একটি অনুগল্প : এক পলাতকের আত্মকথন

কীর্তিনাশা এর ছবি
লিখেছেন কীর্তিনাশা (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৮/১২/২০০৮ - ৫:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জন্ম আমার অছ্যুৎ পরিবারে। যাদের দেখে অন্য সবার শরীর ঘৃনায় রি রি করে ওঠে। রাগে ফুঁসে উঠে তারা। হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়ে তেড়ে মারতে আসে । আমাদের সারাক্ষণ তাই ব্যাতিব্যাস্ত থাকতে হয় নিজেদের লুকিয়ে রাখতে। বাঁচার তাগিদে যে যেখানে পারি গলি ঘুঁপচিতে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি। আঁধারে, ছায়ায় সবার চোখ এড়িয়ে চলাফেরা করি। পালিয়ে বেড়াই এখান থেকে ওখানে। এভাবেও হয়তো বেঁচে থাকা যায়। তবে একটাই বিপদ আমাদের। তা হচ্ছে পেটের টান। ক্ষুধার যন্ত্রনায় যখন আর তিষ্ঠানো যায় না তখন আমাদের বেরুতেই হয়। খাবারের সন্ধানে এদিক ওদিক ছোঁক ছোঁক করতে হয়, উঁকি দিতে হয়। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। ওরা যেন আমাদের জন্য ওৎ পেতেই থাকে। আমাদের টিকির সন্ধান পেলেই হলো সাথে সাথে নানা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা। ওদের অস্ত্রের আঘাতে আমাদের মৃত্যু হবে - এমন নিয়তিই যেন বিধাতা আমাদের কপালে সেঁটে দিয়েছেন।

গত কাল আমার মা বাবাকে হারালাম এক সাথে। তার আগের দিন আমার চাচা আর বড় ভাইকে। সবার কাহিনী ঐ একই। ক্ষুধার কাছে নতি স্বিকার। সবার জন্য খাবার খুঁজতে গিয়েই একে একে ঘায়েল হচ্ছে আমার স্বজনেরা। জানি আমার জন্যও হয়তো অপেক্ষা করছে ঐ নিয়তি। তবে আমার ছোট বোনটার সে দূর্ভাগ্য পোহাতে হবে না। ও তো এখনও হাটতেই শেখেনি। খাবারের অভাবে এই অন্ধকার ঘুঁপচিতেই মরবে ও, যদি আমি ফিরে না আসতে পারি।

আলো নিভে গেছে। এই আঁধারে এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে আমাকে। এইই আমার সুযোগ। কিছু খাবার যদি মিলে যায় ভাগ্যক্রমে তবে আমি আর আমার বোনটা বেঁচে থাকবো আরো কিছুকাল। বোনটাকে একটু আদর করে বেরিয়ে পড়ি আমি। ফিরে না আসতে পারলে ওর যে করুন পরিনতি হবে তা ভেবে কান্না পেল আমার। খুব রাগ হতে লাগলো। মনের ভেতর হাজার প্রশ্ন তোলপাড় তুলল - এমন নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমি কি জন্মাতে চেয়েছিলাম? আমাকে কেন এখানে এভাবে পাঠানো হলো? ঠেঙ্গানি খেয়ে মরার জন্য? আমার এই পিচ্চি বোনটারই বা কি দোষ? কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? বিধাতা নামের সর্বশক্তিমান সত্যিই কি আছেন আমাদের সবার ওপর ?

পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম আমি অন্ধকার ঘুঁপচি গলি থেকে খোলা জায়গায়। নিঃশব্দে এদিক ওদিক খাবারের সন্ধানে ছুটতে লাগলাম। বেশিদূর যেতে হলো না। কিছু দূর এগুতেই খাবারের গন্ধ নাকে লাগলো। সবসময়ের অভুক্ত আমি খাবারের গন্ধ ভালোই চিনি। গন্ধ শুঁকে দ্রুত চলে গেলাম খাবারের কাছে। ক্ষুধার তাড়নায় এটা যে একটা ফাঁদ হতে পারে তা আমার মাথাতেই আসলো না। ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারের ওপর এবং তার পরেই জমে গেলাম। জমে যেতে বাধ্য হলাম। আমার সারা শরীর কেমন এক আঁঠালো পদার্থে ডুবে গেল। সামান্য নড়াচড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেললাম। তখনই বুঝে ফেললাম - আমার সময়ও ফুরিয়ে গেল। ধরা পড়ে গেছি আমি ওদের পাতা ফাঁদে।

একটু পরেই তিব্র আলো ছোড়া হলো আমার চোখের ওপর। কেউ একজন জান্তব উল্লাশ করে উঠলো। কেমন একটা ঝন ঝন আওয়াজ আসলো কানে। বোধহয় কেউ অস্ত্র তুলে নিল হাতে। ছোট বোনটার মুখ ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে। বেচারীর জন্য আবারো খুব মায়া হলো। আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে একটুও ভীত হলাম না আমি। শুধু সেই রাগটা আবারো মনের মাঝে উথলে উঠলো - বিধাতা সত্যিই কি তুমি আছো? তোমার কি চোখ আছে? কান আছে? তুমি কি শুনতে পাও? দেখতে পাও? তুমি কি সত্যিই আমাদের বিধাতা? তুমি যদি সত্যিই থেকে থাকো, তবে জেনে রাখো তোমাকে আমি সর্বান্তকরনে ঘৃনা করি। আর আমার এখন যেভাবে মৃত্যু হবে ঠিক সেভাবে তোমাকে মারতে চাই আমি। তোমাকে পায়ে দলে থেতলে টুকরো টুকরো করতে চাই!

--------------------------------------------------------------------
ফাঁদে আটকা পড়া নেংটি ইঁদুরটা চিঁ চিঁ করে কি বলতে চাচ্ছিল তা নিয়ে এগিয়ে আসা মানুষটার কোন ভাবান্তর হলো না। কখনো হয় না। সে তার হাতের অস্ত্রের এক কোপে ইঁদুরটাকে দুই খন্ড করে ফেলল। তারপর রাগে স্বগোতোক্তি করলো - এতগুলো মারলাম তাও শেষ হচ্ছে না। আর ক’টা যে কোথায় লুকিয়ে আছে! ঘরে যতো বই-খাতা, কাপড়-চোপড় সব কেটে শেষ করে ফেলল বজ্জাতগুলো!


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ভালো লেগেছে। (....কিন্তু অচ্ছুতের কি টিকি থাকে?)

----------------------------------------------------------------------------
The philosophers have only interpreted the world in various ways; the point, however, is to change it.
[MARX : Theses on Feuerbach]


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

কীর্তিনাশা এর ছবি

শোনেন ভাই, মানুষের টিকি মাথায় আর ইঁদুরের টিকি .......... দেঁতো হাসি
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

আরেকটি কীর্তিনাশীয় অণুগল্প! চলুক
ফ্যাক্টরী দেখি পুরোদমে চালু... দেঁতো হাসি


A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?

কীর্তিনাশা এর ছবি

জি ভাই ফ্যাক্টরি চলছে দেঁতো হাসি

আপনে তো মিয়া ৩০০ পার। পুরা সচলায়তন রেকর্ড। এইবার কি খাওয়াইবেন কন। হাততালি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

শশশশ... আস্তে। খাওয়ার কথা এত জোরে বলতে নাই! চোখ টিপি

খাওয়াইলে তো সবার আগে খাওয়াইতে হবে সন্ন্যাসী'দা ও ধূগো'দা'কে (৩০০ তে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য)। তারপর হামদু ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে আপনিই তো যোগ দিলেন বক্স ভাইয়ের সাথে দেঁতো হাসি আর বাকি সবাই তো আছেই। তবে এই সুযোগে ৩০০ কমেন্টের একটা পোস্ট দেখার সৌভাগ্য হয়ে গেল, এটাই বা কম কী! হাসি


A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?

কীর্তিনাশা এর ছবি

শোনেন ভাই প্রহরী ধুগোদা আর সন্ন্যাসী দাদা যেহেতু দেশের বাইরে তাই তাদের তো চাইলেও খাওয়াতে পারবেন না। তাই তাদের ভাগেরটাও আমি আপনার প্রতি সদয় হয়ে খেয়ে নেবোনে দেঁতো হাসি

এখন কথা না বাড়িয়ে দিন তারিখ আর স্থানের নাম কন। চোখ টিপি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

শেষ পর্যন্ত অছ্যুৎ বংশে ইঁদুরের জন্ম! ইঁদুরটাকে বাঁচিয়ে দেয়া যেতো না?

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

কীর্তিনাশা এর ছবি

ফাঁদে আটকালে কয়টা মানুষ বলেন ইঁদুর না মেরে ছেড়ে দেয়? এখানে তো আমি তাই করলাম।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

রণদীপম বসু এর ছবি

চমৎকার !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ রণ'দা হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

এমন ঋদ্ধ লেখা সহসা মেলে না। একটি বাড়িয়ে বলছি না। তাই নিঃসংশয়ে পাঁচ তারা।

কীর্তিনাশা এর ছবি

লইজ্জা লাগে

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

বেশ বেশ ।

(যদি কিছু মনে না করেন, অনেকগুলো বানান ভুল চোখে লাগে। সময় করে ঠিক করে নিয়েন)

কীর্তিনাশা এর ছবি

বাংলা বানানের কথা মনে হলেই কান্না পায় বস্ । মন খারাপ
তারপরও যথাসম্ভব চেষ্টা করবো ঠিক করতে।

ধন্যবাদ শিমুল ভাই।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

রায়হান আবীর এর ছবি

ভালো লাগছে গপ্পটা!

=============================

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ রায়হান হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।