চার - (শেষ কিস্তি)
তারুর বিয়ের পর থেকে কিনা কে জানে রীনারা তিনবোন বা পাড়ার অন্যান্য আবিয়াত মেয়েগুলি হয় তো বিয়েশাদীর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এইবার তো রীনাও পাক্কা ধরে নিয়েছিল পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরলে আম্মা তার ঠিক হওয়া বিয়ে দিয়ে হজ্বে করবে। প্রতিবার বিয়ের কথা হলে তাকে এই কথাই শুনতে হয়। এইবার রীনাও এক রকম কনর্ফাম মনে করেছিল- কারণ এই ছেলে তো গত দুইমাসে দুইবার তাকে দেখতে ঢাকা এসে ঘুরে টুরে রাস্তার পাশে ফুচকা খেয়ে গেছে। তখন এক আধবার আবছা আবছা মনে হওয়া ভয়টাকে সে পাত্তা দেয় নাই যে, শুকনা-ফ্যাকাশে উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা সাদেক আহাম্মদ মিয়া কি জানে যে রীনার বয়স আসলে বাইশ তেইশ কিংবা পঁচিশও না।
তারুর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় যখন তাকে একা একা বাজারের মধ্যে, কাটা কাপড়ের গলি, মুদির দোকান পার হয়ে শর্টকাটে কামারপট্টি তারপর আরেকটু ডাইনে হাঁটলে নির্জন রাস্তা যেখানে ঢাকার চালানঅলা ট্রাকগুলি এসে থামে, আর এইসব ট্রাকের রিভার্স বা ব্রেক চাপার দাপটে রাস্তার চোটলাগা চেহারা বিস্তর খানাখন্দে ভরা। তারপরও বাকী থাকে চৌরাস্তার মোড়, বাটা সু ষ্টোর, পার হলে ইষ্টিশান- সেইখানে তার সরকারী অনুদানের প্রতিশ্রুতিপ্রাপ্ত বালিকা বিদ্যালয়। তারু নাই, নুরুন্নবীর সঙ্গে গরুর পাল ঠেলতে নদীর ওইপার চলে গেছে। আর কেউ জুটলেও জুটতে পারতো, কিন্তু রীনাই আপত্তি করে- “কেউরে লাগবো না, আমি কি ছোট নিকি?”
-“তুই তো ছোটও না, বড়ও না, আর সেইটাই তো ঝামেলা”।
তবে রীনার গো ধরা – কেউরে লাগবো না’র- পর বিষয়টা অনিস্পত্তি হয়ে ঝুলে থাকলে সে নিয়মিত স্কুলে যায়- আসে।
উত্তরের কুয়াশাভরা হাড় কন কন করা শীতে তারা তিনবোন ফুলহাতা গোলাপী সোয়েটারের ওপর ওড়না দিয়ে মাথা জড়িয়ে দুইজন বাড়ির পেছন দিয়ে নদীর দিকে যায় আর রীনা সামনের গেট খুলে গলির শেষ মাথায় এসে বইগুলি দুইহাতে বুকে চেপে মাথা নীচু করে হাঁটে, সেইটাই নিয়ম। সালামতের বৌ বা অন্যরা প্রায়ই তাদেরকে হুশিয়ার করে-“কুজা হইয়া হাঁটবি”, আর মেয়েগুলা পারলে নিজেদের শরীরটাকে ইন্দুরের গর্তে লুকায়া ফালায়।
পাতলা কুয়াশায় থেমে থাকা ঢাকার চালানঅলা ট্রাকের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একদিন রীনার পথরোধ হয়। ড্রাইভার, বা হেল্পার কিংবা তাদের সংগীসাথী ঘুমভাঙ্গা উস্কোখুস্কো চুলে মাফলার পেঁচিয়ে রীনার পাশে পাশে দু এক কদম হাঁটে, দুই একটা কথা জিগায়-“এত সকালে ইশকুলে যাও শীত করে না?” রীনা তাদের মুখ দেখার চেষ্টা না করে হন হনিয়ে হাঁটতে থাকে। তারপরও একজন তার কব্জি চেপে ধরলে সে বই খাতা ফেলে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে একটা দৌড় দেওয়ার পরোয়া করতে চায়। লোক তিনটা, বা চারটা, হয়তো সবাই লোক না, চ্যাংড়া পোলাপানও আছে, কে জানে সেরু কামারের পোলা ও থাকতে পারে – অতকিছু চিন্তা করার উপায় তখন নাই, রীনা খালি জানে – দৌড় দেওয়া দরকার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ট্রাকের মাঝখান দিয়ে সোজা বাঁ দিকে যুব সংঘের পিছনে মনোহারী দোকানের গলি আর মানুষজন পাওয়া যাবে। কিন্তু মোচড় দিয়ে কব্জি ছাড়ানো গেলেও উড়ন্ত ওড়নার কোনাটা এদের কোন একজন ঠিক ঠিক ধরে ফেলে যা মাথায় ঘোমটা দেওয়ার পর রীনার গলায় দুই প্যাচে জড়ানো, গলায় টান পরলে সে সুতরাং, সঙ্গত কারণেই কঁকিয়ে ওঠে, নিজের অজান্তেই নাচের মত কয়েক পাক দিয়ে ওড়না ছাড়িয়ে আবার যখন দৌড় দিতে ঠিক করে তখন দেখে যে সে আসলে একটা ভুড়িওলা বেটামানুষের দুই হাতের মধ্যে ছটফট করছে। “আমারে ছাড়েন” এর সঙ্গে ফোঁপানি যুক্ত কান্না শুনে ভুড়িওলার দিলে রহম হয় নাকি তখনি সেরু কামারের পোলা একটা লাল রঙ্গের দা নিয়া পূর্বদিকে উদয় হয় – রীনার তা স্মরণে আসে না। তাকে বেড়ী করা হাতের বাঁধন শিথিল হচ্ছে অনুভব করে সে দৌড় দেয়।
বাসার টিনের গেটে যখন রীনা তার হাঁপানো নিঃশ্বাস হোঁচট খাওয়ায়- তখন তারুর মা হলুদ বাটা হাতে আলগা করে গেট খুলতে আসে। তার আম্মা হয় তো তখন বারান্দার নরম রোদে মোড়ায় বসে কুরুশ কাঁটা দিয়ে সাদা সায়ার লেস বোনে। মেয়ে সামনে এসে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লে-“কি রে স্কুল হয় নাই, আইসা পড়লি, ইত্যকার নিরুদ্বিগ্ন প্রশ্নে রীনা বিহ্বল বোধ করে এবং ঘটনার বর্ননা দিতে দিতে মুর্ছা যায়। না কিশোরী, না তরুনী মেয়ের জ্ঞান হারানোয় তাদের পাড়ার দৈনন্দিন নিস্তরঙ্গতায় কোন হেলদোল হয় না। সে বারান্দা থেকে ঘরে স্থানান্তরিত হয়। সোনা রূপা ধোয়া পানি খেয়ে বিশ্রাম করতে করতে দুপুরের খাওয়ার সময় হলে ডাকতে এসে রীনার আম্মা দেখে মেয়ের তুলকালাম জ্বর।
মাথায় পানি ঢালা, জলপট্টি এইসবে জ্বর নেমে না গেলে পরদিন ডাক্তার না ডেকে উপায় থাকেনা। পরদিন রীনার দুইবোন স্কুলে যায় আর আব্বা আতাইকুলা গেছে, সুতরাং তারুর মাকে দিয়ে দোকানের কর্মচারী ফজলুকে খবর পাঠাতে হয় এবং ফজলু তারপর অসুখের বিবরণ শুনে, এম বি বি এস ডাক্তার আমিনের ডাক্তারী ব্যাগ দুহাতে জড়িয়ে ডাক্তারের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে তাকে বাসায় নিয়ে আসে। ফজলুর কাছে অসুখের বিবরণে শুধু চড়া জ্বরের কথা উল্লেখ করা হয়, কিন্তু ডাক্তার যখন গলায় বুকে ষ্টেথিস্কোপ আর মুখের ভেতর থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপে তখন রীনা হয়তো দুই একটা ভুল বাক্য বলে থাকলেও থাকতে পারে, তা না হলে রোগী দেখা শেষ করে সাবান গরমপানি দিয়ে বারান্দার কোনায় হাত ধুয়ে নিজের রুমালে মুছতে মুছতে ডাক্তার এই প্রশ্নটা কেন করবে-“ আপনের মেয়ে কি কোন কারণে ভয় ট্য় পাইছিল নাকি?” স্বামীর অনুপস্থিতিতে মেয়ের অসুখ- রীনার আম্মার কান্না পায় এবং মনে হয় যে ডাক্তার আর উকিলের কাছে কোন কিছু গোপন করা উচিত না। সব শুনে আমিন ডাক্তার – “কি বলেন, রেপ টেপ হয় নাই তো”? বলে উঠলে রীনার আম্মা ততক্ষনাত মনে মনে আফসোস করে। রেপ শব্দের মানে না বুঝতে পারার কোন কারণ তার নাই। পুলিশের নাম উচ্চারণে কান্নার গমক বাড়ে তার। ডাক্তারকে বলতেই হয় যে – আসলে কি হইছে, না হইছে কিছুই সে জানেনা, দুই দিন পর মেয়ের আব্বা ফিরা আসলে কি করবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
আব্বা বাড়িতে আসে ডাক্তারী ওষুধপত্র পেটে যায়, কিন্তু তিন মাসেও জ্বর ভালো হয় না, খাওয়া দাওয়া বন্ধ, বিছনার সাথে মিইশা যাইতে থাকে রীনা। অগত্যা পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার ঢাকা যাওয়া, অগত্যা স্কুল কামাই, আর ফলাফলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা ড্রপ আউট।
তারপর দুই তিন বচ্ছর কি বনবাসে ছিল সে? কিরণ মালার মতো? মনে করতে পারে না দেখে রীনার ভালোই লাগে। মাইনষে শুনলে কি কইবো- এই বাক্যটা যখন তার গায়ের গন্ধ হয়ে তার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে তখন একদিন বর্ষা শেষে শুকনা খটখটা জমির আইলের আনন্দটা নিজের ভেতরে টের পেয়ে নিজেই অবাক হয় আর দেখে যে মানুষের কথাকে সে আর আমলে আনছে না। আম্মা যতই ভয় দেখাক তার আবারো ঘর থেকে বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে। সেইটা কি নানীর ফুপাতো বোনের কোরিয়া ফেরত নাতি লোকমান আইসা বাড়ির সবাইকে নিয়ে পদ্মার পাড়ে বেড়ায়া, গাবায়া, উপহার দিয়া তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেললো, নাকি তার ভিতরে একটা ইচ্ছা শাদা দুলফি ফুলের মত বাইরে আসার জন্য তির তির করে বড় হয়ে বসেছিল সুযোগের অপেক্ষায়, রীনার বোঝার দরকার নাই, সে বুঝতে চায় না। মাথা যে আউলা হইছিল আর খালি খালি কতগুলি বছর লস, আফসোস হয়।
এর আগে যে পাত্রের সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা এগিয়েছিলো, সেই মঞ্জুর, কয়দিন এসে হল গেটে দেখা করলো, টি এস সির মাঠে বসে বাদামের চোকলা ফু দিয়ে উড়িয়ে মুখভর্তি আধাচাবানো চিনাবাদাম নিয়ে জানিয়েছিল যে সে যৌতুক চায় না, চাকরিজীবি একটা মেয়ে বিয়ে করতে চায়। তারপর থেকে কত পরীক্ষাই না রীনা দিলো, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, ব্র্যাক, প্রাইমারী স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি জায়গায় কেরানির পদ, কি বাদ দেয় নাই। ইতিহাস, দর্শন এইসব বিষয়ে ডিগ্রী দিয়া চাকরী পাওয়া যায় না, কিন্ত দর্শনের নোট মুখস্থ করা রীনা এখন কারে জিজ্ঞাসা করে যে একটা চাকরীর অভাবে তার বিয়েটা কেন হয় হয় করে করে হয়না?
রীনার ভাবনা বেশীক্ষণ স্থির হয়ে থাকে না, পানির ওপরে ঢিল পড়ে ঢেউ সরে যাওয়ার মত সেও একটা থেকে অন্য একটা ভাবনাতে পাক খায়, শ্লথ ঘোরাঘুরি করে সামনে, পেছনে। রিক্সা গ্রীন রোডে জ্যামে আটকা পড়লে বেতের ফার্নিচারের দোকানে রীনা সব সময়ই বিমোহিত চোখে তাঁকায়। কতদিন জ্যামে আটকা পড়া একঘেয়ে নাতিদীর্ঘ দুপুর রীনা বেতের ফার্নিচার দিয়ে ঘর সাজানোর আপাতঃশৌখিন সাধটা নিয়ে নাড়া চাড়া করেছে মনের মধ্যে। আম্মা যদি তার বয়সটা ছেলে পক্ষের কাছে একটু কমায়া বলতো! কে আর অত খোঁজ খবর করতো, একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সে চাকরীর বিজ্ঞাপনে দাগ দেওয়া বাদ দিয়ে পত্রিকার রূপচর্চা বিভাগ পড়া আর ঘর সংসার সাজানোয় মন দিতে পারতো। প্রথমেই সে এই রকম একটা বড় সড় আয়না কিনতো।
রিক্সার ভীড়, চারপাশের শব্দ আর দুই চার রকম বাতির আলোতে বাতাস কেমন হলুদ ঘোলা ঘোলা লাগে রীনার কাছে। দোকানের সামনে ঝোলানো ডিমের মত আয়নার ফ্রেম ভালো করে দেখতে গেলে রীনা আবারো চমকায়। তার মত ইট রঙ্গের সালোয়ার কামিজ পরা মাথায় পাকা চুল, মুখের চামড়া কুচকানো এক বুড়ি রিক্সায় বসা। সে হাত দিয়া মাথা চুলকায় তো বুড়িও হাত উঠায়। রীনা হাসি দেয় তো বুড়িও হাসি দেয়। তার ফোকলা দাঁত পোকায় কাইটা ফালাইছে।
হলুদ আক্রান্ত- এক
http://www.sachalayatan.com/naharmonica/25216
হলুদআক্রান্ত- দুই
http://www.sachalayatan.com/naharmonica/25363
হলুদ আক্রান্ত-তিন
http://www.sachalayatan.com/naharmonica/25509
মন্তব্য
খুব ভাল গল্প লিখেছেন। আরো লিখুন।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
বেশ লাগল
খুব ভালো লাগলো
ঠিক এরকম গল্প লিখুন আরো অনেক
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আগে মন্তব্য করা হয় নি৷ এই সিরিজটা অসম্ভব ভাল লাগল৷
-------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ভাল লাগল পুরো গল্প
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
খুব চমৎকার একটা লেখা পড়লাম। কিন্তু এই শেষপর্বটা লেখার সময় কী জলদি শেষ করার কোন তাড়া ছিল ?
আশা রাখছি এইরকম আরো কিছু অসাধারণ লেখা পাবো আপনার কাছ থেকে।
নতুন মন্তব্য করুন