আগস্টের ২৪ তারিখ, সকাল নয়টা। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার উত্তর সীমারেখার কাছ ঘেঁষে থাকা ছোট্ট শহর মরগানটাউন। ঘুম ভাঙ্গতেই বুঝতে পারলাম গত রাতের কনসার্টে মাতামাতির ধকল এখনো রয়ে গেছে শরীরে। ভদকা উইদ রেডবুল গিলতে গিলতে পিঙ্ক ফ্লয়েডের সুরের মূর্ছনায় রাতটা কেটে গেছে অনেকটা স্বপ্নঘোরের মত করে। কোনোমতে রেডি হয়ে গাড়িটা নিয়ে ছুট দিলাম পাশের শহর কোর এর দিকে । বেশী দুর না। মাত্র মিনিট পঁচিশের পথ। উদ্দেশ্য মেসন ডিক্সন হিস্টরিকাল পার্কে অনুষ্ঠিত তিনদিন ব্যাপী মাউন্টেইন স্প্রিরিট পাও-ওয়াও ফেস্টিভালটা এক পলক দেখে আসা। পাও-ওয়াও (pow wow) হচ্ছে আমেরিকার আদিবাসীদের একটা বাৎসরিক উৎসব। শব্দটার উদ্ভব হয়েহে আমেরিকার আদিবাসী ন্যারাজান্সেট গোত্রের পাওয়াও (powwaw) শব্দ থেকে। যার মানে হচ্ছে - আধ্যাত্মিক নেতা। বছরের একটা সময়, মুলত গ্রীষ্মকালের মাঝে, আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আদিবাসী আমেরিকান গোত্রের মানুষজন মিলিত হয়ে নাচ, গান, ইত্যাদি আর সামাজিকতা পালন করে - তাদের সংস্কৃতিকে সম্মান জানায়। পুরো আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ছোট বা বড় আকারে এই উৎসব পালিত হয়। সম্প্রতি আমেরিকা প্রদক্ষিন করে যাওয়া পরিব্রাজককূল শিরোমনি বন্ধুপ্রবরের শেয়ার করা সাউথ ডাকোটার পাও-ওয়াও উৎসবের রংচঙয়ে চিত্র দেখে তাদের উৎসব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভের আগ্রহ জেগে উঠেছিলো। তাই খুজে পেতে কাছাকাছির মধ্যে কোর শহরে এই অনুষ্ঠান হচ্ছে দেখে চলে গেলাম।
টিকেট কেটে পার্কের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো সারি সারি প্যান্ডেল। খোলা মাঠের মধ্যে সার বেঁধে কারাভ্যান পার্ক করে রাখা আর তাদের সামনে সামিয়ানা টাঙানো দোকান। বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী সামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে বিক্রয়ের জন্য। মাঠের মাঝখানে দড়ি দিয়ে বেশ বড়সড় একটা যায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে। এখানে আদিবাসীদের নাচ অনুষ্ঠিত হবে। তার কাছেই সামিয়ানার মধ্যে বসানো হয়েছে তাদের নাচের সময় ব্যবহৃত ঢাক।
চিত্র ১: পাও ওয়াও পতাকা গেটের মুখে পতপত করে উড়ছে।
প্রথমেই চোখে পড়ল , আদিবাসী আমেরিকানদের বহুল পরিচিত কনিক আকারের তাঁবু টি-পি (Tipi/TeePee) । শব্দটা এসছে সু (Sioux) গোত্রের লাকোটা (Lakota) ভাষা থেকে। এই তাবুগুলো একসময় কাঠের গুড়ি আর পশুর চামড়া দিয়ে তৈরী করা হত। এখন পশুর চামড়ার বদলে ব্যবহৃত হয় ক্যানভাস কাপড়। শীতের সময় উষ্ণতা, আর গরমের সাময় ঠাণ্ডা থাকে এর ভেতরটা। দ্রুত খুলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা যায়। তাঁবুর মালিক ভদ্রমহিলা জানালেন, মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যে তিনি একাই এই উঁচু তাঁবুটা টাঙ্গিয়ে ফেলেছেন!
চিত্র ২ঃ টি-পি
তাঁবু থেকে বের হয়ে চোখে পড়লো একটা বাহারি কাপড়ের ব্যাগের দোকানের ভেতর দুটো খাঁচা। এক খাঁচার ভেতর ঝিমোচ্ছে গায়ে ফুটকিওয়ালা সাদা একটা পেঁচা। খুব সম্ভবত গ্রেট হর্ণ পেঁচা। অন্যটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা কোনো কারনে। ব্যাপারখানা কি জানার জন্য এগিয়ে গেলাম। দোকানের মালকিনের কাছে জানতে পারলাম ওর ভেতরে রয়েছে একটা বন্য চিল। খাচার উপরের পর্দা সরিয়ে দেখালেন সেই বিশাল পাখি। প্রায় বড় সাইজের একটা টার্কি মুরগীর সমান। পোষ মানাতে পারেননি এখনো। তাই খাঁচা থেকে বের করার প্রশ্নই আসে না। ঠুকরে ছিঁড়ে ফেলবে। চলচ্চিত্রে দেখা নেটিভ আমেরিকানদের মত হাতে চিল নিয়ে দাঁড়াবার অভিজ্ঞতাটা তাই অধরাই রয়ে গেল এইবারের মত।
চিত্র ৩ঃ গ্রেট হর্ণ পেঁচা
চিত ৪ঃ বন্য চিল
এর পাশের দোকানেই চোখে পড়ল কিছু অদ্ভুত দর্শন জিনিসপত্র। হেলতে দুলতে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম - ইয়ে কেয়া চীজ হ্যায় ? ইংরেজিতেই অবশ্য। জানা গেল সেগুলো বিক্রির জন্য নয়। তারা মূলত বিক্রি করছেন পশ্চিম ভার্জিনিয়ার আশে পাশে অবস্থিত আদিবাসীদের তথ্য সম্বলিত বুকলেট এবং প্রাচীন ম্যাপ। ম্যাপগুলো ১৫শ কি ১৬শ সালের। প্রদর্শিত জিনিস পত্রের মধ্যে পাওয়া গেল - খরগোস শিকারের জন্য ব্যবহৃত একধরনের মুগুর। ঘাসবনে লাফিয়ে বেড়ানো খরগোসের মাথা বরাবর ধাঁই করে মেরে কিভাবে তাদেরকে শিকার করা হত দোকানী ভদ্রমহিলা তার রোমহষর্ক বর্ণনা দিলেন। তার পাশেই রাখা কয়েকটি নাচের সময় ব্যবহৃত ঝুমুর জাতীয় আদিবাসী বাদ্যযন্ত্র, কোনোটা হাতে ঝাকিয়ে বা পায়ে পড়ে নাচতে হয়। হঠাৎ দেখলাম অদ্ভুত দর্শন একটা লাঠি। আগায় মুরগীর পা যুক্ত করা । এটা কি কাজে ব্যবহৃত হয় জিজ্ঞেস করায় মহিলা হাত নেড়ে নেড়ে বলতে লাগলেন, গোত্রের ভেতর দুজন মানুষের মধ্যে কলহ হলে তা নিরসনের জন্য এক ধরনের দ্বন্দযুদ্ধের আয়োজন করা হত। তবে অস্ত্র হিসেব ছরি-বল্লমের বদলে ব্যবহৃত হত এই অদ্ভুতদর্শন লাঠি। রক্তপাতহীন দ্বন্দ নিরসনের প্রাচীন এক উপায়! দেখলাম একটা কালো বাক্সের ভেতর যত্ন করে রাখা হয়েছে অর্ধসচ্ছ কোয়ার্টজ পাথরের তৈরী একটা তীরের ফলা।, হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম বেশ ধার। মহিলার রাগী চেহারার স্বামী বল্লেন, এটা মূলত একধরনের রাজ উপঢৌকন। কোন এক জেনারেলকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিলো একসময়। হাতবদল করে এখন এসে পৌছেছে এনাদের কাছে।
চিত্র ৫ঃ সর্ব বামে খরগোশ শিকারে ব্যভ্ররত মুগুর জাতীয় অস্ত্র। তার পাশে রাখা নাচের সময় ব্যাভর্ত ঝুমু র জাতীয় বাদ্যযন্ত্র।
চিত্র ৬ঃ দ্বন্দযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিশেষ
চিত্র ৭ঃ কয়ার্টজ পাথরের তৈরী তীরের ফলা।
স্টলটা থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটতেই, কানে এসে পরিচিত এক বাঁশীর সুর। যেই সুর মূলত এতদিন শুনে এসেছি টিভিতে প্রচারিত আদবাসী আমেরিকানদের নিয়ে কোন তথ্যচিত্র অথবা সিনেমায় । শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা স্টলে চেয়ার পেতে বসে আদিবাসী দাদিমা বাজাচ্ছেন সেই বাঁশী। একধরনের বিষন্ন কিন্তু শান্তিময় তার সুর। যেন হাজার হাজার বছর ধরে জন্ম-জন্মান্তর পেরিয়ে এসে আদিবাসী মানুষের আত্মার কান্না শুনিএয়ে চলেছে । মুগ্ধ হয়ে শুলাম কিছুক্ষণ। বিনীত অনুরোধ করে রেকর্ড করে নিলাম তার কিছু অংশ।
ভিডিও ১ঃ আদিবাসী বাশীর সুর
পার্কের একেবারে কোনায় কয়েকটা টালির ছাদ বিশিষ্ট দালান। তার একটাতে বিক্রি হচ্ছে খাবার-দাবার। যে সে খাবার নয়, আদিবাসী আমেরিকানদের ঐতিহ্যমন্ডিত ফ্রাই ব্রেড দিয়ে বানানো বিভিন্ন ধরনের খাবার। ফ্রাইব্রেড এর সাথে চিনি দিয়ে , অথবা গরুর মাংসের টাকো (taco) বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফ্রাই ব্রেড মুলত তেলে ভাজা পরোটা, তবে আমাদের পরোটার তুলনায় বেশ পুরু। এই ফ্রাই ব্রেড কিন্তু আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের মূল খাদ্য ছিলো না। এত মূল খাদ্য হয়ে ওঠার ইতিহাসটা বেশ করুন। ১৮শ শতকের দিকে যখন নাভাহো ইন্ডিয়ানদের আরিজোনা অংগরাজ্য থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছিলো, তখন আমেরিকার সরকার তাদেরকে রেশন হিসেবে খেতে দেয় এই রুটি। তিনশ মাইল হেঁটে নিউ মেক্সিকোতে তাদের যেতে বাধ্য করা হয়। যা "লং ওয়াক" নামে পরিচিত।
এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি আমিরাকান আদিবাসীদের বিপুল ঐতিহ্যের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় ১৫ হাজার বছর, বা তারো আগে, এই আমেরিকার ভূখন্ডে তাদের প্রথম আবির্ভাব। এশিয়া থেকে বেরিঙ্গিয়া (আমেরিকা এবং এশিয়া মহাদেশের মধ্যবর্তী সংযোগস্থল, যা বেরিং প্রণালী দিয়ে যুক্ত ) হয়ে তারা আসে এখানে। ভুতত্তবিদগণ ধারণা করেন, প্রায় ৬০ থেকে ২৫ হাজার বছর আগে সমুদ্রের উচ্চতা নেমে যাবার কারনে এবং হিমবাহ গলে যাবার ফলে সাইবেরিয়া এবং আলাস্কার মাঝে বেরিং প্রণালী নামক স্থলসেতু তৈরী হয় , যা এই মাইগ্রেশানে সহয়তা করে। পরবর্তী কয়েক হাজার বছরে পেলিও-আমেরিকানরা (paleo-American) শত শত গোত্র এবং জাতীয়তায় বভক্ত হয় আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সরকারীভাবে স্বীকৃত প্রায় পাঁচশ-এরও বেশী আদিবাসী গোত্রের নাম তথ্যভুক্ত করা আছে।
বেশীরভাগ স্টল ঘুরে দেখা গেলো বাহারী রং এর নক্সাদার পোশাক, শাল, কাপড়ের ব্যাগ ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমানে পশুজাত দ্রব্য , খরগোশের ছাল, ভালুকের নখর, কায়োটির দাত, বাজপাখির পালক, হাড়গোড়, কাছিমের খোলস ইত্যাদি। মুলত ব্যবহৃত হয় সাংস্কৃতিক সজ্জায়। এছাড়া পাওয়া গেল টমাহক (আদিবাসী কুঠার), এবং বিভন্ন জাতের ছুরি।
চিত্র ৮ দোকানের সামগ্রী, পোস্খাক, অস্ত্র, পশুজাত দ্রব্য
একপাশে একটা ট্রেইলার ট্রাকের মধ্যে ছোট আকারে যাদুঘর সাজানো হয়েছে। ক্ষুদ্র পরিসরে নানাবিধ ঐতিহাসিক জিনিসপত্র এবং চিত্র দিয়ে সাজানো।
চিত্র ৯ঃ যাদুঘর প্রদর্শিত সামগ্রীর কিছু কিছু
কিছুক্ষন বাদেই শুরু হলো দিনের মূল কার্যকম। মাঠের মাঝকানে দড়ি দিয়ে হিরে রাখা জায়গাটেকে কেন্দ্র করা সবাই চেয়ার বা মাদুর পেতে বসে পড়লো। শুরু হলো আদিম ঢাকার দ্রিম দ্রিম শব্দ আর সেই সাথে খালি গলায় প্রাথনা সংগীত। চোখ বুঁজলে মনে হতে লাগলো যেন হাজার বছরের পুরনো কোন গোত্রের আদিম রীতি অনুষ্ঠানে এসে পড়েছি - বনের মধ্যে খোলা আকাশের মিটিমিটি তারার নিচে জ্বলন্ত আগুন ঘিরে চলছে নৃত্য, ঢাকবাদন আর আদিম সংগীত।
ভিডিও ২-১: আদিবাসী ঢাক বাদন
ভিডিও ২-২ঃ আদিবাসী ঢাক বাদন
ঢাকের তালে তালে বিভিন্ন গোত্রের রীতি অনুযায়ী বিচিত্র বাহারী পোশাক পড়ে মাঠের মধ্যে আসতে লাগলো নৃত্য প্রদর্শনকারীরা। প্রতিটা নাচের আগে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হলো এর ধরন এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে। এই নাচগুলো সাধারনত প্রদর্শন করা ইয় ঘড়ির কাঁটার দিকে অথবা ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে প্রদক্ষিন করতে করতে। ব্যাপারটা জীবনের চক্রাকার নিয়মকে কে প্রতিনিধিত্ব করে । কিছু নাচ পুরুষপ্রধান, কিছু নারীপ্রধান। পুরুষদের বিভিন্ন ভংগিমার নাচ রয়েছে। কোন নাচের ভঙ্গিমা খুবি দৃঢ়, অতি সংক্ষিপ্ত পদচালনা, যেগুলো স্ট্রেইট ডান্স নামে পরিচিত । আরেক রকম নাচের গতি সর্পিল , আতর্কিত ভংগিমার পরিবর্তন, যোদ্ধা নাচের প্রকৃতি অনেকটা এরকম। ঘাস নৃত্যতে দেখা যায় পায়ের চেটো ব্যবহার করে মাটিতে আঘাতের মাধ্যে ঘাস দলিত করার ভংগিমা। সাধারণত প্রাচীনকালে নাচের প্রাঙ্গনে ঘাস সমান করতে এই নাচ দিয়েই মুল অনুষ্টান শুরু করা হত। নারীদের নাচের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শাল নৃত্য। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে বর্ণিল শালের ব্যবহার এই নৃত্যের মূলকেন্দ্র। জিঙ্গেল নাচে মেয়েদের পড়তে হয় ধাতুর তৈরী ঝালরের মত জামা, পরিনত বয়স্ক মহিলাদের গায়ের জামায় লাগানো থাকে ৩৬৫ টি ধাতব ঝালর, যা বছরের প্রতিটাদিনকে প্রতিনিধিত্ব করে। জামাগুলো বেশ ভারী , তাই শুধু পরিনত মহিলারাই এই পোশাক পড়ে নাচতে পারেন।
চিত্র ১০ঃ নৃত্যরত আদিবাসী।
ভিডিও ৩ঃ আদিবাসী মহিলাদের শাল নৃত্য।
ভিডিও ৪ঃ পুরুষদের যোদ্ধা নৃত্য।
অনুষ্টানের ফাঁকে ছবি তুলতে তুলতে আলাপ হলো টিমোথী রে -এর সাথে। জন্মসূত্রে সে অর্ধেক চেরকি ইন্ডিয়ান, অর্ধেক আইরিশ। ভার্জিনিয়া থেকে এসেছে সে এই পাও ওয়াও এ অংশ নিতে। তার কাছে থেকে জানতে পারলাম তার পশু-পখী প্রীতি, আরভেষজ ঔষধ এর প্রতি আগ্রহ সম্বন্ধে। আদিবাসী আমেরিকান নাচের প্রকৃতি সম্বধে জানলাম তার কাছ থেকে। আলাপ বেশ জমে গেল । পরে আলাপ শেষে আগামী বছরের অনুষ্ঠেয় ভার্জিনিয়ার ড্রামস অফ দ্যা পেইন্টেড মাউন্টেইন্সের আংশগ্রহনের আমন্ত্রন পেলাম। পেইন্টেড মাউন্টেনের মূল আকর্ষন হলো, এই পাহাড়ের গায়ে এখনো রয়ে গেছে আদিবাসীদের অংকিত প্রাচীন চিত্রকর্ম।
চিত্র ১১ঃ টিমোথী রে এর সাথে।
বেলা গড়িয়ে এলে অনুষ্ঠান চলে এলো প্রায় শেষের দিকে। এতক্ষন নাচ গানের ফাকে ফাকে হাসি তামাশা করছিলো সবাই। হঠাৎ করে গম্ভীর একটা আবহ সৃষ্টি হল। একইসাথে বুঝতে পারলাম কেন পাও ওয়াও শুধু আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের সাংসৃতিক প্রদর্শনী নয়। এ তাদের সামাজিক আত্মীয়তার মিলন মেলা। উপস্থাপক জানালেন গোত্রের এক দম্পতি তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন খুব সম্প্রতি। আত্মহত্যা করেছে সেই হতভাগ্য কোনো কারনে। তাদের জন্য অনুষ্ঠিত হলো সমবেদনা নৃত্য। দূর্লভ এই অনুষ্ঠান রেকর্ড করতে বারন করা হলো তাই এর কোনো চিত্র দেখাতে পারছিনা। মূলত শোকগ্রস্ত দম্পত্তিকে সামনে রেখে শুরু হলো ধীরপায়ে এক চক্রাকার নৃত্য । সেই সাথে বরাবরের মত ঢাকবাদন এবং প্রার্থনাগীত । দম্পত্তির হাতে একধরনের খড়জাতীয় ধুপ। ধোঁয়া বেরুচ্ছে থেকে থেকে। কিছুক্ষন পর পর তা তুলে ধরা হচ্ছে মাথার উপরে । নাচের মাঝখানে একজন একজন করে গোত্রের সবাই তাদেরকে আলিংগন করে সমবেদনা জানাতে লাগলো। সবার চোখে পানি। বুকের মধ্যে বুঝতে পারলাম তাদের মধ্যেকার টান কতখানি।
অনুষ্ঠান সমাপ্ত করা হলো আদিবাসী পতাকা হাতে সংক্ষিপ্ত এক নাচের মধ্যে দিয়ে। পতাকা গোত্রের আধাত্মিক নেতার হাতে। তার পরনে অবশ্য ছিল সাধারন প্যান্ট-শার্ট । কিন্তু চলন দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তার উপস্তিতির গুরুত্ব এই অনুষ্ঠানে। বুঝলাম বিদায় নেবার পালা এবার। আদিবাসীদের বিদায় জানিয়ে অদ্ভুত এক ভালো লাগা নিয়ে ফিরে চল্লাম নিজ গৃহে।
মন্তব্য
সাড়ে পাঁচ বছর! তাও ভালো, একটা পুরোপুরি অজানা বিষয় নিয়ে আসলেন।
নীল-সাদা-হলুদরঙা আদিবাসী পোষাকের বুকে এতো বড় ক্রস আসলো কোথা থেকে? ইউরোপীয় আগ্রাসণের আগে আমেরিকাতে এইসব কিছু তো ছিল না।
পাঁচশতাধিক আমেরিকান জাতি যাদেরকে বাকি দুনিয়া ইন্ডিয়ান বা রেড ইন্ডিয়ান বলে (আরও কিছু বানোয়াট নাম আছে) তারা নিজেদেরকে সম্মিলিতভাবে কী নাম বলে?
ছবির ক্রম ঠিক করুন। টাইপোর পরিমাণ অনেক, সেটাও ঠিক করুন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সময় নিয়ে পড়া জন্য ধন্যবাদ পান্ডব্দা । হাহাহা । অলসতার পরিনাম। দেখি হাতে আরো কিছু লেখা জমে আছে। আস্তে আস্তে দিবোনে।
হ্যা ঠিক বলেছেন। আমারো মাথায় একি প্রশ্ন এসেছিলো। আমার মনে হয় যেহেতু বিক্রির জন্য, তাই সবধরনের খদ্দেরের কাছেই আকর্ষনীয় করার এক ধরনের চেষ্টা।
রেড ইন্ডিয়ান বলে না। আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা নেটিভ আমেরিকান বলেই নিজেদের পরিচয় দেয়। হয়ত আরো ভালোভাবে মিশতে পারলে , জানতে পারবো।
টাইপোর জন্য দূঃখিত। কাজ থেকে ফিরে ঘুমোবার আগে ক্লান্ত মাথায় লেখা। ঠিক করে নেব এক ফাকে। আরো কিছু তথ্য ছিলো সময় এবং ক্লান্তিজনিত কারনে দেয়া হলো না। হয়ত পরে যুক্ত করে দেব।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আমার আসলে জানার ইচ্ছা প্রাক-কলাম্বিয়ান যুগে America-কে তাদের আদি অধিবাসীরা দেশটাকে কী নামে (বা দেশগুলোকে কী কী নামে) ডাকতেন।
চিত্র-৫-এ দেখানো বাঁশ/বেতের বলটা দেখতে Sepak Takraw খেলার বলের মতো লাগলো। এই বলটা কী কাজে ব্যবহৃত হতো? একই ছবির ঝুমঝুমিটা Alexandro Querevalú–র গানে বহুল ব্যবহৃত একটা বাজনার মতো মনে হলো। কে জানে পেরুভিয়ান আদিবাসী আর এই আদিবাসীরা হয়তো একই উৎস থেকে আগত!
চিত্র-৮-১-এর খোলসগুলিতে ১ অথবা ৩টি খোলস কচ্ছপের (Tortoise) বলে মনে হলো। বাকিগুলো কাছিমের (Turtle)।
চিত্র-৮-৬-এ টোমাহকের নিচের এই ছবিতে দেখানো বস্তুগুলি কী?
কোন Totem Pole ছিল না?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
টোটেম পোল নর্থ আমেরিকার পশ্চিম পাড়ে দেখা যায় সাধারনত, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া তথা পূব পাড়ে না থাকারই কথা।
..................................................................
#Banshibir.
সেটা ঠিক। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি আর উৎসবের বাণিজ্যিকিকরণের যুগে এক মেলাতে সব জাতির জিনিস প্রদর্শন, বিক্রয় অস্বাভাবিক কিছু না। টোটেম পোলের ব্যাপারে আমার নিজের বালখিল্য আগ্রহ আছে, তাই জিজ্ঞেস করা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এটা জানা ছিলো না। তবে ঠিক বলেছেন। টোটেম ছিলো না। তবে কাঠ কুদে তৈরী করা টোটেমের খন্ডিত অংশ বিক্রি করছিলো একজন।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
-এটা অবশ্য নিজে নেট ঘেটে জানা। তাদেরকে থেকে না। আদিবাসীরা ডাকত "টারটল আইল্যান্ড" বলে।
-বলটা সম্বদ্ধে জিজ্ঞেস করা হয়নি। দূঃখিত।
-আপনি ঠিক বলেছেন।
-ওগুলো ঝুমঝুমি জাতীয় বাদ্যযন্ত্র
-না। ছিল না। তবে কাঠ কূদে তৈরী করা টোটেম এর খন্ডিত অংশ বিক্রি করছিলো একজন। তেমন মসৃন কাজ নয়, সচরাচর যেরকম মিউজিয়াম বা ছবিতে দেখা যায়।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
তাঁবুর ছবি দেখে শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল, রেড ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে প্রথম যে লেখাটি পড়ি, তাতে এ ধরনের একটা তাঁবুর পাশে অদ্ভুত দর্শন এক লোক দাঁড়িয়ে ছিল। লেখাটি ভালই লাগলো, তবে একটু অপূর্নতাও থেকে গেল- দাদীমা'র বাজানো বাঁশির সুরের একটা লিঙ্ক থাকলে খুব ভাল হত।
আছে ত ! ছবিটাতে ক্লিক করুন। ওটা ভিডিও-তে নিয়ে যাবে ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ধন্যবাদ। সময় পেলেই ঠিক করে নেব। এটা কোন একক উৎসব নয়। পুরো আমেরিকা জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয়। যে প্রান্তে যে গোষ্ঠীগুলোর প্রাধান্য তাদের আচারগুলোই বেশি প্রদর্শন কোরা হয়। যেমন, পশ্চিম ভার্জিনিয়া অঞ্চলে, সু, চেরকী, শওনি, সাস্কুয়েহান্না ইত্যাদি গোত্রের মানুষ বেশী। যতদূর জানতে পেরেছি উনিশ শতকের শেষের দিকে এই উৎসবের শুরু , যখন আমেরিকান সরকার এইসব গোষ্ঠীকে বিভক্ত করার মাধ্যমে তাদের জাইয়গা গুলো দখল করে নেয়। পরে সরকারি রুল জারি করে কখন এই উৎসব পালন করা যাবে সেই সময়টাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আমেরিকান আদিবাসীদের হস্তশিল্প প্রদর্শনীটা অসাধারণ। এই উৎসবের আয়োজক কী আদিবাসী মানুষেরা নাকি মার্কিন সরকার? আমেরিকার আদিবাসীরা তো এক শতক ধরে রিজার্ভের অধিবাসী বলে জানি। এক অর্থে চিড়িয়াখানার প্রাণী। সেই রিজার্ভে তাদের স্বাধীনতা কতটুকু, নাগরিক অধিকারের সীমানা, ইত্যাদি জানার উপায় আছে কী, থাকলে একটু খোঁজটোজ নিয়ে সেই বিষয়ে একটা পোস্ট লিখতে পারেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এটা কমিউনিটি ভিত্তিক উৎসব । সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলে মনে হয় না। একটা দীর্ঘসময় ধরে রিজারভেশনে থাকার কারণে , সেই জায়গাগুলোই এখন তাদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেছে। তাই ১৯২৪ সালে সরকারী ভাবে তাদের আমেরিকান নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, মাটির টানে তারা এসব জায়গায় বেশিরভাগ সময় ফিরে আসে।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
লেখা, ছবি, ভিডিও সব মিলিয়ে চমৎকার হয়েছে। শালনৃত্যে মনে হয় খানিকটা আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
চমৎকার পোস্ট। একটা কৃত্রিম ভল্লুক থাবা পাওয়া গেলে বেশ হতো, আর কয়োটির দাঁত।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
লেখা ভাল হয়েছে। দাদীমার বাঁশী উপভোগ করলাম। প্রায় বিশ বছর আগে আমার বাডীর পাশেই (আপস্টেট নিউইয়র্ক) ন্যাটিভ আমেরিকান দের মেলায় গিয়েছিলাম। তখন জানতাম না ঐটা পাও ওয়াও উৎসব ছিল। বাফেলো বার্গার আর মিষ্টি আলুর ভাজা বেশ পপুলার এইসব অনুষ্ঠানে। আমাদের এখানে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে হয়।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
খুবই আলাদা ধরনের টপিক। দারুন লেখনী।
নতুন মন্তব্য করুন