নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন একদিন টেলিভিশনেই দেখিয়েছিল এই তথ্যচিত্রটি। আমার দেখা হয়নি সেদিন, কিন্তু দেখলাম আমার ডিপার্টমেন্টের এক বন্ধু মেজর খালেদ’স ওয়ার দেখে উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তথ্যচিত্রটির বর্ণনা দিয়ে আমাকে সে বললো, রুমিকে দেখা যায় এই ছবিতে, তার কথাও শোনা যায়। “একাত্তরের দিনগুলি”র রুমিকে দেখতে পাবো, তার কন্ঠও শোনা যাবে এই কথা চিন্তা করেই আলোড়িত হয়েছিলাম ভীষণভাবে। কবে দেখতে পাবো এই ডকুমেন্টারিটি, সেই কথা ভেবে ছটফট করতাম। কিন্তু ইউটিউব বিহীন সেই সময়ে এমন একটি দুষ্প্রাপ্য তথ্যচিত্র সংগ্রহ করা ছিল যথেষ্টই কঠিন। ঢাকা শহরে যে ভিডিও ক্যাসেটের দোকানগুলি ছিল সেখানেও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই ডকুমেন্টারিটি পাওয়া যেতো না। আরো কয়েক বছর অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে একজনের কাছে পেয়ে যাই এই তথ্যচিত্রটির একটি ভিডিও ক্যাসেট। খুবই খারাপ অবস্থা সেই ভিএইচএস প্রিন্টটির। দৃশ্যগুলো মনে হচ্ছিলো ঘোলা পানির মতো। সাউন্ডের অবস্থাও ভাল নয়। তারপরও ভিসিআরে বার বার সেই ক্যাসেটটি চালিয়ে দেখেছি। তথ্যচিত্রটির বিভিন্ন দৃশ্য, বক্তব্য, শব্দ যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা দর্শককে আকৃষ্ট করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আর মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের সত্যিকারের দৃশ্য ধরা আছে ২৬ মিনিটের এই তথ্যচিত্রটিতে। বিভিন্ন ক্লোজ-আপ শটে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বিখ্যাত সেনানায়ক খালেদ মোশাররফকে, যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক আর মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশল সম্পর্কে ক্যামেরার পাশে থাকা তথ্যচিত্র পরিচালকের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। দেখতে পাই তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের, শুনি তাদের দৃপ্ত, সাহসী কন্ঠস্বর। সেই পুরনো ভিডিও ক্যাসেটটিই দেখেছি বছরের পর বছর। আর এখন এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রটির ঝকঝকে সংস্করণ পাওয়া যায় ইউটিউবেই। নান্দনিক নির্মাণশৈলী আর বিষয়বস্তুর ভিন্নতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মিত ডকুমেন্টারিগুলোর মধ্যে মেজর খালেদ’স ওয়ার অনেকটাই আলাদা এবং আকর্ষণীয়।
তথ্যচিত্রটি সম্পর্কে আমার সহপাঠীর প্রশংসা আর উচ্ছ্বাস যথার্থ হলেও আমাকে দেয়া তার আরেকটি তথ্য সঠিক নয়। মেজর খালেদ’স ওয়ার ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য শফি ইমাম রুমিকে দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যায় রুমির সহযোদ্ধা দুই নম্বর সেক্টরের কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলা, সিলেট ও ফরিদপুরের কিছু অংশ আর ঢাকা শহর ছিল সেক্টর দুই এর অন্তর্গত। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করা বাঙালী সেনা অফিসার মেজর খালেদ মোশাররফ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহসী নেতৃত্ব প্রদান এবং নিখুঁত সামরিক পরিকল্পনা গ্রহণে দক্ষতার জন্য খালেদ মোশাররফ হয়ে ওঠেন অত্যন্ত খ্যাতিমান। বিভিন্ন কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই নম্বর সেক্টর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ আর হত্যাকান্ড চালানোর কয়েকদিন পরই ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ফোর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাঙালী অফিসার মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে পাকিস্তানি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। রেজিমেন্টের অপর জ্যেষ্ঠ বাঙালী কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহের আগে তার সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন এবং দ্রুত সিলেট থেকে এসে তিনি পুরো ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মূলত ফোর্থ বেঙ্গলের সৈনিকদের নিয়েই গঠিত হয় দুই নম্বর সেক্টর। পরবর্তীতে ঢাকা, কুমিল্লা শহরের বহু ছাত্র এই সেক্টরে যোগ দেন এবং পেশাদার সৈনিকদের পাশাপাশি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। মেজর খালেদ মোশাররফ, ১৯৭১ সালের জুন মাসে
খালেদ মোশাররফ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের মাধ্যমে ঢাকা শহরে গেরিলা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ভীত এবং অস্থির করে তুলতে চেয়েছিলেন। এমন হামলার মাধ্যমে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের এমন বার্তাও দিতে চেয়েছিলেন যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক পাকিস্তানি প্রশাসনের এমন বক্তব্য সত্য নয়। ঢাকা শহর খুব ভালভাবে চেনে এমন তরুণদের বিশেষভাবে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়ার ওপর গুরুত্ব দেন খালেদ মোশাররফ। বাঙালী সেনা কর্মকর্তা মেজর হায়দারকে দেয়া হয় গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলিট কমান্ডো ফোর্স স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এসএসজি)-এর একজন সদস্য ছিলেন মেজর হায়দার। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত থ্রি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন থেকে পালিয়ে হায়দার ফোর্থ বেঙ্গলের সাথে যোগ দেন। সেক্টর টু’র অন্তর্গত মেলাঘর নামক স্থানে হায়দার ট্রেনিং দেন ঢাকা শহরের বহু তরুণকে যাদের নিয়েই গঠিত হয় ক্র্যাক প্লাটুন, ঢাকা উত্তর গেরিলা দল সহ অন্যান্য গেরিলা ইউনিট। ঢাকা শহরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করে ক্র্যাক প্লাটুন আর ঢাকা উত্তর গেরিলা দলের সদস্যরা যাদের মধ্যে রুমি সহ ছিলেন হাবিবুল আলম, কাজী কামাল উদ্দিন, ফতেহ্ আলী চৌধুরী, গোলাম দস্তগীর গাজী, হালিম চৌধুরী জুয়েল, বদিউল আলম বদি, কামরুল হক স্বপন, উলফাত, মানিক, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শাহাবুদ্দিন সহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা। প্রশিক্ষণের শুরুতেই এই তরুণরা খালেদ মোশাররফের কাছ থেকে শুনেছিল মাও সে তুং-এর সেই উক্তি - “কোন স্বাধীন দেশই জীবিত গেরিলাদের চায় না।” প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য তাদের লড়াই করে যেতে হবে কমবয়সী এই তরুণরা সেক্টর কমান্ডারের কাছে সেই কথা জেনেই গ্রহণ করেছিলেন গেরিলা ট্রেনিং। তারপর প্রবেশ করেছিলেন ঢাকা শহরে। মুক্তিযোদ্ধাদের সফলতায় দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু রুমি, মানিক, জুয়েল, বদি সহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছিলেন সেই স্বাধীনতার জন্য।
মেজর খালেদ’স ওয়ার-এ দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের সেই বিখ্যাত সেক্টরের মানুষদের। ১৯৭১ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা টেলিভিশনের কর্মীরা এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণের জন্য বাংলাদেশে আসেন। তথ্যচিত্রের পরিচালক ভানিয়া কিউলি আট দিন সেক্টর টু-তে কাটিয়ে সংগ্রহ করেন তথ্যচিত্রের উপাদান। এই সেক্টরের অধিনায়ক, অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা, বেসামরিক যোদ্ধা, গ্রামের সাধারণ মানুষদের সাথে কথোপকথনের দৃশ্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন হামলা পরিচালনার ফুটেজ অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে তৈরি হয় এই তথ্যচিত্রটি। বেসামরিক গেরিলা যোদ্ধারা বরাবরই এই সেক্টরে গুরুত্ব পেয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্র। এই সেক্টরে কর্মরত সেনাবাহিনীর ডাক্তার ক্যাপ্টেন আখতার আহমেদ লিখেছেন সারা দেশের, বিশেষ করে ঢাকার সেরা ছেলেগুলো এসে হাজিড় হয়েছিল সেক্টর টু-তে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বামপন্থী চিন্তার অনুসারী অনেক তরুণের প্রতি আওয়ামী লীগের সমর্থক বিভিন্ন নেতা এবং ভারত সরকারের এক ধরনের সন্দেহ থাকলেও, সেক্টর টুতে বামপন্থী যুবকদেরও গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনরকম বাধা প্রদান করা হয়নি। দেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত সবাইকেই যোদ্ধা হিসেবে এই সেক্টরে গ্রহণ করা হয়। সেক্টর টুকে এইজন্য সেই সময় “রেড সেক্টর” নামেও ডাকা হতো। ক্যাপ্টেন আখতার আহমেদ বাম-হাতি দেখে একবার খালেদ মোশাররফ রসিকতা করে বলেছিলেন, এমনকি আমাদের সেক্টরের ডাক্তারও “লেফ্টি।”
চলচ্চিত্র ভাষার নান্দনিক ব্যবহারের কারণে মেজর খালেদ’স ওয়ার প্রথম দৃশ্য থেকেই গতানুগতিক ধারার তথ্যচিত্র থেকে আলাদা হয়ে ওঠে। ছবির প্রথম দৃশ্যেই দেখানো হয় বাংলাদেশের নিস্তরঙ্গ এক গ্রামের দৃশ্য। একজন কৃষক গরু নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। ক্যামেরা জুম ব্যাক করে লং শটে দেখায় দৃশ্যটি। এরপর ডিজল্ভ এর মাধ্যমে দৃশ্য বদলে যায়। ক্যামেরা এবার জুম ইন করে এগিয়ে যায় সবুজ ধানক্ষেতে কাজ করতে থাকা এক কিশোরের দিকে। দেখা যায় একজন মাঝবয়সী কৃষককেও। নিবিষ্ট ভাবে কাজ করে চলেছে তারা। শোনা যায় পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। ক্লোজ-আপে দেখা যায় পানিভরা ধানক্ষেতে কৃষকের হাত পরিচর্যা করছে কচি সবুজ ধানগাছ। এই শান্তিময় শব্দ আর দৃশ্য থেকে হঠাৎই একটি কাটের মাধ্যমে আরেকটি ক্লোজ-আপে আবার দেখা যায় মানুষের হাত, তবে কচি ধানপাতা নয়, গোলা নিক্ষেপের জন্য অন্য মানুষদের সেই হাতগুলো এবার প্রস্তুত করছে একটি মর্টার। দেখা যায় এই বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের ভয়ালদর্শন শেল। ধানক্ষেতে পানির নড়াচড়ার মৃদু শব্দের পরিবর্তে সাউন্ডট্র্যাকে এবার ভেসে আসে ওয়াকিটকিতে সৈনিকদের কথা বলার যান্ত্রিক, অস্বস্তিকর শব্দ। আবার একটি কাটের মাধ্যমে দেখানো হয় গ্রামের পুকুর থেকে এক গ্রাম্য মহিলার পানি নেয়ার দৃশ্য, লং শটে দেখা যায় গ্রামের শান্ত, খোলা প্রান্তর। তারপরই আবার কাট, শোনা যায় ‘ফায়ার’ চিৎকার, আর সৈনিকরা শুরু করে মর্টারের গোলাবর্ষণ। গোলাবর্ষণের তীব্র শব্দ আগের দৃশ্যগুলিতে দেখা গ্রামের সমাহিত সৌন্দর্যকে যেন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। হঠাৎই আরেকটি কাট, আর এবার দেখা যায় খালেদ মোশাররফের মুখ। অত্যন্ত শান্তভাবে কিন্তু আশ্চর্য রকমের কাঠিন্যদীপ্ত কন্ঠে তিনি বলেন: “উই আর ফাইটিং আ ওয়ার অফ অ্যাটরিশন। ইন দ্যাট, উই কিল, কিল, কিল... ইন সেল্ফ ডিফেন্স। অ্যাজ লং অ্যাজ দে আর গোইং টু কাম অ্যান্ড ফাইট উইথ আস।” গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এই সাহসী কথাগুলো বলার সময় খালেদ মোশাররফের চোখের পাতা একবারও পড়ে না। তার মুখমন্ডল শান্ত থাকে কিন্তু তার দুচোখের তীব্রতা নির্দেশ করে অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য কতোটা দৃঢ়তার সাথে তিনি শত্রুর মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। গ্রামের শান্ত দৃশ্যের পাশে গোলাবর্ষণের দৃশ্যের উপস্থাপন নির্দেশ করে কিভাবে বাংলাদেশের নিরিবিলি গ্রামগুলো হঠাৎই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
পুরো তথ্যচিত্রে বিভিন্ন সময় খালেদ মোশাররফের সরাসরি সাক্ষাতকার গ্রহণ দেখানো হয়। কখনো ভয়েস ওভারের মাধ্যমেও শোনা যায় খালেদের বিভিন্ন বক্তব্য। একসময় ভয়েস ওভারে শোনা যায় খালেদ বলছেন, বাঙালীরা সবসময়ই শান্তিপ্রিয়। তাদের সমৃদ্ধ সাহিত্য আর সংস্কৃতিই তাদের রুচিশীলতা নির্দেশ করে। কিন্তু কাউকে কোণঠাসা করলে, তাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে তাদের রুখে দাঁড়াতেই হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি সরকার তখন বর্ণনা করতো দুষ্কৃতকারী হিসেবে। আর যুদ্ধকে বর্ণনা করা হতো সীমান্ত সংঘর্ষ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন মাস পর বাঙালী যোদ্ধা আর সাধারণ মানুষদের সাথে কথা বলে সেই সময়ের আসল পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেন পাশ্চাত্যের এই গণমাধ্যম কর্মীরা। তথ্যচিত্রে খালেদ মোশাররফ আর দুই নম্বর সেক্টরের আরেকজন সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন সালেক চৌধুরী ব্যাখ্যা করেন এটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ, সীমান্ত সংঘাত নয়। জানানো হয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী প্রতিদিন হাউইটজার, মর্টার প্রভৃতি ভারী অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে। কখনো তারা ব্যবহার করছে ট্যাংক। সীমান্ত সংঘর্ষে কখনোই এমন ভারী আর্টিলারি ব্যবহার করা হয় না, সেখানে ব্যবহৃত হয় হালকা অস্ত্র।
ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ক্যাপ্টেন সালেক চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের (যা পাঠান রেজিমেন্ট নামেও পরিচিত) অফিসার ছিলেন। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে তিনি ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে স্টাফ ক্যাপ্টেন। ২৫ মার্চের পরই তিনি পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। সেক্টর টুতে বিভিন্ন সামরিক এবং গেরিলা অভিযান পরিচালনায় সালেক চৌধুরীর ভূমিকা ছিল অসামান্য। সালদানদী অঞ্চলে সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। ১৯৭১-এর অক্টোবরে যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুতর আহত হলে খালেদ মোশাররফকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন খালেদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে তৈরি কে-ফোর্সের নেতৃত্ব দেন সালেক চৌধুরী। ক্যাপ্টেন সালেক চৌধুরী
একটি দৃশ্যে খালেদ মোশাররফ আর সালেক চৌধুরীকে যুদ্ধের বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়। তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে এবং বসে থাকতে দেখা যায় বিভিন্ন কমবয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের। খালেদকে বলতে শোনা যায়, “উই ইনটেন্ড টু মেক দ্য হোল নেশন আ ফাইটিং ফোর্স।” তিনি জানান সারা দেশ থেকে হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিচ্ছে। তখনি দেখা যায় ১৯ বছর বয়সী এক মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে আসছে একদল কমবয়সী মুক্তিযোদ্ধা। এই মুক্তিযোদ্ধাদের কারো পরনে ফ্যাশনেবল জ্যাকেট আর বুট, আবার কেউ পরে আছে লুঙ্গি, কারো পায়ে কোন জুতো নেই। বোঝা যায় বিভিন্ন শ্রেণির তরুণ এই সেক্টরে যুদ্ধ করছে একসাথে। দলটির সামনে থাকা যুবকের নাম ইশরাক। তার হাতে দেখা যায় একটি চাইনিজ সাব-মেশিনগান, আর কোমরে বাঁধা গুলির ম্যাগাজিন। ইশরাক ছিল ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। প্রচন্ড সাহসী এক যোদ্ধা হিসেবে সে পরিচিত ছিল সেক্টর টুতে। পেশাদার সৈনিকদেরও প্রিয় ছিল সে। একটি দৃশ্যে দেখা যায় খালি পায়ে পানি ভরা ধানক্ষেতে নেমে ইশরাক ছবির পরিচালককে দেখাচ্ছে সেখানে গতকাল রাতেও তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা পড়েছিল। “শেলিং কন্টিনিউজ হিয়ার অলমোস্ট অল দ্য টাইম। অ্যান্ড ইউ আর ভেরি লাকি নট টু উইটনেস এনি শেলিং রাইট নাউ” - এমন বিপদজনক পরিস্থিতিতেও গ্রানাডা টেলিভিশনের কর্মীদের সাথে রসিকতা করে উনিশ বছরের এই তরুণ। দুই নম্বর সেক্টরের বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা
তথ্যচিত্র পরিচালক ভানিয়া কিউলির কন্ঠে একসময় শোনা যায় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ: “দ্য গেরিলাজ’ ল্যাক অফ আর্মস অ্যান্ড অ্যামুনিশন ইজ কমপেনসেটেড বাই দেয়ার প্যাশন ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাংলাদেশ; অ্যান্ড দেয়ার হেটরেড অফ দ্য ওয়েস্ট পাকিস্তানিজ ইজ কনস্ট্যান্টলি রিনিউড বাই দ্য স্টোরিজ দ্যাট দ্য রেফিউজিস টোল্ড দেম।” এরপর বৃদ্ধ, গ্রামের মহিলা, শিশু বিভিন্ন মানুষের মুখে শোনা যায় সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম অত্যাচার কথা। ক্যামেরা দেখায় এক কমবয়সী তরুণকেও। শহুরে বেশভূষার এই তরুণের চোখেমুখে লক্ষ্য করা যায় তীব্র ক্ষোভের চিহ্ন। ভানিয়া কিউলিকে লক্ষ্য করে সে বলতে থাকে: “আই উইশ আই কুড টেক ইউ ইনসাইড। অল দ্য ক্যান্টনমেন্টস ইন বাংলাদেশ আর নাথিং বাট কনসেনট্রেশন ক্যাম্পস। হানড্রেডজ অ্যান্ড থাউজ্যান্ডস অফ গার্লস আর কেপ্ট দেয়ার অ্যাজ প্রিজনারস। দে আর টরচার্ড, দে আর রেপ্ড, দে আর ডিজঅনার্ড। অ্যান্ড আফটার দ্যাট দে আর কিলিং দেম।” গ্রামের এক কিশোরকে দেখিয়ে ক্যাপ্টেন সালেক বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, এই ছেলেটির মা-বাবা সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছে এবং তার বোনকেও তুলে নিয়ে গিয়েছে। এখন এই ছেলেটি বলছে তার আর হারানোর কিছু নেই। সে তাই যতোজন সম্ভব পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে প্রতিশোধ নিতে চায়। যুদ্ধক্ষেত্রের শহুরে তরুণকে আবার বলতে শোনা যায়: “ইয়াহিয়া ইজ দ্য ইনিশিয়েটর অফ অল দিজ। হি ইজ জাস্ট ইন দ্য সেম র্যাঙ্ক উইথ হিটলার অ্যান্ড হিজ কমপ্যানিওনস, আইকম্যান অ্যান্ড আদার্স।”
তথ্যচিত্রে দেখা যায় দুই নম্বর সেক্টরের আরেকজন অত্যন্ত সাহসী এবং বিখ্যাত সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন মেহবুবুর রহমানকে। নির্ভয়পুর সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে প্রায় তিন হাজার নিয়মিত সৈন্যকে নেতৃত্ব দেন তিনি। খুবই হালকা-পাতলা গড়নের ক্যাপ্টেন মেহবুবকে তথ্যচিত্রে দেখায় একজন কলেজ ছাত্রের মতো। ক্যামেরার সামনে তিনি অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলতে থাকেন গ্রামবাসীরা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে, তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করছে এই কারণেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রামের মানুষদের ওপর ক্ষিপ্ত। সেক্টর টু যুদ্ধ হাসপাতালে কিছুদিন কাজ করা ডাক্তার শামসুদ্দীন ক্যাপ্টেন মেহবুব সম্পর্কে লিখেছেন, মেহবুবের শান্ত চেহারার নীচে লুকিয়ে থাকতো রাগী এক বাঘের রুদ্রমূর্তি। প্রচন্ড সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের অধীনস্ত যোদ্ধারাই সেক্টর টুতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি আঘাত আর নাজেহাল করেছে। ক্যাপ্টেন মেহবুবুর রহমান
ক্যাপ্টেন মেহবুবের বাহিনীর কোন অভিযানের দৃশ্য দেখানো না হলেও, তথ্যচিত্রের সিনেমাটোগ্রাফার মাইক হুইটেকারের ক্যামেরায় ধরা পড়ে ২৭ জুন ১৯৭১ বিকেলে ক্যাপ্টেন সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধার মন্দভাগ রেলস্টেশনের পাশে একটি বৈদ্যুতিক তারের পাইলন উড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য। সালেক একদল সৈনিককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন, তারপর তারা একটি ছোট খাল অতিক্রম করে এগিয়ে যান পাইলনটির দিকে। হুইটেকারও খালে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এগিয়ে যেয়ে হাতে ক্যামেরা ধরে ধারণ করেন বিপদজনক মুহুর্তের সেই দৃশ্যগুলো। পাইলনটি উড়িয়ে দেয়ার ফলে কুমিল্লা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ কয়েকদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পাইলন ধ্বংসের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা
তথ্যচিত্রে খালেদ মোশাররফকে বলতে শোনা যায়, এই যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। এই যুদ্ধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক সব দিককেই একসাথে প্রভাবিত করছে। ইয়াহিয়া যেমন কোন সরকার এখানে গঠন করতে পারবে না, তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করার মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী অর্থনৈতিক দিকেও গতিশীলতা আনতে দেবে না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তখন মাত্র তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। ভবিষ্যতে যুদ্ধের ধারা কোন্ দিকে যাবে তা বলা যায় না। অথচ নিজের সেক্টরে বিদেশি সংবাদকর্মীদের সাথে কথোপকথনের সময় খালেদ মোশাররফকে অত্যন্ত শান্ত এবং আত্মবিশ্বাসী দেখায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না এই সেনা অধিনায়কের মনের জোর কতোটা অসাধারণ ছিল। পুরো দেশজুড়ে অগণিত বাঙালীর স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠার কারণেও তখন বোঝা যাচ্ছিলো এই যুদ্ধে বাঙালীর বিজয় আসবেই। নিজেদের জীবনের বিভিন্ন দিক বিসর্জন দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছেন মৃত্যুর। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, জেদ বা মনোবলের অভাব নেই। যে সালেক চৌধুরীকে বিভিন্ন দৃশ্যে দেখা যায় গভীর মনোযোগের সাথে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ করছেন, বা অভিযান পরিচালনা করছেন তাকে যখন ভানিয়া কিউলি জিজ্ঞেস করেন তার পরিবারের সদস্যদের কথা সালেক চৌধুরী অল্পক্ষণের জন্য চুপ থাকেন। তারপর বলেন: “আমি জানি না আমার পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন। কিন্তু অন্যান্য আরো বহু পরিবারই তো বিপদের মধ্যে আছে। অন্যান্য অফিসারদের পরিবারের সদস্যদেরও তো বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাই আমি আর নিজের পরিবারের কথা ভাবি না। তাদের বিপদ হতে পারে জেনেই তো আমি পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি।” সবসময় তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে কথা বলা সালেক চৌধুরীর কন্ঠে আর চেহারায় এই মুহুর্তে লক্ষ্য করা যায় বিষণ্ণতা। তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে তিনি বলেন: “সিন্স আই হ্যাভ স্যাক্রিফাইসড দেম, সো হাউ ক্যান আই থিঙ্ক অ্যাবাউট দেম নাউ?” কেমন মানসিক অবস্থা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সেই সময় দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছিলো তথ্যচিত্রটির বিভিন্ন দৃশ্য তা ধরে রেখেছে চিরদিনের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের একটি সেক্টরে আট দিন থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নির্মিত মেজর খালেদ’স ওয়ার ছবির পরিচালক আরো কিছু পাকিস্তানি প্রচারণার বিরুদ্ধেও বক্তব্য তুলে ধরেন। যখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি ক্যাম্পে খালেদ মোশাররফকে ক্যাপ্টেন মেহবুব সহ অন্য আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে দেখা যায় ভয়েস ওভারে আমরা শুনি ভানিয়া কিউলি বলছেন যেহেতু পালিয়ে আসা বাঙালী শরণার্থীদের বেশির ভাগই হিন্দু আর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা মুসলমান তাই অনেকে মনে করতে পারেন চলমান যুদ্ধটি একটি ধর্মীয় যুদ্ধ। কিন্তু আমি মুক্তিফৌজের যতোজন সদস্যকে দেখেছি তারা প্রত্যেকেই মুসলমান। ভারতীয়রা তাদের সৈন্য আর সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে বাংলাদেশিদের সাহায্য করছে, ভারতীয়রা পাকিস্তানি সৈনিকদের লক্ষ্য করে ভারী গোলা বর্ষণ করছে পাকিস্তানি সরকারের এমন অভিযোগও এই তথ্যচিত্রে ভানিয়া কিউলি নাকচ করে দেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের ভেতর তিনি কোন ভারতীয় সৈন্য এবং ভারতের একটিও সামরিক উপকরণ দেখেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি কেবল ভারতে বিশ্রাম নিতেই যেতে দেখেছেন। আর মুক্তিবাহিনী ভারতীয় এলাকা থেকে নয়, বাংলাদেশি ভূখন্ড থেকেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণ করছে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে এই তথ্যচিত্রটি বিবিসি এবং গ্রানাডা টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানি প্রচারণার বিরুদ্ধে ভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরে মেজর খালেদ'স ওয়ার ।
ছবির শেষ দিকে খালেদ মোশাররফ জানান পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর প্রচন্ড অত্যাচার করার পর এবং তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার পরও সাধারণ মানুষ ভীত নন, তারা ভেঙ্গে পড়েননি। বরং তারা এমনও বলছেন যে দরকার হলে বাংলাদেশে কোন মানুষ জীবিত থাকবে না, তব্ওু পাকিস্তানিরা যেন এই দেশকে পরাজিত করতে না পারে: “লেট দেয়ার বি নোবডি ইন বাংলাদেশ, দে ক্যাননট টেক দ্য সয়েল আউট অফ আওয়ার কান্ট্রি। লেট দ্য সয়েল রিমেইন। উই মাস্ট কন্টিনিউ দ্য অ্যাকশন। দেয়ারফোর, দ্য ওয়ার উইল গো অন।” খালেদ মোশাররফের এই কথাগুলো শেষ হতে না হতেই একটি শান্ত, সুরেলা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ভেসে আসে। একটি কাটের মাধ্যমে নতুন দৃশ্যে আমরা দেখি সবুজ ধানক্ষেতের পাশে অনেক গাছপালায় ঘেরা একটি মেঠো পথ ধরে খালেদ মোশাররফ এগিয়ে আসছেন, পেছনে দু’জন সৈন্য। সবার পরনে সাধারণ প্যান্ট-শার্ট, হাতে চাইনিজ সাব-মেশিনগান। মেজর খালেদ মোশাররফ
ক্যামেরা প্যান করে তাদের চলে যাওয়া দেখায়, তারপর এগিয়ে চলে তাদের পিছু পিছু। দেখা যায়, খালেদ এগিয়ে যেয়ে সবুজ গাছপালার মাঝে মুক্তিবাহিনীর একটি অবস্থানে অন্য যোদ্ধাদের সাথে যোগ দেন। এরপর তারা সবাই সতর্কভাবে তাকিয়ে থাকেন দূরে, যেখানে হয়তো অবস্থান নিয়ে আছে হানাদার পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা। খালেদ মোশাররফ আর তার সঙ্গীদের যুদ্ধ এগিয়ে চলে। সেক্টর টু সহ সারা দেশেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের এই প্রতিরোধ আর যুদ্ধের ফলেই ১৯৭১ শেষ না হতেই বাংলাদেশ অর্জন করে স্বাধীনতা। স্বাধীন এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছর পর বর্তমান সময়ের মানুষেরা কি মনে রেখেছে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের? এই তথ্যচিত্রটিতে যাদের দেখা যায় সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ক’জনের নামই বা জানেন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা? কতোটা গুরুত্বের সাথে নতুন সময়ের মানুষদের জানানো হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা? অন্ধকার এক সময়ে আলো হয়ে যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য, এই দেশের মানুষের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছেন তাদের চেনার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ না থাকা আমাদের মনের দীনতাই কেবল নির্দেশ করবে।
মন্তব্য
এতগুলি ছবি দিলেন, তথ্যচিত্রটার লিঙ্ক দিলেও পারতেন। যাইহোক, আমি দিয়ে দিলাম এখানে --
১। মূল ইংরেজিতেঃ https://www.youtube.com/watch?v=tsjTQLtIHEI
২। বাংলা ভয়েস-ওভারকৃত সংস্করণঃ https://www.youtube.com/watch?v=RIiTBbMHRCA
****************************************
ইউটিউব লিংক আমি ইচ্ছে করেই দেইনি। আমি তথ্যচিত্রটি সম্পর্কে লিখতে চেয়েছি, লেখায় উল্লেখ করেছি এখন ইউটিউবে তথ্যচিত্রটির ঝকঝকে সংস্করণই পাওয়া যায়। যদি কারো দেখার আগ্রহ থাকে তবে তিনি নিজেই ইউটিউবে সার্চ দিয়ে তথ্যচিত্রটি খুঁজে বের করবেন। আমার লিংক দেয়া না দেয়ায় কিছুই আসবে যাবে না। মানুষের আগ্রহটিই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
আপনাকে ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
খুব ভাল লেগেছিল তথ্যচিত্রটি।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
তথ্যচিত্র টি দেখলাম, অসাধারাণ অনূভুতি, ধন্যবাদ আপনাকে। সম্ভবত এটির কিছু কিছু ফুটেজ বাংলাদেশে টিভি সংবাদ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান এ ব্যাবহৃত হতে দেখেছি।
অনন্যা
তথ্যচিত্রটি দেখেছি। কিভাবে খোঁজ পেয়েছিলাম মনে নেই,সম্ভবত ব্লগের কোন একটা লেখা থেকেই ইউটিউব লিঙ্কটা পেয়েছিলাম। এই মুহূর্তে পড়ছি খালেদ মোশাররফের লেখা “ মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স ” ।তার লেখনীতেও মানসিক দৃঢ়তার ছাপটা খুঁজে পাওয়া যায়। অবশ্য প্রথমা প্রকাশিত বই বলে একটু আশঙ্কায় আছি, কিছু বদলে দিল কিনা এই ভেবে।
যতটুকু পড়েছি তাতে মূল লেখার ফাকে ফাকে থার্ড ব্র্যাকেট দিয়ে টীকা লেখার ব্যাপারটা খুব দৃষ্টিকটু ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ লাগল। একটা উদাহরণ দেই। বইয়ে প্রথম যখন মেজর জিয়াউর রহমানের নাম এলো, তখন তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে নিচের মতো করে।
তথ্যগুলো ঐতিহাসিক সত্য হলেও এই বইয়ের বিষয় বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হলনা। খালেদ মোশাররফের যখন বইটা লিখেছিলেন তখন মেজর জিয়াকে তার অন্য আর দশ জন সহকর্মীর মত মনে করেই লিখেছিলেন বলে মনে হয়। সামরিক আইন প্রশাসক ( কি সুন্দর শব্দরে বাবা ! ) কথাটা পড়লে মনে হয় জাতির ক্রান্তিলগ্নে শক্তহাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকারী একজন ব্যক্তি। সাধু, সাধু।
সিসিবি তে মাসরুফ হোসেন ভাইয়ের ক্র্যাক প্লাটুন গেরিলা ফতে আলী চৌধুরীকে নিয়ে একটা লেখায় মেজর এটি এম হায়দারের কথা আমি প্রথম জানতে পারি।যতদূর জানি উনি খালেদ মোশাররফের করুণ পরিণতির সময় নিখোঁজ হয়েছিলেন। তার উপর একটা বই সংগ্রহ করেছি, একটু সময় করতে পারলেই পড়ে ফেলব।
চমৎকার লেখার জন্য ।
আমি তোমাদের কেউ নই
মেজর হায়দার নিখোঁজ হননি। তাঁকেও মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ আর কর্ণেল নাজমুল হুদার সাথে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর হত্যা করা হয়।
লেখা আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম। অনেক ধন্যবাদ।
এতদিন ঝাপসা প্রিন্ট দেখেই সন্তুষ্ট থেকেছিলাম। এরকম ঝকঝকে প্রিন্ট আছে জানতামই না। পোস্টের জন্য আপনাকে আর লিংকের জন্য মনমাঝিকে ধন্যবাদ। এটা সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোন সেক্টর কমাণ্ডারের একমাত্র তথ্যচিত্র।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
দারুণ! (Y)তথ্যচিত্রের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা ভালো লাগলো ভাই।
আপনি নিজে কি ক্যামেরার পেছনে কাজ করা মানুষ নাকি?
আলোচনায় ব্যবহৃত কিছু র্টাম পড়ে সেরকমই লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ। লেখা আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
দরকারী পোষ্ট। ধন্যবাদ
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
চমৎকার লিখেছেন। বেশ অনেক দিন পর ভিডিওটা দেখে খুব ভাল লাগল। মুক্তির গানেও বেশ অনেকগুলো সত্যিকার দৃশ্য ছিল না?
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
ধন্যবাদ।
হ্যাঁ "মুক্তির গান" তথ্যচিত্রেও তৈরি দৃশ্যের সাথে বেশ কিছু সত্যিকারের দৃশ্য তো ছিলই।
সুন্দর লেখা, দামী লেখা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ।
লেখাতো প্রায় স্পয়নার রে ভাই
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
স্পয়লার?
কিছুটা স্পয়লারের মতো তো বটেই। তবে কথা হলো এটি তথ্যচিত্র, ফিকশন ফিল্ম না। ছবিটি বর্তমানে কোন হলেও চলছে না, তা ৪৪ বছর আগে তৈরি। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি মনে করি যারা ১৯৭১ নিয়ে আগ্রহী তারা এমন স্পয়লার গোছের বর্ণনা শুনে সেই সময়ের দুষ্প্রাপ্য সত্যিকারের দৃশ্যগুলো দেখার জন্য আরো বেশি আগ্রহী হবেন। তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু অনেকটা জানা হয়ে গিয়েছে বলে তা দেখা থেকে বিরত থাকবেন না। এই লেখা স্পয়লার হচ্ছে কিনা তা নিয়ে আমার মধ্যে এই চিন্তাগুলিই কাজ করেছে।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন