একজন নিরীহ মানুষ

কীর্তিনাশা এর ছবি
লিখেছেন কীর্তিনাশা (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০৬/২০০৮ - ৯:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

- তোমার জন্মদিন কবে? আশার এ প্রশ্নে আমি টলে উঠলাম। যেসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই তা কেউ করলেই আমি টলে উঠি। ভয় পাই। আমি যে সুপার স্টোরে সেলসম্যানের কাজ করি তার বস একদিন জিজ্ঞেস করলেন - তোমার মা-বাবা মারা গেছেন কি করে? এ প্রশ্ন শুনেও আমি টলে উঠলাম। কারন এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমি যখন এক বছরের শিশু সেই সময়ের ঘটনা। মামার কাছে যত দূর শুনেছি তাতে সড়ক দূর্ঘটনায়। কিন্তু বসকে একদম সঠিক তথ্য না দিতে পারলে কখন আবার ধমক খাই। আশা আরেকদিন জানতে চেয়েছিল - তোমার বা হাতের কব্জিতে ও কিসের দাগ? এতেও আমি টলে উঠেছিলাম। কারন এ দাগ যে মামীর আক্রোশের ফল তা যদি আশাকে বলি, আর মামী যদি তা জানতে পারেন তবে এই পঁচিশ বছর বয়সেও আমার শরীরে ওরকম আরো দাগের সৃষ্টি হতে পারে।

আমার ডে সিফটে কাজ বলে অফিস থেকে বাসায় ফিরি সন্ধ্যা ছটায়। এর বেশি দেরী হলে মামীর নানা জটিল প্রশ্নে আমাকে টলে উঠতে হয়। তবে আজ কারন ছিল বলে বাসায় ফিরলাম সাড়ে সাতটায়। ফিরতেই মামীর ধমক - কি রে ডাক্তার দেখাতে এতক্ষণ লাগে? ওদিকে বিকেল থেকে আমার বাজার দরকার। তোকে দিয়ে কি কোন কাজই ঠিক মত হবে না? আমতা আমতা করে কারন বলতে যেতেই মামী আবার ধমকে উঠলেন - হয়েছে আর মেনী বিড়াল সাজতে হবে না। টেবিলে খাবার দেয়া আছে। খেয়ে তারাতারি বাজারে যা। আমি তারাতারি ডাইনিং রুমে গেলাম।

বাজার থেকে ফিরতেই মামার রুমে ডাক পড়লো। তাঁর কাছে যেতেই প্রশ্ন - কি নান্টু ডাক্তার কি বলল? এতো এতো যে টেস্ট করালো, তা রিপোর্টে কি হাতি ঘোড়া পেয়েছে ? আমি টলে উঠে বললাম - মামা, ডাক্তার বলেছে গার্ডিয়ান নিয়ে যেতে। আমাকে নাকি রিপোর্ট দেয়া যাবে না।

পরদিন সন্ধ্যায় মামা অনেক গাঁই গুঁই করে আমার সাথে গেলেন ডাক্তারের কাছে। আমাকে রিসেপশনে বসিয়ে রেখে তিনি ডাক্তারের সাথে অনেক ক্ষণ কথা বললেন। তারপর যখন বেরিয়ে এলেন তখন তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে আছে। ফেরার পথে রিক্সায় মামা কখনোই যা করেন না তাই করলেন। আমার কাঁধে আলতো হাত রেখে বললেন - নান্টু আইসক্রিম খাবি? আমি প্রচন্ড ভাবে টলে উঠে বলতে গেলাম - না মামা, আমি.....। কিন্তু মামা আমার কথায় কান না দিয়ে জোড় করে আইসক্রিম কিনে দিলেন। বাচ্চা ছেলের মত খেলাম আমি।

রাতে আমাকে থাকতে হয় ডাইনিং রুমে। পাশেই মামা মামীর ঘর। তাই প্রায় প্রতি রাতেই মামা মামীর ভালোবাসা-বাসীর কথা শুনতে হয়। শুনতে না চাইলেও শুনতে হয়। আজ মামার মুখে ভালোবাসার কথা নেই। আশ্চর্য হয়ে শুনলাম তিনি আমার কথা বলছেন - জানো ডাক্তার বলেছে নান্টুর দুটি কিডনিই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে । আর এজন্যই মাঝে মাঝে ওর তলপেটে ব্যাথা হয়। ইমিডিয়েট অপারেশন করিয়ে ওর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। বলো কি? - মামী প্রায় চিত্কার করে উঠলেন। হ্যা, অনেক টাকার ব্যাপার - মামা বললেন - প্রায় লাখ পাঁচেক টাকা লাগবে। কি করবো বুঝতে পারছি না। এবছর যে গাড়ি কিনতে চেয়েছিলাম। তা বোধহয় আর হলো না।

কি বলছো তুমি? - মামী আরো জোরে চিত্কার করে বললেন - গাড়ি কেনা হবে না মানে? তুমি নান্টুর পেছনে এত গুলো টাকা খরচ করবে না কি? মামার গলায় ইতস্তত ভাব - তা হলে কি করবো? ওকে তো বাঁচাতে হবে। মামী কড়া গলায় বললেন - আরে রাখো তোমার বাঁচানো! এত দিন ওকে পুষেছি। এখন একটা রোগ বাধালেই হলো? এত টাকা ওর পেছনে কিছুতেই খরচ করা যাবে না বলে দিচ্ছি। তা ছাড়া এ বছর গাড়ি কিনতেই হবে। আমি সবাইকে গাড়ির কথা বলে ফেলেছি।

তাহলে নান্টুটা চিকিত্সা ছাড়াই মরবে না কি? মামার কন্ঠে যত না বাধা দেবার প্রবনতা তার চেয়ে বেশি সমর্থন পাবার চেষ্টা। মামী উত্তর দিলেন - না তা হবে কেন? ওকে আমরা হোমিওপ্যাথির ডাক্তার দেখাবো। আর প্রতি মাসে যে ওর বেতনের টাকা নিয়ে নেই সেটা নেব না। সেই টাকা দিয়ে ও ওষুধ কিনে খাবে। মামার মনে তখনো সংশয় - হোমিওপ্যাথ ডাক্তার তো কিছুই পারবে না! যা পারে তাই করবে - মামী বললেন - এর চেয়ে বেশি কিছু করার মতা আমাদের নেই। ঠিক আছে তুমি যা ভালো বোঝ করো - মামা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

পরদিন অফিসে তলপেটে প্রচন্ড ব্যাথায় জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম অনেকগুলো উদ্বিগ্ন মুখ আমার দিকে ঝুঁকে আছে। তার মধ্যে আশার চোখে মুখে উত্কন্ঠা সবচেয়ে প্রবল - কি হয়েছে ? খুব খারাপ লাগছে? এই প্রথম আমি আশার প্রশ্নে টললাম না এবং মিথ্যে বললাম - না সব ঠিক আছে।

সেদিন সন্ধ্যায় বাসার ছাদে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। মামীর শাসন আজ সকাল থেকেই একটু ঢিলে হয়েছে। অফিস থেকে ফেরার পর তিনি খুব যত্ন করে আমাকে খাবার খেতে দিয়েছেন। তারপর খুব মিঠে গলায় বলেছেন - যা বিশ্রাম কর গিয়ে। আজ আর তোকে বাজারে যেতে হবে না। আমি এখন কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। রাগ করলে কার ওপর রাগ করবো ? কার ওপরই বা অভিমান করবো ? এ পৃথিবীতে এই মামা ছাড়া আর তো কেউ নেই আমার যার কাছে গিয়ে একটু আশ্রয নেব। আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবা-মার কথা ভাবার চেষ্টা করলাম । কিন্তু তাদের আমি এত ছোট বেলায় হারিয়েছি যে তাদের কোন কিছুই আমার মনে পড়ে না।

এমন সময় তলপেটে আবার তিব্র ব্যাথা শুরু হলো। প্রচন্ড ব্যাথায় পেট চেপে কুঁকরে বসে আছি। চোখের কোল বেয়ে নিজের অজান্তেই পানি গড়ানো শুরু হয়েছে। এ সময় টুনির কন্ঠ - মামা, কি হয়েছে ? কাদছো কেন তুমি? পৃথিবীতে এই একজন যার প্রশ্নে আমি টলি না। ও আমার মামাতো বোনের পাঁচ বছরের কন্যা। আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি পৃথিবীতে কাউকে ভালোবাসলে ওকেই বাসি। আমি উত্তর দিলাম - পেটে খুব ব্যাথা হচ্ছে আম্মু। তাই কাঁদছি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফোঁপানো ছাড়া কোন শব্দ হলো না। টুনির আবার প্রশ্ন - পেটে ব্যাথা হচ্ছে কেন? নানু বুঝি আজও খাবার দেয়নি ? দাঁড়াও আমি এক্ষুণি গিয়ে খাবার দিতে বলছি। টুনি নিচে য়েতে উদ্যত হলো। আমি বললাম - না টুনি তুমি যেও না। আমি খেয়েছি। তুমি লক্ষী মেয়ের মত আমার পাশে বসো ।

- তবে পেটে ব্যাথা হচ্ছে কেন?
- আমার পেটে খুব অসুখ তো তাই।
- তাহলে ডাক্তার দেখাও। আমার একবার দাঁতে ব্যাথা হয়ে ছিল। ডাক্তার দেখাতেই ভালো হয়ে গেছে।
- এ খুব কঠিন অসুখ। ডাক্তার সারাতে পারবো না।
- তা হলে কি ভাবে সারবে?
- এ অসুখ অপারেশন করলে সারবে। সে অনেক টাকার ব্যাপার।
- আমার নানা ভাইর তো অনেক টাকা। তাকে বললেই তিনি তোমাকে টাকা দেবেন।
- না মামনী, তোমার নানা ভাইর কাছেও অত টাকা নেই। (আমার আবার কান্না পেল)
- আচ্ছা দাঁড়াও আমি আসছি।

এই বলে টুনি নিচে ছুটে গেল। আমি তখন ব্যাথায় চোখে অন্ধকার দেখছি। মাথা নিচু করে ব্যাথা সামলাবার চেষ্টা করছি। হঠাত্ শুনি - এই নাও, আমার সবগুলো টাকা তোমাকে দিচ্ছি। এখন আর কেঁদোনা। তোমার অসুখ ভালো হয়ে যাবে। আমি তাকিয়ে দেখলাম টুনী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ওর লাল ছোট্ট মাটির ব্যাঙ্ক। এতটুকু শিশুর কাছে ঐ ছোট ব্যাঙ্কে যে টাকা আছে তাই অনেক। এ দিয়ে অনেক আইসক্রিম খাওয়া যায়। অনেক খেলনা কেনা যায়। আর টুনী তার সেই সর্বস্ব আমাকে দিয়ে দিচ্ছে। আমি টুনীকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার কান্না কিছুতেই থামতে চাচ্ছে না।


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ভাল লাগলো।

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ রউফ ভাই।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পুতুল এর ছবি

গল্পটি খুব নিখুৎ হয়েছে। আপনি লিখে যান। ৫ তারা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কীর্তিনাশা এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ পড়া মন্তব্যের জন্য।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেকক্ষন চুপচাপ রইলাম গল্পটি পড়ার পর। খুব ভাল গল্প লিখেছেন আপনি।

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

খুব ভাল... মন খারাপ করা ভাল...

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ নুশেরা আপা।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ তীরন্দাজ ভাই। আপনাদের মন্তব্য আমাকে আরো গল্প লেখার উত্সাহ যোগাবে।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

এক্কেরে ফাঁচ তারা! গুল্লি

কীর্তিনাশা এর ছবি

থ্যাঙ্কু!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আরে দারুণ! তোমার হাত যে আস্তে আস্তে দারুণ পেকে উঠেছে! সাবাস! আরো ভালো গল্প চাই, আরো চমৎকার টুইস্ট! আর আমি তো জানিই, তুমি সেটা খুব সাঙ্ঘাতিকভাবে পারো!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ মৃদুল ভাই। আমি চেষ্টা করবো আরো ভাল লিখতে।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

চমৎকার একটা মন খারাপ করা গল্প পড়লাম।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

কীর্তিনাশা এর ছবি

আপনার মন খারাপ করে দেয়ার জন্য দুঃখিত।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ। দেখিস, আমিও একদিন লিখবো।

খালেদ

কীর্তিনাশা এর ছবি

দেখিস আমিও একদিন তোর গল্প পড়বো!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

উৎসাহ দিলাম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ নজরুল ভাই।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

পারলে আমিও পাঁচ তারা দিতাম।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

কীর্তিনাশা এর ছবি

পাড়বেন নিশ্চই একদিন। সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

রেনেট এর ছবি

একরাশ মুগ্ধতা।
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

এমন গল্প পড়তে ভারি কষ্ট হয়। পড়ার পর মন-খারাপের রেশ থেকে যায়...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

রণদীপম বসু এর ছবি

করুণ মানবিক আবেদনটা ওঠে এসেছে চমৎকার। ভালো লেগেছে। কষ্ট কষ্ট ভালোলাগা।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

কীর্তিনাশা এর ছবি

সন্ন্যাসী দা, রণদীপম দা আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ পড়া ও মন্তব্যের জন্য।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।