বই পড়ার খুব ভীষণ একটা মজা আছে।
ছোটবেলায়... কিন্ডারগার্টেন ইশকুলে পড়ি তখন। ক্লাশ থ্রিতে পড়ার সময় থেকেই কিভাবে যেন গল্পের বই পড়াটা নেশা হয়ে যায়। আর অবাক হয়ে খেয়াল করি যে আমার যারা বন্ধু... তারা কেবল তাদের বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু, আত্মীয়, শিক্ষক, ফেরিওয়ালাকেই চেনে... কিন্তু আমি এদের বাইরেও অনেক অনেককে চিনি। আর আমার সেই চেনা লোকগুলো মোটেও চারপাশের উপদেশদায়ক বুড়ো লোকগুলো না। এক্সাইটিং সব ক্যারেক্টার... যারা সোনার কাঠি রূপার কাঠি ছুঁইয়ে জাগিয়ে তুলতে পারে অপরূপা রাজকন্যাকে। যারা ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে ঘূরে আসতে পারে গোটা পৃথিবী, পাতালপুরীতক। অমিতশক্তির রাক্ষসদের মেরে হাড় গুঁড়ো করে দিতে পারে। যাদের কথায় ওঠে বসে চন্দ্র সূর্য... বনের পশুপাখি।
খুব অবাক হয়ে দেখলাম আমি এদের সকলকে চিনি... সকলের সাথে ঘুরে বেড়াই দেশ দেশান্তর।
আর খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম বন্ধুদের মাঝে আমি হিরো হয়ে গেছি অজান্তেই। আমার মুখনিসৃত এইসব গল্প তারা গোগ্রাসে গেলে। প্রতিদিনই নতুন নতুন গল্প শোনার আব্দার। আর আমি হয়ে যাই বন্ধুদের মধ্যমণি... নিজেকে রাজ্জাক রাজ্জাক লাগতে শুরু করলো।
আর এই হিরোইজমের নেশায় পাগলের মতো বই পড়া শুরু। প্রতিদিন যে আমাকে নতুন নতুন গল্পের যোগান দিতে হবে। নাহলে যে আমার শিরোপা হাতছাড়া হয়ে যাবে। বই পড়ো... বই পড়ো নজরুল... বই তোমাকে পড়তেই হবে... অনেক বই পড়তে হবে। মেয়েরা আর তোমার কাছে গল্প শুনতে চাইবেনা। তো চললো আমার বই পড়া।
পড়ার প্রয়োজনটা আরো বেশি দেখা দিলো ইশকুলেরই এক তরুনী শিক্ষিকার কারনে। বালক বয়সের যা দোষ... একটু কম বয়সী এক সুন্দরী টিচার। তার মুখে তখন বকা শুনতেও ভালো লাগে। ক্লাশে বই পড়ার অপরাধে দিলেন বকা, কিন্তু ক্লশে শেষে সেই বইটাই ধার নিলেন পড়তে, দিলেন পরদিন। জিজ্ঞেস করলেন আর কোনো বই আছে কি না ? মনে আছে... তার পরদিন ইশকুলে হাজির হয়েছিলাম গোটা পাঁচেক বই নিয়ে। একটা না একটা তাকে নিতেই হবে যে ! তিনি সেথা থেকে তুলে নিলেন একখানা বই... আহা... মরি মরি। তারপর প্রতিদিন... শুধু তার জন্য বই জোগাড় করতেই আমার দিন গুজরান। একদিন তিনি বই নিলেন না আমার কাছ থেকে... বললেন এগুলো তার পড়া। মেজাজ গেলো খিঁচড়ে, জেদ গেলো বেড়ে, বই তাকে নিতেই হবে। আরো বই... আরো বই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়না। কিভাবে হবে? এগুলো যে বাচ্চাদের বই। অতএব বড়দের ভাণ্ডার থেকে বই হাতানো শুরু হলো। বালক বয়সেই পড়া শুরু হয়ে গেলো বড়দের উপন্যাস। কৈশোরে সবাই যখন ইশকুল বেঞ্চে নিজের নাম ছাড়া আর কিছু খোদাই করতে পারতোনা... তখন আমি আস্ত প্রেমের কবিতা বোর্ডে লিখে দিতে পারি... আহ্। মেয়েদের তেড়ছা চাহনী... আহা... বই না পড়লে কি এগুলো কিছু জুটতো কপালে?
ইশকুলে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ হবে... তো সদা ভুড়ো কুঁচকানো হেডস্যার আমাকেই ডেকে পাঠান। দশম শ্রেণীর ছাত্রদের বিদায় সম্বর্ধনা ? বই উপহার দিতে হবে? বই বাছাই আর কেনার দায়িত্বও আমার। বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় সেরা ছাত্রদের জন্য বই কেনাতেও। ইশকুলে গণ্যমান্য অতিথি আসবেন? মানপত্র লেখতে হবে? ডাকো নজরুলকে। ইশকুলভর্তি ছেলেমেয়েদের অবাক চোখের সামনে দিয়ে আমি স্যারদের সাথে সাথে সব কাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠি। আহারে বই পড়া... কত যে দিলি আমাকে।
অবশ্য পাঠ্যবইয়ের নিচে গল্পের বই আবিষ্কার করে বা এ্যাসেম্বলীতে প্যান্টের পকেটে মাসুদ রানাসমেত ধরা পরে অনেক অপমানও সইতে হয়েছে। কানমলাও খেতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও আমার হিরো হওয়াটা ঠেকাতে পারেনি সেই ভিলেন স্যারেরা।
তখন যখন স্যাটেলাইট মোবাইল ইন্টারনেট দেশে নাই... তখন মেট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পাসের পরে ছিলো বই পড়ার সিজন। যে জীবনে গল্পের বই পড়ে নাই সেও তখন দুচারটা পড়তো। তিন মাস সময় যে কাটাতে হবে। আর এই সময়টাতে আমার কদর বাড়তো খুব। কারন মহল্লায় আমার বইয়ের কালেকশন ভালো ছিলো। সিনিয়র ভাইবোনেরা বই ধার নিতো। আমারই ক্লাশের এক সুন্দরীর বড়ভাই মেট্রিক পরীক্ষার পরে আমার বইয়ের নিয়মিত ধারক হইলো। আমি তো দেখলাম এই মওকা। আমি তারে যতো বই ধার দেই সেই বইতেই একটা কইরা সুইট রোমান্টিক কবিতার দুচার চরণ দিয়া দিই... কারন গোপন সূত্র মারফত খবর পাই... সেই নারী সেই বই পড়ে!
***********************************
এরপর আরো অনেক কিছু লিখিবার ইচ্ছা ছিলো... কিন্তু লিখিত হইলো না। এটুকু লিখেছিলাম ফেব্র“য়ারির শুরুতে। আর একদিন বসলেই হয়ে যেতো... কিন্তু সময় সুযোগ কপালে জোটে না। ভাবলাম এপর্যন্তই তো ছাড়ি অন্তত! এটলিস্ট সচল হওনের বাসনা পূর্ণ হউক...
মন্তব্য
মজা লাগলো পড়ে।
আসলেই একটা সময় যেকোন পরীক্ষার পরের ছুটিতে সবাই বই পড়ত। তখন বন্ধুদের মধ্যে খুব বই দেয়া-নেয়া হত। এখন মনে হয় তার জায়গা নিয়েছে ডিভিডি।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
তখন তিন মাস টাইম কাটানোই মহা ঝক্কির ছিলো। আমার তো মনে আছে মেট্রিক পরীক্ষার পরে কি কি করা হবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে সেই চিন্তা শুরুই করছিলাম এক বছর আগে থেকে। তারপরও যেন সময় কাটতো না। এখনকার পোলাপানের তো এই সমসয় কাটানোর ক্রাইসিস নাই। উল্টা কাহিনী এখন। পরীক্ষার আগে যাও একটু সময় থাকে পরীক্ষার পরে এক্কেবারে সময় নাই। মেডিক্যাল, ভার্সিটি, বুয়েট- সবধরনের ভর্তি কোচিং সেন্টার করতে করতে জিহ্বা বাইর হয়।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এরা যতো বেশি পড়ে
ততো বেশি জানে
ততো কম মানে
ভাল্লাগলো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
হ... জ্ঞানীরাই জ্ঞানপাপী হয়, নাইলে হয় হুদা পাপী। ধন্যবাদ।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
রোমান্টিক কবিতার চরণ পড়ার পর সেই নারীর কি হয়েছিল? সেই কাহিনী কবে লিখবেন?
কি মাঝি? ডরাইলা?
সেই নারীর প্রতিক্রিয়া জানতারি নাই। কিন্তু টের পাওনের পরে তার ভাই বই ধার নেওয়া বন্ধ কইরা দিছিলো।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মজাদার।
ধন্যবাদ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
রাজ্জাক ভাই...চরম লাগলো লেখাটা...পাঁচ তারকা।
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
আপনি দেখি বিরাট বড় আতেল !!!
আমিও গোগ্রাসে বই পড়ি । তবে সেটা শুরু হয়েছে ক্লাস সিক্সে উঠে। তাও হুমায়ুন আহমেদের হিমু দিয়ে !
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বাহ, নজু ভাই, জোস লিখেছেন তো! খুব মজা লাগল। বই পড়ার কারণে বাল্যকালে আপনার এমন অসামান্য সৌভাগ্য দেখিয়া হিংসায় কিছুটা "জ্বলিত" হইলাম
_________________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
নতুন মন্তব্য করুন