আমাদের বোস রেডিও

মুস্তাফিজ এর ছবি
লিখেছেন মুস্তাফিজ (তারিখ: রবি, ২০/১২/২০০৯ - ৪:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আব্বা ব্যক্তিগত বা অফিসের কাজে প্রায়ই ঢাকা যেতেন। সেসময় ঢাকা-ময়মনসিংহের বর্তমান রাস্তাটা ছিলোনা, বাস যেতো টাঙ্গাইল ঘুরে, ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল ৬০ মাইল, এরপর টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা ৬০ মাইল, আর ট্রেনে গেলে ৯৪ মাইলের মতন, সময় লাগতো কম, তাই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যেতে ট্রেন ছিলো সবার প্রথম পছন্দ। ঢাকায় এলে অফিসের কাজ সেরে আব্বা ঘোরাঘুরি করতেন, টুকিটাকি জিনিষ কিনতেন। আর এসবের জন্য অবশ্যই “গনী’স” এ যেতেন। এ দোকানটি ছিলো বর্তমানে পিজি হাসপাতালের সামনের বিল্ডিং এর নীচ তলায় যেখানে অনেকগুলো অষুধের দোকান সেখানে। বছরখানিক আগেও সেখানকার একটা থামে “গনী’স” এর মুছে যাওয়া নেমপ্লেট দেখেছিলাম। ষাটের দশকে ঢাকায় যেসব দোকানে বিদেশী জিনিষ পাওয়া যেতো “গনী’স” তার অন্যতম। তৈরী পোষাক, ইলেকট্রনিক আইটেম এ সবকিছু কেনার জন্য আব্বার প্রথম পছন্দ ছিলো “গনী’স”।
আমার জন্মের ঠিক পরপরই আব্বা সেখান থেকে একটা রেডিও কিনেছিলেন, বোস রেডিও, সেটার আবার তারের জালীর এরিয়াল ছিলো সিগন্যাল ধরার জন্য। এ এরিয়াল টানাতে হতো ছাদে। আমার বয়স যখন একবছর সে সময় পায়ে তার আটকে রেডিওটা টেবিল থেকে পড়ে যাওয়াতে এরপর থেকে এটার স্থান হয়েছিলো আমাদের নাগালের বাইরে। আব্বা একটা কাঠের খাঁচা বানিয়ে এটাকে দেয়ালের সাথে লটকে দিয়েছিলেন। ট্রাঞ্জিস্টারের প্রচলন সেসময় ছিলোনা আর রেডিও ব্যয়বহুল হওয়াতে আশে পাশের সব মধ্যবিত্ত পরিবারে একমাত্র আমরাই রেডিও’র মালিক ছিলাম। ৬৬/৬৭’র দিকে আশে পাশে অনেকের বাসাতেই ট্রাঞ্জিস্টার চলে এলেও জোরে শব্দ হতো বলে আমরা রেডিও নিয়ে গর্ব করতাম।
এই রেডিওতে বেশী শুনতাম বাংলা গান, আগে প্রতিদিন রেডিওতে সিনেমার গানের অনুষ্ঠান হতো, বিশেষ করে দুপুরের দিকে। ছোট বেলায় শোনা সেসব গানের কিছু কিছু এখনও আমার পছন্দের প্রথম দিকে। এই যেমন ধরেন “তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো”

তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো
তুমি কখন এসে দাঁড়ি...
Hosted by eSnips

বা “যার ছায়া পড়েছে”

যার ছায়া পড়েছে, মনের ও আয়নাতে, সে কী তুমি নও ওগো তুমি নও
যার ছায়া পড়েছে, মন...
Hosted by eSnips

এই সব অদ্ভুত সুন্দর কিছু গান। আব্বা অবশ্য শিলং, গুয়াহাটি এসব স্টেশনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বেশী, ভোর বেলাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখতাম আব্বা রেডিও টিউনিং করছেন। আম্মার দখলে থাকতো দুপুর বেলাটা।
‘৭১ এর মার্চের শুরু থেকেই এই বোস রেডিও আমাদের কাছে বেশ গুরুত্ব পূর্ণ হয়ে উঠে। মার্চের ২৬ তারিখ সকালে সবাই যখন জেনে গেলো ঢাকার হত্যাজজ্ঞের কথা এরপর সারাদিন আব্বাকে দেখলাম কি যেনো টিউন করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকতে, মাঝে মাঝে তিন তলা থেকে নীচে নামেন, দু’একজনের সাথে ফিসফাস কথা বলেন এরপর আবার উপরে উঠে এসে রেডিও নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই ফিসফাসের মধ্যেই আমরা জেনে গেলাম বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন আর চিটাগাং থেকে তা প্রচারও হয়েছে। সেদিন আমাদের আর বাইরে যাওয়া হলোনা, সারাদিন তিন তলার বারান্দায় বসে বসে সবার ছোটাছুটি দেখলাম। কালুরঘাট, বঙ্গবন্ধু আর যুদ্ধ এই কয়টা শব্দ বার বার ঘুরে ফিরে সবার মুখে ফিসফিস করে উচ্চারিত হতে থাকলো।
সন্ধ্যার ঠিক পরপর আব্বাকে পলিটেকনিকের শিক্ষকদের কমনরুম থেকে দৌড়ে বাসার দিকে আসতে দেখলাম,হালকা অন্ধকারে খেয়াল করে দেখলাম বেশ কয়জন শিক্ষক ট্রাঞ্জিস্টার হাতে নিয়ে সিগন্যাল পাবার জন্য খোলা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছেন। আব্বা বাসায় এসে আবারো রেডিও নিয়ে পড়লেন, রাত কয়টা হবে খেয়াল নেই আব্বা বললেন যে অস্ট্রেলীয়ার কোন এক রেডিও স্টেশন থেকে কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষনা পূণঃপ্রচারিত হয়েছে। (এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি “আমি মেজর জিয়া বলছি” এই ঘোষনাটি এসেছিলো ২৭শে মার্চ)।
আমাদের এই রেডিও নিয়ে যে ঘটনার কথা আজকে আপনাদের শোনাতে আসা সেটা আরো আগের, মার্চের ৬ তারিখের কথা। আব্বা আমাকে নিয়ে ছাদে গেলেন, সাথে বড়ভাই। রেডিওর এরিয়াল আব্বা খুলে নিয়ে আসার পর আমরা দুভাই ৫ ইঞ্চির মত চওড়া আর ১৫ফিটের মত লম্বা জালের মতন এরিয়ালটি ধরে থাকলাম। আব্বা ব্রাশ আর গামছা দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো এরিয়ালটি পরিষ্কার করলেন, তখন শুনলাম আগামীকাল রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষন প্রচার করা হবে, আমাদের রেডিওর আওয়াজ বেশী বলে সবাই এখানেই তা শুনবে,তাই ঠিকঠাক করা। ৭ তারিখ সকালেই এক এক করে পলিটেকনিকের শিক্ষকরা আমাদের বাসার সামনে এসে জড়ো হতে থাকলেন। এই প্রথম কাঠের বাক্স থেকে আমাদের রেডিও নেমে এসে বারান্দার টেবিলের উপর জায়গা নিলো। বারান্দা থেকে নীচে তাকিয়ে দেখলাম ২০/২৫টা চেয়ারের প্রায় সবগুলোই ভর্তি। সবার মতন আমরাও অপেক্ষায়, রেডিওতে গান হচ্ছে কিন্তু ভাষন আর প্রচারিত হচ্ছেনা। আমার ঠিক মনে নেই কিন্তু একসময় মনে হলো ভাষন শুরু হয়েছে কিন্তু তারপর সব বন্ধ, আবার গান, এরপর আবার বন্ধ, বন্ধ তো বন্ধই আর কোনকিছুই শোনা গেলোনা সেদিন।
৮ তারিখ সকালে যথারীতি আব্বা রেডিও টিউন করতে বসলেন, আজ আর গুয়াহাটি বা শিলং নয়, ঢাকা। টিউন করতেই শুনলেন আর কিছুক্ষণ পরই বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত ভাষন প্রচার করা হবে। চারদিকে আবার সাজ সাজ রব পড়ে গেলো, আমাদের পাঠানো হলো সবাইকে খবর দিতে, আমরা দৌড়ে বাসায় বাসায় যেয়ে খবর দিয়ে এলাম, অনেকে ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে চলে এসেছেন, আব্বাকে ডাকাডাকি করছেন। আমরা যখন বাসায় ফিরেছি ততক্ষণে নীচে ৫০/৬০ জন মানুষ অপেক্ষায়, নীচ থেকে রেডিওর শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, বার বার ঘোষনা আসছে একটু পরই প্রচারিত হবে সেই ঐতিহাসিক ভাষন। কতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলাম মনে নেই, তবে মনে আছে অনেকক্ষণ, কয়েকঘন্টা হবে। মাঝখানে একবার বাসায় যেয়ে নাস্তাও করে এসেছি। এরপর বহু প্রতিক্ষিত সেই ভাষন, যা শুনলে এখনও শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যায়, চলুন আরেকবার শুনি

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

পুনশ্চঃ এই ভাষনটি সেদিন সরাসরি সম্প্রচার হবারই কথা ছিলো, সম্প্রচারের শুরুতেই মেজর সিদ্দিক সালিক ওয়্যারলেসে এটাকে বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং নির্দেশ অমান্য করলে পল্টন আক্রমণের সিদ্ধান্তের কথা জানান। সেখানে উপস্থিত রেডিওর কর্মকর্তারা বিষয়টি বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধুকে একটি কাগজে লিখে জানিয়ে দেন (যারা সেই বক্তৃতার ভিডিও দেখেছেন তারা খেয়াল করবেন মাঝপথে একটা কাগজ উনার দিকে এগিয়ে দেবার দৃশ্য)। রেডিওর কর্মকর্তারা সে সময় সম্প্রচার বন্ধ করে নেমে গেলেও নাসার আহমেদ চৌধুরী নামে এক অনুষ্ঠান সংগঠক উনার সাথে রাখা টেপে প্রথম থেকেই পুরো ভাষন রেকর্ড করে রাখেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষনে এসময়ই রেডিওর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেই ঐতিহাসিক কথাটি বলেন “মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিও আমাদের কথা না শোনে...” এরপর রেডিওর সব কর্মচারীরা বিদ্রোহ করে পালিয়ে থাকলে রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। মিলিটারীরা তখন রেডিওর পরিচালক জনাব আশরাফুজ্জামান খানকে ধরে নিয়ে যায় এবং সব শর্ত মেনে নিয়ে রেডিও চালু করতে বলে, কিন্তু উনারা তা সেদিন চালু না করে পরদিন থেকে অনুষ্ঠান শুরু করেন।
পল্টনে রেডিওর যেসব কর্মকর্তা সরাসরি সম্প্রচারের জন্য সেদিন উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন
জনাব আশরাফুজ্জামান খান - পরিচালক, জনাব আহমাদুজ্জামান - সহকারী পরিচালক, জনাব মবজুলুল হোসেন - সহকারী পরিচালক, জনাব মফিজুল হক - সহকারী পরিচালক, জনাব সাইফুল বারি - বার্তা পরিচালক, জনাব জালালউদ্দীন রুমী - অনুষ্ঠান সংগঠক, জনাব আশফাকুর রহমান - অনুষ্ঠান সংগঠক, জনাব তাহের সুলতান - অনুষ্ঠান সংগঠক, জনাব শামসুল আলম - অনুষ্ঠান সংগঠক, জনাব কাজী রফিক - অনুষ্ঠান সংগঠক, জনাব বাহরামউদ্দীন সিদ্দিকী - অনুষ্ঠান সংগঠক, জনাব নাসার আহমেদ চৌধুরী - অনুষ্ঠান সংগঠক, জনাব মীর রায়হান - অনুষ্ঠান প্রযোজক, জনাব ফয়েজ আহমদ চৌধূরী - সহকারী বার্তা পরিচালক।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে নাসার আহমেদ চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে যেয়ে সেই টেপটি যুদ্ধে যোগদান করা আরেক সহকর্মী জনাব জালালউদ্দীন রুমীর কাছে পৌঁছে দেন স্বাধীনবাংলা বেতারে পাঠানোর জন্য।

নীচে বংগবন্ধুর ভাষনের পুরোটা দেয়া হলো

ভায়েরা আমার,
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।

কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস- এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন - আমরা মেনে নিলাম।

তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কি পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে।

আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।

ভায়েরা আমার,
২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে মতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।

আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।

আমি পরিষ্কার করে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।

২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় - তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু -আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা।
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না।

মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।

মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন।
কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন।
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্‌।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

জয় বাংলা।


মন্তব্য

রানা মেহের এর ছবি

এই লেখাটা পড়েছেন মুস্তাফিজ ভাই?
http://nasarchoudhury.wordpress.com/2009/01/29/looking-back-at-the-historical-7th-march-1971/

আপনি মুক্তিযুদ্ধের অভিগ্গতা লিখছেন।
কীযে ভালো লাগছে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

মুস্তাফিজ এর ছবি

ধন্যবাদ লিঙ্কটার জন্য। একই তথ্য যাচাই হয়ে গেলো। আমি যার থেকে তথ্য গুলো পেয়েছি উনি স্বাধীনতার পরে বেতার থেকে প্রকাশিত একটা ম্যাগাজিন থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করে রেখেছিলেন।

...........................
Every Picture Tells a Story

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

এরশাদ লুইচ্চার আমলেও এই ভাষন হারাম ছিলো প্রচার মাধ্যমে। তাই অনেক বড় হয়ে এই ভাষণের ভিডিও দেখার পরম সৌভাগ্য হয়েছিলো। কিন্তু আব্বা সেদিন পল্টনে উপস্থিত থাকার কারনে উনার মুখে এই ভাষনের চৌম্বক অংশ গুলো শুনেছিলাম। যারা সরাসরি এই ভাষণ শুনেছিলো তারা কতোনা সৌভাগ্যবান। রক্ত ঠান্ডা রাখা আসলেই খুব কঠিন।

মনে রাখবেন, শত্র“বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দুমুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।
- কতটা গভীর চিন্তাপ্রসূত, কতটা সহনশীল, কতটা অসাম্প্রদায়ীক বক্তব্য।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। - কাউকে তো বিশাল রকমের বিদ্বান হতে হয়না এই কথার মর্মার্থ বুঝতে।

অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই।

=================================================
সকলই চলিয়া যায়,
সকলের যেতে হয় বলে।

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

মুস্তাফিজ এর ছবি

এই ভাষনের পুরো কপি এখানে তুলে দেবার অন্য একটা কারন আছে। একসময় এমন কথাও উঠেছিলো যে বংগবন্ধুর এই ভাষনটি লিখিত ভাষন ছিলো এবং কেউ কেউ আড়ালে আবডালে এটাকে নিজের লেখা বলে জাহির করার অপপ্রয়াসও চালিয়েছিলেন। খুব ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে যে ভাষনটি কোন লিখিত ভাষন নয়, কিছু কিছু বিষয় যে একেবারে তাৎক্ষনিক তার প্রমান রেডিওর ব্যাপারটা, আরো আছে যেমন বক্তৃতার পুরো সময় মাঠের উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়াউড়ি করছিলো, তাদের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বংগবন্ধু বলেছিলেন “...তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না...”

...........................
Every Picture Tells a Story

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পছন্দের পোস্টে যোগ করে নিলাম। আর কী বলবো?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মাহবুব লীলেন এর ছবি

...

হিমু এর ছবি

জয় বাংলা! কী আশ্চর্য শক্তিশালী একটা জয়ধ্বনি, অথচ এটা আমাদের চোখের সামনেই একটি দলীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে।

হাটেমাঠেঘাটে আবার শুনতে চাই, জয় বাংলা! ক্রিকেটের গ্যালারিতে, ফুটবলের গ্যালারিতে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে মানুষের মুখে শুনতে চাই, জয় বাংলা!



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

রাহিন হায়দার এর ছবি

মন খারাপ এ কি আর সম্ভব?

________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

হিমু এর ছবি
অকুতোভয় বিপ্লবী এর ছবি

সম্ভব হয়েছে। এখন থেকে বাঙালি আবার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান দেবে - জয় বাংলা!

------------------------------------
সময় এসেছে চল ধরি মোরা হাল,
শক্ত কৃপাণে তুলি বরাহের ছাল।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

খুবই ভাল লেখা।

গৌতম এর ছবি

মুস্তাফিজ ভাই, অনেকে বলেন বঙ্গবন্ধু নাকি ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করার সময় 'জয় বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান' শব্দগুলো বলেছিলেন। অনেকে বলেন, না, তিনি এটা বলেন নি।

আমি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি নানা জায়গায় শুনেছি কিন্তু কোথাও তাঁকে জিয়ে পাকিস্তান শব্দগুলো বলতে শুনি নি। এ ব্যাপারে কি কিছু আলোকপাত করতে পারবেন?

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

গৌতমদা,

ছফার '১৯৭১: মহাসিন্ধুর কল্লোল' থেকে একটু কোট করি।

'একটা কথা বলি, শেখ সাহেব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে জয় বাংলার সঙ্গে সঙ্গে জয় পাকিস্তান শব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন। এখন এই ভাষণ নিয়ে নানা বিতর্ক-বিতণ্ডা চলছে। আমি এত ছোট্ট মানুষ ! আমাকে সাক্ষ্য দিতে কেউ ডাকবে না। আমি যেমন শুনেছি, তেমনি বললাম। হতে পারে, আমার শ্রুতির বিভ্রম ঘটেছিল।'

গৌতম এর ছবি

এখন তো আরও ধন্ধে পড়ে গেলাম! চিন্তিত

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

মুস্তাফিজ এর ছবি

আমি শুনিনি, রেডিওতে প্রথম প্রচারে তা ছিলোনা সেটা নিশ্চিত।

...........................
Every Picture Tells a Story

হিমু এর ছবি

আমার বাবা উপস্থিত ছিলেন ময়দানে, আমার ভাইকে ঘাড়ে করে। এক শিবিরের বাচ্চার মুখে এই গুজব শুনে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি পরিষ্কার জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের কোনো জয়ধ্বনি বঙ্গবন্ধু দেননি।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

অমিত এর ছবি

একই ব্যাপার আমার ক্ষেত্রেও। আমার বাবাও ছিলেন এবং জিয়ে পাকিস্তান এর ধারে কাছেও কিছু বলেননি বঙ্গবন্ধু ।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

বুকমার্কড করে রাখলাম। এই ভাষণ বারবার শুনতে ইচ্ছে করে, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়!
----------------------------------------
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
----------------------------------------
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

মামুন হক এর ছবি

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষনটা এককালে আমার মুখস্থ ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালীন রাজনৈতিক ভাষনগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম।
জয় বাংলা!

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

জয় বাংলা! জয় বাংলা!
চোখ ভেজানো বুক কাঁপানো গায়ে কাঁটা দিয়ে তোলা দুই শব্দ।
ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই।
আমাদের একটা ফিলিপস রেডিও ছিল সেই পাক আমলেই। বেশ ওজন, ভারী মজবুত চেহারা। আমরা যখন বড়, সেটাতে বাবা বিবিসি শুনেছেন ৯৫-৯৬ সাল পর্যন্তও। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হল, তখন আমার মা আর দুই বোন এক ভাই মামাবাড়িতে, জামালপুরের শেরপুরে। ঢাকার অবস্থা বিপন্ন দেখে মার্চের শেষ কোনো এক তারিখেই বাবা পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছিলেন শেরপুরের দিকে। তারপর টানা চারদিন না পাঁচদিন প্রায় পুরোটা পথই হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলেন শেরপুরে, আমার মামার বাড়িতে। তাঁর পায়ের পাতা ফেটে রক্ত পড়ছিল, জীবন বিপন্ন হয়েছে অনেক বার, আর্মির সামনে পড়তে পড়তে বেশ কয়বার বেঁচে গিয়েছেন, বিহারী সন্দেহে (বাবার বেশ বাঘাটে চেহারা ছিল) কখনো কখনো স্থানীয় বাঙালিরাও মেরে ফেলার জন্য চেপে ধরেছিল। কখনো কোনো বাড়িতে পেয়েছেন খাবার, কখনো ক্ষেত থেকে টমেটো ছিঁড়ে খেয়ে খিদে মিটিয়েছেন।
এই পুরো পথেই তাঁর সঙ্গে ছিল সেই ফিলিপস রেডিও। সেটা হাতছাড়া করেন নি তিনি।
এই পদযাত্রার কথা বাবাকে আমি বার বার লিখতে বলেছি, কিন্তু তিনি সেটা লিখতে চান নি। হয়ত সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করতে চান নি। বাংলাদেশ তো তখনো পুরোটাই গ্রাম, ঝোপঝাড়ে ঘেরা পথে গভীর রাতে চাঁদের আলোতে হেঁটে যেতে যেতে কী কথা উদয় হয়েছিল আমার জনকের মনে খুব জানতে ইচ্ছে করে। সন্তানের মুখ আর দেখতে পাবেন কিনা, পৌঁছাতে পারবেন কিনা তাদের কাছে, পথে চলতে চলতে অগণিত মৃত মুখ দেখে তাঁর মনে কতটা জ্বালা জেগেছিল নিজের দেশের জন্য, বড় জানতে ইচ্ছে করে।
কিংবা এত দূর এই অসম্ভব যাত্রা শেষ করে তিনি যখন এসে ঢুকলেন আমার মামাবাড়ির সদর দরজা দিয়ে, ক্লান্ত বিধ্বস্ত, শরীরে ময়লা কাপড়, পা ফেটে রক্ত পড়ছে... তখন তাঁকে দেখে কী দৃশ্য তৈরি হল বাড়ির আঙিনায়, খুব জানতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু আমার এখন দুঃখ হয় সেই রেডিওটার জন্য। যেটার ঐতিহাসিক মূল্য বুঝে উঠার আগেই কোনো এক কটকটিওয়ালা বা পাড়ার ইলেকট্রিশিয়ান বগলদাবা করে নিয়ে গেছে সেটাকে!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

হিমু এর ছবি

রেডিওটার জন্য মন খারাপ হয়ে গেলো।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

মুস্তাফিজ এর ছবি

কিন্তু আমার এখন দুঃখ হয় সেই রেডিওটার জন্য। যেটার ঐতিহাসিক মূল্য বুঝে উঠার আগেই কোনো এক কটকটিওয়ালা বা পাড়ার ইলেকট্রিশিয়ান বগলদাবা করে নিয়ে গেছে সেটাকে!

একই অবস্থা আমাদেরও

...........................
Every Picture Tells a Story

রাহিন হায়দার এর ছবি

জয় বাংলা!

ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই। লিখুন আরো।
________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

চলুক
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

জয় বাংলা...

ভাষণটা আমি আগে পুরোটা পড়িনি, ধন্যবাদ পুরোটা তুলে দেবার জন্যে।

মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট আপনার এই স্মৃতিচারণটা খুব ভালো লাগছে, আরো লিখবেন আশা করি।

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই, আমাদের সবার অনুরোধ রাখার জন্য।
এই রকমই চাইছিলাম। এমনটাই...
আমাদের প্রজন্ম স্বাধীনতার সেই গৌরবময় স্মৃতি মস্তিস্কের কোষে কোষে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে... এ আমার বিশ্বাস।
রক্তবীজ কখনো মরে না... মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে।

[পুনশ্চঃ মুস্তাফিজ ভাই, কিছু বানান অপ্রত্যাশিত ভাবে ভুল হয়েছে। বিশেষ করে বারবার 'বঙ্গবন্ধু' বানানটা বারবার চোখে লাগছে।(এই একটু পিঠ চুল্কে দিলাম আরকি) ঃ)]

---- মনজুর এলাহী ----

মুস্তাফিজ এর ছবি

ধন্যবাদ
আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু 'বঙ্গবন্ধু' লিখতে গেলে ওরকমই হচ্ছে। এখন এখান থেকে কপি করে ঠিক করে দিচ্ছি।

...........................
Every Picture Tells a Story

মুস্তাফিজ এর ছবি

আজ সেই ৭ই মার্চ।

...........................
Every Picture Tells a Story

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই!

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

অতিথি লেখক এর ছবি

বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চ এর ভাষনে বলেছিলেন-

"আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।"

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,
আপনি বঙ্গবন্ধু'র যোগ্য উত্তরসূরী। বঙ্গবন্ধু'র দেখা স্বপ্ন আপনি বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর। স্টেডিয়াম, এয়ারপোর্ট, নদীর উপর ব্রীজ সবকিছুর নামকরণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নামে। আমরা জানি বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন আপনি তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন, কিন্তু উনার বলা উপরের কথাটুকু আপনি কতটুকু মেনে চলছেন? এদেশের মানুষের অধিকারের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখে গিয়েছিলেন তা কি আপনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন?

সুপ্রিয় দেব শান্ত

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

জয় বাংলা!

আচ্ছা, একটা কথা কই। আপনারা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবিত ছিলেন, তখনকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিখ্যাত গানগুলো শুনেছেন, রক্তে কাঁপন উঠেছে আপনাদের, কাঁটা দিয়েছে ত্বকে। কেন এই মুক্তির গানগুলো এখন অপাংক্তেয়? কোথায় সেই গানগুলোর বহুলপ্রচার? শুধু কর্পোরেট পুঁজির ব্যবসা বাড়াতেই কি ওগুলো এখন ক্যাসেটবন্দী?

মাঝেমধ্যে সেগুলোর কিছু শুনি সাতই মার্চে বা ২৬ মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বরে এবং তা শুধু লীগ ক্ষমতায় থাকলে। এটাওবা কেন? বিএনপির আমলে কি গানগুলো বাজাতে মানা? তাদের কোন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও কেন সেগুলো বাজানো হয় না? এটা রাজনৈতিক আলাপ নয়, শুধুই পর্যবেক্ষণ, দুঃখের সাথে।

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

মুস্তাফিজ এর ছবি

জয় বাংলা

...........................
Every Picture Tells a Story

নজমুল আলবাব এর ছবি

জয় বাংলা

চিলতে রোদ  এর ছবি

জয় বাংলা!

Mahbubur Rahman এর ছবি

Unfortunately after 1971, Abba was transferred to Feni and struggle and hardship began. We had to go and stand in line for powder milk from TCB. There was a rumour that govt will take away agri-lands of non-absentee owners. So Amma decided to start farming herself which she continued for next 40 yrs. The 'radio' went to a repair shop named "Radio Hospital" in Mymensingh and we couldnt afford to take it back!!

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

জয় বাংলা!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

তাসনীম এর ছবি

জয়বাংলা।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

জয় বাংলা!

SADIK CHOWDHURY এর ছবি

দারুণ কাজ। ভাষনটা কপি পেষ্ট করলাম ভাই। হাততালি হাততালি

স্যাম এর ছবি

আজ আবার পড়া হল। জয় বাংলা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।