জনশ্রুতি আছে, জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ নাকি বলেছলেন, "ঈশ্বরের সাথে যখন দেখা হবে আমি তাকে দুটো প্রশ্ন করবোঃ এক হলো আপেক্ষিকতা কেন? আরেকটা হলো, টার্বুলেন্স বা আলোড়ন কেন ? আমার বিশ্বাস প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা সে দিতে পারবে।" মানবমস্তিস্কের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটা বৈশিষ্ট্য হলো প্যাটার্ন চিনতে আর তা বর্ণনা করতে পারা। আর তারমধ্যে অন্যতম কঠিন যে প্যাটার্ন আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি তা হলো ফ্লুইড ডাইনামিক্সের টার্বুলেন্স বা আলোড়ন প্রবাহ । গাণিতিকভাবে এটা বোঝা কষ্টসাধ্য হলেও শিল্পের সাহায্যে আমরা কিন্তু একে চিত্রায়িত করতে সক্ষম হয়েছি।
১৮৮৯ সালের জুন মাস। এক মনবিকারে আক্রান্ত হয়ে নিজের কান হারিয়ে ফ্রান্সের সেইন্ট-রেমি-ডি-প্রভঁসের সেইন্ট-পল-ডি-মুজল আশ্রমে দিন যাপন করছেন ভিনসেন্ট ভ্যানগগ। কামরার জানলা দিয়ে দৃশ্যমান সূর্যদয়ের ঠিক আগের মূহূর্তের চিত্রটা এঁকে ফেললেন তিনি একদিন। 'দ্য স্টারি নাইট' নামের সেই ছবিতে বৃত্তাকার পথে তুলি চালিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘূর্নায়মান মেঘমালা আর তারারাজি।
ছবিঃ দ্য স্টারি নাইট, ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, ১৮৮৯।
ভ্যানগগ আর তার সমসাময়িক ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পীরা তাদের পূর্বসুরীদের চেয়ে একটু ভিন্নভাবে আলোর উপস্থিতিকে ক্যানভাসে ধারন করতে চেয়েছেন। দেখে মনে হয়ে যেন শুধু আলোর উপস্থিতি নয়, তার গতিপ্রকৃতিকেও ক্যানভাসবন্দি করার চেষ্টায় ছিলেন তারা। যেমন, পানিতে আলোর ফোটা ফোটায় উপস্থিতি অথবা ঝিকিমিকি করা তারার আলো আর রাতের ঘননীল আকাশে নরম দুধসাদা আলোকতরঙ্গের মিশেল। এই প্রভাবটা তৈরী হয়েছে লুমিনেন্স বা ঔজ্জ্বল্যের জন্য। ক্যানভাসে ব্যবহৃত রঙের মধ্যে যে আলোর ইনটেন্সিটি বা তীব্রতা সেটাকেই লুমিনেন্স বা ঔজ্জ্বল্য বলা হচ্ছে। আমাদের মাথার পেছনে মস্তিস্কের দৃশ্যপট প্রক্রিয়াকরণ যে অংশ রয়েছে, যেটাকে ভিজুয়াল কর্টেক্স বলা হয়, তার অপেক্ষাকৃত অদিম অংশটি আলোক বৈসদৃশ্য বা কন্ট্রাস্ট আর গতি চিনতে পারে, তবে রং নয়। দুটো ভিন্ন রঙের ঔজ্জ্বল্য যদি এক হয় তাহলে সে দুটোকে মিশিয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের যে নরগোষ্ঠীগত উপভাগ (primate subdivision) রয়েছে, সেটা মিশেল ছাড়াই আলাদা দুটো রঙ দেখতে পারে। মস্তিষ্কের এই দুটো আংশ যখন একি সাথে প্রক্রিয়া করতে থাকে, তখন ইম্প্রেশনিস্টদের এসব চিত্রে আলোর কাজগুলো দেখলে মনে হয় যেন তা কম্পমান, ঝিকিমিক করছে, বিচিত্রভাবে বিকির্ণ হচ্ছে। এই কারনে ভ্যানগগের এই অমরসৃষ্টিসহ অন্যান্য ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা, শক্তিশালী, সংক্ষিপ্ত তুলির আঁচড়ে অদ্ভুতরকম বাস্তব আলোর চঞ্চলতার প্রকৃতি চিত্রবন্দী করতে পেরেছেন।
ছবিঃ রোড উইথ সাইপ্রেস এন্ড স্টার, ১৮৯০, আলোড়ন চিত্রায়নের আরেক উদাহরন।
ছবিঃ হুইটফিল্ড উইথ ক্রোওজ, ১৮৯০।
কাছাকাছি সময়ের কথা। রুশ গণিতবিদ আন্দ্রেই কোলমোগরভ টার্বুলেন্সের ব্যাপারে আমাদের গানীতিক সমঝোতাকে আরো এগিয়ে আনেন যখন তিনি প্রস্তাব করেন, আলোড়িত তরলে R দৈর্ঘে যে শক্তি সেটি R^(5/3) এর সমানুপাতিক। পরিক্ষাগারে পরিমাপ করে দেখে গেছে কলমোগরভ আলোড়িত স্রোত কিভাবে কাজ করে তা সমাধানে খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন। যদিও আলোড়নের সম্পূর্ন ব্যাখ্যা এখনো পদার্থবিদ্যার অমিমাংসিত সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। একটা আলোড়ন স্রোত প্রতিরূপ হয় যদি শক্তিধারার অবস্থান থাকে। অন্যভাবে বলতে গেলে, বড় ঘূর্নী ছোট ঘূর্নীতে শক্তি সঞ্চারন করে, যেটা একিভাবে সঞ্চারন করে আরো ভিন্ন আকারের ঘুর্ণীতে। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, বৃহস্পতি গ্রহের বিশাল লোহিত ফোটা (great red spot), আকাশে মেঘের আকার এবং মহাজাগতিক ধুলিকণা। ২০০৪ সালে, হাবল মহাকাশ দূরবীণের সাহায্যে, বিজ্ঞানীরা দেখতে পান এক নক্ষত্রের চারপাশে অবস্থিত ধুলিমেঘ আর গ্যাসের ঘূর্নী। যা তাদের ভ্যান গগের 'স্টারি নাইট'-এর কথা মনে করিয়ে দেয়।
ছবিঃ ভয়েজার-১ থেকে তোলা বৃহস্পতির গ্রেট রেড স্পট।
ছবিঃ সুপারজায়ান্ট নক্ষত্র ভি৮৩৮ এর চারপাশের মহাজাগতিক ধুলি থেকে আলো ঠিকরে আসছে।
এর থেকে উৎসাহিত হয়ে মেক্সিকো স্পেন আর ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা ভ্যান গগের ছবির ঔজ্জ্বল্য পরীক্ষায় আগ্রহী হন। তারা আবিস্কার করেন আলোড়িত তরলের কাঠামোর বিশেষ প্রকৃতি, যেগুলো কলমোগরভের সমীকরনের কাছাকাছি, ভ্যান গগের অনেক চিত্রে তা লুকিয়ে আছে। গবেষকগন চিত্রগুলোকে ডিজিটাইজ করে যেকোন দুটো পিক্সেলের মধ্যবর্তী উজ্জ্বলতার তারতম্য পরিমাপ করেন। পিক্সেল পার্থক্যের চার্ট থেকে তারা সিদ্ধান্তে আসেন যে ভ্যানগগের মনবিকারগ্রস্ত সময়ের চিত্রগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে তরল আলোড়নের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ন। পাইপ মুখে আত্মপ্রতিকৃতি, তার অপেক্ষাকৃত শান্ত পর্যায়ের জীবনের ছবি, তাতে কিন্তু এই সাদৃশ্য নেই।
ছবিঃ আত্মপ্রতিকৃতি, ভ্যান গগ, ১৮৮৯। পাইপের ধোয়ায় আলোড়ন অনুপস্থিত।
ছবিঃ এডভার্ড মাঙ্ক, দ্য স্ক্রিম, ১৯১০।
অন্যান্য শিল্পীদের কাজ যেগুলো প্রথম দেখায় আলোড়নপূর্ন মনে হয় যেমন, মাঙ্কের 'দ্য স্ক্রিম' তাতেও কিন্তু অনুপস্থিত। অনেক সহজেই বলে ফেলা যায় যে ভ্যানগগের দুর্দান্ত প্রতিভা তাকে আলোড়ন চিত্রায়িত করতে সক্ষম করেছে। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটার ভেতর থেকে উঠে আসা সৌন্দর্য্যটাকে ঠিকমত প্রকাশ করাটা অত্যন্ত কঠিন যে প্রচন্ড কষ্টের এক্টা সময় অতিবাহিত করার সময় ভ্যানগগ কোন এক উপায়ে, গোটা মানুষ্যজাতীর কাছে অন্যতম দূর্বোধ্য প্রকৃতির এক ধারনাকে উপলব্ধি করতে এবং চিত্রায়িত করতে পেরেছেন। তার অদ্বিতীয় মানস্পটে আন্দোলন, তরল এবং আলোর গভীরতম রহস্য একীভূত হয়েছে।
ছবিঃ নিউইয়র্ক মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট, ২০১৭। অমর সৃষ্টির সান্নিধ্যে অধম।
তথ্যসূত্রঃ
[১] Aragón, José Luis, et al. "Turbulent luminance in impassioned van Gogh paintings." Journal of Mathematical Imaging and Vision 30.3 (2008): 275-283.
মন্তব্য
চমৎকার!
বৃহস্পতির বিশাল লোহিত ফোঁটা যেহেতু একটাই, একে আরেকটু আঁটো করে বিষুদতিলক ডাকলে কেমন শোনায়?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য:
(অমিমাংসিত > অমীমাংসিত)
ধন্যবাদ ভাই হিমু। পরিভাষাগত ব্যাপারেও আমি অত ঘাটাঘাটি করি নাই - টার্বুলেন্স, লুমিনেন্স, ইন্টেন্সিটি, ভিসুয়াল কর্টেক্স, প্রাইমেট সাবডিভিশান এগুলোর সহজ যে পরিভাষা মাথায় এসেছে সেটাই ব্যবহার করেছি আর সাথে ইংরেজিটা দিয়ে দিয়েছি এ কারণে । ভালো বাংলা শব্দ থাকলে জানাবেন ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
বিষুদতিলককে আরেকটু আঁটো করে বৃহস্পুটু ডাকলে জ্যোতির্বিদরা কি রাগ করবেন?
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আসল ‘স্টারি নাইট’ এত ছোট?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
প্রদর্শিত ছবিটা কি আসল? প্রায়শই ছবিগুলো "সংরক্ষিত" থাকে বলে শুনেছি। নকল একটা প্রদর্শিত হয়।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
তা ত জিজ্ঞেস করে দেখিনি । তবে এই তফাত ধরতে পারে এরকম ওস্তাদ কয়জন আছে? যারা আছে তারা ত এসব মিউজিয়ামেরই শিল্প বিশেষজ্ঞ ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
হুম আড়াই ফিট বাই তিন ফিট
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
হুম আড়াই ফিট বাই তিন ফিট
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
দারুণ উপস্হাপনের জন্য জাঝা ভ্রাত! মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট গিয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরেটুরে চলে এসেছি। ছবিছাবা তুলিনি। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ছবির ক্ষতিটতি হয় যদি।
অনেক ধন্যবাদ । হ্যাঁ ফ্ল্যাশে মানা । তবে ফ্ল্যাশ লাগার কথা না। আলোর ত অভাব থাকে না। এই শেষের ছবিতে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু আমার সামনে প্রায় ২৫-৩০ জন মানুষ ভিড় করে ছবি তুলছিলো ওই সময়ে ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
লেখাটা ভাল লেগেছে।
প্রসঙ্গান্তরেঃ আমরা নানা কারণে অনেক সময় বিন্দুতে সিন্ধু দেখি। আপনার তথ্যসূত্র-টি নিয়ে https://www.businessinsider.com/why-physicists-love-vincent-van-gogh-2015-10 -এ Elena Holodny-র লেখাটার শেষ অনুচ্ছেদে গবেষকের মজার মন্তব্যটি কি আসলে আরো অনেক কিছুর সূচনাবিন্দু? কে জানে! আবার অসুস্থ শিল্পী কোন ছবি অসুস্থতার কারণে এঁকেছেন, অথবা ঔষধের ঘোরে এঁকেছেন - সেইটা নিয়েও বিতর্ক চলছে। দুনিয়া বড়ই বিচিত্র!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট সূচকে ওঠানামায়ো এই প্যাটার্ন লক্ষ্য করা গেছে। ব্যক্তিগত আমার কাছে সেটা অপেক্ষাকৃত কম চমকপ্রদ কারণ এই ধরনের জটিল ডাটায় বিভিন্ন ধরনের প্যাটার্ন অবিস্কার করা যায়। কিন্তু ভ্যানগগের মনবিকারগ্রস্থ সময়ের চিত্রগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষের মানসিক/সৃজনশীল ক্ষমতার এক ধরনের নতুন দিগন্ত দেখায়। এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব আগ্রহের।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
- এই বাক্যগুলি মোটামুটি মাথার দশ হাত উপর দিয়ে গেলো। এই ভাষা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদের চেয়েও জটিল ও আড়ষ্ট লাগলো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হাহা অনেক ধন্যবাদ পান্ডবদা। এই ধরনের সমালোচনার জন্যই আমি অপেক্ষা করে বসে থাকি। পদার্থবিদ্যার ছাত্র না হয়েও এরকম জটিল একটা বিষয় নিয়ে লিখতে যাওয়া আমার জন্যে ত ধৃষ্টতা। তারপরেও এক ধরনের ভালোবাসা থেকে চেষ্টা করা। টার্বুলেন্স ফ্লো নিয়ে আরেকটু পড়তে হবে। দেখি সময় করে উঠতে পারি কিনা।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
শুরুটা কেন জানি টেড-এড এর এই ভিডিওর ওনুবাদ মনে হল
অনুবাদ ভালো হয়েছে ?
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
হুম
সাংঘাতিক ব্যাপারস্যাপার! এই ব্যাপারটা চিজিন ল্যু তার ডেথস এন্ডে বলছিলেন, কিন্তু তোর লেখায় বিস্তারিত জানলাম। ভাল লিখছিস।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ওয়াও তাই নাকি ? সিরিজটা পড়তে হবে।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
অসাধারন। ব্যাপারটা বাংলায় বোঝানো কষ্টসাধ্য, কিন্তু আপনি অনেকটাই সফলভাবে তা পেরেছেন।
অনেক ধন্যবাদ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
নতুন মন্তব্য করুন