেক সময় কাটিয়ে উঠলাম। যেতে হবে অনেকটা পথ।
রাস্তায় আরেকবার দাঁড়াতে হয়েছিলো তেল নেবার জন্য। সেই স্টেশনে ব্রাহ্মনবাড়ীয়ার মহসিনের সাথে দেখা, বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে আনন্দ তার দেখে কে। ভেতরে নিয়ে যেয়ে তার বসের সাথে হাত মিলিয়ে দিলো আমার। তেল নেবার পরপরই সিট বদলালাম দুজন। ড্রাইভিং সিটে এখন আমি। জিপিএস আর রাস্তার মার্কিং দেখে চালাচ্ছি, একটু পরই হাইওয়ে শেষ, হিসাবে প্রায় শদেড়েক কিমি বাকি, এই শদেড়েক কিমি রাস্তা ভয়াভহ, পাহাড়ের মাঝদিয়ে আঁকাবাকা আর উঁচুনিচু, ঘুম ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে সাবধানে চালাতে হচ্ছে। পাশের সিটে অরূপ ঘুমিয়ে গেলেও একটু পর পর উঠে নির্দেশ দিচ্ছে, ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা আমাকে, মার্সিং শহরের কাছাকাছি এসে আবারো সিট বদলানো হলো, বেড়াতে এসে ট্রাফিকের ঝামেলায় কে পড়তে চায় বলেন?
ভোর সাতটার একটু পর মার্সিং পৌঁছালাম। সেখানকার পার্কিং এ গাড়ী রেখে জেটিতে গেলাম, হাত মুখ ধোয়া, টয়লেট সারা, নাস্তা করা আর রিসোর্টের লোক থেকে কাগজ পত্র নেয়া, কাজ অনেক। এ এরিয়াতে মুসল্মানের সংখ্যা বেশী, মেয়েদের সবার মাথায় হিজাব, সহজেই আলাদা করা যায়। নাস্তা করলাম নারকেল দুধ আর বাদাম দেয়া ভাত একটু চাটনী সাথে একটা ডিম আর কেচকী মাছের শুটকী। খেয়েদেয়ে গাড়ীতে বিশ্রাম নেবার চেষ্টাটা মশার জ্বালায় হলোনা। সময়ও হয়ে এসেছে তাই জেটিতে চলে এলাম। আমাদের মত অনেকেই ফেরির অপেক্ষায়। কাছেধারে বলে সিঙ্গাপুরের লোকজনই বেশী, ইউরোপিয়ানও আছে অনেক। এখানকার ফেরী গুলো আমাদের দেশের মতন, সময় মানেনা, ঘণ্টা খানিক দেরীতে ফেরী ছাড়লো, ভেবেছিলাম ছাদে বসে যাবো, শুনলাম ছাদে বসা নিষেধ, মন খারাপ করে সিটে বসে ঘুমিয়ে গেলাম। কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা, ঘুম ভেঙ্গে জানালা দিয়ে তাকাতেই মন ভালো হয়ে গেলো, দূরে পানির উপর জেগে আছে তিওমান, আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে চেহারা, নীল পানিতে সবুজের দলা হয়ে ভেসে আছে। দক্ষিনের দিকটার উপরের অংশ মেঘে ঢাকা, তিওমানের উঁচু চূড়াটা সেখানেই, ১০৩৮ মিটার উঁচু গুনাং কাজাং।
ফেরী গুলো প্রথমে দ্বীপের দক্ষিনেই থামে, এরপর আস্তে আস্তে লোক নামাতে নামাতে উত্তরের দিকে যায়। আমরা ছিলাম সালাং এ, এটা সবার শেষে, সালাং যখন পৌঁছালো সময় দুপুর দুটো। ফেরী থেকে নেমে কয়েকশ মিটার হেঁটে পাড়ে পৌঁছানোর পর আমাদের ঠিকানার খোঁজ নিতে যেয়ে শুনলাম হাঁটতে হবে প্রায় এক কিমি।
আমাদের ডান দিকে খাবার দোকান, রিসোর্ট আর তার পেছনে পাহাড়, বামে কয়েক হাত বিচ পেরিয়ে নীল সমুদ্র, উত্তরের দিকে যাচ্ছি আমরা, যেতে যেতে সবশেষে সালাং বিচ রিসোর্ট। রুমে ব্যাগ রেখে ঝটপট খেয়েই বের হলাম, স্কুবা ডাইভের খোঁজ নিতে হবে।
স্কুবা করার স্বীকৃত নিয়ম হলো অবশ্যই ট্রেনিং থাকতে হবে, যার যতটুকু ট্রেনিং সে অনূযায়ী ঠিক করা হবে কতটুকু পানির নিচে যেতে পারবে। আমরা দুজনই নবীশ, সে হিসাবে আমাদের স্কুবা গীয়ারই পড়তে দেবার কথা না। তারপরও সাহস নিয়ে দেখা করলাম আইরিশ ট্রেনার ডেভিডের সাথে। চমৎকার মানুষ। অনেক কথাবার্তার পর প্রাথমিক জ্ঞানদান শুরু হলো, হাতে কলমে দেখানোর পাশাপাশি ৪০মিনিটের ভিডিও, এরপর ছোট্ট একটা পরীক্ষা, দুজনই পাশ করলাম তাতে, খুশী হয়ে পানিতে নামার অনুমতি মিললো, ডেভিডও আমাদের সাথে, পানিতে নামার পর আরোকিছু সেফটি ম্যাটার ডুবে ডুবে দেখালেন, অনুশীলন করালেন, এরপর মিনিট পাঁচেক একা একা ঘুরে তীরে উঠলাম আমরা। আশাহত হলেও ডেভিডের থেকে শেখা বিষয় গুলো ভুলবার নয়, পরের দিন স্নোরকলিং করতে যেয়ে সে অভিজ্ঞতা খুব কাজে দিয়েছে আমাদের। ভবিষ্যতেও লাগবে।
রিসোর্টে পৌঁছতে পৌঁছতে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেল, লাল, হলুদ, সোনালী রঙ ছড়িয়ে আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে এলো পশ্চিমের আকাশ, গোসল করে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম, এরপর হাঁটতে হাঁটতে জেটির দিকে এসে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে আবারো কিছু খেয়েদেয়ে রুমের দিকে চলে এলাম, অনেকটা সময় নির্ঘুম কাটানোর ফলে মাথা ব্যাথা করছে আমার, শোয়ার সাথে সাথে ঘুম আসবে আশা করি।
মন্তব্য
ঠিক করে দিলাম। তিওমাননামা তো আপনারই লেখার কথা!!
...........................
Every Picture Tells a Story
- প্রিজন ব্রেকের পয়লা সিজন টাইপের লেখা পড়লাম, ভালোও লাগলো। কিন্তু অপেক্ষায় আছি 'বেহেশতি জিনিষ'-এর।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
লেখা আর ছবি দুটোই দারুন হচ্ছে !
নাসি লেমাকের নাম অনেক শুনেছি কিন্তু আসলে কি বস্তু তা আজকেই প্রথম জানলাম।
-----------------------------
--------------------------------------------------------
স্বাদ ভালোনা
...........................
Every Picture Tells a Story
মালয়েশিয়া দেখিনি কখনও। স্কুবা ডাইভিং আর স্নরকেলিং এর জন্য নিরাপদ সৈকত মালয়েশিয়ায় থাকতে লোকে অস্ট্রেলিয়া যাবে কেন? হাতের কাছে ভরা কলস। আপনার লেখা এবং ছবি সবই দারুণ।
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
স্নরকেলিং এরটা জানিনা তবে যাদের স্কুবা লাইসেন্স আছে তারা বিভিন্ন সৈকতে ঘুরে ঘুরে স্কুবা করে।
...........................
Every Picture Tells a Story
ছবিগুলো হেভি আর লেখাও
মালেশিয়াতো জবরদস্ত জায়গা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
দারুন বর্ণনা আর দারুন দারুন ছবি! আমিও ঘুরে এলাম ইটালীর এলবা দ্বীপ। লিখতে চাইছি, কিন্তু সময় করতে পারছি না। আর আপনার মতো এতো সুন্দর ছবি তোলার হাত আমার একেবারেই নেই।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
এলবা তো সুন্দর দ্বীপ, পিসা যাবার সময় মনের মিল হয়নি বলে যাওয়া পড়েনি। ওখানকার বেশ কয়টা রূপকথা শুনেছিলাম। আশাকরি আপনার লেখায় পাবো
...........................
Every Picture Tells a Story
নেট স্পিড এতো কম যে একটা ছবিও দেখতে পারলাম না।
এই দুঃখ কোথায় রাখি?
মুম্বাই গিয়া ঐশ্বরিয়ারে না দেখার অনুভূতি নিয়া মন্তব্য করতেছি।
যাহোক, লেখা ভালো হইছে, ঘুরাঘুরি ঈর্ষনিয়। আগামী মাসের অর্ধেকটা আমার হয়তো কক্সবাজার থাকতে হইবো। সেখানে প্রচুর ছবি তুলুম সিদ্ধান্ত নিছি। কালকে বসুন্ধরা সিটির দোকানদার আমারে বাকীতে ট্রাইপড দিয়া দিছে। (যে না ক্যামেরা, তার আবার ট্রাইপড)
নাসি লেমাক বাংলাদেশে পাওয়া যায়। বনানী ১১ নম্বর রোডের শুরুতেই দেখবেন কিংস কনফেকশনারী আছে। ধানমন্ডিতেও আছে। সেখানে নাসি লেমাক পাওয়া যায়। আমি মাঝে মাঝে খাইতাম আগে। ১০০ টাকা দাম আছিলো। এখন মনে হয় বাড়ছে কিছুটা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আহারে, এমন সময় কক্সবাজার
...........................
Every Picture Tells a Story
ছবিগুলা দেখে আসলে মনটা খারাপ হয়ে গেল
কেমন মেশিনের মত জীবন
ধুর
মেশিন্ময় জীবন থেকে মুক্তির জন্যই বেড়ানো দরকার
...........................
Every Picture Tells a Story
বড় সৌন্দর্য হইসে।
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
যা থাকে কপালে , মালয়েশিয়া যামু ।
আমিও যামু
...........................
Every Picture Tells a Story
আগের অফিস থেকে মালয়েশিয়া নিয়া গেসিলো ৬/৭ বছর আগে। সারাদিন ট্রেনিং, হোটেলে ফিরা বসকে রিপোর্ট করা, তারপর রাইতে খাইয়া ঘুমানো। সম্ভবত: 'কোরাস' নামের একটা হোটেল ছিলাম। সেই সুবাদে খাওনের পর উঁচা বিল্ডিংটার কাছে গিয়া বসতাম মাঝে মাঝে।
মালয়েশিয়া গিয়া আপনের এই বেশুমার আমোদ দেইখা খুবই হিংসিত হইলাম মুস্তাফিজ ভাই
মনে বড় ব্যথা পাইলাম
...........................
Every Picture Tells a Story
দেরীতে হইলেও পড়ে ফেললাম।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
কেমন লাগলো জানবো কেমনে?
...........................
Every Picture Tells a Story
পরেরটা দেখেন নাই?
...........................
Every Picture Tells a Story
নতুন মন্তব্য করুন