সামনে তাকিয়ে হান্নান ভাইকে সতর্ক করি-
- ভাই সামনে ক্যামেরা।
- কই? হাঃ হাঃ হাঃ, বুঝলেন্নি মুস্তাফিজ ভাই, ঐগুলা ফলস, শুধু ঢাকনা দিয়া রাখছে।
- কীভাবে বুঝলেন?
- আরে কী কন? কত গেছি এই রাস্তায়!
এরপর শুরু হয় উনার ড্রাইভিংয়ের গল্প। কতবার জরিমানা দিয়েছেন আর কতবার উনার লাইসেন্স স্থগিত রাখা হয়েছিলো সেই গল্প করতে করতে চিৎকার করে উঠেন উনি-
- আহারে, আহারে, ক্যামেরাটা খেয়াল করলেন না।
আমি মুচকি হেসে বলি- আমি ভাবছি ফলস।
- আরে না, সব ফলস হইলে দুনিয়া চলবো কেমনে?
তারপরও দুনিয়া চলে, চলে তার নিজস্ব গতিতে। কয়েক ঘণ্টা আগেও যার নামই শুনিনি সেই হান্নান ভাই হঠাৎ করেই যে এত আপন হয়ে যাবেন তা কী আমরা বুঝতে পেরেছিলাম? পারি নাই। এমনকি আগের রাতে ট্রেন স্টেশনে আমাদের নিতে আসা টেকো, দাড়িয়াল, থ্রী কোয়ার্টারের চাইতে একটু লম্বা প্যান্ট পড়া হান্নান ভাইকে প্রথম দেখায় অপছন্দই করেছিলাম আমি। সেই এক মুহূর্তই। এরপর থেকেই হান্নান ভাইয়ের সঙ্গ উপভোগ করতে থাকি।
- আপনে কি মুস্তাফিজ?
- জ্বী, আপনি হান্নান ভাই?
- হেঁ হেঁ হেঁ, আসেন বুক মেলাই। আপনে এম্বাসেডরের ভাই মানে আমাগোরও ভাই।
- না ভাই, আপনি ভুল করতেছেন, আমি এম্বাসেডরের ভাই না।
- ঐ অইলো, আপনার ভাই-ই আমাগো এম্বাসেডর।
পরিচয়পর্ব সেরে উঠে যাই উনার গাড়িতে। স্পেনের দক্ষিণে সমুদ্রের পাড়ে ছোট্ট শান্ত শহর মালাগা। সমুদ্রের ওপর পাড়ে মরক্কো আর তার পেছনে পুরো আফ্রিকা। রাতের অন্ধকার পেরিয়ে ছুটতে থাকে গাড়ি। সমুদ্র থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়।
- আপনাগো কী দেখামু? এখন তো রাত, ঘুমানোর সময়। খাওয়া দাওয়া করেন, ভালো একটা ঘুম দেন, ভোর পাঁচটায় গ্রানাডায় যাইতে অইবো, নাইলে কাভার করতে পারবেন না।
- গ্রানাডা এখান থেকে কতক্ষণের পথ?
- সেইটা সমস্যা না, যত আগে যাইবেন তত বেশি দেখতে পারবেন। যা দেখবেন সবই মুসলমানেরা বানাইছে। ডিনারের পর আপনাদের একটা হোটেলে তুলে আমি বাসায় চলে যাবো। ভোরে আবার আসবো।
বলতে বলতে গাড়ি একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামে। নূরজাহান। জগতের আলো। দোতলা আলো-আঁধারিতে বাইরে থেকে চমৎকার লাগে।
- এই যে এইটা দেখছেন, নূরজাহান, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট, বাঙ্গালি মালিক, মুসলমান, নাম কাশেম। ঐ যে সামনে আরেকটা, ঐটার নাম শাহজাহান, ঐটাও মুসলমান। এরা দুইজন আগে একখানে ছিলো, এখন ঝগড়া কইরা আলাদা হইছে। এইখানে আরো একটা একটা আছে তাজমহল।
- ঐটাও কি মুসলমান?
- জ্বী জ্বী ঠিক বলছেন। আগে সব এক ছিলো, এখন আলাদা আলাদা। এই তিনটাই এখানকার সবচাইতে বড়। চলেও।
- কিন্তু এরা ইন্ডিয়ান হোটেল বলে কেন?
- কী যে কন! বাঙ্গালি খাবারের নাম বললে চলবো নাকি? কয়জন চিনে? ভিতরে গেলেই বুঝবেন।
আমরা ভেতরে ঢুকি। সিঁড়ি থেকে ভেতর পর্যন্ত মোটা তুলির আঁচড়ে নানান ছবি আঁকা। কিছু কিছু আবার ফ্রেমে বাঁধানো। রাধাকৃষ্ণ, রাজা-বাদশা, সৈন্যসামন্ত, হাতি-ঘোড়া থেকে ফুল-প্রজাপতি সবই আছে সেখানে।
হান্নান ভাইকে খোঁচা দিয়ে বলি: আচ্ছা, এইটা মুসলমানের দোকান?
উনি হেসে দিয়ে ক্যাশবাক্সের দিকে আঙুল তোলেন। ইঞ্চি ছয়েক লম্বা একটা স্টিকারে কলেমা তৈয়েবা লেখা। তার পেছনে বসে আছেন রেস্টুরেন্টের মালিক কেরানীগঞ্জের কাশেম ভাই।
উনি জানালেন উনার খদ্দেরদের বেশির ভাগই হয় মরোক্কান, লিবিয়ান কিংবা তিউনিসিয়ান। অল্প একটু সমুদ্র পাড়ি দিলেই মালাগা, ওদের বেড়ানোর প্রথম স্থান। মসলাদার খাবারের দিকে ওদের খুব ঝোঁক, তাই চলেও ভালো। আমারা থাকতে থাকতেই একদল ঢুকলো, হালাল খাবার কি না নিশ্চিত হয়ে অর্ডার দিয়ে ওয়াইন আর বিয়ারের বোতল খুলে বসে গেলো। আমরাও পেট পুরে হালাল খাবার খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে ঘুমানোর জায়গা খুঁজতে বের হলাম।
রাতে ঘুম ভালোই হয়েছে, ঠিক পাঁচটায় যখন হান্নান ভাইয়ের ফোন পেলাম সে সময় আমি আর রিতা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। উনি এসেই গাড়িতে ওঠার তাড়া দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম- ভাই, বাস কয়টায়?
- এত সকালে বাস পাইবেন কই? পাগল অইছেন নাকি?
- কী বলেন! তাহলে যাব কীভাবে?
- আগে উঠেন, একটা বন্দোবস্ত তো করতে অইব। আপনারা মেহমান, এম্বাসেডরের ভাই, বন্দোবস্ত না কইরা কি রাস্তায় ছাইড়া দিমু?
- আবার বলেন এম্বাসেডরের ভাই! আমি না বলছি আমার ভাই এম্বাসেডর না।
- অই অইলো। আপনার ভাই-ই আমাগো এম্বাসেডর।
আমরা গাড়িতে উঠি। বুঝতে পারছিলাম না কোথায় যাচ্ছি। দেখতে দেখতে আলাপে আলাপে শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে এসে উঠলাম। বুঝতে পারলাম উনি নিজেই ড্রাইভ করে আমাদের গ্রানাডায় পৌঁছে দিচ্ছেন।
- ভাই, কাজটা কি ঠিক হলো? এই দেড় দুইশো কিলোমিটার ড্রাইভ করে আমাদের গ্রানাডায় পৌঁছে দেবার কোন দরকার ছিলো না। আমরা বাসে যাব সেই প্ল্যান করেই তো এসেছি।
- আরে, কী যে বলেন! আপনারা মেহমান, এম্বাসেডরের ভাই... এইভাবে কী রাস্তায় নামাইতে পারি? খালি খেয়াল রাখেন স্পিড ক্যামেরা আছে কি না।
আমি এই অদ্ভুত মানুষটাকে আর কিছুই বলি না। প্রসঙ্গ পালটে নানান বিষয়ে গল্প করি, উনি বলেন উনার কথা। এক বৃটিশ পরিবারের দত্তক হিসাবে ছোট থাকতে স্পেনের উপকূলে জিব্রাল্টারে চলে আসেন হান্নান ভাই। উনার যখন ষোল বছর বয়স সে সময় সেই ব্রিটিশ পরিবার লন্ডনে ফেরত গেলেও উনি থেকে যান সেখানেই, সেখান থেকে মালাগা।
- বুঝলেননি ভাই, এই যে জিব্রাল্টার, এইটা কিন্তু আসলে একটা পাহাড়, নাম অইলো জাব্ আল্ তারেক, মানে তারেকের পাহাড়। মুসলমানেরা যখন এইদিকে আসলো তখন সেনাপতি তারেক এই পাহাড়েই প্রথম ঘাঁটি গাড়ছিলো। এইদিকে তো তখন কিছুই আছিলো না।
- এইজন্যই কি আপনে বলেন যে সব মুসলমানেরা বানাইছে?
- জ্বী জ্বী জ্বী আপনে জ্ঞানী মানুষ বুঝতে পারছেন।
- কিন্তু থাকতে পারলো না কেন?
- ঐ যে দেখলেন না একতা নাই, একটা ভাইঙ্গা তিনটা দোকান হইছে।
আমি তর্ক করি না। হান্নান ভায়ের সরল সমীকরণে তাল মেলাতে মালাতে ঘণ্টা দুয়েকের মাথায় গ্রানাডায় এসে পৌঁছাই। পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে উনি বললেন আপনারা একটা হাত পা খেলান, আমি আসছি। আমরা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতেই উনি ফিরে এলেন আলহামরা কমপ্লেক্সে ঢোকার তিনটা টিকিট হাতে।
হান্নান ভাইয়ের গল্প এত সহজে শেষ হবে না। বরঞ্চ তা তোলা থাক অন্য সময়ের জন্য, আমার আজকের গল্প আলহামরা প্রাসাদের ছবি।
চলেন দেখি।
মন্তব্য
ভালই লাগছে, চলুক।
[ তবে সচলে একটু বড় আকারের ছবি দিলে আরো ভালো লাগত, (মানে ফ্লিকারে যেতে হত না)]
ধন্যবাদ।
দেশের নেট স্পিডের কথা চিন্তা করেই ছবি ছোট রাখা হয়েছে।
...........................
Every Picture Tells a Story
অসাধারণ সব ছবি!!
ধন্যবাদ।
...........................
Every Picture Tells a Story
গ্রানাডা>গেরনাতা>ডালিম।
এই জায়গাটা আমাকে এখনো অবাক করে। মানুষেস সৌন্দর্যবোধ এত গভীর কিভাবে হয়?
মানুষের রক্তচুষে বানানো এই সৌন্দর্যবোধ নিয়েই আমরা গর্ব করি।
...........................
Every Picture Tells a Story
চমৎকার।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ ভাই।
...........................
Every Picture Tells a Story
বাহ! চমৎকার! ছবিগুলো আগেই দেখেছিলাম ফ্লিকরে। তার সাথে আপনার সাবলীল গল্প! দারুন!
আচ্ছা, ১০১টা ছবির গল্প মানে তো "(এক বা একাধিক) ছবি নিয়ে ১০১টা গল্প" তাই না? প্রথমদিকে এই সিরিজে আপনি মনে হয় এক গল্পে একটা/দুটো ছবি দিতেন। এখন অনেক বেশি দেখছি, সেটা তো অবশ্যই অতি আনন্দের, কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিলো যে এটা যদি "১০১টা ছবি নিয়ে কয়েকটা গল্প" এরকম হয়, তাহলে আপনি না আবার ৯/১০ পর্বেই ১০১টা ছবি দিয়ে সিরিজ শেষ করে ফেলেন!
পাঠকদের চাহিদা থেকেই এই পরিবর্তন। এটাকে অনেকটা ছবি ব্লগ বলতে পারেন।
...........................
Every Picture Tells a Story
দারুণ।
জিব্রাল্টারের নামকরণের গল্প শুনেছিলাম কোথায় জনাই, ভাল লেগেছিল।
facebook
হু, সব মুসলমানেরা বানাইছে।
...........................
Every Picture Tells a Story
ছবি ছুডু ছুডু
গল্প আগের মতনই (গুড়)
বিবিসির The First Eden ডকুটায় কর্ডোবার প্রাসাদের অতুলনীয় খাল-ব্যবস্থার কথা বলেছিল। রুক্ষ মরু থেকে আসা মূর'রা জল সংরক্ষণ করতে এবং প্রাসাদ ঠান্ডা রাখতে খুব দক্ষ ছিল নাকি।
কর্ডোবায় গিয়েছিলাম, সেদিনই। তবে কর্ডোবার চাইতে সেগোভিয়ার জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা এত দারুণ ছিল যে এই দুই হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তা সচল!
ছবি দেখেন
...........................
Every Picture Tells a Story
চমৎকার।
অসাধারণ সব ছবি!
চলুক!
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ রাজা
...........................
Every Picture Tells a Story
হান্নান ভাইয়ের গল্প দারুণ। তারচেয়ে বেশি সুন্দর ছবিগুলো।
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
হান্নান ভাই মানুষ হিসাবেও অসাধারণ।
...........................
Every Picture Tells a Story
ছবি আর গল্প, ভাল লাগল ছবির গল্প।
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
গত কালই পড়েছিলাম।
আপনার ছবি এবং গল্প বলার ধরণ বরাবরই টানে মুস্তাফিজ ভাই।
শুভেচ্ছা।
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ তাপস শর্মা।
...........................
Every Picture Tells a Story
গতকাল থেকে মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল। আপনার ছবি আর গল্পে মনটা ভাল হয়ে গেল।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার মতন অবস্থা আমারও ছিলো। আমাদের কিছু কিছু ঘটনা আছে যা দেশ স্বাধীন হবার পরে যাদের জন্ম তাদের কোনভাবেই বোঝানো যাবেনা।
...........................
Every Picture Tells a Story
হান্নান ভাইরে নিয়া আরো লেখার দাবী জানায়া গেলাম।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হান্নান ভাই তোমাগো দেশী।
...........................
Every Picture Tells a Story
আমগো দেশী না হইলে এমন ব্যপক জিনিস হইবো ক্যামনে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সেটাই
...........................
Every Picture Tells a Story
হান্নান ভাই রকস!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
...........................
Every Picture Tells a Story
আপনার ছবি নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা তৈরি হতে এখনো আমার আরো কয়েকবার জন্মনিতে হবে। হান্নান ভাইয়ের গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে এইটাই বলতে আসলাম। ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ। হান্নান ভায়ের সাথে সেদিনের আরো কিছু ঘটনা আছে, লেখবো।
...........................
Every Picture Tells a Story
জব্বর! অনেকদিন পর ঢুঁ দিয়া দেখি ৭ লম্বর, এতদিনে তো ৭০ এ চইলা যাওনের কথা আছিল গুরু!
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
গাড়ি চলেনা সাইফ।
...........................
Every Picture Tells a Story
দারুণ লেখা। পড়তে ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ অপ্র।
...........................
Every Picture Tells a Story
হুম।
মুসলমানদের তৈরি।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
হু, এই মুসল্মান হান্নান ভায়ের আড়াইশো সন্তান, সবই ছেলে।
...........................
Every Picture Tells a Story
ছবি আর গল্প দুটোই খুব ভাল লাগল ।
হান্নান ভাইয়ের গল্প আরও শুনতে চাই ।
আর কন, আপনে কি সত্যিই অ্যাম্বাস্যাডারের ভাই ?
ভাল থাকবেন ।
শুভেচ্ছা ।
ধন্যবাদ প্রদীপ্তময় সাহা
...........................
Every Picture Tells a Story
অসাধারণ হয়েছে। লেখাটাও আর ছবিগুলো সেই লেখাকেই উজ্জ্বল করে তুলে।
--
তমাল
ধন্যবাদ তমাল
...........................
Every Picture Tells a Story
অনেকদিন পর আবার রেগুলার হওয়ার বাসনায় ঢুকে আপনার আপডেট দেখতে মঞ্চাইলো,,,,,
একের পর এক সব লেখা ও ছবি পড়ে যাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে।
আপনার সমস্ত লেখা আর ছবি, পড়ব আর দেখবো।
ধন্যবাদ
...........................
Every Picture Tells a Story
একে আপনার পোস্ট, তায় ১০১, কত আশা করে ঢুকে দেখি মোটে ১৯টা ছবি। এইটা কি ঠিক হইলো? লেখা দারুণ, ছবি দারুণ
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন