(হিমু ভাইয়ের এক মন্তব্যের রেশ ধরে এই লেখার সূত্রপাত। জীবনানন্দের মৃত্যু স্রেফ দূর্ঘটনা না আত্নহত্যা সে সম্পর্কে বিদ্যমান তথ্য এবং আমার নিজস্ব বিশ্লেষণের আলোকে যুক্তিগুলোকে গেঁথে ফেলার চেষ্টা করব এই লেখার মাধ্যমে। আজ দিলাম এর প্রথম কিস্তি।)
জীবনানন্দ যখন পড়ি তখন দুজন জীবনানন্দ আমার সামনে এসে দাঁড়ান; একজন জীবন সম্বন্ধে প্রাজ্ঞ ,প্রেম প্রকৃতি আর সৌন্দর্যের উপাসনায় নিবেদিত; সোনার কাঠি রূপার কাঠি হাতে বাংলা কবিতার এক অভিমানী রাজকুমার; যিনি তাঁর যাদুস্পর্শে পাঠকের হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেন অনুভূতির অতীত অপার্থিব এক সৌন্দর্যবোধ, বাংলা কবিতায় যোগ করেন নবতর উপমা আর জীবনবোধের এক নতুন রাজ্য। এই অমিত শক্তিধর কবি এবং রহস্যময় পুরুষের পাশে অধোমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি বৈষয়িক জীবনে পরাস্ত ,সামাজিকতায় অনভ্যস্ত, জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত ,দাম্পত্যজীবনে অসংবেদনশীলতার মর্মবেদনায় পীড়িত সাদামাটা চেহারার এক মধ্যবয়স্ক বাঙ্গালীকে। রাজকুমারের মন হুহু করা কোন বাঁশীর সুরে নতমুখের এই জীবনানন্দ যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন- ঠিক তখনই আমার মত প্রজাকে খুঁজে বেড়াতে হয় রাজপুরীর অভ্যন্তরের ইতিহাস।
‘জীবনানন্দ সংসারজীবনে সুখী ছিলেন না’- এই সন্দেহটা কবির পরিবার ছাড়িয়ে পাঠক মহলে অনুরণিত হতে শুরু করে ট্রাম দূর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর পর। ১৫ই অক্টোবর ১৯৫৪ সালে সে দূর্ঘটনার কিছুক্ষন আগে কবির সাথে সময় কাটিয়ে আসা সুবোধ রায়ের জবানিতেই শোনা যাক ঘটনার বিবরণঃ
“সুস্থ সবল জলজ্যন্ত মানুষ। এই সেদিনেও মানে ঘটনার দিনেও কত গল্প করে এলাম। বেতারে ঠিক তার আগের দিন ‘মহাজিজ্ঞাসা’ আবৃত্তি করেছেন জীবনানন্দ দাশ। কেন কি জানি, আমার মতামতের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলেন জীবনানন্দ। তাই সরাসরি অফিস ফেরতাই চলে গেলাম জীবনানন্দের কাছে।
আলোচনা হল অনেকক্ষণ। শ্রীকুমুদ মল্লিক , করুণা নিধান, বনফুল, সজনীদাস, সুধীনদত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, জীবনানন্দ, প্রত্যেকের কবিতা, তাঁদের বাকশুদ্ধি, বাচনভঙ্গি সব কিছুর পুংখানুপুংখ আলোচনা। কারো কারো আয়ত্তাতীতে কৌতুকোদ্দীপক ত্রুটির কথাও উল্লেখ করলাম। এসব কথা রসযুক্ত করে বললে আর রক্ষে নেই। একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়েন কবি।..................।
লঘু আলাপ আলোচনায় কাটে আরও কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়াতেই বললেন, ‘আসছেন তো আবার? আমি কিন্তু অপেক্ষা করছি’
ইনফ্লুয়েঞ্জার জের ছিল সেদিনও আমার। বললাম, ‘আজ আর নয়; বড্ড ক্লান্ত। আপনি বরং একাই যান আজ’।
নাছোড়বান্দা জীবনানন্দঃ ‘না-না ক্লান্তি আবার কীসের? হাঁটলেই ঠিক চাঙ্গা হয়ে উঠবেন । চলুন – অপেক্ষা করছি , আসুন শীগগির।’
সম্মত হলাম না তবু। ‘না’ বললাম জোর করে।
তবু কষ্ট হলো। অস্বস্তি বোধ করছিলাম বাড়ি এসে। নাঃ যাই। বললেন এত করে কবি!
সামান্য কিছু মুখে দিয়ে, পোশাক বদলাতে যেটুকু সময় লাগে; এই দশ বারো মিনিট পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ল্যান্সডাউনে কেবল পা বাড়িয়েছি। দেখি, ফ্যাকাশে-অস্বাভাবিক চেহারা হন্তদন্ত হয়ে রঞ্জু আমারই কাছে ছুটে আসছে- কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয়তম সন্তান-‘জানেন, সর্বনাশ হয়েছে। বাবাকে এইমাত্র হাসপাতালে নিয়ে গেল।’
..... ‘কে বলেছে? কার কাছে খবর পেলে? তোমার বাবাই যে জানলে কী করে?’
‘জলখাবার থেকে এক ভদ্রলোক এসে খবর দিয়ে গেলেন।’
আর কথা নয় । ছুটলাম রঞ্জুকে নিয়ে তখুনি ‘জলখাবারে’র দিকে। রাসবিহারী য়্যাভিনূর ওপর টুকরো টুকরো ভিড় তখনো এখানে- ওখানে ছড়ানো। খবর সংগ্রহ করলাম একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে।
স্থির নিশ্চয় হলাম ‘জলখাবারে’র সত্বাধিকারীর ভাই শ্রী চুনিলাল দে’র মুখে নির্ভুল বিস্তারিত খবর পেয়ে। শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই নন, এই শোচনীয় দূর্ঘটনার প্রথম থেকেই প্রাথমিক চিকিৎসায় তিনি সজ্ঞান, আন্তরিক সাহায্য করেছিলেন। ঘটনাটা এইরকম-
‘জলখাবার’ ‘জুয়েল হাউজের’ সামনে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছিলেন জীবনানন্দ দাশ। শুধু অন্যমনস্ক নয়, কী এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন কবি। চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম স্পটিং স্টেশন থেকে তখনো প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে। অবিরাম ঘণ্টা বাজানো ছাড়াও বারংবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিল ট্রাম ড্রাইভার। যা অনিবার্য তাই ঘটলো। গাড়ি থামল তখন, প্রচন্ড এক ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গেই কবির দেহ যখন ক্যাচারের ভিতর ঢুকে গেছে। ক্যাচারের কঠিন কবল থেকে অতি কষ্টে টেনে হিঁচড়ে বার করলেন সবাই কবির রক্তাপ্লুত, অচেতন দেহ। কেটে, ছিঁড়ে থেঁতলে গেছে এখানে সেখানে।।....... চুরমার হয়ে গেছে বুকের পাঁজরা, ডান দিকের কটা আর উরুর হাড়।
ধরাধরি করে সবাই মিলে কবির বেহুঁস দেহ নিয়ে গেলেন রাস্তার ওপারে। তার পরে জল, বাতাস, বরফ.. ধীরে ধীরে কিছুক্ষণ পর সংজ্ঞা ফিরে পেলেন কবি, ‘কী হয়েছে? আমি এখানে কেন?’
‘হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।’- কে একজন বলল।
‘আপনার নাম, ঠিকানা কী?’ আরেকটি প্রশ্ন।
‘জীবনানন্দ দাশ। ১৮৩, ল্যান্সডাউন রোড।’ খানিক এধার- ওধার তাকালেন’ আমি এখন বাড়ি যেতে পারি?’
‘তা, যেতে...হাঁ, যেতে পারেন বৈকি।’ বললেন কে একজন।
উঠতে গিয়েই ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন। ছাতু হয়ে গেছে ডান পা। যেমন-তেমন জখম নয়, এবার বুঝলেন সবাই... তক্ষুনি ডাকা হল ট্যাক্সি। উপচিকীর্ষু মন নিয়ে এগিয়ে এলেন ডোভার লেনের এক কর্তব্যপরায়ণ তরুন, শ্রী বিমলেন্দু শীল, ঐ ট্রামেরই অন্যতম যাত্রী।সঙ্গে গেলেন শ্রী চুনিলাল দে এবং আরো দু’একজন। একজন পুলিশও।”
শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে দু নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় কবিকে। খবর পেয়ে দেখতে আসেন অনেকেই। এসে পড়েন কবির নিকটাত্নীয় স্বনামধন্য চিকিৎসক শ্রী অমল দাশ, এবং আরেকজন খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ ডঃ এ.কে.বসু।
“ডাক্তার অমল দাশকে দেখে ধড়ে প্রাণ এলো কবির, ‘কে বুবু? বুবু এসেছিস? বাঁচিয়ে দে....’শিশুর মতো অসহায় কণ্ঠ ‘বুবু, বাঁচিয়ে দে ভাই!’
২২শে অক্টোবর , শুক্রবার। সকাল থেকেই কথা বন্ধ হয়ে গেল কবির। কিছুই খাওয়ানো গেল না। .....তারপর একসময় রুদ্ধ হল সেই শ্বাস। চিরনিদ্রায় অভিভূত হলেন কবি! তখন রাত এগারোটা পঁচিশ”।
এই দূর্ঘটনা ,কবির দাম্পত্যজীবন আর সৃষ্টির বেদনা এদের যোগবিয়োগে কেন কবির মৃত্যুকে আত্নহত্যা বলা হয় সেই বিশ্লেষণ আগামী পর্ব থেকে করার চেষ্টা করব।
তবে আজ এইটুকু বলে যাই আমাদের এই কবিই লিখে গেছেন...
“ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি- এখন গভীর রাত
কবেকার কোন সে জীবন যেন টিটকারী দিয়ে যায়
‘তুমি যেন রডভাঙ্গা ট্রাম এক –ডিপো নাই, মজুরীর প্রয়োজন নাই’
কখন এমন হলে হায়!
আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে
কবেকার কোন সে জীবন ডুবে যায়।”
(ট্রামের লাইনের পথ ধরে- জীবনানন্দ দাশ)
(চলবে)
তথ্যসূত্রঃ১) জীবনানন্দ স্মৃতি – সুবোধ রায়
মন্তব্য
আত্মহত্যা বানান ভুল!
keyboard er barota bazse, on screen keyboard die likhchi.
so pardon me.
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
খাইছে!!! অন-স্ক্রীণ কি-বোর্ড দিয়া?
লেখা জটিল হয়েছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
=============================
তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা!
রাঙ্গা মাটির দেশে যা!
ইতাক তুরে মানাইছে না গ!
ইক্কেবারে মানাইসে না গ!
অজানা ছিল অনেক বিষয়। অনেক কিছুই জানলাম। আপনার উদ্যোগটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। চালিয়ে যান।
বিশ্লেষণ পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
আমি শুনেছি ঘটনার দিন কবির পকেটে টাকা-পয়সা কিছুই ছিল না। এ-কারণেও অনেকে দাবি করেন এটা ছিল পরিকল্পিত আত্মহত্যা। পরবর্তী পোস্টের জন্য প্রহর গুণছি।
জটিল চলুক চলুক।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
উদ্ধৃতি
‘কে বুবু? বুবু এসেছিস? বাঁচিয়ে দে....’শিশুর মতো অসহায় কণ্ঠ ‘বুবু, বাঁচিয়ে দে ভাই!’
বাঁচার আকুতি যাঁর কণ্ঠে তিনি আত্মহত্যা করবেন ভাবাই যায় না! মনে হয় এটি দুর্জনের প্রচার।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
দারুণ হচ্ছে ! জলদি পরের পোস্টটা দিয়ে দিন।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্ভবত বাংলাদেশে জীবনানন্দবিশেষজ্ঞদের একজন। এ সম্পর্কে তাঁর কিছু বিশ্লেষণ আছে বলে শুনেছিলাম, যদিও পড়িনি।
তপন রায়চৌধুরীর "বাঙালনামা"য় জীবননান্দের নাজুক পারিবারিক হাল নিয়ে সামান্য বর্ণনা আছে। তবে তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে রায় দেয়া হয়নি সেখানে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
ভাল হচ্ছে।
অজানা বিষয় জানার অপেক্ষায় আছি।
জীবনানন্দ আত্মহত্যা করেননি
মৃত্যুর এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন....
কী সব মন্তব্য যে করেন! একেবারে বেকুব হয়ে যাই।
ভাইজান আপনের মাথায় অত বুদ্ধি ক্যান?
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
খাইছে আমারে! অন স্ক্রিন কীবোড দিয়া এতবড় টাইপ করছিস? তোর জীবনানন্দ প্রীতি তো আমাকে ভীতি জোগাচ্ছে, শেষ পরযন্ত তুই ও যদি জীবনানন্দ ভাবতে ভাবতে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটা ধরিস...............
আবীর, অতন্দ্র প্রহরী,দৌবারিক, এস.এম. মাহবুব মুর্শেদ, জুলিয়ান সিদ্দিকী, রণদীপম বসু, হিমু,অনিন্দিতা, মাহবুব লীলেন (সবাইরে এক সাথে কী ডাকা যায় মাথায় আসছে না; তাই গণ)ভাইসহ সবাইকে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আশা করছি দ্রুতই দ্বিতীয় পর্ব দিতে পারব।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
২০০৮ সালে লেখা আমি ২০১৩ তে এসে পড়ছি। চরম আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। পরের পর্ব খুঁজতে যাচ্ছি। সচলে এতো অসাধারণ সব পুরনো লেখা আছে! না পড়লে আসলেই মিস!
মৃত্যুর ঘটনাটা পড়তে যেয়ে আমার চোখে জল এসে গেছে! সে যখনই মারা যেয়ে থাকুন না কেন জীবনানন্দ আমার কাছে জীবন্ত। প্রিয় কবি!
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
নতুন মন্তব্য করুন