স্কুলের মাঠ লোকে লোকারন্য। আজ বিজয় দিবস। তারই উদযাপন অনুষ্ঠান চলছে এখানে। নাচ, বাউল গান, যাত্রা-পালা কত কিছুরই না আয়োজন হয়েছে। অনুষ্ঠানের শুরু হবে রহিম মাঝিকে সোনার মেডেল পড়িয়ে। সে এ এলাকার গর্ব। সে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এ পুরো অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলতাফ মাতবর। একাত্তরে তার ভূমিকা নিয়ে যদিও প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মনে, কিন্তু আলতাফ মাতবরের ক্ষমতার দাপটে সে সব প্রশ্ন বহু আগেই ঢাকা পড়ে গেছে।
মঞ্চে তখন বক্তৃতা পর্ব চলছে। প্রথমে পাতি অতিথি, তারপর বিশেষ অতিথি অবশেষে প্রধান অতিথি বক্তৃতা দেবে। আজকের প্রধান অতিথি উপজেলার ইউএনও। বিশেষ অতিথি আলতাফ মাতবর নিজেই। আর পাতি অর্থাত্ সাধারন অতিথি আছে চার পাঁচজন। সবাই তারা মঞ্চে আসনে উপবিষ্ট হয়ে আছে। মুখে তাদের সৌম্য হাসি। অতিথির মর্যাদা পেয়ে সবাই খুব পুলকিত।
রহিম মাঝি, যে মুক্তিযোদ্ধাকে আজ মেডেল পড়ানো হবে, সে বসে আছে মঞ্চের সামনে পেতে রাখা চেয়ারের একটিতে। ষাট বছরের কাছাকাছি হয়ে গেছে বয়স। কিন্তু শরীরটা এখনো তেমনি সবল। এ বয়সেও সে নৌকা বাইতে পারে সারাদিন। সে পড়ে আছে ময়লা শাদা পাঞ্জাবি আর তার চেয়েও ময়লা লুঙ্গি। তবে সেদিকে আজ কারো লক্ষ্য নেই। আজ এই ময়লা পোষাক পড়া রহিমই এখানকার নায়ক। তাই তার আশেপাশের গন্য-মান্য, সমাজে প্রতিষ্ঠিত লোকজন তার দিকে সমিহের চোখে তাকাচ্ছে। তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু রহিম নির্বাক। তার মুখে কোন কথা নেই। সে সেই তখন থেকে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।
রহিমের মনে ঝড় ছুটেছে, তিব্র ঝড়। তার গোটা জীবনে একটাই মাত্র বিজয়। সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। তারপরের কাহিনীর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে তার পরাজয়ের ইতিহাস। যুদ্ধ থেকে বাড়িতে ফিরে বাপকে পায়নি, রাজাকারেরা ধরে নিয়ে গেছে। ছোট বোন, তাকেও নিয়ে তুলে দিয়েছে পাকি আর্মিদের হাতে। যুদ্ধ ফেরত্ রহিম পাড়েনি সে সব রাজাকারদের কিছু করতে। সে সামান্য মাঝি আর ওরা ছিল এ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত ধনী পরিবারগুলোর ছেলে-পেলে। যুদ্ধ শেষের কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে, আবার তারা স্বরূপে হাজির হয়েছে। বৃদ্ধা মা বেঁচে ছিল। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তি দূর্ভিক্ষে সে'ও দুনিয়া ছেড়েছে। কিছুদিন পরে সে বিয়ে করেছিল গ্রামেরই এক কৃষকের মেয়ে রাহেলাকে। বাচ্চা হতে গিয়ে সে মারা গেল, বাচ্চাটাও আর দুনিয়ার মুখ দেখলো না। তারপর রহিম একা হয়ে গেল এ সংসারে। আর কোন আত্মীয়-স্বজন থাকলো না তার খোঁজ নেয়ার। সেও কারো ধার ধারতো না। নিজের মনে নৌকা বাইতো। আর রাতে নিজের ভিটেতে, নিজের কুড়ে ঘরে আশ্রয় নিত। একদিন সে আশ্রয়টাও কেড়ে নিল সর্বগ্রাসী নদী। নদী ভাঙনে তলিয়ে গেল তার ঘর-বাড়ি, ভিটা-মাটি সব কিছু। সর্বশান্ত রহিমের শেষ আশ্রয় হোল তার নৌকা। প্রায় দশ বছর হতে চলল সে নৌকাতেই বসবাস করে। নৌকাই তার ঘর-বাড়ি, নৌকাই তার জীবিকা।
এতো গুলো বছর কেটে গেছে যুদ্ধের পড়ে। কেউ কখনো তার খোঁজ নেয় নি। কেউ জানতে চায়নি তার যুদ্ধকালীন দিনগুলোর কথা। গ্রামের যারা বয়স্ক তারাই কেবল জানে রহিম মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। নতুন প্রজন্মের কেউ জানে না। এ নিয়ে রহিমের কোন আক্ষেপ নেই। যে দেশে এখনো রাজাকার আর তার দোসররা আস্ফালন করে বেড়ায়, যে দেশে তার বাপ আর বোন হত্যার বিচার হয় না, সে দেশে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে তার কি হবে? রহিম পুরো দেশের অবস্থা জানেনা, খবরও রাখে না। সে তার নিজের এলাকা দিয়ে দেশকে চেনে। আর সেখানে সে এখন রাজাকারের রাজত্ব দেখে। যে আলতাফ মাতবর যুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের রাজাকার প্রধান ছিল। সে'ই এখন এখানে দন্ড মুন্ডের কর্তা, এলাকার রাজনৈতিক নেতা, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। সে তার পুরোনো ভোল পাল্টে এখন জনদরদী সেজেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কথা বলে। যারা তার বিপক্ষে কথা বলেছিল তাদের সে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে এ তল্লাট থেকে। এলাকার সুবিধাবাদিরাও জুটে গেছে তার সাথে। এখানে এখন আলতাফ মাতবরের একচ্ছত্র আধিপত্ত।
রহিম এসব নিরবে দেখে গেছে। সে সামান্য মাঝি এর কি প্রতিকার করবে? যাদের করার কথা ছিল তাদেরই তো কোন খোঁজ নেই। সবাই যার যার আখের গোছাতে ব্যাস্ত। রহিম তার নৌকা নিয়ে পড়ে থাকতো। এ ঘাট ও ঘাট যাত্রী পারাপার করে তার দিন কাটতো। আর তার জীবনের একমাত্র বিজয়ের কাহিনী সেই একাত্তরকে নিজের বুকে লালন করতো সে। যুদ্ধকালীন প্রতিটা মুহুর্ত এখনো তার চোখের সামনে ভাসে। সেসব দিন খুব কষ্টের ছিল। কিন্তু কেমন একটা উন্মাদনাও ছিল। বুক ভরা স্বপ্ন ছিল। নতুন দিনের স্বপ্ন। গর্বও ছিল। দেশের জন্য যুদ্ধ করার গর্ব। কিন্তু সে সব স্বপ্ন, গর্ব সব এখন ধুলোয় মিশে গেছে। শুধু স্মৃতিটাই রয়ে গেছে।
রহিম সেই স্মৃতি নিয়েই পড়ে থাকতে চেয়েছিল। জীবনে আর তো মোটে কটা দিন বাকি। এ কটা দিন সে নৌকা বেয়ে আর তার ঐ এক মাত্র বিজয়ের স্মৃতি নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু তাও হলো না। আজ তার সেই বিজয়ের স্মৃতি ভুলুন্ঠিত হতে চলেছে। আজ সকালে একদল লোক তার নৌকার কাছে হাজির। তাদের সর্বাগ্রে আলতাফ মাতবর। তারা রহিমকে একরকম জোড় করেই এ অনুষ্ঠানে ধরে এনেছে। মুক্তিযোদ্ধার স্বিকৃতি স্বরূপ তাকে মেডেল পড়ানো হবে।
রহিম প্রথমে খুব চেষ্টা করেছিলো না আসার। কিন্তু যখন সে দেখলো ওরা নাছোড়বান্দা, তাকে যেতেই হবে নইলে তার নৌকা জ্বালিয়ে দেয়া হবে, তখন সে রাজি হলো। একজন রাজাকারের হাত থেকে মেডেল নিতে হবে - এই ভেবে তার মনে যে দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠলো তা দমিয়ে রাখলো। সে যে একাত্তরের গেরিলা। সে জানে কখন জ্বলে উঠতে হয়। রহিম মনে মনে সংকল্প করলো - তার একমাত্র বিজয়কে কিছুতেই সে ভুলুন্ঠিত হতে দেবে না।
এখানে আসার আগে সে ওদের কাছ থেকে সময় নিয়ে নৌকার ছৈয়ের ভেতরে ঢুকেছিল। তার বহুদিনের যত্নে রাখা ছোট ট্র্যাংকটা খুলেছিল সন্তর্পনে। সেখানে সে মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষন করেছিল। সেই স্মৃতিচিহ্ন থেকে একটি সে তার লুঙ্গির কোঁচড়ে কোমোরে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে।
মঞ্চ থেকে রহিমের ডাক আসলো। তাকে এখন যেতে হবে মেডেল পড়তে। তাকে মেডেল পড়াবে ইউ এন ও আর রাজাকার আলতাফ। রহিমের সারা শরীর রাগে কেঁপে উঠলো আবার। মুক্তিযুদ্ধ করে সে কি কোন পাপ করেছিল? নইলে এতো পরাজয় কেন তার জীবনে ? কেন আজ এ চুড়ান্ত অপমান ? একজন রাজাকার মেডেল পড়িয়ে দেবে তাকে, এটা সে কি করে মেনে নেবে? সে কি করে ভুলবে তার শহীদ বাপ, বোনের কথা ? তার সহযোদ্ধা যারা যুদ্ধে অকাতরে প্রান দিয়েছে তাঁদের কথা ? সে তার লুঙ্গির কোঁচড়ে অনুভব করে সেই জিনিসটা। এতকাল পরে এটা কি কাজ করবে? রহিমের মনে সংশয় জাগে। কিন্তু তা সে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যায়। ওটা কাজ না করলে অন্য কোন উপায়ে সে ঠিকই তার উদ্দেশ্য হাসিল করবে।
রহিম মঞ্চের দিকে এগুতে এগুতে তাকিয়ে দেখে - সেখানে সবগুলো মুখে হাসি ফুটে আছে। এদের মাঝে দুজন মুক্তিযোদ্ধাও নাকি আছে। যারা এখন বড় নেতা হয়েছে, সমাজ সেবা করছে রাজাকার সাথে নিয়ে। সবার সামনে মেডেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে আলতাফ মাতবর আর ইউএনও। রহিম মঞ্চে উঠতে উঠতে ভাবে মুক্তিযুদ্ধের এত বড় অপমান যারা করতে উদ্দত তারা কেউ বাঁচার অধিকার রাখে না।
মঞ্চে উঠে রহিম এগিয়ে গেলো আলতাফ মাতবর আর ইউএনও'র কাছে। তারা তাকে মেডেল পড়াতে উদ্দত হতেই সে লুঙ্গির কোঁচড় থেকে গ্রেনেডটা বের করলো। এতদিন এটা তার কাছে ছিল স্মৃতি হিসেবে। আজ এটা তার কাজে দেবে। দিতেই হবে। নইলে নিজ হাতে সে আলতাফকে গলা টিপে মারবে। সে একটানে গ্রেনেডের পিন খুলল। তারপর সজোড়ে আছড়ে ফেলল মঞ্চের মেঝেতে।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট বিস্ফোরনে কেঁপে উঠলো পুরো এলাকা। মঞ্চের সবাই লুটিয়ে পড়লো রক্তের স্রোতে। রহিমেরও দীর্ঘ্য দিন পর সকল কষ্ট থেকে মুক্তি মিলল। আরেকটি বিজয় হলো তার!!
মন্তব্য
গল্পের থিমটা ভাল লাগল।
খুব ভাল লাগলো গল্পটি। এরকম রহিম মুক্তিযোদ্ধার ভেতরে রাজারদের প্রতি যে ঘৃণা, তার অনেক প্রয়োজন ছিল আমাদের দেশে।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
গল্পের কাহিনী আগে থেকে ধারণা করা গেলেও এধরনের গল্প সবসময়ই ভালো লাগে। বেশ কয়েকমাস আসে এই ধরনের থিম নিয়ে করা একটা নাটক দেখেছিলাম ইন্টারনেটে। কোন টিভিতে দিয়েছিল তা মনে নেই। তবে গুগলে bangla natok minister দিয়ে সার্চ দিলে অবশ্যই কোননা কোন লিংক পাওয়া যাবে। নাটকটার নির্মাণ ও অভিনয় সত্যিই ভালো ছিল।
গুগলে খুজে দেখলাম এই লিংকে গিয়ে নাটকটা দেখা যায়। তবে সাবধান, সাইটটিতে "অসাধারণ" কিছু বিজ্ঞাপন দেখে বিব্রত হতে পারেন।
প্রকৃতিপ্রেমিকের সাথে একমত। যতো অনুমেয়ই হোক, মুক্তিযোদ্ধার প্রতিশোধের কাহিনী কি খারাপ লাগতে পারে?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
অসাধারণ! কীর্তিনাশা! পড়ে শেষের দিকে আমার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেছিলো। আবারও বলি অসাধারণ। বিপ্লবী চেতনায় উজ্জ্বল। ধন্যবাদ আপনাকে।
জেগে উঠুক সকল মুক্তিযোদ্ধা। দীক্ষিত হোক আরেকটি মুক্তির মন্ত্রে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন