সাধারণ মানুষের চলমান হতাশা

নাদির জুনাইদ এর ছবি
লিখেছেন নাদির জুনাইদ (তারিখ: সোম, ১২/০৩/২০১২ - ১১:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(এক)

আজ দৈনিক “প্রথম আলো”-তে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনে লেখা হয়েছে বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামালউদ্দীন, বীর বিক্রম-এর কথা। অল্প কিছুদিন আগে এই বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। দেশকে স্বাধীন করতে আরো বহু মানুষের মতো দেশের জন্য গভীর ভালোবাসা নিয়ে তরুণ কাজী কামাল যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। অংশ নিয়েছেন অনেক অসমসাহসিক অপারেশনে। তার সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা রুমি, বদি, আজাদ, জুয়েল, মাণিক দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন; পাকিস্তানী সেনাদের হাতে ১৯৭১-এর ২৯ আগস্ট ধরা পড়ে যাওয়ার পরও তাদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাদের হতচকিত করে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কাজী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাক্ষাত মৃত্যুর সাথে যেন সরাসরি ধস্তাধস্তি করেই তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন ১৯৭১-এ। তারপর বহু মানুষের অসীম সাহস আর গভীর আত্মত্যাগ দিয়ে স্বাধীন করা এই দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল দেখেছেন আরো চারটি দশক। আজ সংবাদপত্রে তাঁর ওপর প্রকাশিত ছোট বিবরণটিতে লেখা আছে যে এই ধরনের প্রতিবেদনের জন্য তাঁর কাছে তথ্য জানতে চাইলেই তিনি বলতেন, “কী হবে আর লিখে? এই বাংলাদেশের জন্যতো আমি যুদ্ধ করিনি। দেশ মানে কী শুধু পতাকা আর মাটি?”

দেখতে পাই মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধার মনে স্বাধীন দেশের বাস্তবতা তৈরি করেছিল গভীর দুঃখ, হতাশা আর ক্ষোভ। কাজী কামালের এমন উক্তির কথা শুনে মনে পড়ে গেল তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রের নির্মাণ নিয়ে তৈরি সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্রটিতে দেখা মুক্তিযুদ্ধে সাত নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা নাজির আহমেদ খান বাচ্চু’র ব্যথাতুর মুখের কথা। ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রে ১৯৭১-এ ধারণকৃত দৃশ্যে দেখা যায় আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে তরুণ নাজির আহেমদ খান কোলে অস্ত্র নিয়ে বসে আছেন; তার মুখের ওপর ক্যামেরা থেমে থাকে কিছুক্ষণ। আমরা দেখি তার মনোবল-দৃপ্ত মুখ; তার দুই চোখে উদ্বেগ বা ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই; সেই চোখে স্থির হয়ে আছে দেশকে স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র হাতে নেয়া মুক্তিযোদ্ধার দৃঢ় সঙ্কল্প ও সাহস। আর ১৯৭১-এর অনেক বছর পর যখন তথ্যচিত্রটির প্রয়োজনে তারেক মাসুদ তার সাক্ষাতকার নেন তখন আমরা দেখি দেশের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে সেই চোখ দুটিই জলে ভরে উঠেছে, যে চোখ ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা জ্বলতে দেখেছিলাম। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে দুঃখ মেশানো মন্তব্য আমরা শুনি এই মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রাখার কথা বার বার আমাদের দেশে বলা হয়; আমাদের রাজনৈতিক নেতারা মুক্তিযুদ্ধের কথা, গণতন্ত্রের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন নিয়মিতভাবে। কিন্তু যাদের সাহসী অবদান আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন দেশের বাস্তবতা নিয়ে সেইসব মানুষদের দুঃখ আর হতাশা কতোখানি স্পর্শ করে এই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের?

(দুই)

আজকের ‘প্রথম আলো’-তেই প্রথম পাতায় চোখে পড়লো একজন বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত তার পাঁচ বছরের ছেলেটিকে কোলে নিয়ে পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পাশে ছেলেটির মা বহন করছে ওষুধ আর স্যালাইন। আহত সন্তানকে কোলে নিয়ে অতি সাধারণ এই মা-বাবাকে পথে অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে, কারণ বিরোধী দলের মহাসমাবেশকে ঘিরে সরকার ও বিরোধী দলের রেষারেষির যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে করে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা শহর। ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে অসংখ্য সাধারণ মানুষকে। শিশুসন্তান কোলে এই বাবা-মা’র পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যটি এই সমাজে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বেরই একটি উদাহরণ তুলে ধরলো। সংবাদপত্রে প্রকাশিত আরেকটি খবরে জানলাম বিরোধী দলের মহাসমাবেশকে ঘিরে নগরীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ধরপাকড় চলছে তাতে যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা বেশির ভাগই রিকশাচালক, দিনমজুর। কারো কারো বিরুদ্ধে থানায় কোন মামলা বা অভিযোগও নেই। এই রকম নিম্নবর্গের মানুষদের কোন সুস্পষ্ট অভিযোগ ছাড়াই হঠাৎ বন্দী করার পর তাদের দারিদ্র-পীড়িত পরিবার কেমন বিপদের মুখোমুখি হয় তা কী দেশের ক্ষমতাশালী মানুষরা ভেবে দেখেন? একটি গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দমনমূলক একটি সমাজের কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়ে এই দেশ জন্ম নিয়েছিল; অথচ এখনো এই সমাজে যারা হতদরিদ্র, অসহায় তারা যেন পুরনো উপনিবেশী ব্যবস্থার ‘নেটিভ’দের মতো নিপিড়ীত হচ্ছে। এই অবস্থা দেখে মনে পড়ে ফ্র্যান্তজ্ ফ্যাননের লেখার কথা – একটি উপনিবেশী অবস্থা বিভিন্ন পরিবেষ্টনী বা এলাকায় বিভক্ত। সমাজের ক্ষমতাশালীরা বাস করেন আধুনিক, আলোকিত এলাকায়; আর মলিন, অস্বাস্থ্যকর দিকে বাস করে নেটিভরা। মনে পড়ে ফ্যাননের সাবধানবাণী – একটি সফল স্বাধীনতাযুদ্ধের পরও কিন্তু সাবেক উপনিবেশী ব্যবস্থার আদলে সমাজে এমন ভাগ টিকে থাকতে পারে। যে দরিদ্র মানুষরা এই সময় বিভিন্ন বস্তি এবং অন্যান্য এলাকা থেকে গণগ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন, বা হয়েছিলেন অতীতে যেমন ২০০৪ সালে, সেইসব মানুষদের অবস্থা অতীতের উপনিবেশী সময়ের ‘নেটিভ’দের থেকে তাহলে কতোখানি ভিন্ন? লুই আলথুসারের ‘রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাসেস’ ধারণার কথাও মনে পড়ে যায় বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন শক্তিপ্রয়োগের উদাহরণ দেখে।

(তিন)

১৯৭১-এর আদর্শ কেবল পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায় নিয়ন্ত্রণ আর শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিজয় অর্জন করাকেই নির্দেশ করে না। ১৯৭১-এর মহান মু্ক্তিযুদ্ধের আদর্শ এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর এবং সৎ সমাজ নির্মাণের অনুপ্রেরণা আর দায়িত্বকেও নির্দেশ করে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মানুষ অপরিসীম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করেছিল অন্যায়, অবিচার আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে। ন্যায়ের শাসন এবং প্রগতিশীল মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, অত্যাচার এবং শোষণের অবসান এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা-পরবর্তী নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন ছিল। তাহলেই পূর্বের সমাজ-কাঠামোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং বহু ত্যাগ স্বীকার করা এই দেশের সাধারণ মানুষের স্বপ্ন পূরণ হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন সময় এই দেশের সাধারন মানুষকে পীড়িত করেছে তীব্র হতাশা এবং দুঃখ। বার বার বিভিন্ন গণআন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণেই সফলতা এসেছে, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই সাধারণ মানুষের জন্য সেইসব সাফল্যের আনন্দকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেনি। গত অনেক বছরের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিলেই তো বোঝা যায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও কতো সমস্যা এই সমাজে টিকে রয়েছে কেবল সেইসব সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের আন্তরিকতার অভাবের জন্যই।

১৯৭১-এ যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা এই দেশে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং সমর্থন পাবার কারণেই সংহত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ দূরের বিষয়ে পরিণত হলে সেই পরিস্থিতি শক্তিশালী করবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী পক্ষকেই। আর তেমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ আর এই দেশের সাধারণ মানুষ। দেশের যেসব রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রাখার কথা বলেন, সেই আদর্শকে শুধু মুখের কথায় নয়, প্রকৃতভাবে টিকিয়ে রাখতে তারা কতোটা সফলতার পরিচয় দিচ্ছেন তা তাদের ভেবে দেখতে হবে। তাদের এও মনে রাখতে হবে কপট আচরণ অনুধাবন করতে সাধারণ মানুষ কখনোই ব্যর্থ হয় না।


মন্তব্য

মাহমুদ.জেনেভা এর ছবি

দেশের যেসব রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রাখার কথা বলেন, সেই আদর্শকে শুধু মুখের কথায় নয়, প্রকৃতভাবে টিকিয়ে রাখতে তারা কতোটা সফলতার পরিচয় দিচ্ছেন তা তাদের ভেবে দেখতে হবে। তাদের এও মনে রাখতে হবে কপট আচরণ অনুধাবন করতে সাধারণ মানুষ কখনোই ব্যর্থ হয় না।

খুব ধারালো আপনার লেখা, কিন্ত আপনি এত কম লিখেন কেন?

চরম উদাস এর ছবি

চলুক

রিয়েল ডেমোন এর ছবি

দারুন!

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

চলুক চলুক চলুক
শতভাগ সহমত

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।