ফুল ভালবাসত যে লোকটা

অবনীল এর ছবি
লিখেছেন অবনীল (তারিখ: শুক্র, ২৭/০৩/২০০৯ - ৭:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৬৩ সালের মে মাসের এক সদ্যাগত সন্ধ্যায়, নিউ ইয়র্কের থার্ড এভিনিউ দিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলছিল এক যুবক। আবহাওয়াটা ছিল নরম আর সুন্দর। আকাশটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছিল নীল থেকে শান্ত, মনোরম গোধুলীর বেগুনি রঙে। অনেকে আছেন যারা শহর-প্রেমিক, এরকম এক রাতেই তারা প্রথম মজেছিলেন সেই প্রেমে। ডেলিক্‌টেসনগুলোর দরজায় সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে। ড্রাই-ক্লিনিংএর দোকান আর রেস্টুরেন্টগুলো যেন হাসছিল। একটা পুরোনো বেবি প্রামে দুটো ব্যাগভর্তি কাঁচাবাজার নিয়ে ঠেলতে থাকা এক বয়স্ক মহিলা যুবকটার দিকে দাঁত বের করে হাসলো। ডাক দিলো, “হেই, বিউটিফুল!” যুবকটা একটা একপেশে হাসি হেসে হাত নাড়লো।

মহিলা তার পথে চলে গেলেন, ভাবলেনঃ ছেলেটা প্রেমে পড়েছে

ওর চেহারায় একটা ব্যাপার ছিল। গায়ে হালকা ছাই রঙের একটা স্যুট, চিকন টাই অল্প টেনে নামানো, কলারের বোতাম খোলা। চুল কালো, ছোট করে ছাঁটা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল, হালকা নীল চোখ। অসাধারন কোন চেহারা না। কিন্তু বসন্তের এই নরম সন্ধ্যায়, এই এভিনিউয়ে, ১৯৬৩ সালের মে মাসের এই দিনে, সে ছিল সুন্দর। বয়স্ক মহিলাটি মুহুর্তের এক মধুর নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলেন। ভাবতে লাগলেন, বসন্তে চাইলে যে কেউ সুন্দর হতে পারে, যদি প্রেয়সীর সাক্ষাত পেতে কেউ এভাবে উদগ্রীব হয়ে ছোটে। প্রিয়তমার সাথে ডিনারে, আর হয়ত তারপরের নাচের আসরে যোগ দিতে। বসন্ত হচ্ছে একমাত্র মৌসুম যখন নস্টালজিয়া যেন কখনোই তিক্ত নয়। মহিলাটি তার পথে চলে গেলেন। খুশি, যুবকের সাথে কথা বলেছেন। খুশি, যুবকটি তার প্রশংসা ফিরিয়ে দিয়েছে এক হাফ-সেলুটে।

যুবকটি সিক্সটি-থার্ড স্ট্রীট পেরুলো। প্রতি পদক্ষেপে হালকা লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছিল সে। ঠোটের কোনায় সেই একপেশে হাসি। কয়েক ব্লক সামনে এক বুড়োলোক ফুলভর্তি চল্‌টা ওঠা সবুজ রঙের একটা হ্যান্ডকার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কার্টের ফুলের মধ্যে হলুদরঙের প্রাধান্যই বেশি, হলুদ জ্বরে আক্রান্ত জঙ্‌কুইল আর পূর্ণ প্রষ্ফুটিত ক্রোকাস। আরো আছে কার্নেশন আর কিছু হটহাউস টি রোজ। বেশিরভাগই হলুদ আর সাদা। প্রেৎসেল খেতে খেতে হ্যান্ডকার্টের কিটি কর্ণারে রাখা একটা স্থুলকায় ট্রানজিস্টর রেডিও শুনছিল বুড়োলোকটা।

ক্রমাগত দূঃসংবাদ প্রচার করে যাচ্ছিল রেডিওটা। অবশ্য কেউ তাতে কান দিচ্ছিল নাঃ এক হ্যামার মার্ডারার এখনও পলাতক; জেএফকে ঘোষণা দিয়েছেন ভিয়েতনাইন (সংবাদ পাঠক বলছিল ‘ভিয়েত-নান’) নামের ছোট্ট এশিয়ান দেশটার অবস্থায় নজর দেওয়া প্রয়োজন; ইস্ট রিভার থেকে অজ্ঞাতনামা এক মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে; হেরোইনের বিরদ্ধে যুদ্ধরত সিটি এডমিনিস্ট্রেশনের এক গ্রান্ড জুরি ড্রাগলর্ডকে অভিযুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে; রাশিয়ানরা একটি পারমানবিক বোমা বিস্ফোরিত করেছে। এগুলোর কোনটাই বাস্তব মনে হচ্ছিল না। এসবের কোনটাতেই যেন কিছু যায় আসে না। নরম, মিস্টি আবহাওয়া। বেকারির সামনে ভুড়িওয়ালা দুইজন লোক দাঁড়িয়ে, কয়েন ছোড়াছুড়ি খেলায় আর একে অন্যকে খোঁচায় ব্যস্ত। গ্রীষ্মের কোনায় বসন্ত কেঁপে উঠছিল। আর শহরে, গ্রীষ্ম হচ্ছে স্বপ্নের মৌসুম।

যুবকটা ফুলের দোকানটা পেরুতেই দূঃসংবাদের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। ইতঃস্তত করলো সে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, চিন্তা করে দেখলো। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে আবার ভেতরের জিনিসটা ছুঁল। কিছুক্ষনের জন্য ওর চেহারা মনে হল যেন বিভ্রান্ত, নিঃসঙ্গ, অনেকটা ভূতে পাওয়া। তারপর, পকেট ছেড়ে হাত বার করতে করতে চেহারায় আবার সেই আগের অধীর আকাঙ্খার অভিব্যক্তিটা ফিরে আসলো।

ফুলের দোকানটার দিকে ঘুরলো সে। মুখে হাসি। প্রেয়সীর জন্য কিছু ফুল নিয়ে যাবে। সে খুশি হবে। সারপ্রাইজ পেয়ে বিস্ময় আর আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা সেই চোখ দুটো দেখতে ভালোবাসে যুবকটা। তবে সারপ্রাইজ হিসেবে ছোটখাট জিনিসই দেয় সে। ও তো মোটেই বড়লোক না। কখনও একবাক্স চকলেট। কখনও একটা ব্রেসলেট। একবার দিয়েছিল শুধু এক ব্যাগ ভ্যালেন্সিয়ার কমলা, জানে ওগুলো নরমা-র খুব প্রিয়।

“মাই ইয়াং ফ্রেন্ড,” ছাইরঙা স্যুট পরা মানুষটা ফিরে আসতে ফুলবিক্রেতা বলে উঠলো। হ্যান্ডকার্টে রাখা ভান্ডারে দ্রুত চোখ বুলালো সে। বিক্রেতার বয়স আটষট্টির মত হবে, সন্ধ্যার ঈষদুষ্ণ আবহাওয়া সত্ত্বেও গায়ে একটা ছেঁড়া, হাতে বোনা সোয়েটার। মাথায় নরম ক্যাপ। চেহারা যেন বলিরেখার মানচিত্র, চোখদুটো গভীরে নিমজ্জিত, আঙ্গুলের ফাঁকে অস্থির একটা সিগারেট। কিন্তু তারও মনে পড়ে গেল বসন্তের যৌবনমুখর দিনগুলোর কথা। নবীন আর ভালোবাসায় এমনভাবে সিক্ত সেই দিনগুলোতে সত্যিকার অর্থেই যেন ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো চারিদিকে। বিক্রেতার চেহারা স্বভাবতই রুক্ষ, কিন্তু এখন সে হাসলো একটু, কাঁচাবাজার ঠেলে নিয়ে যেতে থাকা বয়স্ক মহিলাটি যেভাবে হেসেছিলো, কারন যুবকের ঘটনা একেবারে পরিস্কার। ঢোলা সোয়েটারের সামনে থেকে প্রেৎসেলের গুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে ভাবলোঃ যে ডোজে ছেলেটা প্রেমে হাবুডুবে খাচ্ছে, এখন যদি সেই একই ডোজে তার অসুখ হত, এতক্ষনে তাকে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে রাখতে হত।

“ফুল কত করে আপনার?” যুবকটা জিজ্ঞেস করলো।

“তোমাকে এক ডলারে আমি সুন্দর একটা বুকে করে দিতে পারি। এগুলো টি রোজ, এগুলো হটহাউজ। একটু বেশি দাম, পার পিস সত্তর সেন্ট। তিন ডলার পঞ্চাশ সেন্টে তোমাকে আধা ডজন দিতে পারি।”

“বেশ দাম,” যুবকটা বল্লো।

“ভালো কোন কিছুই সস্তা হয়না, ইয়াং ফ্রেন্ড। কি তোমার মা শিখায়নি কখনও?”

যুবকটা দাঁত বের করে হাসলো। “বলেছিল মনে হয়।”

“অবশ্যই। অবশ্যই বলেছেন। আধা ডজন দিচ্ছি তোমাকে, দুটো লাল, দুটো হলুদ, দুটো সাদা। এর থেকে আর ভালো হয়না, কি বল? কিছু বেবিস ব্রেথ দিয়ে দাও – ওরা খুব ভালোবাসে – আর কিছু ফার্ণ দিয়ে ভরে দাও। চমৎকার। নাহলে এক ডলারে একটা বুকে পেতে পার।”

“ওরা?” যুবকটা জিজ্ঞেস করলো, মুখে এখনও হাসি।

“মাই ইয়াং ফ্রেন্ড,” সিগ্রেটের গোড়াটা আঙ্গুলের আলতো টোকায় ড্রেনে ফেলে, মুখে হাসি ফিরিয়ে নিয়ে ফুল বিক্রেতা বল্লো, “কেউ মে মাসে নিজের জন্য ফুল কেনে না। এটা ন্যাশনাল ল’ এর মত, বুঝতে পারছ কি বলতে চাইছি?”

যুবকটা নরমা-র কথা চিন্তা করলো। আনন্দিত, বিস্মিত চোখ আর এক স্নিগ্ধ হাসি ভেসে উঠলো মানস্পটে। অল্প একটু মাথা নিচু করলো সে। “মনে হয় পারছি,” বল্লো সে।

“অবশ্যি পারছ। ত কি বল?”

আপনার কি মনে হয়?”

“তোমাকে বলছি আমার কি মনে হয়। পরামর্শ ত এখনো ফ্রী, তাই না?”

যুবকটা হাসলো, “মনে হয় শুধু ওটাই বাকী আছে।”

“আলবাৎ,” ফুল বিক্রেতা বল্লো,“ওকে, মাই ইয়াং ফ্রেন্ড। এই ফুল যদি তোমার মার জন্য হয়, তাহলে একটা বুকে নাও। কিছু জঙ্কুইল, কিছু ক্রোকাস, কিছু লিলি অফ দ্য ভ্যালি। সব নষ্ট করে দিয়ে উনি বলবেন না, “ওহ্‌ জুনিয়র আমার খুবই পছন্দ হয়েছে - কত নিল - ওহ্‌, এত অনেক বেশি – অযথা টাকাপয়সা নষ্ট না করার মত যথেষ্ট জ্ঞান কি এখনও হয়নি তোমার?”

যুবকটা মাথা পেছনে হেলে সশব্দে হেসে উঠলো।

বিক্রেতা বললো,“কিন্তু সে যদি তোমার প্রেমিকা হয়, তাহলে ভিন্ন ব্যাপার মাই সান, তুমি ত জান। তার জন্য টি রোজ নিয়ে যাও, সে তোমার একাউন্ট্যান্ট সাজবে না, বুঝতে পারছ কি বলতে চাইছি? আরে! সে তোমার গলা জড়িয়ে ধরবে-”

“টি রোজ দেন আমাকে,” যুবকটা বললো। এইবার ফুলবিক্রেতার হাসবার পালা। কয়েন ছোড়াছুড়ি খেলতে থাকা লোক দুজন এক পলক তাকালো, মুখে হাসি।

“হেই, কিড!” ওদের একজন ডাক দিল। “সস্তায় বিয়ের আংটি কিনবে? আমারটা বিক্রি করে দেব তোমার কাছে...আমার আর দরকার নাই।”

যুবকটি দাঁত বের করে হাসলো। ওর কালো চুলের গোড়া পর্যন্ত লজ্জায় আরক্ত হলো।

ফুলবিক্রেতা ছয়টা টি রোজ বেছে, লতাপাতা একটু ছেঁটে, পানি স্প্রে করে, বড় একটা চোঙাক্ৃতির পাতলা কাগজে মুড়ে দিল।

“আজকের আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে একবারে আপনার মনের মত,” রেডিওটা বলে উঠলো। “শান্ত আর মনোরম, তাপমাত্রা ষাটের মাঝামাঝি থেকে একটু ওপরে। ছাদে বসে তারা দেখার জন্য একবারে যথোপযুক্ত, যদি রোমান্টিক হয়ে থাকেন আপনি। এনজয়, গ্রেটার নিউ ইয়র্ক, এনজয়!”

ফুলবিক্রেতা প্যাঁচানো কাগজটার জোড়মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিল। যুবককে বলে দিল যেন তার ওকে বলে দেয় পানিতে যদি একটু চিনি দিয়ে ফুলগুলো তাতে রাখে তাহলে ওগুলো অনেকদিন টিকবে।

“আচ্ছা বলব,” যুবকটা বল্লো। একটা পাঁচ ডলারের নোট এগিয়ে দিল। “ধন্যবাদ।”

“এটাই ত আমার কাজ, মাই ইয়াং ফ্রেন্ড,” বিক্রেতা বললো। এক ডলার আর দুই কোয়ার্টার ফেরত দিল। তার হাসিটা একটা বড় S-এর আকার নিল-“আমার পক্ষ থেকে ওকে একটা কিস দিও”।

রেডিওতে ফোর সিসন্স ‘সেরি’ গাওয়া শুরু করেছে। ভাংতি টাকা পকেটে পুরে রাস্তা ধরে সামনে এগোতে লাগলো যুবকটি। চোখদুটো সম্পূর্ন খোলা, সজাগ এবং উদগ্রীব। থার্ড এভিনিউ এর ভেতরে আর সামনের দিকে ভাটার মত প্রবাহমান জীবনের স্রোতের দিকে তাদের দ্ৃষ্টি নেই। তারা প্রত্যাশায় পরিপূ্র্ণ। কিন্তু কিছু জিনিস ঠিকই ব্যাঘাত ঘটালোঃ একটা বাচচাকে ওয়াগনে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকা এক মা, বাচচাটার চেহারা হাস্যকরভাবে আইসক্রিমে মাখানো; ছোট্ট একটা মেয়ে স্কিপিং করছে, সুর করে ছড়া কাটছেঃ ‘বেটি এন্ড হেনরি আপ ইন এ ট্রী, কি-স-ইং! ফার্স্ট কামস লাভ, দেন কামস ম্যারেজ, হিয়ার কামস হেনরি উইদ আ বেবি ক্যারেজ!’ ওয়াশাটেরিয়ার সামনে দুজন মহিলা দাড়িয়ে, ধুমপানরত আর অন্তঃসত্তা অবস্থা নিয়ে তুলনায় ব্যস্ত। একটা হার্ডওয়ার স্টোরের জানালার সামনে কিছু লোক দাঁড়িয়ে চার অংকের প্রাইস ট্যাগওয়ালা বিশাল একটা কালার টিভির দিকে তাকিয়ে – একটা বেসবল খেলা চলছে, খেলোয়াড়দের সব দেখাচ্ছিল সবুজ, খেলার মাঠ হালকা স্ট্রবেরি। টপ নাইনথে নিউ ইয়র্ক মেটরা ফিলিসদের থেকে ছয়-একে এগিয়ে।

সে হেঁটে চললো, খেয়াল করল না পেপার ভর্তি টী রোজ নিয়ে সামনে দিয়ে হেটে যাবার সময় ওয়াশাটেরিয়ার সামনে দাড়ানো দুই মহিলা মুহুর্তের জন্য কথা বন্ধ করে দিল। বিষন্ন, ব্যাকুল এক দ্ৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। তাদের ফুল পাবার দিন চলে গেছে অনেকদিন আগে। খেয়াল করলো না একজন তরুন ট্রাফিক পুলিশ তীব্রভাবে হুইসেল দিয়ে থার্ড আর সিক্সটি-নাইনের ইন্টারসেক্সনের গাড়িগুলোকে থামিয়ে তাকে রাস্তা পার হতে দিল। পুলিশটি নিজে এনগেজড। যুবকের চেহারার স্বপ্নীল অভিব্যক্তি সে চিনতে পেরেছে তার নিজের শেভিং মিরর থেকে। আজকাল যা প্রায়ই দেখতে পায় সে। খেয়াল করলো না উল্টো দিক থেকে হেটে আসতে থাকা দুজন কিশোরী নিজেদের আঁকড়ে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

সেভেনটি-থার্ড স্ট্রীটে এসে থামলো সে, ডানদিকে মোড় নিল। এই রাস্তাটা অল্প অন্ধকার, সারি সারি ব্রাউনস্টোন আর ইতালিয়ান নামওয়ালা ওয়াক-ডাউন রেস্টুরেন্ট। তিন ব্লক দূরে, আবছা আলোয় একটা স্টিকবল খেলা চলছিল। যুবকটা অতদূর গেল না, হাফ ব্লক গিয়ে একটা সরু লেনে মোড় নিল।

তারারা বের হয়ে এসেছে এখন, নরমভাবে জ্বলজ্বল করছে। লেনটা অন্ধকার, ছায়াময়। নানা আকৃতির গার্বেজ ক্যান সারি করে রাখা। যুবকটা এখন একা – না, একেবারে একা নয়। দ্বিধাগ্রস্ত এক আর্তনাদ জেগে উঠলো রক্তাভ, অস্পষ্ট অন্ধকারে। যুবকটা ভ্রু কোঁচকালো। কোন হুলোবেড়ালের প্রেমসঙ্গীত। সৌন্দর্য্যের কোনই ছিটেফোটা নেই তাতে।

তার হাটার গতি আরো মন্থর হলো। ঘড়ির দিকে একপলক তাকালো সে। সোয়া আটটা বাজে, যেকোন মুহূর্তে নরমা...ঠিক তখনই তাকে দেখলো ও। কোর্টইয়ার্ড থেকে তার দিকে আসছে। গায়ে গাঢ় নীল স্ল্যাক্স আর সেইলর ব্লাউজ। তার হৃদয়ে ব্যথার সৃষ্টি করলো এই দ্ৃশ্য। প্রথমবারের মত নরমাকে দেখা সবসময়ই একটা চমক, সবসময়ই মিষ্টি একটা শক – সে এত ইয়াং!
এবার দীপ্তিময় হয়ে উঠলো ওর হাসি – বিকীরন ছড়াতে লাগলো। দ্রুত হাটতে লাগলো সে।

“নরমা!” সে বললো।

মেয়েটি মুখ তুলে তাকিয়ে হাসলো...কিন্তু কাছে আসতে আসতে হাসিটা মুছে গেল।

যুবকের হাসিটা অল্প কেঁপে উঠলো। মুহুর্তের জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করলো। সেইলর ব্লাউজের উপরের চেহারাটা হঠাৎ যেন মনে হলো অস্পষ্ট। আরো অন্ধকার হয়ে এসেছে এখন...ও কি ভুল করলো? নিশ্চই না। এটাই নরমা।

“ফুল নিয়ে এসেছি তোমার জন্য,” সুখময় এক স্বস্তিতে বলে উঠলো সে। কাগজের মোড়কটা মেয়েটির হাতে দিল।

মেয়েটা এক মুহুর্তের জন্য ফুলগুলোর দিকে তাকালো। হাসলো – আর ওর হাতে ফেরত দিয়ে দিল।

“ধন্যবাদ, কিন্তু আপনি ভুল করছেন,” মেয়েটি বললো। “আমার নাম-” “নরমা”, যুবকটা ফিসফিস করে বললো, আর কোটের পকেটে সবসময় রাখা ছোট হাতলওয়ালা হাতুড়িটা বের করলো। “ওগুলো তোমার জন্য, নরমা...সবসময়ই তোমার জন্য...সব তোমার জন্য।”

মেয়েটা পিছু হটলো, তার চেহারা সাদা অস্পষ্ট এক গোলক, তার মুখ O আক্ৃতির আতঙ্কের এক কালো গহবর, সে নরমা নয়। নরমা ম্ৃত, দশ বছর ধরে সে ম্ৃত, তাতে কিছু যায় আসে না কারন মেয়েটা এখন চিৎকার করে উঠবে। সে হাতুড়িটা চালালো সেই চিৎকারটা বন্ধ করার জন্য, চিৎকারটাকে হত্যা করার জন্য। কাগজের মোড়কে রাখা ফুলগুলো হাত থেকে পড়ে গেল। ছলকে উঠে খুলে গেল মোড়কটা। লাল, সাদা, আর হলুদ টী রোজ ছড়িয়ে পড়লো তোবড়ানো ট্রাশ ক্যানগুলোর পাশে, যেখানে বিড়ালরা অন্ধকারে অপার্থিব সঙ্গমে লিপ্ত হয়, চিৎকার করে ওঠে ভালোবাসায়, চিৎকার করে ওঠে, আর চিৎকার করে ওঠে।

সে হাতুড়ি চালালো। মেয়েটা চিৎকার করলো না। কিন্তু চিৎকার করতে পারত। কারন সে ত নরমা না। ওদের কেউই নরমা না। সে হাতুড়ি চালালো, চালাতে থাকলো, আর চালাতে থাকলো। সে নরমা না। তাই সে হাতুড়ি চালালো। যেমন সে করেছে আরো পাঁচবার।

কিছু অজানা সময় পরে হাতুড়িটা কোটের ভেতরের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। অন্ধকার ছায়াময় ক্লবারস্টোনেগুলোকে পেছনে ফেলে, গার্বেজ ক্যানগুলোর পাশে পড়ে থাকা টী রোজগুলোকে দূরে ফেলে সে এগিয়ে চললো। মোড় নিয়ে সরু লেনটা ছেড়ে চলে এল সে। এখন পুরোপুরি অন্ধকার সব। স্টিকবল খেলোয়াড়রা বাসায় চলে গেছে। ওর স্যুটে যদি রক্তের দাগ থেকেও থাকে, তাহলেও ওরা দেখতে পেত না, এই অন্ধকারে না, এই নরম শেষ বসন্তের অন্ধকারে না। দেখতে পেত না যদি মেয়েটার নাম নরমা না হত। ও কিন্তু জানে তার নিজের নাম। ওর নাম...নাম

ভালোবাসা।

ওর নাম ভালোবাসা, এই অন্ধকার পথগুলোয় হাটে সে কারন নরমা তার অপেক্ষায়। ওকে খুজে বার করবে সে। শিগগীরি কোনদিন।

হাসতে শুরু করলো সে সেভেনটি-থার্ড স্ট্রীটে চলতে চলতে প্রতি পদক্ষেপে হালকা লাফিয়ে হাটতে লাগলো। বাসার সিঁড়িতে বসে থাকে মধ্যবয়স্ক এক দম্পতি চলে যেতে দেখলো ওকে। মাথা উচু, দৃষ্টি বহুদূরে নিবদ্ধ, একপেশে একটা হাসি ঠোঁটে। সামনে দিয়ে চলে যাবার সময় মহিলাটি বলে উঠলো, “তোমাকে কেন আর ওরকম দেখায় না?”

“উম্‌, কি?”

“কিছু না,” বললো মহিলাটি, দেখলো ছাইরঙা স্যুট পড়া যুবকটা হারিয়ে যেতে লাগলো অগ্রসরমান রাতের আধো-অন্ধকারে। ভাবলো বসন্তের থেকে যদি আর কোন কিছু সুন্দর হয়, তা হবে যৌবনের ভালোবাসা।

[স্টিফেন কিং এর ছোটগল্প ‘দ্য ম্যান হু লাভড ফ্লাওয়ারস’ এর অনুবাদ।]


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

মূলটা পড়ছিলাম, অনুবাদ খুবই ভাল হইছে! আরো লেখ, কিছু ভুল আছে ঠিক কইরা নিস।

মেয়েটা পিছু হটলো, তার চেহারা সাদা অস্পষ্ট এক গোলক, তার মুখ O আক্ৃতির আতঙ্কের এক কালো গহবর, সে নরমা নয়। নরমা ম্ৃত, দশ বছর ধরে সে ম্ৃত, তাতে কিছু যায় আসে না কারন মেয়েটা এখন চিৎকার করে উঠবে।

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অবনীল এর ছবি

থ্যাংকু দোস্ত :D। অইটা অভ্রর কি জানি প্রব্লেম। ওয়ার্ডে লিখতে গ্যালে ঋ-কারটা খালি ভাইঙ্গা যায়। ঠিক করতে পারিনা। ইয়ে, মানে...
___________________________________
স্বপ্ন নয়, - শান্তি নয়, - কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে!

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

এই গল্পটা বাংলায় আগেই অনুবাদ করা হয়েছে, খুব সম্ভবত করেছেন অনীশ দাশ অপু (স্মৃতিশক্তি প্রতারণা না করলে, "ঐতিহ্য" এর কোন একটা সংকলনে গল্পটা পেয়েছিলাম...)।

...যাই হোক, আপনার অনুবাদ ও চমতকার...

-------------------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

অবনীল এর ছবি

ওয়াও, তাই নাকি? উনি ত বস্‌ পাবলিক। দেখি খুজে দেখব উনারটা পাই কিনা। গল্পটা পড়ে চ্রম লাগল তাই ফটাফট বাংলায় লিখে আপ্নাদের সাথে শেয়ার করলাম। কিং এর ছোটগপ্লের মজাই আলাদা। ভালো লাগার জন্য থ্যাঙ্কস।
___________________________________
স্বপ্ন নয়, - শান্তি নয়, - কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে!

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বুঝছি... খেকু টেকু দিয়া কাম হইবো না... এরা খালি ঘুরায়... অবনীলের সাথেই যোগাযোগ করতে হইবো।

গল্পটা আপাতত পড়তে পারলাম না দৌড়ের উপ্রে থাকায়... পড়বো বলে আশা করছি।

ধন্যবাদ অনেক।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অবনীল এর ছবি

হ, এই জন্যই কেডা জানি অর নাম দিছে ভুলু খেকু। খাইছে
___________________________________
স্বপ্ন নয়, - শান্তি নয়, - কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে!

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

সবজান্তা এর ছবি

চলুক

দুর্ধষ নাভেদ ভাই ! দারুন...

চালিয়ে যান কিং-এর অনুবাদ...


অলমিতি বিস্তারেণ

অবনীল এর ছবি

থ্যাংকু সবজান্তা।
___________________________________
স্বপ্ন নয়, - শান্তি নয়, - কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে!

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

রানা মেহের এর ছবি

খুব ভালো লাগলো অনুবাদ
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অবনীল এর ছবি

থ্যাংকস্‌ রানা ভাই, অনেকদিন পর লিখলাম, ভালো লেগেছে জেনে আমারো ভালো লাগছে। দেঁতো হাসি
___________________________________
স্বপ্ন নয়, - শান্তি নয়, - কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে!

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।