চোখের সামনে বিস্তৃত একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। যেন সত্যজিৎ রায়ের একশৃঙ্গ অভিযান গল্পের ডুংলুং-ডো। আশ্চর্য কোন জগত অপেক্ষা করে আছে তার ওপাশে। শুধু ংমুং লেপা জুতো পড়ে ফাইন্ডিং নেভারল্যান্ডের বাচ্চাদের মত ভেসে ভেসে প্রাচীর পাড়ি দেবার অপেক্ষা। কিন্তু দেয়ালটা স্থির নয়। প্রবল গর্জনে প্রতি সেকেন্ডে হাজার টন পানির ধারা ঝড়ে পড়ছে এর গা বেয়ে। প্রায় দেড়শ ফিট নিচে এসে আছড়ে পড়ে পানির উপর তৈরী করছে রহস্যঘেরা কুয়াশাজাল। হর্স-শু ফল! অসাধারন সেই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেওজনা সামলে রাখা কঠিন। কুয়াশা-কুমারী নামের এই ফেরীতে অবস্থিত অন্যান্য যাত্রীদের অবস্থাও তাই। চিৎকার চেঁচামেচি করে তারা তাদের উত্তেজনার বহিপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। কিন্তু ফেরী দেখি এগোচ্ছেই। মনে হচ্ছে যেন আসলেই এই জলরাশী ভেদ করে চলে যাবো বজ্রদেবতা হিমাম-এর গুহায়। যেখানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অপেক্ষা করে আছে আসল কুয়াশা-কুমারী লেলাওয়ালা । আছড়ে পড়া জলের ছিটায় ভিজে যাচ্ছি আমরা। অবশ্য যাত্রার শুরুতেই সবাইকে পঞ্চো দিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই রক্ষা। ফেরী প্রপাতের আরো কাছে চলে এসেছে। কথা বলতে গেলে এখন চিৎকার করতে হচ্ছে । তারপরো পানির তোড়ের শব্দ ছাপিয়ে কোন কিছু বোঝার উপায় নেই। ফেরী থামবে কখন ?
***
কে এই কুয়াশা-কুমারী বা মেইড অফ দ্য মিস্ট ? তাহলে একটা কিংবদন্তীর গল্প বলি। সে অনেককাল আগের কথা। আমেরিকার আদিবাসীদের প্রাচীন উপকথায় আছে, এককালে অনগিয়ারা নামে এক গোত্র বাস করত নিয়াগ্রা নদীর তীরে। হঠাৎ একদিন কোন কারণ ছাড়াই একে একে তাদের গোত্রের লোকজন মারা যেতে লাগলো। তারা মনে করলো নিশ্চই হিমাম তাদের উপর রূষ্ট হয়েছেন। তাদের বিশ্বাস ছিলো বজ্রদেবতা হিমাম তার দুই পুত্রকে নিয়ে বাস করে হর্স-শু জলপ্রপাতের পিছনে। দেবতার অর্ঘ হিসেবে প্রথমে তারা নিয়াগ্রা নদীতে ভাসিয়ে নৌকাভর্তি ফুল-ফল আর শিকার পাঠালো জলপ্রপাতের কাছে। কিন্তু মড়ক লেগেই থাকলো। তারপর আদিবাসীরা তাদের গোত্রের সবচেয়ে সুন্দরী কুমারীকে বলি দেওয়া শুরু করলো। প্রতিবছর ভোজসভায় তাকে নির্বাচন করা হতো। কোন এক বছর, লেলাওয়ালা, চিফ ইগল আই-এর মেয়ে নির্বাচিত হলো। নির্ধারিত দিনে তাকে নদীর তীরে নিয়ে আসা হলো। জলপ্রপাতের শুরু যেখান থেকে। গায়ে তার হরিণীর চামড়ার তৈরী লম্বা আঙরাখা। মাথায় বনফুলের মালা। সাদা বার্চগাছের বাকল দিয়ে তৈরী ক্যানুতে ভেসে জলপ্রপাতে ঝাপ দিলো সে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে। তার বাবা শোকে পাগল হয়ে আরেকটা ক্যানুতে তার পিছু নিল আত্মাহুতি দিতে।
কিন্তু লেলাওয়ালা যখন পড়ে যাচ্ছিল হিমাম-এর দুই পুত্র তাকে উদ্ধার করলো। কিন্তু অদৃষ্টের ফেরে দুজনই প্রেমে পড়লো। লেলাওয়ালা শর্ত দিলো সে তাকেই গ্রহণ করবে যে বলতে পারবে কোন অশুভশক্তি তার গ্রামের মানুষজনকে মেরে ফেলছে। অনুজ দেবপুত্র তাকে জানালো নদীর তলদেশে বাস করা এক বিরাটাকায় শ্বেতসর্পের কথা। বছরে একবার সেই সাপের যখন খিদে পায়, রাতের বেলা সে গ্রামে ঢুকে পানিতে বিষ দেয় আর বিষাক্ত পানি পানে মৃতদের গিলে খায়। লেলাওয়ালা তখন আত্মারূপে গ্রামবাসীদের কাছে গিয়ে সেই সাপনিধন করতে বলে দিলো । পরের বছর যখন সাপ গ্রামে আসলো, সাহসী গ্রামবাসীর দল মেরে মারাত্মকভাবে জখম করে দিল ওকে। নদীতে করে নিজের ডেরায় ফেরার সময় তার মাথা আটকে গেল একপাড়ে, আর লেজ অপরপাড়ে। অর্ধচন্দ্রাকৃতির মত করে। ঠিক ঘোড়ার-নাল জলপ্রপাতের কিনারে । আর লেলাওয়ালা ? সে ফিরে গেলো হিমাম দেবতার গুহায়। রাজত্ব করতে লাগলো কুয়াশা-কুমারী হয়ে।
***
২০১৭ সালের আগস্ট মাস। দিনের পর দিন পাহাড়সম কাজের চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। কয়েকদিনের জন্য সবকিছু ছেড়ে কোথাও বেড়িয়ে পড়তে মন চাইছে। এমন সময় মেইল পেলাম আমাদের আন্তর্জাতিক ছাত্রসেবা পরিষদ থেকে। স্থানীয় চার্চ আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য প্রতিবছরের মত এবারো আয়োজন করেছে নিয়াগ্রা ফলস ভ্রমন। চারদিনের এই ট্রীপে আমরা প্রথমে লেক ইরি হয়ে চলে যাবো নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহর ফিনলে লেক-এ। সেখানে আমাদের যার যার হোস্টদের বাসায় উঠবো সবাই গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে। পরদিন চলে যাবো মেইড অফ দ্য মিস্ট ফেরী-যাত্রায়। সেখান থেকে কেভ অভ দ্য উইন্ডস। হেটে হেটে আবার আমেরিকান ফলস, ব্রাইডাল ভেইল ফলস, হর্সশু ফলস, থ্রী সিস্টার্স, রেইনবো ব্রীজ, হুইর্লপুল পার্ক দেখে ফিনলে লেক ফিরবো। তারপরদিন যাবো ফিনলে লেকের কাছেই ব্ল্যাকবেরী ফার্মে। পরদিন মরগানটাউন ফেরত।
১০ তারিখ সকালে ব্যাকপ্যাক কাধে উপস্থিত হলাম চার্চের দ্বারপ্রান্তে। দেখি প্রায় বিশ-পচিশজনের বিশাল দল যাচ্ছে । বেশীরভাগি চীনদেশীয়, তবে কয়েকজন ভারতীয়ো আছে। একজন পশ্চিমবঙ্গীয় পেয়ে গেলাম। আরিজিত কলকাতার ছেলে । তবে দেশীভাইও যাচ্ছে দুজন। শুভ্র আর নিঝুম। আরো পরিচয় হলো মালয়শিয়ান ফরেন্সিক বিজ্ঞানের ছাত্র ফ্রিজলি মাজরি-এর সাথে। চিরাচরিতভাবে সবকিছুর কর্ণধার হিসেবে আছে চাক। মানে চাক লিউইস। চার্চের যাবতীয় আউটডোর প্রগ্রামে যে পরিচালকের ভূমিকায় থাকে । ষাটোর্ধ হাসিখুশি এক মজার মানুষ। সেই সাথে তার স্ত্রী জিনি, খুবই অমায়িক এবং আড্ডাপ্রিয় মহিলা। সকাল সাড়ে ন'টার দিকে কলকল করতে করতে বাসে উঠে পড়লাম সবাই। ফিনলে লেক যাবার পথে পড়বে লেক ইরি। সেখানে কিছুক্ষন থামা হবে। এখান থেকে প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা লাগে ইরি যেতে। আমার সাথে বসলো শুভ্র। ওর সাথে কথা বলতে বলতে আর মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পার করে দিলাম সময়টা।
বাস থামতেই ঝিমুনি ঝেড়ে সজাগ হলাম। ইরি চলে এসেছি। বাস থেকে নেমে কিছুদূর হাটতেই গেট পেরিয়ে লেক ইরির বিচে। পরিস্কার নীল আকাশে টুকরো মেঘ। সৈকতের সাদাবালি চিক চিক করছে রোদ পড়ে। আর লেক কোথায় ? এত সমুদ্র বলে ভুল হয় ! শুধু থেকে থেকে আছড়ে পড়া ঢেউ অনুপস্থিত। প্রায় স্থির নীল জলরাশি। সাতারের প্যান্ট পড়াই ছিল । গেঞ্জি প্যান্ট খুলে ঝাপিয়ে পড়লাম পানিতে আমরা ক'জন। বেশ ঠান্ডা পানি তবে খানিকক্ষন সাতরালে ঠান্ডা ভাবটা আর থাকেনা। শুভ্র দেখি বল নিয়ে এসেছে । লোফালোফি খেলা শুরু করলাম। আমাদের সাথে যোগদিল এন্ড্রু। সেও আমাদের মত বেড়াতে এসেছে লেকে।
ছবিঃ ইরি লেক। হঠাৎই আকাশে মেঘ চিরে রশ্মির ছটা।
এই ফাকে জানিয়ে রাখি লেক ইরি সম্বন্ধে কিছু কথা। গ্রেট লেকস বলতে আমেরিকায় যে পাচটা বৃহদাকায় সুপেয়পানির হ্রদকে বুঝানো হয় ইরি তার অন্যতম । আর চারটি হচ্ছে - সুপিরিয়র, মিশিগান, হুরন, আর ওন্টারিও। এই পাচটা হ্রদ এলাকার হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্রদের সমষ্টি। আর আয়তনের হিসেবে পৃথিবীর ২১ শতাংশ সুপেয়পানি ধারন করে এই পাচ হ্রদ। এই ইরি থেকেই পানি বয়ে গেছে নায়াগ্রা নদী হয়ে লেক ওন্টারিয়তে । আর যাবার পথে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে এসে ঝাপিয়ে পড়ছে প্রায় দু'শ ফিট নিচে।
পানি থেকে উঠে রোদ পোহাচ্ছি। এমন সময় শুভ্র এসে ফিসফিস করে বলে -
- "ভাই বুড়া ত সাধাসিধা মনে করছিলাম। হে ত বড় ফাজিল।" বুঝলাম চাক-এর কথা বলছে। হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলাম
- "কেন সে কি করসে? "
- "আমাকে বিকিনি পড়া কয়েকটা মেয়ে দেখায়া চোখ টিপ মারে।" বুঝলাম বাবাজি হাভাতের মত রৌদ্রস্নানরত স্বল্পবসনা শ্বেতাঙ্গিনীদের দিকে তাকিয়েছিলো দেখে চাক মজা করেছে। বললাম -
- "আরে এই ত চান্স। বুড়ার মাধ্যমে ভাব জমায় ফেলো।" শুভ্রর চেহারা দেখে মনে হলো কথাটা সে আসলেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। এমনসময় চাকের আবির্ভাব।
- "ভলিবল খেলবে নাকি ?" চাক জিজ্ঞেস করলো।
- "খেলা যায়"
- "চলো তাহলে সবাই।" বিচের ধারেই বেশ কয়েকটা ভলিবল খেলার কোর্ট । ওদিকে যাওয়া শুরু করলাম।
- "আরো কয়েকজন নিয়ে নিই।" বলে সাথে সাথে চাক কাছেই শুয়ে থাকা দুই বিকিনিপরিহিতা তরুনীকে ডাক দিয়ে খেলায় আমন্ত্রণ জানালো। সাথে সাথে রাজি। বুঝলাম আমাদের পোয়াবারো। বিচের বালিতে খেলা জমে উঠলো। যাহোক, খেলা শেষে তরুনীদের বিদায় জানিয়ে গোসল-টোসল সেরে উঠে পড়লাম বাসে। উদ্দেশ্য এবার ফিনলে লেক। এখান থেকে আধা ঘন্টার পথ।
ফিনলে লেকে পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। কে কোন হোস্টের সাথে যাবে আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো। আমি, শুভ্র আর দুজন চীনদেশীয় মা-মেয়ে উঠব প্যাস্টর মার্টিনের বাসায়। মার্টিনের গাড়িতে করে পৌছালাম তাদের ওখানে। অত্যন্ত ভদ্র এবং অতিথীপরায়ণ মানুষ মার্টিন ও তার ফ্যামিলি। মানে তার স্ত্রী এনি আর তাদের অত্যন্ত মিষ্টি দুই ছেলে আর এক মেয়ে। যারা আমাদের সাথে সাথেই আপন করে নিলো। তাদের স্বজ্জনতায় এবং আতিথীয়তার প্রচেষ্টায় কিছুটা বিহবল হয়ে পড়েছিলাম আমরা সত্যি বলতে গেলে। যাহোক ছিমছিয়াম পরিস্কার, অত্যন্ত গোছানো একবাসা। যাকে বলে টিপিকাল আমেরিকান বাসা ঠিক তাই। একতলায় লিভিং রুম, এবং সংলগ্ন কিচেন। বেসমেন্টে খেলার জায়গা। দোতলায় সব বেডরুম। আলাদা তিন বেডরুম আমাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হলো। বুঝলাম বেশ আরামেই কাটবে এই কটা দিন। হোস্টদের সাথে রাতের খাবার সারলাম। কারোরি ঘুম আসছিলো না। মার্টিন প্রস্তাব দিলো ফিনলে লেকের আশপাশটা ঘুরতে যাব কিনা। রাজি হয়ে গেলাম। ছোট একটা লেক। মাছ ধরার জন্য বেশ জনপ্রিয় এই লেক জানালো মার্টিন। সময় থাকলে হয়ত নৌকাভ্রমন করা যেতে পারে আশ্বাস দিলো সে । কদিন আগেই মেমোরিয়াল ডে ছিলো, তাই লেকের ধারের বাড়িগুলো আমেরিকার পতাকা দিয়ে সাজানো। লেকের পাড়ে বসে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে ফিরে আসলাম। ক্লান্ত ছিলাম সবাই। তারপরো বাচ্চাদের সাথে কিছুক্ষন খেলাধুলা করে যার যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকাল সকাল বেরোতে হবে নিয়াগ্রার উদ্দেশ্যে!
পরদিন সকালে দ্রুত নাস্তা সেরে মার্টিনের গাড়িতে করে চলে আসলাম চার্চে। বাস দাড়িয়েই ছিলো। উঠে পড়লাম সবাই। ফিনলে লেক থেকে নিয়াগ্রা ফলস স্টেট পার্ক যেতে ঘন্টা দুয়েকের মত লাগে।
পার্কিং লটে বাস থেকে নেমে সোজা গেট দিয়ে কিছুদুর এগোতেই পার্কে স্বাগত জানালেন চিফ রো-ওয়া-দা-গা-রা-দেহ ওরফে চিফ লাউড ভয়েস ওরফে চিফ ক্লিনটন রিকার্ড । তবে জলজ্যান্ত নয়। ব্রোঞ্জের লাইফ-সাইজ মুর্তি রাখা আছে ঠিক পথের পাশে। টুসকারোরা গোত্রের প্রধান এই চিফ ইন্ডিয়ান ডিফেন্স লিগের জন্য পরিচিতি। আদিবাসী আমেরিকানদের সার্বভৌমত্য রক্ষায় কাজ করে গেছেন আজীবন।
ছবিঃ পার্কে ঢুকে সামান্য এগোতেই সামনে চিফ লাউড ভয়েসের মূর্তি।
আরেকটু এগোতেই মেইড অভ দ্য মিস্টের টিকেন্ট কাউন্টার। বিশাল ভিড় সেখানে। লাইনে দাড়িয়ে পড়লাম আমরা সবাই। ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম অবজারভেশান টাওয়ারের দিকে। এই জায়গায় দাড়িয়ে আপনি একবারে দেখতে পাবেন আমেরিকান, ব্রাইডাল ভেইল আর হর্সশু ফল। অসাধারন একটা দৃশ্য। সেই সাথে জাহাজের আসা-যাওয়া, আমেরিকা আর কানাডা দুই প্রান্ত থেকে , একটা দেখবার মত ব্যাপার।
ভিডিওঃ পর্যবেক্ষন টাওয়ার থেকে সব জলপ্রপাত একনজরে।
অবজারভেশান টাওয়ারের সাথেই আছে লিফট । তাতে চড়ে নিচে নেমে গেলাম সবাই। এখান থেকে ঘুরে ঘুরে সিঁড়ি চলে গেছে ঘাটের দিকে যেখানে ফেরি অপেক্ষা করে আছে আমাদেরকে হর্স-শু ফলের কাছে নিয়ে যাবার জন্য! ফেরীতে ওঠার আগেই সবার হাতে হাতে দিয়ে দেওয়া হলো নীল রঙের পঞ্ছো । পানির ছিটা থেকে রক্ষা পাবার জন্য। প্রায় আশি ফিট লম্বা আর ত্রিশ ফিটের মত চওড়া দোতলা ফেরী । ধারনক্ষমতা প্রায় ছ'শ জনের মত। প্রায় গাদাগাদি অবস্থায় উপরের ডেকে দাড়ালাম রেলিং ঘেষে। ধীরে ধীরে রওনা দিলো ফেরী। প্রথমেই আমেরিকান ফলসের পাশ দিয়ে চললাম। নায়াগ্রা ফলসের তিন জলপ্রপাতের মধ্যে এটা দ্বিতীয় বৃহত্তম। উপরে দাড়িয়ে এই জলপ্রপাতগুলোর বিশালত্ব পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় না। সাড়ে ন'শ ফিট চওড়া আর প্রায় একশ আশি ফিট উচু পাড় থেকে অঝোরে ঝরে পড়ছে হাজার টন পানি। প্রকৃতির কি বিচিত্র আর কি বিস্ময়কর রকম সুন্দর! ঠিক এর পাশেই নায়াগ্রা নদী ভাগ হয়ে গেছে লুনা দ্বীপের কারনে, আর অপর পাশে সৃষ্টি করেছে ছোট্ট ব্রাইডাল ভেইল (নববধূর পর্দা) ফলস। বিশাল আমেরিকান ফলসের পাশে একে আলাদা করে বোঝা যায়না প্রথম দেখায়। এর নিচেই হচ্ছে আরেক আকর্ষন 'কেভ অভ দ্য উইন্ডস' যেখানে জলধারার একেবারে কাছে চলে যাওয়া যায়। ব্রাইডাল ভেইল পার হয়ে আমরা এগোতে লাগলাম মূল আকর্শন হর্স শু ফল! নিয়াগ্রা নদীর নব্বই শতাংশ পানি বয়ে যায় এর পর দিয়ে। বাকীটুকু যায় অপর দুই জলপ্রপাত দিয়ে। প্রায় আড়াই হাজার ফিটেরও বেশী চওড়া আর একশ ষাট ফিটের মত উচু এই জলপ্রপাতের মুখোমুখি হলে উপলব্ধি করা যায় প্রকৃতির কি অপার বিস্ময় -এর সামনে উপস্থিত হতে পেরেছি ! এরপরের ঘটনা কি হলো তা ত আগেই বলেছি। শেষ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ ফিট দূরত্বে আমাদের ফেরী থামলো। শিহরিত মনে তাকিয়ে থাকলাম আমরা কিছুক্ষন। পাগলের মত সবাই ছবি তুলতে লাগলো। কতক্ষন হলো মনে নেই কিন্তু সময় যেন বইছিলো না। কিন্তু একসময় আবার ফেরীর নাক ঘুরতে শুরু করলো ঘাটের দিকে।
ভিডিওঃ হর্স শু ফলের সামনে ফেরীতে। উত্তেজনায় হতবুদ্ধি অবস্থা।
কুয়াশা-কুমারী যাত্রে শেষে চললাম সবাই পরবর্তী গন্তব্য গোট আইল্যান্ড বা ছাগল দ্বীপ। হর্স-শু ফলসকে আমেরিকান আর ব্রাইডাল ভেইল ফলস থেকে পৃথক করে রেখেছে এই গোট আইল্যান্ড। সেই দ্বীপে রয়েছে আমদের পরবর্তী আকর্ষন ঝড়োবাতাসের-গুহা বা কেভ অফ দা উইন্ডস । টিকেট কেটে প্রথমেই আমাদের জুতো বদল করে স্যান্ডেল পরে নিতে হলো। সেই সাথে এবারও পঞ্চো দেওয়া হলো। লিফটে করে নামতে থাকলাম। লিফট খুলতেই চোখের সমানে এক লম্বা স্যাতস্যাতে অন্ধকার করিডোর। তার অপরপাশ থেকে আসছে প্রবল পানির তোড়ের গর্জন আর বাতাস। এগুতে থাকলাম সবাই হেঁটে হেঁটে। বাইরে বেরোতেই অবাক দৃশ্য! কাঠের সিঁড়ি চলে গেছে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরের দিকে একেবারে জলপ্রপাতের ধার ঘেঁষে। প্রবল তোড়ে পানি আছড়ে পড়ছে পাথরের উপর। পঞ্চো না থাকলে ভিজে চুপসে যেতাম সবাই। উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। উদ্দেশ্যে হারিকেন ডেক। পানির তোড় সেখানে এত যে ধাক্কায় দাড়িয়ে থাকা মুশকিল। মনে হয় যেন ভয়ানক কোন ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজের ডেকে দাড়িয়ে আছি। আমরা তিন বাংলাদেশী সেখানে দাড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করতে করতে ভিজতে লাগলাম পাগলের মত। সে এক আনন্দময় এক মূহুর্ত। কাঠের সিড়ির একেবারে শেষ মাথায় আবার অন্ধকার করিডোর । সেটার শেষে লিফটে করে ফিরে আসলাম উপরে।
ভিডিওঃ ব্রাইডাল ফলসের নিচে। কেভ অভ দা উইন্ডস ট্যুর।
ছবিঃ হারিকেন ডেকে এক উত্তজনাময় মুহুর্তে ।
এবার উদ্দেশ্যে টেরাপিন পয়েন্ট। হর্স-শু ফলসের বিখ্যাত যত চিত্র আমরা বইয়ের পাতায় বা ইন্টারনেটে দেখি। তার বেশীরভাগই তোলা হয়ে এই টেরাপিন পয়েন্ট অবজারভেশান এরিয়া থেকে। এখানে আমরা নদীর লেভেল থেকে দেখতে পাবো হর্স-শু এর আরেক সৌন্দর্য। হাজার টন পানি প্রবল ধারায় আছড়ে পড়ে রহস্যে ঘেরা কুয়াশাজাল তৈরী করে রেখেছে পুরো জায়গাটাতে। ফেরীতে উত্তেজনায় অনেকসময় হর্স-শুর বিশালতা উপলব্ধি করা যায় না। এখন যখন ঠান্ডা মাথায় তা উপলব্ধি করতে যাই তখন অনেকেরই, বিশেষ করে যারা অনুভূতিপ্রবন, তাদের নানারকম বিচিত্র প্রতিক্রিয়া হয়। শুভ্র হঠাৎ করে দেখলাম খালি বলতে লাগলো - "এতো পানি কোত্থেকে আসছে ? এতো পানি কোত্থেকে আসছে ? " । ভাবলাম একবার বলে যেখান থেকে আসছে সেখানে আমরা সাঁতরে এসেছি আসবার সময় , কিন্তু পরমূহূর্তেই বুঝলাম আসলে একধরনের আধ্যাত্মিক বোধ জাগ্রত হয়েছে ওর মধ্যে। আমাদের সাথেই ছিল জিনি, তার সাথে সে ধর্মের সার্বজনীনতা নিয়ে হঠাৎ করেই আলাপ শুরু করে দিল। চার্চের লোকেরা কেন এই ভ্রমনের উদ্দ্যোগ নেয় তার সার্থকতা টের পেলাম।
ভিডিওঃ টেরাপিন পয়েন্টে হর্স-শু ফলসের ভিউ।
টেরাপিন পয়েন্ট থেকে আমরা চলে গেলাম লুনা আইল্যান্ড। যেই দ্বীপ আমেরিকান ফলস আর ব্রাইডাল ভেইল-কে পৃথক করে রেখেছে। ঠিক দুই প্রপাতের মাঝখানে দাড়িয়ে দেখা যায় দু পাশ থেকে ঝড়ে পড়া প্রবল জলরাশি আর ভেসে থাকে কুয়াশার জাল।
ভিডিওঃ লুনা আইল্যান্ডে দুই জলপ্রপাতের মাঝে।
সেখান থেকে আমরা লম্বা হাটা দিলাম দ্বীপের দক্ষিনে । উদ্দেশ্যে থ্রী সিস্টারস আইল্যান্ড। সেলিন্ডা, এঞ্জেলিনা, আর আসেনাথ হুইটনি - নিয়াগ্রা ফলস এলাকায় প্রথমদিকার ঔপনিবেশিক, জেনারেল পার্খার্স্ট হুইটনির তিন কন্যার নামে এই তিনটা ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপ। একসময় আমেরিকার আদিবাসী ইরোকুয়ে গোত্রের লোকের এখানে ফল্মূল আর অন্যান্য উপঢৌকন উৎসর্গ করত তাদের বজ্রদেবতা হি-নো-এর উদ্দেশ্যে। তাদের ওঝা যোগাযোগ করত দেবতার সাথে এখান থেকে।
থ্রী সিস্টারস দ্বীপমালা থেকে আমরা ফিরে চললাম বাসে ওঠার জন্য। ট্যুর -এর এ পর্যায় এসে আমাদের প্ল্যান ছিলো রেইনবো ব্রিজে ওঠার। কিন্তু সেটা করতে হলে কানাডিয়ান ভিসা লাগবে যেটা আমাদের অনেকেরই করা নেই তাই আর যাওয়া হলো না। সিদ্ধান্ত হলো চলে যাবো আমরা নিয়াগ্রা জলঘূর্নির কাছে। নায়াগ্রা নদী থেকে বের হয়ে এসেছে একছোট স্রোতধারা গিরিসংকটের মাঝ দিয়ে। ধারনা করা হয় প্রায় চার হাজার বছর আগে উর্ধগামী স্রোতের কারনে পাহাড় ক্ষয়ে এই হুইর্লপুল বা জলঘূর্নির সৃষ্টি হয়েছে। সাধারনত ঘড়ির কাটার উল্টোদিকে স্রোতটা ঘুরতে থাকে অবাক এই প্রাকৃতিক খেয়াল ।
ভিডিওঃ নিয়াগ্রা জলঘুর্ণি।
এর সংলগ্ন পার্কেই দুপুরের খাবার সারলাম। খাবারের পর আমাদের ত্রিরত্নের পেয়েছে ধুমপানের তৃষ্ণা। (আমি তখন সিগারেট ছাড়ার চেষ্টায় আছি, কিন্তু দুই বিড়িখোরের পাল্লায় পড়ে নেশাটা আবার চাগিয়ে উঠেছিলো। ) কিন্তু আশেপাশে কোন দোকান পাইনি আশার পথে । ফিনলে লেকেও না। হঠাৎ দেখি আমাদের দলের রোগামত এক চীনা লোক একটু দূরে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে। সিদ্ধান্ত নিলাম তার সাথে ভাব জমিয়ে সিগারেট বাগাতে হবে। চাক-কে নাম জিজ্ঞেস করতে বলে তার নাম - বাবা ! আমরা ত অবাক। বলে কি। শুভ্র আর নিঝুম শুরু করল খাঁটি বাংলায় মান্না স্টাইলে মর্মান্তিক ডাক -
"বাবা ! বাবা ! একটা সিগারেট হবে বাবা। বড় তিয়াস পেয়েছে বাবা"। তো বাবা বুঝলো কিনা জানি না। সড়াৎ করে পকেট থেকে প্যাকেট বের করে সিগারেট অফার করলো। এরকমই ত বাবা চাই! তবে তার সাথে আলাপ জমানো দূঃসাধ্য । ইংরেজী জ্ঞানে একেবারে ক-অক্ষর গোমাংস অবস্থা। তবে ইশারা ইঙ্গিতে বিড়িখোরে-বিড়িখোরে আলাপ ভালোই জমে উঠলো। যাহোক, খানাপিনা শেষে আমরা চললাম শপিংমলের উদ্দেশ্যে । এখানে কেনাকাটা সেরে সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। চাক জানালো এখন আরেক সৌন্দর্য দেখবে তোমরা। নদীর অপর পাড় থেকে বর্ণিল লেজার রশ্মি জলপ্রপাতের উপর ফেলে এক স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে । দ্রুত পা চালালাম জলপ্রপাতের দিকে।
ছবিঃ লেজারের লাল-নীল আভায় উদ্ভাসিত রাতের নিয়াগ্রা।
লেজার শো দেখে বাসে উঠে ফিনলে লেকের দিকে ফিরে চললাম সবাই। নিয়াগ্রা সফরের এখানেই সমাপ্তি। তবে শেষ দেখা নয়। দ্বিতীয়বার নিয়াগ্রার সাথে মোলাকাত হলো এ বছরে। এক কনফারেন্সে যোগ দিতে এসে আবার ঘোরা হয়ে গেলো। তবে এবার বোনাস হিসেবে পেয়ে গেলাম কাস্টিলিনি আর্ট মিউজিয়ামের বিখ্যাত সব নিয়াগ্রা প্রপাতের নৈসর্গিক দৃশ্যের অঙ্কিত চিত্র। সময়ের পাতা থেকে উঠে আসা সব ছবি। প্রায় শত বছর আগে কিরকম ছিলো এই জায়গা ? কেমন করে উপভোগ করত নায়াগ্রা সে সময়কার মানুষ? আদিবাসী আমেরিকানরা এর পাড়ে কিভাবে বাস করত ? এসব প্রশ্নের কিছু উত্তর পাওয়া যায় এই প্রদর্শনী দেখে।
ছবিঃ কাস্টিলিনি আর্ট মিউজিয়ামের অসামান্য কিছু চিত্রকর্ম-১। ঝড়ের রাতে উত্তাল নিয়াগ্রা।
ছবিঃ কাস্টিলিনি আর্ট মিউজিয়ামের অসামান্য কিছু চিত্রকর্ম-২। আদিবাসীরা ক্যানুতে পাড়ি দিচ্ছে নিয়াগ্রা।
ছবিঃ কাস্টিলিনি আর্ট মিউজিয়ামের অসামান্য কিছু চিত্রকর্ম-৩। আমেরিকান এবং ব্রাইডাল ভেইল শিল্পীর তুলিতে।
বারবার যেতে ইচ্ছে করে এমন এক জায়গা নিয়াগ্রা ফলস স্টেট পার্ক । আপনাকেও দেখে আসার আমন্ত্রণ রইলো ।
For all the said,
I could not see the waterfall
until I came and saw the water falling,
its lace legs and its womanly arms sheeting down,
while something howled like thunder,
over the rocks,
all day and all night –
unspooling
like ribbons made of snow,
or god’s white hair.
At any distance
it fell without a break or seam, and slowly, a simple
....
wings of the tumbling water
I never could have
imagined. And maybe there will be,
after all,
some slack and perfectly balanced
blind and rough peace, finally,
in the deep and green and utterly motionless pools after all that
falling?
-- Mary Oliver: The Waterfall
মন্তব্য
বর্ণনা, ছবি,ভিড্যু মিলে অতি চমৎকার উপস্হাপন ভাই! এরকম জায়গায় গেলে কেমন জানি ভ্যাবলা বনে যাই। প্রথমবার গিয়ে কানের পাশে, ওমাইগড! ওয়াওওও টাওয়াও ইত্যাদি উচ্ছ্বাসেও কেমন বোকা বোকা চোখে দেখে গেছি শুধু ওই বিশাল জলরাশির বিস্ময়! সবার সাথে পাল্লা দিয়ে ছবিছাবা তুলতেও হাত ওঠে না....আপনার এই সচিত্র বর্ণনাগুলো সময়ের চমৎকার স্মৃতি ধরে রাখছে। সচল থাকুক ভ্রমণ-আনন্দ-আর বর্ণনাকথন। শুভকামনা।
আসলেই হতবিহবল অবস্থায় ছবি তোলার কথাই মনে থাকে না অনেকসময়। ভাগ্যিস মনে করিয়ে দেবার মত লোকজন সাথে ছিল। লেখা ভালো লেগেছে যেনে অনেক ভালো লাগলো। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ । সেইসাথে আগামী লেখা পড়ার আমন্ত্রণ রইল ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আয়নাদিদির মন্তব্যর সাথে সহমত।
এরপর একবার কানাডার দিক থেকে দেখে আসুন এই প্রপাত-কে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি - অন্যরকম লাগবে, আরো ভালো লাগবে। আর ঘূর্ণায়মান ভোজনালয়টিতে আগাম ব্যবস্থা করে ভোজন সারতেও ভুলবেন না আশা করি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ। কানাডার দিক থেকে নাকি আরো সুন্দর লাগে শুনেছি। যাবার ইচ্ছে আছে। হাহা, ঘুরতে ঘুরতে খেতে গিয়ে মাথা ঘুরে যাবে না তো ?
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
মাথা ঘুরে যাবে - দামে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
চালায়ে যা ব্যাটা, একদিন হাইকিং-এ দেখা হয়ে যাবে
facebook
থ্যাংকস দোস্ত। চেষ্টা করছি যতটুকু পারি। অবশ্যই সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকলাম। সেই বহুবছর আগে ফয়েজ লেকে টিলায় বসে হিমালয় নিয়ে যে গল্প বলেছিলি, ওইরকম আরও গল্প শোনা আর আড্ডা হবে নিশ্চই।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
নতুন মন্তব্য করুন