ভটভট শব্দ করতে করতে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে আমাদের স্টীমার ওয়াইও নদীর বুক চিরে। কোন অত্যাধুনিক জলযান নয়, সেই ১৯শতকের শুরুর দিকে ব্যবহৃত স্টীমইঞ্জিন চালিত প্যাডল হুইলবিশিষ্ট স্টিমবোটেরই এক নব অনুরূপ । কিন্তু একি স্টেয়ারিং হুইল এ কার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন ক্যাপ্টেন ? স্বয়ং এই নাদানের হাতে! নিজেকে ত পপাই দা সেইলরম্যান মনে হচ্ছে! শুধু মুখে পাইপ আর নাবিকদের টুপিটাই পড়া বাকি। কিন্তু সাথে স্পিনাচ না থাকায় সেই বিশাল কাঠের স্টিয়ারিংটাকে ফ্যানের মত ঘুরান্তি দিতে পারলাম না। সত্যি বলতে গেলে দুহাতে খুব জোর দিয়ে স্টিয়ারিং কিছুটা ঘুরিয়ে সামান্য ডানে-বায়ে করতে পারলাম স্টীমারটাকে। ঠিকমত এগিয়ে নিতে পারবো তো ?
ছবিঃ ব্লেনারহ্যাসেট ম্যানসন।
...
ওহাইও নদীর মাঝে এক দ্বীপ, নয়নাভিরাম ক্ষেতখামার আর ঘাসের বিস্তির্ণ সমতল, তার উপরে প্রাসাদপম এক বাড়ী। যেন উনবিংশ শতাব্দির লেখা কোন উপন্যাসের পটভূমি। ভ্রমন বৃত্তান্তে এইরকম বর্ণনা আর ছবি দেখে আর দেরী করিনি, ঝট করে বুক করে ফেললাম ব্লেনারহ্যাসেট হিস্টরিকাল স্টেট পার্কের ভ্রমনে। ওহাইও নদীর সবচেয়ে নামকরা দ্বীপ ব্লেনারহ্যাসেট। পারকারসবার্গ থেকে দুই মাইল পশ্চিমে এর অবস্থান। লম্বায় চার মাইল আর ৩৮১ একর আয়তনের ব্লেনারহ্যাসেট ওহাইও নদীর পঞ্চম বৃহত্তম দ্বীপ। অনুমান করা হয় ১৩০০ খৃষ্টাব্দের কিছু পরে ওহাইও নদীর মূল ধারার উত্তরে একটা অতিরিক্ত ধারা তৈরী হয় যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় এই দ্বীপ। উর্বরা জমি, সুপেয় পানি আর নদীপথে যাতায়াতে সুবিধাজনক আশ্রয়স্থল হিসেবে দ্বীপটা স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্টকরে অভিবাসীদের। ১৬৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দ্বীপ ছিল আদিবাসী আমেরিকানদের দখলে। তারা দ্বীপের বেশীরভাগ জঙ্গল পরিস্কার করে ভুট্টা চাষ করা শুরু করে, বাস করতো গাছের ছাল আর নলখাগড়ার তৈরী মাদুরজাতীয় কাঠামো দিয়ে তৈরী ঘরে। বিংশ শতাব্দীর প্রত্নতাত্তিক খননে প্রকাশ পেয়েছে ব্লেনারহ্যাসেট হচ্ছে মিডওয়েস্ট স্টেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রত্নশিল্প সমৃদ্ধ এলাকা।
খুব সকালে মরগানটাউন স্টেশান থেকে বাসে চেপে বসলাম পারকার্সবার্গ-এর উদ্দেশ্যে। বাস ভর্তি বিভিন্ন দেশী ছাত্রছাত্রী, ভিজিটিং স্কলার এবং আমার মত কাজ ফাকি দেওয়া সহকারী গবেষক। যাহোক প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে মোটামোটি বৈশিষ্ট্যহীন এক বাস যাত্রার পর এসে পৌছলাম ওয়াইও নদীর তীরে। ট্রীপ পরিকল্পনায় ছিলো আগে আমরা ঢু মারবো ব্লেনারহ্যাসেট মিউজিয়াম অব রিজনাল হিস্টরী-তে। তিনটা তলায় প্রদর্শিত হচ্ছে এই মিউজিয়ামের দর্শনীয় বস্তুগুলো। প্রথম তলায় আছে পোর্ট্রেট গ্যালারি, হস্তনির্মিত বিভিন্ন বস্তু এবং ব্লেনারহ্যাসেট পরিবার এবং তাদের নামধারী দ্বীপের ইতিহাস। দ্বিতীয় তলায় রিভারবোট এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন আগ্নেয়াস্ত্রের প্রদর্শনী। তবে আমার কাছে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক লাগলো মাটির নিচে বেসমেন্টে অবস্থিত তাদের আদিবাসী আমেরিকানদের হস্তশিল্পের প্রদর্শনী। আদিবাসী আমেরিকানদের হস্তনির্মিত বিভিন্ন নিদর্শনের এত বৈচিত্রময় সংগ্রহ আমি বড় বড় মিউজিয়ামগুলোতেও দেখিনি।
ছবিঃ প্রথম তলায় রক্ষিত প্রাচীন স্থল এবং জলযানের সংগ্রহ।
ছবিঃ দ্বিতীয় তলার ১৯ শতকের বিভিন্ন রিভলবারের সংগ্রহ। কোলট পয়েন্ট ৩৬ (১৮৫১), কোল্ট পয়েন্ট ৩১ (১৮৪৯) এবং কোল্ট পয়েন্ট ৪৪ (১৮৬০)।
ছবিঃ ১৯ শতকের ব্যবহ্ররত রাইফেলের সংগ্রহ। উপরের গুলি হাফ স্টক পারকাশন রাইফেল। মাঝখানে টুয়েলভ গজ ডবল ব্যারেল শটগান। তার নিচে ফুল স্টক পারকাশন রাইফেল। একদম নিচে দুটি অফিসার্স সোর্ড।
ছবিঃ আগ্নেয়াস্ত্রের আরো সংগ্রহ বিভিন্ন ধরনের কোল্ট রিভলবার এবং ফুল স্টক পারকাশন রাইফেল।
মাটির নিচের ঘরে আদিবাসী আমেরিকানদের ফেলে যাওয়া নিদর্শনের বেশ জবরদস্ত এক সংগ্রহশালা।
ছবিঃ অলংকারের আদি নিদর্শন। ১৮৬৬ থেকে ১৯১১ মাঝে ওয়াইও নদীর তীরে ভেসে আসা এগুলো।
ছবিঃ একদম প্রথমদিককার ব্যবহ্ররত টমাহক কুঠার। লক্ষ্য করুন ফলাগুলো পাথরের (উপরে) , পরের দিকের (নিচের) টমাহকের ফলা ছিলো ধাতব নির্মিত।
ছবিঃ তীরের ফলার বিবর্তন। উপরের গুলো আদিমতম থেকে নিচে অপেক্ষাকৃত আধুনিকগুলো।
ছবিঃ রাজদন্ডবিশেষ। আভিজাত্যের এবং কতৃত্ববহনকারী প্রতীক।
ছবিঃ এক অত্যাশ্চর্য সংগ্রহ । ম্যামথের পায়ের হাড়। খোজ পাওয়া যায় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার বোয়াজ-এ।
মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে সবাই চললাম ঘাটের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে স্টীমারে করে আমরা পাড়ি দেবো দ্বীপের উদ্দেশ্যে। যথাসময়ে তরী এসে ভিড়লো ঘাটে। একতলা এবং তুলনামূলকভাবে ছোট আকৃতির স্টীমার, টেনেটুনে জনা পঞ্চাশেক লোকের জায়গা হবে এতে। ছাদে ক্যাপ্টেন্স ডেক আর সেই সাথে রেলিং এ ঘেরা চেয়ার দিয়ে সাজানো ছাদ। নদী ভ্রমনের দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতে চাইলে এর থেকে ভালো যায়গা আর হয়না। স্টীমার ছেড়ে দিলে শুরু হলো ওহাইও নদী নিয়ে ক্যাপ্টেনের গতবাধা ধারা বিবরনী।
ছবিঃ ১৯শতকের দিকে এই প্যাডেল হুইলই ছিলো স্টীমবোট-এর মূল পরিচালক। পরে ১৯শতকের শেষের দিকে এসে স্ক্রু প্রপেলার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
প্রায় ৯৮০ মাইল লম্বা ওহাইও নদীর শুরু হয়েছে পশ্চিম পেন্সিলভেনিয়া থেকে দক্ষিন-পশ্চিমে। লেক ইরির কিছুটা দক্ষিন থেকে শুরু এর প্রবাহ । সেখান থেকে চলে গেছে ইলিনয়ের দক্ষিন কোনে যেখানে গিয়ে সে মিশেছে মিসিসিপি নদীর সাথে। আমেরিকার আদিনিবাসী সেনেকা গোত্র এই নদীকে ডাকত ওহি-ইয়ো, যার মানে হলো 'ভালো নদী'। সেখান থেকেই ওহাইও নামের উৎপত্তি। আমেরিকার অন্যতম জাতীর-জনক থমাস জেফারসন ওহাইও-কে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম নদী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। যাহোক, এক পর্যায় ক্যাপ্টেন আমন্ত্রন জানালেন কেউ বোট স্টীয়ার করতে চায় কিনা। নতুন কোন অভিজ্ঞতার সুযোগ থাকলে সাধারনত তা হেলায় হারাই না। ঢুকে পড়লাম ক্যাপ্টেন্স ডেকে । ছোট একটা কক্ষ। সামনে বিশাল বড় এক স্টীয়ারিং হুইল আর তার চারপাশে বিভিন্ন হাতল এবং ডায়াল। এরপরে কি হলো তা তো শুরুতেই বলেছি। স্টীমার চালকদের কাজের ব্যাপারে ধারনা এবং নতুন করে শ্রদ্ধাবোধ জন্মালো এই সামান্য সময়ের স্টীমার চালনার অভিজ্ঞতা থেকে।
ছবিঃ স্টীমারের স্টীয়ারিং হুইলের সাথে ধস্তাধস্তিরত অধম।
যাহোক, কোনরকম বাধাবপত্তি ছাড়াই শেষ পর্যন্ত প্রায় আধাঘন্টা নদীভ্রমন শেষে পৌছলাম দ্বীপের ঘাটে। ঘাটের একেবারেই কাছে ব্লেনারহ্যাসেট ম্যানশান । দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম সদর দরজায় দাড়িয়ে আছেন ম্যানশান ট্যুরগাইডরা। তাদের সবার পরনে উনবিংশ শতাব্দীর গাউন এবং মাথায় বনেট। মনে হচ্ছিল হুট করে চলে এসেছি ভিক্টোরিয়ান সময়কালের কোন এক রহস্য দ্বীপে। হয়ত আদিভৌতিক কোন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে সেই আপাতঃ সুন্দর ম্যানসনের অচেনা অন্দরে? নরম ঘাস বিছানো মাঠ আর তার মাঝে মাঝে সুবজে ছাওয়া গাছ - জায়গাটাতে এই গরমের মধ্যেই একধরনের শীতল আবহ সৃষ্টি করেছে। আস্তে আস্তে রওনা দিলাম আমরা ম্যানসনের দিকে। সবাই একসাথে জড়ো হলে এবার সেই গাইডরা আমাদের শোনাতে লাগলেন মানসন এবং দ্বীপের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস । ব্লেনারহ্যাসেটের লিখিত ইতিহাস শুরু হয়েছে ১৭৬৫ সালে। একজন রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে ব্যবসাকারী পশ্চিমা, নাম জর্জ ক্রোগআন এর জার্নালে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় এই স্থানের। ১৭৬৬ সালের এক পরিব্রাজক উল্লেখ করেন ডেলাওয়ার চিফ নেমাকলিন-এর কেবিন এই দ্বীপ থাকার কারনে এর নাম "নেমাকলিন্স আইল্যান্ড" হিসেবে অভিহিত হয় পরবর্তিতে। এছাড়াও বেলপ্রে দ্বীপ হিসেবেও এটি পরিচিত। ১৭৯১-৯৫ সালে ওয়াইও ভ্যালির ইন্ডিয়ান যুদ্ধের সময় এই দ্বীপে নিউ ইংল্যান্ডাররা চাষাবাদ করতো। দ্বীপ্টার সবচেয়ে স্মরণীয় অধ্যায় শুরু হয় ১৭৯৮ সালে হারম্যান এবং মার্গারেট ব্লেনারহ্যাসেট এর আগমণে। ধনী আইরিশ অভিজাত বংশীয় ছিলেন তারা । রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং ব্যক্তিগত মানহানী এড়াতে তারা পালিয়ে আসেন এই দ্বীপে। তাদের এই দ্বীপ জীবন যদিও সংক্ষিপ্ত হলেও ছিলো নানবিধ হুজুগ আর আড়ম্বরে পরিপূর্ন। কপতির ম্যানসন পশ্চিমের সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি হিসেবে নাম রটে গেল। ১৮০৫-০৬ সালের দিকে তৎকালিন ভাইস প্রেসিডেন্ট এরন বার-এর দক্ষিন-পশ্চিম সামরিক অভিযানের সময় সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহারের ফলে দ্বীপটা সারাদেশে পরিচিত হয়ে ওঠে আর সেইসাথে আমেরিকার ইতিহাসে তাদের স্থান পাকাপাকিভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। তবে সেই ইতিহাস সুখ্যাতি পূর্ন নয় কারন অচিরেই বার, ব্লেনারহ্যাসেট পরিবার এবং অন্যান্য প্রভাবশালী মহল মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত - এই অভিযোগ আনা হয়। বলা হয় তারা নাকি মধ্য আমেরিকায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছিলেন - যা 'বার কন্সপিরেসি' হিসেবে পরিচিত। তৎকালিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ আনেন এবং তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। পালিয়ে যান ব্লেনারহ্যাসেট পরিবার। ভার্জিনিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী তছনছ করে ফেলে ম্যানসনটি। ১৮১১ সালে অজ্ঞাত কারোনে পুড়ে ধুলিস্বাত করা হয় বাড়িটি। পরবর্তিতে প্রায় হুবহু অনুরূপ তৈরী করা হয় জনসাধারনের প্রদর্শনের জন্য। জর্জ ওয়াশিংটনের মাউন্ট ভেরননের বাসস্থানের সাথে যথেষ্টই মিল রয়েছে ব্লেনারহ্যাসেট ম্যানসনের, সেটা এর প্যালাডিয়ান স্টাইলের নির্মানকাঠামোর জন্যই। বিভিন্ন খ্যাতিমান লেখক, কবি-সাহিত্যিক, চিত্রকরের কাজে উল্লেখ রয়েছে এই দ্বীপের কথা, যেমন - ‘দ্য স্কারলেট লেটার'-খ্যাত লেখক নাথানিয়েল হ্যাওথর্নের এক ছোটগল্পের বিষয় হিসেবে চলে আসে এই দ্বীপ, ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতায় ধরা দেয় এই স্থান, পূর্বদেশীয় চিত্রশিল্পীদের ক্যানভাসে আর দুটো নিউ ইয়র্কের অপেরায়।
ছবিঃ উনবিংশ শতাব্দীর পোশাক পরিহিত গাইড এবং লেখক।
সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই বিশাল এক হলরুম । দুপাশ দিয়ে সিড়ি অর্ধচন্দ্রাকৃতির আকারে উঠে গেছে উপর তলায়। দুই সিড়ির মাঝখান দিয়ে এগোলে ডাইনিং রুম । আর দুপাশের দুকোনায় বৈঠকখানা। গাইডরা তাদের রুটিনমাফিক অন্দরমহলের এবং আসবাবপত্রের ইতিহাস বলতে লাগলেন। মাথা ঘুরিয়ে দেখছি মাথার উপরের বিশাল ঝাড়লন্ঠন, দেয়ালে ঝুলানো প্রাক্তন অধিবাসীদের তৈলচিত্র। ডাইনিং-রুম এমনভাবে সাজানো দেখে মনে হয় যেন এখনি বাসার সবাই কলকল করতে করতে ছুটে এসে খেতে বসে যাবে, কৃত্রিম খাবারের নমুনা দিয়ে একেবারে ধরে রাখা হয়েছে সেই মুহুর্ত, সাথে সেই সময়কার কাপ-পিরিচ, ছুরি চামচ, বাসন-কোসন, ফুলদানী ইত্যাদি। বৈঠকখানায় ফায়ারপ্লেসের পাশে সুদৃশ্য কালো মেহগনীর টেবিল চায়ার পাতা, টেবিলে দোয়াত-কলম কাগজ, যেন লিখতে বসে কেউ উঠে গেছেন এইমাত্র, একটু বাদেই ফিরে আসবেন। একপাশে প্রাগতৈহাসিক এক পিয়ানোর উপরে সুরলিপি রাখা, বাজানোর অপেক্ষায়। ছোট কফি টেবলে কাপ-পিরিচ, কেতলী রাখা । নিচের তলা দেখা শেষে সিড়ি বেয়ে উপরে ঊঠে আসলাম সবাই। ঠিক মাঝখানে আরেকটা ফ্যারপ্লেসের সাম্নে গেম টেবিল, উপরে তাসের বান্ডিল রাখা। দুই পাশে করিডোর দিয়ে এগুলে সারি সারি কয়েকটি শোবার ঘর, আর তাতে সুসজ্জিত সব বিছানা, ড্রেসিং টেবিল ইত্যাদি।
ছবিঃ হলঘরের ঝাড়বাতিটা বেশ নজরকাড়া।
ছবিঃ নিচের তলার ডাইনিং রুম যেন একেবারে রেডি টু সার্ভ।
ছবিঃ বৈঠকখানা। বেশ শান্ত একটা ভাব রয়েছে ঘরটাতে।
ছবিঃ লেখালেখির ঘর। দোয়াত-কালি রেডি শুধু লেখকের অপেক্ষায়।
ছবিঃ উপরতলার একটি সুসজ্জিত বেডরুম। দেখেই মনে হচ্ছিল ইস যদি একটু গড়িয়ে নিতে পারতাম ।
ম্যানসন থেকে বেরিয়ে এসে রওনা দিলাম পরবর্তী আকর্ষনের উদ্দেশ্যে। ঘোড়াটানা গাড়ীতে দ্ব্বীপের কিয়দংশ ঘুরে দেখা। সেই আদ্যিকালের ঘোড়াটানা ওয়াগন গাড়ী, ঠিক যেমন ওয়েস্টার্ন সিনেমায় দেখে থাকি। ঘোড়াগুলো দেখতে স্বাস্থ্যবান হলেও একটা দেখলাম মুখ থেকে খালি ফ্যানা ঝড়াচ্ছে, গাড়োয়ান আমাদের আস্বস্ত করলো, ব্যাপার কিছুনা কি একধরনের বেরি জাতীয় ফল খাবার প্রতিক্রিয়ায় এরকম হচ্ছে। যাহোক, গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে ট্যুরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেশিক্ষন লাগলো না আমাদের পালা আস্তে। আমাদের গ্রুপ আছে দুই আমেরিকান যুগল, এক ফিলিস্তিনি ছাত্রী - পরে পরিচয় হলে নাম জানলাম - হাদীল, এবং আরো কয়েকজন সহযাত্রী। ওয়াগনে চড়ার ব্যাপারটা নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলেও তাতে চেপে বসার পড় বুঝতে পারলাম যে জিনিসটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না তা হলো ঘোড়ার গা থেকে ভেসে আসা তীব্র গন্ধ। গাড়োয়ানের তাতে কোন সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না, সে হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানালো । খামারের রাস্তা ধরে যাত্রা শুরু হতে শুরু হলো তার ইতিহাস বয়ান। ধীর গতিতে চলছে আমাদের ওয়াগন, গাড়োয়ানের মুখ বন্ধ হবার কোন সম্ভাবনা দেখছি না। আশে পাশে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ছে একটা দুটো লগ কেবিন আর কাঠের ঘের দেওয়া ঘোড়াদের চারণ ক্ষেত্র। এক জায়গায় এসে রাস্তা একটু ঢালুমত হয়ে যাবার পর গাড়োয়ান মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো - "এই গাড়ী কত জোরে ছুটতে পারে দেখতে চাও তোমরা?"। ওর বকবকানীতে এমনিতেই বোর হয়ে পড়েছিলাম সবাই। একটা ভিন্ন কিছু হবে এই জেনে সোৎসাহে রাজী হয়ে গেলাম সবাই। কি একটা সিগন্যাল দিলো গাড়োয়ান আর সাথে সাথে সবেগে ছুটতে শুরু করলো ঘোড়া আর সেই সাথে ওয়াগনে ঝাকুনি খেতে খেতে আমরা, আশপাশ দিয়ে দ্রুতবেগে অপসরমান ঘাসে ছাওয়া জমি আর বৃক্ষের সারি । যাহোক, ছুটোছুটি শেষে ফিরতি পথে ঘুরে ফিরে আসলাম যাত্রাশুরুর স্থানে।
ছবিঃ ঘোড়ায় টানা ওয়াগন। ব্লেনারহ্যাসেট ট্রীপের অবধারিত অংশ এই ওয়াগন রাইড ।
ওয়াগন থেকে নেমে ঘাটের দিকে হেটে ফিরছি এমন সময় চোখে পড়লো ফেলে রাখা কতগুলো সাইকেলের দিকে। কাছে গিয়ে দেখি এগুলো ভাড়া দেওয়া হচ্ছে ঘন্টা হিসেবে নিজে নিজে দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য। লোভনীয় সুযোগ। আমরা কয়েকজন ঠিক করে ফেললাম স্টীমার ফিরে আসতে আসতে এখনো ঘন্টা দেড়েক বাকী আছে এর মধ্যে নিজেরা সাইকেলে কিছুটা প্রদক্ষিন করে ফেলা যায়। চার-পাচ জন মিলে ভাড়া করে ফেললাম । মাটির রাস্তায় তেমন উচুনিচু নেই তাই চালাতে বেশ আরাম, কড়া রদ্দুরটাই একটু সমস্যা। কিন্তু এত সুন্দর ট্রেইল যে মনে হচ্ছিলো যেতেই থাকি , আর রাস্তাতো মনে হয় পুরো দ্বীপ জুড়েই , কোন শেষ নেই। কিন্তু ফিরতে হবে। অগত্যা ঘুরে ঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করলাম আরেক ট্রেইল ধরে।
ছবিঃ স্বপ্নময় সুন্দর এক ওয়াগন ট্রেইলে সাইক্লিংরত আমরা।
স্টীমারে এবার নিচের তলায় ধারের রেলিং এর পাশে দাড়ালাম আমরা চার-পাচজন। ওয়াগন আর বাইকিং করে বেশ পরিচিত হয়ে গেছিলাম আমরা ক'জন। নিজেদের দেশ, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে থাকার অভিজ্ঞতা, অন্যসব ভ্রমন অভিজ্ঞতা এসব নিয়ে আলাপ জমে উঠলো। আস্তে আস্তে দ্বীপ ছেড়ে দিল স্টীমার। কিছুটা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলাম ব্লেনারহ্যাসেট দ্বীপের দিকে। এই অল্পসময়েই এক ভালোলাগার বন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছে যেন দ্বীপটা। হয়ত ফিরে আসবো আবার ওহাইও নদীর মাঝে এই অপরূপ প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থলে। আপাতত বিদায় ব্লেনারহ্যাসেট !
To the fair Isle reverts the pleasing dream,
Again thou risest in thy green attire,
Fresh as at first thy blooming graces seem,
Thy groves, thy fields their wonted sweets respite,
Again thou'rt all my heart could c'er desire
Oh' why dear Isle art thou not still my own?
Thy charms could then for all my griefs atone.
-- The Desert Isle by Margaret Blennerhassett
মন্তব্য
বেশ একটা ঘুরন্তি হয়ে গেল আপনার ছবি আর গল্পের সাথে সাথে
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ। এই ভ্রমনটা বছর দুয়েক আগের । লিখব লিখব করে শেষ করে ওঠা হয়নি এতদিন। স্মৃতির উপর নির্ভর করে যতটা পারি বর্ণনা দেবার চেষ্টা করেছি। উপভোগ্য হয়েছে জেনে ভালো লাগলো।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
বেশ ভাল লাগল আপনার ভ্রমন কাহিনী, ভ্রমন মানুষকে বেশ মানুষিক দৃপ্তি দেয়, প্রচন্ড কাজের চাপে মানুষ যখন হাঁসফাঁস করে তখন একমাত্র এই ভ্রমণই পারে পূর্ণ মানসিক শান্তি দিতে।
আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ চমৎকার একটি ভ্রমণ আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
শুভ কামনা।
ঠিক বলেছেন। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ সময় করে পড়ার জন্য।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ এক লহমা।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
ঘুরে আসলাম। ভূগোলের পাতায়।। কালের পাতায়ও।।।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
বেশ ভাল লাগল আপনার ভ্রমন কাহিনী
নতুন মন্তব্য করুন