৪।
গুদাম ঘরটা সুবিশাল কিন্তু অসীম নয়। তবে কেন জানি আঁধার ঘেরা জায়গাটা ঘুরে দেখতে দেখতে ফ্র্যাঙ্কের মনে হতে লাগলো এর শীতল অভ্যন্তর, এর দেওয়াল ঘেরা স্থানের পরিমান থেকে বেশী। যেন দালানের একটা অংশ বিস্তৃত হয়েছে অন্য কোন জগতে। অথবা দালানের ব্যপ্তি নিয়ে ফ্র্যাঙ্কের অতিরঞ্জিত উপলব্ধির সাথে একমত পোষন করে যেন কোন যাদুবলে এর আকার ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তিত হচ্ছে। কাঠের বাক্সের দ্বারা তৈরী গলিপথ আর কার্ডবোর্ড কার্টনে ভর্তি দালানের মত উচু ধাতব থাকগুলোর মাঝামাঝি সরু রাস্তাগুলোতে স্ক্যাগের খোজ করলো ফ্র্যাঙ্ক। থেমে থেমে বাক্সের ঢাকনাগুলো পরীক্ষা করলো, যদি স্ক্যাগ কোন একটা খালি বাক্সের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, কিন্তু চলমান মৃতমানবটার জন্য অস্থায়ী কফিনের কোন ব্যবস্থা খুজে পেলো না সে। দুইবার ক্ষনিকের জন্য তার খোজ থামলো ডানপাশের ধকধকে ব্যাথাটা সামাল দেবার জন্য। স্ক্যাগের অন্তর্ধানে এতটাই মনোযোগী হয়ে পড়েছে যে, সে প্রায় ভুলেই গেছিলো একটা ইস্পাতের খুন্তি দিয়ে তাকে হাতুড়ীর মত আঘাত করা হয়েছে। এই অসাধারন যন্ত্রনা সহ্য করার ক্ষমতা, তার কাঠিন্য নিয়ে খ্যাতিতে পালক যোগ করেছে আরো। ডিপার্টমেন্টের এক বন্ধু একবার বলেছিলো যে কঠিন চীজ শ'-এর ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা একটা গন্ডার আর একটা কাঠের বেড়ার খুটির মাঝামাঝি। কিন্তু কিছু কিছু সময় আছে যখন ব্যথা সম্পূর্নরূপে সহ্য করা কাম্য। একটা কথা সত্যি, এই ব্যথা তার অনুভূতিগুলোকে আরো তীক্ষন করেছে, তাকে রেখেছে সতর্ক। একই সাথে যন্ত্রনার অনুভূতি মানুষকে বিনয়ী করে। একজন মানুষকে তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবমুখী করতে সাহায্য করে। মনে করিয়ে দেয় জীবন মূল্যবান। ফ্র্যাঙ্ক কোন মর্ষকামী মানুষ নয়, কিন্তু সে জানে যন্ত্রনা মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। স্ক্যাগকে গুলি করার পর পনের মিনিট পার হয়ে গেছে, ফ্র্যাঙ্ক এখনো তাকে খুজে পেলো না। তারপরো, সে নিশ্চিত খুনিটা এই গুদামঘর-দালানের ভেতরেই আছে, জীবিত অথবা মৃত, বৃষ্টিভেজা রাতের আধারে পালিয়ে যায় নাই। তার এই দৃঢ় বিশ্বাস নিছক কোন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নয়। এক নির্ভরযোগ্য অন্তদৃষ্টির অধিকারী সে, যা ভালো পুলিশ আর দুর্দান্ত পুলিশ অফিসারের মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। মুহুর্ত পরেই, তার অন্তর্দৃষ্টি ভীতিপ্রদক রকমভাবে নির্ভুল প্রমানিত হলো। দালানের একটা কোনায়, যেখানে বিশটা নানা আকারের ফর্কলিফট এক ডজন বৈদ্যুতিক কার্টের পাশে পার্ক করে রাখা, সেখানে অনুসন্ধান করছিলো ফ্র্যাঙ্ক। বিভিন্ন ধরনের গাঁটবিশিষ্ট হাইড্রোলিক সংযোগ আর ভোতা কাটার মত প্রসারিত অংশের জন্য লিফটগুলোকে মনে হচ্ছিলো যেন একেকটা অতিকায় কীট। আর ছাদ থেকে নেমে আসা বাতির কুয়াশাচ্ছন্ন হলুদ আলোকপ্রভায় লিফটগুলো প্রকান্ড শিকারী পতঙ্গ-এর মত সব ছায়া ফেলে আছে অন্য সব যন্ত্রপাতির উপর। সেই সব চোখা চোখা ছায়ার মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছিল ফ্র্যাঙ্ক, এমনময় স্ক্যাগ পেছন থেকে বলে উঠলোঃ "আমাকে খুজছিস নাকি?" বাঁই করে ঘুরে বন্দুক তুলে ধরলো ফ্র্যাঙ্ক। বারো ফিট দূরে স্ক্যাগ দাঁড়িয়ে। "দেখতে পাচ্ছিস আমাকে?" খুনিটা জিজ্ঞেস করলো। তার বুকের ছাতি অক্ষত, কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। "দেখতে পাচ্ছিস আমাকে?" তার তিনতলা বিল্ডিং-এর সমান পতনের ফলেও শরীরে কোন হাড় ভাঙেনি, কোন মাংসপেশী ভর্তা হয়ে যায়নি। তার নীল সুতির শার্ট রক্তে ভেজা, কিন্তু সেই রক্তের দাগের কোন উৎস চোখের পড়ছে না। "দেখতে পাচ্ছিস আমাকে?" "পাচ্ছি।" ফ্র্যাঙ্ক বললো। মুখ বাঁকা করে হাসলো স্ক্যাগ।
- "কি দেখছোস সেটা বুঝতে পারসোস ?"
- "একটা শুয়োরের বাচ্চা দেখছি। "
- "তোর ঐ ক্ষুদ্র মস্তিস্কের পক্ষে আমার আসল প্রকৃতি সম্পর্কে ধারনা করা সম্ভব না।"
- "সম্ভব, তুই একটা কুত্তার বাচ্চা।"
- "আমাকে অপমান করার ক্ষমতা তোর নেই।" স্ক্যাগ বললো।
- "চেষ্টা করে দেখতে পারি।"
- "তোর তুচ্ছ মতামত নিয়ে আমার আগ্রহ বা উদ্বেগ কোনটাই নেই।"
- "হে ঈশ্বর, আমি যেন এনাকে প্যাচাল পাড়তে পাড়তে ক্লান্ত করে না ফেলি।"
- "বিরক্তিকর হয়ে উঠতাসোস তুই। "
- "আর তুই তার-ছিঁড়া।"
একটা কৌতুকতাবিহীন হাসি উৎপন্ন করলো স্ক্যাগ, অনেকটা তার আগের সেই হাসির মত যেটা দেখে ফ্র্যাঙ্কের কুমিরের বাঁকা হাসির কথা মনে হয়েছিলো। “আমি তুই এবং তোর জাতের চেয়ে এতটাই ক্ষমতাধর যে তোর পক্ষে আমাকে বিচার করাই সম্ভব না।" "ও। তাইলে হে মহান ঈশ্বর আমার বেয়াড়া আচরনের জন্য ক্ষমা করে দিও।" স্ক্যাগের বাঁকা হাসিটা একটা কদর্য মুখবিকৃতিতে পরিণত হলো। তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে উঠলো। সেগুলো দেখতে আর সাধারন বাদামী চোখ বলে মনে হচ্ছে না। তাদের অন্ধকার গহীনে এক ক্ষুধার্ত, শীতল সরিসৃপের মত সতর্কতা। ফ্র্যাঙ্ক-এর বোধ হতে লাগলো যেন সে একটা মেঠো ইঁদুর, একটা কালোনাগীনের সম্মোহনী চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এক পা এগোলো স্ক্যাগ। ফ্র্যাঙ্ক পেছলো এক পা। "তোর জাত শুধু একটা কাজের-ই যোগ্যঃ তোরা হচ্ছিস মজাদার শিকার। " ফ্র্যাঙ্ক বললো, "বেশ, আমরা মজাদার শুনে ভালো লাগলো। " আরেক পা এগুলো স্ক্যাগ । শিকারী পতঙ্গের মত একটা ছায়া ওর মুখের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলো। ফ্র্যাঙ্ক পেছোলো আরেক পা। "তোর জাতের জন্মই হয়েছে মৃত্যুর জন্য।" বদ্ধোম্মাদ অপরাধীদের চিন্তাপ্রকৃতি নিয়ে সবসময় আগ্রহ ফ্র্যাঙ্কের, যেমন একজন শল্যচিকিৎসকের আগ্রহ রোগীর দেহ থেকে কেটে ফেলা ক্যান্সারের প্রকৃতি নিয়ে। ফ্র্যাঙ্ক বলে উঠলো, "আমার জাত মানে ? সেটা আবার কোন জাত ? " "মানবজাত।" "ও, আচ্ছা।" "মানুষ্যপ্রজাতী।" পুনরাবৃত্তি করলো স্ক্যাগ। এমনভাবে শব্দটা বলো যেন সেটা একটা জঘন্য বিশেষন। "তারমানে তুই বলতে চাইতাসোস তুই মানুষ না এইতো?" "সেটাই।" একমত হলো স্ক্যাগ। "তাহলে তুই কি?" স্ক্যাগের উম্মাদ অট্টহাসি সুমেরুর চরম শীতল বায়ুপ্রবাহের মত মর্মস্পর্শী। মনে হচ্ছে যেন শরীরের রক্তপ্রবাহের মধ্যে বরফের টুকরো জমাট বাধতে শুরু করেছে, ফ্র্যাঙ্ক শিউরে উঠলো। "আচ্ছা, অনেক হয়েছে এসব। এখন হাঁটুগেড়ে বস। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।" "তুই একেবারেই মোটামাথা।" স্ক্যাগ বললো। "এখন কিন্তু তুই আমার বিরক্তি উদ্রেক করতাসোস, হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড় হারামীর বাচ্চা।" স্ক্যাগ তার ডানহাতটা এমনভাবে প্রসারিত করে ধরলো যেন মুহূর্তের জন্য ফ্র্যাঙ্কের মনে হলো খুনিটা তার কৌশল পরিবর্তন করে জীবনভিক্ষা চাইতে শুরু করবে। তারপর তার হাতটা পরিবর্তিত হতে শুরু কলো। হাতের তালু আস্তে আস্তে লম্বা আর প্রশস্ত হতে লাগলো। আংগুলো গুলো দুই ইঞ্চি বেড়ে গেলো। গাটগুলো আরো মোটা আর গ্রন্থিল হয়ে উঠলো। হাতটা কালো হতে হতে একসময় এক অসুস্থ গলিত বাদামী-কালো-হলুদ রঙে ছেয়ে গেলো। রুক্ষ রোম গজিয়ে উঠলো চামড়া ভেদ করে। নখগুলো বেড়ে পরিনত হলো ভয়াল ধারালো নখরে। "খুব তো সাহসের ভান্ডার দেখালে এতক্ষন, দুইনাম্বারী ক্লিন্ট ইস্টউড। এখন তো ভয় লাগছে, তাই না বাছা ? ভয়টা ঠিকই পেলে শেষ পর্যন্ত, তাই না ?" শুধু ওর একটা হাত পরিবর্তিত হলো। স্ক্যাগের চেহারা বা শরীর এমনকি অন্য হাতটাতেও কোন পরিবর্তন দেখা দিলো না। নিজেকে রূপান্তরিত করার ক্ষমতার উপর তার সম্পূর্ন দখল রয়েছে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। "নেকড়েমানব," বিস্মিত হয়ে ফ্র্যাঙ্ক বললো। স্ক্যাগের মুখ থেকে আরেকটা উম্মাদ অট্টহাস্য খসে পড়ে গুদামঘরের ধাতব দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো। তার অন্য হাতটা রূপান্তরিত করতে শুরু করলো সে, কুঞ্চিত আর প্রসারিত হতে লাগলো দানবীয় আংগুলগুলো। "না। নেকড়েমানব নয়।" হিংস্রভাবে ফিসফিস করে বললো সে। "তার থেকে আরো অনেক অনেক বেশী রূপান্তরিত হবার ক্ষমতা সম্পন্ন কোনকিছু । অসীমতর অদ্ভুত এবং আরো মজার। ভয় পাচ্ছোস এখন ? প্যান্ট কি ভিজিয়ে ফেলসোস, মুরগীর বাচ্চা পুলিশ?" আবার পরিবর্তিত হতে লাগলো স্ক্যাগের হাত। রুক্ষ রোমগুলো যেখান থেকে গজিয়ে ছিলো সেই চামড়ার ভেতর মিলিয়ে গেলো। বিচিত্র বর্নের চামড়া আরো কৃষ্ণকায় হতে লাগলো, আর রংগুলো সুবজ-কালো রঙের সাথে মিশে যেতে লাগ্লো, মাছের মত আঁশ প্রকাশ পেলো। আঙ্গুলের ডগাগুলো মোটা আর বিস্তৃত হলো, গোলাকৃতির চোষক গজিয়ে উঠলো তাতে। দুই আংগুলের মাঝখানে জালের অস্তিত্ব প্রকাশ পেল। নখরগুলো সূক্ষভাবে আকার পরিবর্তন করতে লাগলো, কিন্তু তারা আগের নেকড়েসদৃশ্য নখরের চেয়ে কোন অংশেই ছোট বা কম ধারালো নয়। তার কুৎসিত ছড়ানো আঙ্গুলের মাঝের অর্ধচন্দ্রের মত অস্বচ্ছ জালের উপর দিয়ে ফ্র্যাঙ্কের দিকে কুটিল দৃষ্টি হানলো স্ক্যাগ। তারপর হাতটা সামান্য নামিয়ে বাঁকা হাসি হাসলো। তার ঠোটদুটো এখন পাতলা, কালো আর দানাদার। হাসিটা তার নবপ্রাপ্ত ধারালো দাঁত আর বাকা শ্বদন্ত প্রকাশ করলো। একটা পাতলা, পিচ্ছিল, কাটাচামচের মাথার মত ভাগ হয়ে যাওয়া জিহবা দাতের উপর দিয়ে দ্রুত চলে গেলো, দানাদার ঠোটদুটো চেটে নিলো। ফ্র্যাঙ্কের ভয়াবহ বিশ্ময় অবলোকন করে অট্টহাসি হেসে উঠলো সে । আবার মুখ পরিবর্তিত হয়ে মানুষের মুখে ফিরে গেলো। কিন্তু হাতে আরেক রূপান্তর ঘটে চলেছে এবার। মাছের আশের মত চামড়ার অংশগুলো এখন শক্ত, মসৃণ, বেগুণী-কালো, পতঙ্গের বহিরাবরনের মত খন্ড খন্ড অংশের ন্যায়, আর আঙ্গুলোগুলো, মনে হচ্ছে যেন আগুনের সামনে মোম এনে ধরা হয়েছে, গলতে গলতে স্ক্যাগের কব্জীর কাছে এসে খুরের মত ধারালো সাঁড়াশীতে পরিনত হলো। "এগুলো দেখসোস? নিশিরাতের কসাইয়ের কোন ছুরির প্রয়োজন নেই।" ফিসফিস করে উঠলো স্ক্যাগ। "আমার হাতের মধ্যেই আছে অসীম সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন খুর।" ফ্র্যাঙ্ক তার পয়েন্ট আটত্রিশটা প্রতিপক্ষের দিকে তাক করে রেখেছিলো, যদিও এতক্ষনে সে বুঝে ফেলেছে একটা টেফলন-মাথা ম্যাগনাম-কার্তুজে পূর্ণ পয়েন্ট তিনশ' সাতান্ন ম্যাগনাম হাতে থাকলেও তা আত্মরক্ষা করার জন্য যথেষ্ট নয়। বাইরে, বজ্রের কুঠারে বিদীর্ণ হলো আকাশটা। বিদ্যুৎঝলকের ধারালো ফলক গুদামঘরের উচুতে ছাদের কাছের সরু জানালা চিরে ঢুকলো। এক ঝাঁক ভেলার মত ছায়ার দল স্ক্যাগ আর ফ্র্যাঙ্কের উপর এসে পড়লো। রাতের আকাশে জুড়ে বজ্রধ্বনিত হবার সাথে সাথে ফ্র্যঙ্ক বলে উঠলো, "তাইলে তুই কোন নরকের কীট?" স্ক্যাগ সংগে সংগে উত্তর দিলো না। কয়েকমূহুর্ত এক দৃষ্টিতে ফ্র্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে রইল ও, বিভ্রান্ত মনে হলো তাকে। যখন সে কথা বলে উঠলো, তার কন্ঠস্বরে দুইরকম তীক্ষ্ণতাঃ কৌতুহল আর ক্রোধ ।
-"তোদের জাত হচ্ছে নরম। না আছে কোন স্নায়ুবল, না কোন সাহস। অজানার মুখোমুখি দাড়িয়ে, তোদের জাত এমনভাবে প্রতিক্রিয়া করে যেন নেকড়ের গন্ধ পাওয়া ভেড়া। তোদের এই দূর্বল জাতকে আমি ঘৃণা করি। সবচেয়ে শক্তিধর মানুষও ভেঙ্গে পড়ে এখন পর্যন্ত আমি যা প্রকাশ করেছি তা দেখে। শিশুর মত চিৎকার করে তারা, আতঙ্কিত হয়ে পালায়, নাহলে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মত দাড়িয়ে থাকে ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে। কিন্তু তুই না। তুই কেন আলাদা? তোর এই সাহস কোথা থেকে আসলো? নাকি তুই মাথামোটা? বুঝতে পারছিস না তুই একটা জিন্দালাশ? তুই কি এতই বোকা যে ভাবছিস এখান থেকে বেচে বের হতে পারবি? দেখ, তোর বন্দুক ধরা হাতটা কাঁপছেও না।"
-"এর থেকেও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।" আড়ষ্টভাবে বলো ফ্র্যাঙ্ক। "দুইটা ট্যাক্স অডিটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে।" স্ক্যাগ হাসলো না। পরিস্কারভাবেই অভীষ্ট শিকারের আতঙ্কগ্রস্থ প্রতিক্রিয়া তার প্রয়োজন। না হলে খুনের মধ্যে যথেষ্ট তৃপ্তি পাওয়া যায় না, এটা স্পষ্ট যে শিকারের চুড়ান্ত অপমান আর হীনতম অবস্থা তার কাম্য । হারামীর হাড্ডি, তুই আমার কাছে থেকে সেটা আদায় করতে পারবি না, ফ্র্যাঙ্ক ভাবলো। সে আবার জিজ্ঞেস করলো, "তো তুই কোন দোজখের বান্দা?" ওর মরনঘাতী সাঁড়াশীগুলো স্বশব্দে খুলতে আর বন্ধ করতে করতে ধীরে দীরে আরেক পা এগিয়ে স্ক্যাগ বলে উঠলো,"হয়তো আমি জাহান্নামের প্রসব। তোমার কি মনে সেটাই আসল ব্যাখ্যা? হ্যা? "আর কাছে আসার চেষ্টা করোনা।" ফ্র্যাঙ্ক সাবধান করলো। স্ক্যাগ ওরদিকে আরেক পা এগুলো। "নাকি আমি হয়ত একটা পিশাচ, নরকের কোন গন্ধকময় গর্ত থেকে উঠে এসেছি? তোর আত্মার মধ্যে কি একটা বিশেষ শীতলতা অনুভব করতে পারছিস। বোধ করতে পারছিস এক অশুভ কিছুর সন্নিকটে তুই?" পিছাতে গিয়ে একটা ফর্কলিফটের সাথে ধাক্কা খেল ফ্র্যাঙ্ক, বাধাটা এড়িয়ে আবার পেছোতে লাগলো সে। এগোতে এগোতে স্ক্যাগ বলে উঠলো,"অথবা আমি অন্যজগতের কোনকিছু, এক ভিন্নবিশ্বের প্রাণী, ভিন্ন কোন চাঁদের নিচে যার মাতৃগর্ভে আগমন, ভিন্ন কোন সূর্যের নিচে যার জন্ম?" কথা বলতে বলতে তার ডান চোখ খুলির ভেতরে ঢুকে গেলো, ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেলো চোখটা। চোখের গর্তটা এমনভাবে বন্ধ হয়ে গেলো যেমন ভাবে পুকুরে ঢিল ছোড়ার পর পানি ঢিলের তৈরী গর্তটাকে আবার ঢেকে দেয়, চোখের জায়গাটাতে শুধু মসৃণ চামড়া এখন। "অন্যগ্রহের প্রাণী হলে চলবে? তোর কল্পনা নাগালোর মধ্যে কি সেটা?" স্ক্যাগ বলেই চললো। "তোর কি যথেষ্ট ঘিলু আছে এটা বোঝার জন্য যে আমি এই পৃথিবীতে এসেছি স্থান-কালের মহাসাগর পাড়ি দিয়ে, মহাজাগতিক জোয়ারে ভেসে?" ফ্র্যাঙ্ক-কে আর ভাবতে হলো না কিভাবে গুদামগরের দরজা ভেংগে ঢুকেছিলো স্ক্যাগ, নিশ্চই সে হাতদুটোকে শিং-এর মত বাকা হাতুড়ী বা লোহার খুন্তির মত রুপান্তরিত করে কাজটা করেছে। আর আঙ্গুলের ডগার অত্যন্ত সরু কোন প্রসারন সৃষ্টি করে সেটা দিয়ে এলার্ম সুইচটা নিষ্ক্রিয় করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। স্ক্যাগের বাম গালে টোল পড়লো, একটা গর্তের সৃষ্টি হলো সেখানে। হারানো ডান চোখটা সেখান থেকে প্রস্ফুটিত হলো, ঠিক বাম চোখের নিচে। চোখের দুটো পলক ফেলার সাথে সাথে আবার পরবির্তন ঘটলো ওদেরঃ এখন আর সেগুলো মানুষের চোখ নয়, পতঙ্গসদৃশ, ঠিকরে বেরোন আর পুঞ্জিভুত। মনে হচ্ছে তার গলাতেও কি যেন পরিবর্তন ঘটে চলেছে, স্ক্যাগের কন্ঠসর ভারী আর খরখরে হয়ে উঠলো। "পিশাচ, ভিনগ্রহের আগন্তুক...অথবা আমি কোন জেনেটিক গবেষনা চলাকালীন ভয়াবহ দূর্ঘটনার ফসল। হ্যা? কি মনে হয় তোর ?" আবার সেই অট্টহাসি। ফ্র্যাঙ্কের অসহ্য লাগলো হাসিটা। "কি মনে হয় তোর?" স্ক্যাগ বকেই যাচ্ছে এগোতে এগোতে। পিছোতে পিছোতে ফ্র্যাঙ্ক বলে উঠলো,"তুই হয়ত ওগুলোর কোন একটা হবি। যেমনটা তুই বলেছিস...তুই আরো অদ্ভুদ এবং আরও মজার কোনকিছু।" স্ক্যাগের দুটো হাতই এখন সাড়াশীতে পরিনত। রূপান্তর এখন হাত থেকে আরো উপরের বাহুতে ক্রমশ ঘটে চলেছে; আস্তে আস্তে তার মানবাকৃতি আরো কাঁকড়াসদৃশ হয়ে উঠছে। তার সার্টের হাতার সেলাইগুলো ছিড়ে যেতে লাগলো; তারপর দেহের উপরের অংশে রূপান্তরের সাথে সাথে কাধের সেলাইগুলোও ছিড়ে গেলো। পতঙ্গের বহিরাবরনের মত খন্ড খন্ড অংশ তার বুকের ছাতির আকার আর আকৃতি বদলে দিতে থাকলো, শার্টের বোতাম গুলো ফটফট করে খুলে গেলো। যদিও ফ্র্যাঙ্ক জানতো সে শুধুই গুলির অপচয় করছে, তারপরো যত দ্রুত তারপক্ষে ট্রিগার দাবানো সম্ভব তত দ্রুত পরপর তিনটা গুলী করলো । একটা রাউন্ড স্ক্যাগের পেটে গিয়ে লাগলো, আরেকটা বুকে আর শেষেরটা গলায়। মাংসপেশী ছিন্ন হলো, হাড্ডি ভাঙলো, রক্ত নির্গত হলো। পেছনে টলে গেলো বহুরূপীটা কিন্তু মাটিতে পড়ে গেলো না। গুলির আঘাতপ্রাপ্ত জায়গাগুলো দেখলো ফ্র্যাঙ্ক, সে জানতো একজন মানুষ সাথে সাথে মারা যাবে এইসব ক্ষত থেকে। স্ক্যাগ শুধু একটু দুলে উঠলো। দেহের ভারসাম্য ফিরে পেতে পেতেই তার মাংশপেশীগুলো আবার সেলাইয়ের মতো জোড়া লাগতে শুরু করেছে। আধা মিনিটের মধ্যে ক্ষতগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলো। একটা ভেজা চিড় খাওয়ার শব্দের সাথে সাথে স্ক্যাগের মাথার খুলি আগের চেয়ে দ্বিগুন হয়ে গেলো, যদিও এর সাথে বহুরূপীটার রিভলবারের গুলি খাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। তাহার চেহারায় যেন এক আভ্যন্তরিন বিস্ফোরন ঘটলো, চেহারার সব বৈশিষ্ট্য ভেতরের দিকে ধসে পড়লো, কিন্তু প্রায় সাথে সাথে সামনের দিকে স্ফিত হলো এক পিন্ড কোষকলা, কিম্ভুত পতঙ্গজাতীয় আকৃতি ধারন করতে শুরু করলো। স্ক্যাগের নতুন মুখোবয়বের কিম্ভুতকিমাকার খুটিনাটি দেখার জন্য ফ্র্যাঙ্ক অপেক্ষা করলো না। আরো দুটো রাউন্ড গুলি করলো সেই বিকট নমনীয় চেহারাটার মধ্যে, তারপর এক দৌড়ে, একটা বৈদ্যুতিক কার্ট-এর উপর দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে, একটা বিশাল ফর্কলিফটকে পাশ কাটিয়ে, দুটো লম্বা ধাতব থাকের মাঝের গলিতে ছুটে গেলো, আর দীর্ঘ গুদামঘরের ভেতর দৌড়াতে দৌড়াতে চেষ্টা করলো পাশের ব্যাথাটা বোধ না করার। সেদিনের সকালটা যখন শুরু হয়েছিলো, বিষন্ন আর বৃষ্টিভেজা, শম্বুক গতিতে যখন যানবাহন শহরের কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছিলো, পাম ট্রী থেকে ফোটায় ফোটায় পানি ঝরে পড়ছিলো, মলিন দেখাচ্ছিলো মেঘাচ্ছন্ন দিনের নিস্প্রভ আলোতে দালানগুলো, ফ্র্যাঙ্ক ভেবেছিলো এই দিনটা এই ভেজা স্যাতস্যাতে আর থমথমে আবহাওয়ার মতই হবে - ঘটনাবিহীন, বিরক্তিকর, হয়ত এমনকি বিষাদময় । কি অবাক কান্ড। তা না হয়ে দিনটা হয়ে ঊঠলো উত্তেজনাপূর্ন, মজাদার, এমনকি উল্লাসজনক। সে কখনই জানতো না ভাগ্য কি জমা রেখেছে তার ভবিষ্যতের জন্য, এজন্যই জীবনটা মজাদার আর বেঁচে থাকাটা সার্থক। ফ্র্যাকের বন্ধুরা বলে তার এই কঠিন বহিরাবরন থাকা সত্ত্বেও, সে আনন্দমুখর জীবন পছন্দ করে। কিন্তু সেটা শুধু ওর সম্বন্ধে তাদের বলা কথাগুলোর একটা ভাগমাত্র। এক ক্রোধোম্মত মেষের মত সম্পূর্ন অমানুষিক এক চিৎকার করে উঠলো স্ক্যাগ । যে রূপ-ই সে পরিশেষে ধারন করে থাকুক না কেন, ফ্র্যাঙ্ককে ধরতে আসছে সে, আর সে আসছে দ্রুত।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন