"কিপ রোয়িং ফরওয়ার্ড!" পেছন থেকে চাক চেঁচিয়ে উঠলো। ডানে বসে থাকা লীও অস্ফুটস্বরে চিনা ভাষায় কি জানি বলে উঠলো, মনে হয় "ইয়াল্লা" জাতীয় কিছু। ভেলার ঠিক সামনে বসে বৈঠা বাইছি আমি। আমার ঠিক পেছনে বামে ফিল , আর ডানে লীও। সবার পেছেন হাল ধরে চাক। চোখের সামনে ফেনিল জলরাশি, তার ভেতর জেগে আছে বিশাল বিশাল ভয়ালদর্শন পাথর, সেই সাথে কানে তালা লেগে যাওয়া পানির গর্জন। পানির গতি বেড়ে চলেছে। কারন সামনেই নদী কয়েক ফিট নেমে গিয়ে ছোট একটা জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে। সেইদিকে ছুটে চলেছি আমরা। উত্তেজনায় টানটান শরীর । কি-হয়, কি-হয় অবস্থা। কোনোমতে পাথরের ফাঁক গলে পার হতেই, তীব্র গতিতে ভেলা সোজা লাফ দিয়ে পড়লো প্রপাতের নিচে। পড়া মাত্র নাক উচু করে ফেলো প্রায় কয়েক ফিট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিটকে গিয়ে পানিতে পড়লাম আমি। বুঝতে পারলাম দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছি পানির ভেতর। চারপাশে ঘিরে আসছে গহীন অন্ধকার । গলায় পানি ঢুকে গেছে। খাবি খাচ্ছি একটু বাতাসের আশায়।
ছবি ১ঃ প্রবল স্রোতের সাথে যুদ্ধরত আসহায় ভেলারোহী
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আমার এক বন্ধু ছিল। সবাই তাকে ডাকত কানা পন্ডিত। তার দুটি কারন, এক চশমা, আর দুই মাঝে মাঝেই বিজ্ঞজনের মত কিছু অমৃতবাণী বর্ষন করা। তার বিখ্যাত অনেক উক্তির একটা - “ভাত পায় না, চা খায়। ঘোড়ায় চইরা হাগবার যায়।” । যেদিন চাক-এর ইমেইল পেলাম যে তারা ওহাইওপাইল যাবার প্ল্যান ঠিক অরেছে, স্বভাবমত আমি খোজ নিতে শুরু করলাম সেখানে এডভেঞ্চার জাতীয় কি কি কর্মকান্ড করার আছে। অনলাইনে একটু সার্চ দিতেই বেরিয়ে এলো ওহাইওপাইলের বিখ্যাত ইয়কাগেনি নদীতে হোয়াইট ওয়াটার র্যাফটিং ট্রিপ এর উত্তেজনাপূর্ন সব ছবি আর চমৎকার সব অফার । চাক, মানে চাক লিউইস, এখানকার স্থানীয় সিএমএ চার্চের প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর। হাসিখুশী এক ষাটোর্ধ "তরুন" , আউটডোর একটিভিটিতে দারুন আগ্রহ। বেশ কয়েকটা ট্রীপ দিয়েছি তার সাথে - নায়াগ্রা ফলস, এপালাচিয়ান ট্রেইলে ক্যাম্পিং, যেগুলো নিয়ে পরে সময় পেলে লিখবো । যাহোক, হোয়াইট ওয়াটার ট্রিপের কথা বলতেই সে রাজী। কিন্তু বলে দিলো, ভেলা চালাতে লাগবে কমপক্ষে চার জন মানুষ। তাই, অন্যদের মধ্যে আরো দু'জন রাজী না হলে হবে না। ট্রীপের আগের দিন গিয়ে হাজির হলাম গীর্জার নিয়মিত সম্মেলনে। দেখি এককোনায় বসে আছে ফিল জনসন। ফিল ডব্লুভিইউ-তে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করছে। খুব ভদ্রটাইপের নিরীহগোছের মানুষ। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সহজে না বলতে পারে না। ফিল সেই গোত্রীয়। তাই ভুজুংভাজুং দিয়ে সহজেই তাকে রাজী করিয়ে ফেললাম। আমার মত তারো এটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। খাবারের টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি চাক কথা বলছে এক চিনা ভদ্রলোকের সাথে। পরিচয় করিয়ে দিলো। নাম লীও ফেং । ইকনমিক্স ডিপার্ট্মেন্টের ভিজিটিং স্কলার। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে অতি কষ্টে কথা বার্তা চালাচ্ছে। চাক কথায় কথায় বলে উঠলো রাফটিং-এ যাবার প্ল্যানটা। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে বুঝিয়ে বলতেই দেখি তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আগ্রহভরে অংশ নিতে চাইলো। হড়বড় করে বলো চিনদেশে নাকি এরকম সে দেখেছে। যাক অন্ততপক্ষে চারজন হয়ে গেল। অন্যদের যদি পারা যায় সেখানে গিয়ে কনভিন্স করার চেষ্টা করা যাবে।
পেন্সিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত, ওহাইওপাইল (ohiopyle) স্টেট পার্ক প্রায় ১৯ হাজার একর জায়গা নিয়ে বিরাজমান। গাড়ী করে যেতে মরগানটাউন থেকে প্রায় এক ঘন্টার মত লাগে। এর মূল আকর্ষন হলো ১৪ মাইলের মত লম্বা গিরিসংকটের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া ইয়কাগেনি (youghiogheny) নদী । এছাড়া আছে ৫ টা বড় সড় জলপ্রপাত। ২০ থেকে ৩০ ফিট এদের উচ্চতা। আর আছে মিডো রান বলে এক জায়গা যেখানে পানির ক্রমাগত স্রোতের কারনে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হয়েছে পাথরের মাঝে মসৃণ ঢাল। এখানে সবাই এসে ওয়াটার স্লাইড করে। বেশ মজার একটা ব্যাপার।
ছবি ২ঃ কিউকাম্বার ফলস
ছবি ৩ঃ মিডো রান ওয়াটার স্লাইড
এখানে নদী সম্পর্কিত কিছু কথাবার্তা আগেভাগে বলে রাখি। হোয়াইট ওয়াটার বা ফেনীল জলরাশীর সৃষ্টি হয় যখন নদীর কোন অংশ ঢালু হয়। তখন বেগবান স্রোতের সাথে বাতাসের মিশ্রন ঘটে সাদা ফেনার সৃষ্টি হয়। নদীর যেসব জায়গায় এই ব্যাপারটা ঘটে সেওগুলোকে বলা হয় র্যাপিড । এই জায়গাগোলতে ভেলা চলে তীরের বেগে। কিন্তু সমস্যা শুধু তা-ই নয়। এসব নদীর তলায় রয়েছে বড় বড় পাথরের চাই যেসব পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে যেকোন সময় উল্টে যেতে পারে ভেলা। আবার যদি গভীরতা কম হয় তাহলে পাথরের উপর এসে ভেলা আটকে যেতে পারে । এরপর আছে হাইড্রলিক্স (Hydraulics)। পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে উল্টোস্রোতের সৃষ্টি হয় যার কারনে পানির ভেতরেই গর্তের মত নিচু অংশের সৃষ্টি হয়, একে বলা হয় হাইড্রলিক্স। এসব জায়গায় ভেলা অনেকটা রোলার কোস্টারের মত লাফাতে থাকে ।
নদীযাত্রা কত কঠিন তার একটা আন্তর্জাতিক স্কেল আছে। এই স্কেল-এ ৬ টা ক্লাস। ক্লাস ১ -২ সহজ, ক্লাস-৩ মধ্যমমানের, ক্লাস-৪,৫ দক্ষ নৌচালকের প্রয়োজন, আর ক্লাস ৬ মানে নৌকা বাওয়া বিপদজনক। এই ক্লাসের উপর ভিত্তি করে ইয়কাগেনি নদী তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেঃ লোয়ার, মিডল এবং আপার। লোয়ার ইয়ও হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৭ মাইল লম্বা, এর ক্লাস ৩-৪ , মানে কোন কোন অংশ ক্লাস-৩, কোন কোন অংশ ক্লাস ৪। এই সেকশান্টাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। লোয়ার ইয়ও (yough) সেক্সানে প্রায় দশটার মত র্যাপিড রয়েছে। যার কোনো কোনোটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। মিডল ইয়ও ক্লাস-১,২ ফ্যামিলি ট্রিপের জন্য উপযূক্ত। আর আপার ইয়ও হলো ক্লাস-৫, সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। একেবারে দক্ষ ভেলাচালকরা শুধু এই সেকশান বেছে নেয়। যাহোক, ওয়াইওপাইল পৌছে সোজা চলে গেলাম র্যাফটিং এর জন্য সাইন আপ করতে। দিনের শুরুতেই করে ফেলা ভালো, কারন ঘন্টা ছয়েকের মত নদীতে থাকতে হবে। তার উপর এখন র্যাফটিং এর মৌশুম। শুরুতেই সমস্যা। আমাদের সাথে বাচ্চা মেয়ে আছে, ১২ বছরের নিচে হলে লোয়ার ইয়ও যাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে আমরা গোঁ ধরে বসে আছি লোয়ার ইয়ও ছাড়া মজা নেই। তার উপর অনেকেই নানারকম অজুহাত দেওয়া শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লাম। ঠিক হলো আমরা চারজন যাবো, বাকিরা কাছাকাছি অন্যান জায়গায় ঘোরাঘুরি করবে। সাইন আপ আর রিলিজ ফরম সই করে সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে চললাম আরেক জায়গায়। সেখানে আমাদের পিএফডি (লাইফ জ্যাকেট) হেলমেট ইত্যাদি দেওয়া হবে আর পোশাক বদলের সুযোগ হবে। গিয়ে দেখি বিস্তর ভিড়। বুঝলাম সব র্যাফটিং কোম্পানিগুলো এখানে তাদের যাত্রীদের জড়ো করে । গাইডরা সবাইকে জড়ো করে কিভাবে হেলমেট আর পিএফডি পড়তে হবে সে ব্যপারে ছোটখাট একটা লেকচার দিল। সেই মোতাবেক সব করে টরে তারপর আমরা গিয়ে উঠলাম বাসে। দুটো হলুদ স্কুল বাস রেডি করে রাখা ছিল সবাইকে নেওয়ার জন্য। এই বাসদুটোতে করে মিনিট পনেরো জার্নি করে আমরা পৌছাবো নদীর তীরে।
নদীর ধারে পৌছে গাইডরা আমাদেরকে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে র্যাফট বেছে নিয়ে তাতে বসে পড়তে বললো। প্রায় ১০-১২ টার মত র্যাফট ভরে গেলো মানুষে। র্যাফট বা ভেলাগুলো রাবারের , ভেতরে বাতাস পাম্প করা। খেয়াল করে দেখি, শুধু আমাদের ভেলাতেই চারজন । অন্যগুলোতে অন্ততপক্ষে ৬ থেকে ৮ জন করে মানুষ। পরে জানা গেল শুধু তাই নয়, সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিটিও আমাদের ভেলাতেই। যাহোক কি আর করা। এদিকে গাইডরা তাদের বহুল চর্চিত ট্রিপ-পূর্ব বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলো। বলা হলো, তারা কায়াক-এ করে আমাদের সামনে থাকবে। হাত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সিগনাল দেবে। সেই অনুসারে বৈঠা বাইতে হবে। কি সিগনালের কি মানে বুঝিয়ে দেওয়া হলো, লেফট প্যাডল, রাইট প্যাডল, রিভার্স প্যাডল ইত্যাদি। পানিতে পড়ে গেলে কি করতে হবে সেটাও বলে দেওয়া হলো। কিভাবে কেউ পড়ে গেলে তাকে উদ্দ্বার করতে হবে তা-ও বুঝিয়ে দেওয়া হলো। পাথরে যদি ধাক্কা লেগেই যায়, তাহলে ভেলা যাতে না উল্টায় সেজন্য, কিভাবে দ্রুত একপ্রান্ত থেকে সরে এসে আরেকপ্রান্তে ওজন বাড়াতে হবে সে ব্যাপারে গাইডরা ব্যাখ্যা করলো। সেই সাথে বলা হল, “it is not the matter of if you are gonna fall, but when you are gonna fall”। তাই সবাইকে নৌকা উলটে পানিতে হাবুডুবু খেতে হবে সেই ব্যাপারে মনে মনে প্রস্তুতি নিতে বললো। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা নিয়ে বসে আছি। এমন সময় বলা হলো প্রত্যেক ভেলায় একজনকে ক্যাপ্টেন বাছাই করতে। সেই ভেলার পেছনে বসে হাল ধরবে। আমাদের মধ্যে একমাত্র চাক-এরি আগে বার তিনেক র্যাফটিং করার অভিজ্ঞতা আছে তাই সেই নিজে থেকে হাল ধরার দায়িত্ব নিলো। এবার সবাইকে বলা হলো ভেলাগুলো তুলে খানিক হেটে নিচে নেমে নদীতে ভাসাতে। চারজন চার কোনায় ধরে নিয়ে চল্লাম ভেলাটাকে। ভেতরে বাতাস হলে কি হবে, বেশ ভারী।
ছবি ৪ঃ যাত্রাশুরুর আগ মূহুর্তে কিঞ্চিৎ ফটোসেশান
ভেলাগুলো চালিয়ে নদীর উপর দিয়ে কিছুদূর গিয়ে এক্টা যায়গায় জড়ো হলাম। চোখের সামনে দেখা দিলো পাথরময় ফেনীল জলরাশী। কায়াকে থাকা গাইড কাছে এসে আমাদেরকে বললো, "এখন আমরা আমাদের প্রথম র্যাপিডের মুখোমুখি হবো।" যেহেতু এখানে প্রপাতের মত এক্টা অংশ আছে বেশীর ভাগ সময়েই নৌকা থেকে অনেকে পড়ে যায় টাল সামলাতে না পারে। সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাক্তে বলা হলো। খুব খেয়াল রাখতে বললো তাদের নির্দেশের দিকে। প্রথমে গাইড চলে যাবে র্যাপিড পার হয়ে। তারপর এক্টা এক্টা করে ভেলা পার হবে জায়গাটা। কয়েকটা ভেলার পর আমরা যাত্রা শুরু করলাম দুরু দুরু বুকে। এরপর কি হলো তা তো শুরুতেই বললাম।
[
ছবি ৫ঃ প্রপাতে ঝাপিয়ে পড়ার মূহুর্তে আতংকিত চার নদীযাত্রী ।
পানিতে ডুবতে ডুবতে একটা জিনিস আবিস্কার করলাম। আমার মনে হয় এটা সবার বেলাতেই ঘটে। তা হলো বিপদের আগে উৎকন্ঠা থাকে বেশী। কিন্তু বিপদে যখন কেউ নিপতিত হয় তখন মাথা হয়ে যায় ঠান্ডা। এই মুহূর্তে বাঁচতে হবে এইটাই শুধু টার্গেট। গাইডের নির্দেশ ছিলো পানিতে পড়লে শরীরকে ঘুরিয়ে চিৎ করে পা লম্বা করে ফেলতে হবে। এতে করে পুরো শরীর দ্রুত পানির উপরে উঠে আসবে, যেহেতু পিএফডি গায়ে আছে। ভেসে ওঠার সাথে সাথে নির্দেশমাফিক ঘাড়ের কাছের জ্যাকেটের বকলস ধরে ফিল আর চাক টেনে ধরলো । ভেলার ধার ধরে কোনোমতে উঠে গেলাম। র্যাপিড পার হয়ে গেছি ততক্ষনে । তাই ভেলা নদীর এক কোনে ভিড়িয়ে অন্যদের পার হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। একে একে সবাই আস্তে লাগল। কয়জন পুরো সাকসেসফুলি পার হতে পেরেছিলো এ মূহুর্তে মনে নেই। কারন তখনো গলার ভেতর পানি ঢুকে যাওয়ায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। চাক-এর কাছে রুট বিয়ার ছিলো তাতে চুমুক দিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হলাম। সেইসাথে মুগ্ধতার সাথে চারিদিকে তাকালাম। এতক্ষন খেয়াল করিনি। গিরিশংকটের দুপাশ দিয়ে উঠে গেছে ঘন বন। নীল আকাশে টুক্রো টুক্রো সাদা মেঘের দল। এখানের শান্ত পানিতে তার ছায়া পড়েছে। হঠাৎ শুনি কু-ঝিকঝিক শব্দ। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি গাছের ফাকে ফাকে দেখা যাচ্ছে চলন্ত রেলগাড়ী। অপুর্ব দৃশ্য। এদিকে লীও-কে দেখি ছোটখাট জিনিস দেখে কারনে-অকারনে খুশীতে বাগবাগ হয়ে যাচ্ছে। পানির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলছে, 'ফিস! ফিস!' । তাকিয়ে দেখি কিছু মাছের পোনা জাতীয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওকে নিয়ে আমাদের একটু বেগ পেতে হচ্ছে কারণ উত্তেজনাকর মুহুর্তে সে তার সংক্ষিপ্ত ইংরেজী জ্ঞানের সবটুকুই হারিয়ে ফেলছে। লেফট প্যাডেল বললে দেখা যাচ্ছে সেও বাওয়া শুরু করেছে। আলাদাভাবে বলে দিতে হচ্ছে। মহা ঝামেলা।
ছবি ৬ঃ শান্ত জলে দম নিবার পাশাপাশি তুলে নিলাম অপুর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য।
এরপরের র্যাপিড পার হলাম খুব বেশী সমস্যা ছাড়াই। হাইড্রলিক-গুলোর উপর দিয়ে ভেলা যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল যেন ট্রাম্পলিনের উপর বসে বসে লাফাচ্ছি। মজাই লাগে এ সময়। ভাগ্যক্রমে আগের কদিন বৃষ্টি হওয়ায় নদী বেশ ফুলে ফেপে ছিলো। তাই পাথরের উপর দিয়ে কয়েক জায়গায় ঘস্টে ঘস্টে ভেলা এগোলেও আটকে যায়নি। নাহলে ভেলার উপর লাফিয়ে লাফিয়ে তাকে ছুটাতে হতো। পরবর্তী র্যাপিডের আগে গাইডরা আবার সবাইকে নদীর একপাশে জড়ো করলো। বলা হলো, এবার যে র্যাপিডটা আসছে সেটা বেশ কঠিন। কারন বিশাল পাথরের চাই-এর ফাক দিয়ে ভেলা ডানে বামে ঘুরিয়ে পাথর বাচিয়ে এগোতে হবে। পাথরের উপরে দাড়িয়ে গাইডরা আমাদের বলে দেবে কখন কিভাবে বৈঠা বাইতে হবে। একটা এক্টা করে ভেলা নেমে যেতে লাগ্লো র্যাপিডে। আমি এখানে যায়গা বদল করে মাঝে বামদিকে বসেছি। পেছন থেকে চাক ফিসফিস করে বললো, "এই র্যাপিডটার কথাই বলছিলাম, এই যাত্রার সবচেয়ে কঠিন অংশ"। টাইমিং এর একটু এদিক ওদিক হলে পাথরে আছড়ে ভেলা উল্টে যাবে। যাইহোক, সামনে এগুনো ছাড়া আর পথ নেই। যা আছে কপালে মনে মনে বলে বৈঠা বাইতে লাগলাম। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি গাইড ফরোয়ার্ড প্যাডেল করতে ইশারা করছে। পেছন থেকে চাক নির্দেশ দিলো, "অল ফরোয়ার্ড"। বড় বড় দুটো পাথরের চাইয়ের মাঝ দিয়ে স্রোত চলে গেছে, সেদিকে আগাতে থাকলাম। কাছাকাছি যেতেই, গাইড ইশারা পরিবর্তন করলো। "লেফট ব্যাক!" চাক চেচিয়ে উঠলো। তার মানে আমাকে উল্টো বাইতে হবে। প্রাণপনে বাইতে থাকলাম যাতে পাথরটাকে বামে ফেলে আগাতে পারি। কোনোরকমে পার হয়ে ফাক গলে যেতেই, হঠাৎ স্রোত এমন কঠিন হয়ে গেল যে ভেলা বাই বাই করে ঘুরতে লাগলো। আমাদের বৈঠা দিয়ে নিয়ন্ত্রন করার দূর্বল চেষ্টা পাত্তা পেলো না প্রবল স্রোতের কাছে। তাকিয়ে দেখি বিশাল এক পাথরের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। সংঘাত নিশ্চিত। দ্রুত পজিশান চেঞ্জ করে ভেলার অপরদিকে চলে আসলাম। উলটানো ঠেকাতে হবে। ধড়াম করে আছড়ে পড়লো ভেলা। পাথরের গায়ে অর্ধেক, পানিতে অর্ধেক। মূহুর্তের মধ্যে আবার পানিতে। কোনোক্রমে উল্টানোর হাত থেকে রক্ষা পেলাম। র্যাপিড পার হয়ে শান্ত পানিতে আসার পর দেখি গাইডরা হাততালি দিচ্ছে। তার মানে পারফরমেন্স ভালোই হয়েছে বলা যায়! মনে মনে সবাই একটু খুশী হলাম।
প্রায় ছয়ঘন্টা চললো ভাগে ভাগে খরস্রোতা পাথুরে নদীর সাথে এই যুদ্ধ। মাঝখানে দুপুরের খাবারের জন্য নদীর পাশে ভিড়ানো হলো। কিন্তু দম ফেলার ফুরসত ছিলো না কোনো র্যাপিডেই। তবে আমাদের ভেলাতে আর কোনো অঘটন ঘটলো না। তা অনেকটা চাকের দক্ষ হাতে হাল ধরার জন্যই। র্যাফটিং শেষে ভেলা পাড়ে ভিড়িয়ে , ধরে ধরে নিয়ে আসা হলো উপরে। একটা ট্রেলারে এগুলোকে ডাঁই করে বাসে চেপে বসলাম । এবার ফেরত যাবার পালা।
ছবি ৭ঃ বাসে ওঠার আগে বিদায়-পূর্ব ফটোসেশান।
মন্তব্য
ওয়াও ! একদম ঝর্ণার মতন লেখা। পড়ার সাথেই একটা ঝর্ণা স্নানের অনুভূতি হল।
অসংখ্য ধন্যবাদ। অনেকদিন বাদে লেখালেখি শুরু করলাম। কিছু টাইপও আছে । সুযোগ পেলেই ঠিক করে নেব। আর নিয়মিত পোস্ট দেবার ইচ্ছা আছে। আশা করি আপনাকে পাঠক হিসেবে পাব ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
কোন দুঃখে যে এইসব লেখা পড়তে যাই! দিনটা বরবাদ করে দিলেন অবনীল। আমার এখানে আবার ঠাণ্ডা পড়ে যাচ্ছে। এখন র্যাফটিং তো দূরের কথা, লেকের ধারে বসে মাছ ধরতেও কলিজা লাগে। দেখা যাক আগামী সামারে ভুজুং ভাজুং দিয়ে কয়েকজনকে রাজি করাতে পারি কিনা।
---মোখলেস হোসেন
হাহা । অবশ্যই যাবেন। লেখা পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
সাতার না জানায় জীবনের বহু মজা মিস হয়ে গেল
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
শিখে ফেলেন । আমার সাঁতার শেখার শুরুটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির সুইমিং পুলে। পরে এখানে এসে প্র্যাকটিস করেছি পুরপুরি আয়ত্বে আনতে।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
বাহ!! দারুন লাগলো পড়ে। মনে হচ্ছে আরো লেখা আসবে, আপনিতো চুপ করে বসে থাকার লোক নন। হোক আরেকটা অভিযান।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অনেক ধন্যবাদ সময় করে পড়ার জন্য। হ্যাঁ হাতে আরও কিছু লেখা আছে। দ্রুত দেবার আশা রাখি ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
পড়ে মনে হলো আমি নিজেই গেছি সেই ঝর্ণায়
Ali Amzad
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
ভালো লাগল। পরের অভিযানের গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
খায়া কাম নাই আর মাইনষের!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
“ভাত পায় না, চা খায়। ঘোড়ায় চইরা হাগবার যায়।”
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
সাঁতার খারাপ জানিনা, তবুও এমন সাহস দেখিয়ে চা খাইতে যাবো না বাপ!
লেখা-ছবিতে জমজমার পোস্টের জন্য উত্তম জাঝা।
অনেক ধন্যবাদ ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
এই জিনিসটা আমি টিভিতে সিনেমায় দেখেই অভ্যস্ত। নিজেকে কখনো ওই জায়গায় ভাবার সাহস পাই না। আপনার বিবরণ পড়তে পড়তে শিউরে উঠলাম ডুবে যাওয়া মুহূর্তের কথাটি ভেবে। অসাধারণ একটি অভিজ্ঞতা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
অনেক ধন্যবাদ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
নতুন মন্তব্য করুন