অবাক বই পাঠ: আরিফ জেবতিকের একুশ নম্বর আঙুলের কারুকাজ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/০৫/২০১০ - ৪:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
আরিফ জেবতিক উপন্যাস শুরুই করেছেন মানুষ দিয়ে। যে মানুষগুলো দেখতে একই রকম, একই মুখ, চোখ, ভুরুর গড়ন, একই দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ নিয়ে তারা একসাথে কথা বলে ওঠে। অথবা তারা হয়তো কথা বলে না, একই সাথে গোঁ গোঁ করে। এই বোবা শব্দগুলো, শব্দ চেপে রাখার চেষ্টায় উৎপন্ন শব্দগুলো, সবই এক মনে হয় লেখকের।

কিন্তু উপন্যাস ভর্তি প্রভুদের কথা। প্রভুর ওপাড়ে প্রভু, তার ওপরে প্রভু... প্রভুরা আরো বেশি প্রভু হওয়ার চেষ্টায় আত্মনিবেদিত।

আরিফ জেবতিকের উপন্যাস ১/১১র রাতের একুশ নম্বর আঙ্গুল এইসব মানুষ আর প্রভুর গল্প।

২.
রাজনৈতিক ডামাডোলের সুযোগে আমাদের দেশে প্রবেশ করলো সামরিক সরকার, ছদ্মবেশে। আমাদের নতুন প্রজন্ম সামরিক শাষণ দেখেনি। তাদের দেখার একটা সুযোগ করে দেওয়া হলো। সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির কারখানা বানানো হলো বাংলাদেশকে।
আর সেই পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে কিছু দুর্বৃত্তকে বলি হতে হলো। তারই এক জীবন্ত বর্ণনা জেবতিক ফুটিয়ে তুলেছেন এই উপন্যাসে।

৩.
রাজনীতিক সমরনীতিক সবাই আমাদের মনে প্রবল ভয় ঢুকিয়ে রাখেন। হুলিয়ার ভয়ে তাই আমরা উপন্যাস লেখি প্রেমের। এর বাইরে কিছু করতে গেলে উপন্যাসের জোয়াল চাপিয়ে দেই গ্রাম বাংলার জেলে চাষাদের কাধেঁ। রাজনীতি আমরা ঘাঁটাতে চাই না। সেনাশাষন নিয়ে লেখা হয় না একেবারেই। জিয়ার আমল বা এরশাদের আমলের অজস্র গল্প তাই মুখে মুখে রয়ে যায়। দুই মলাটে তুলে আনার চেষ্টা তাই কাউকে করতে দেখা যায় না। জাফর জয়নাল দিপালী সাহাদের নাম মনে রাখার হয়তো আমরাই শেষ প্রজন্ম।

যারা ব্লগে লেখালেখি করেন, সাহস বোধহয় তাদের কিঞ্চিত বেশি। তাই আমরা হাসান মোরশেদ-এর কাছ থেকে পাই "শমন শেকল ডানা।" আরিফ জেবতিকের কাছ থেকে পাই "১/১১র রাতের একুশ নম্বর আঙুল।" ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো আর কোথাও পাবে না, কিন্তু এখানে পাবে সামরিক প্রভুরা আমাদের কতোটা কণ্ঠরোধ করে দিতে চেষ্টা করেছিলো। অজস্র কণ্ঠরোধের এই গোঁ গোঁ শব্দগুলি লুকিয়ে থাকে জেবতিকের উপন্যাসের পাতার আড়ালে আড়ালে, শুনতে পাই।

৪.
বিনা বিচারে মানুষ মেরে ফেলাটা প্রভুদের কাছে মোটেও অপরাধ না। নিতান্তই রুটিন ওয়ার্ক। নানান সময়ে এর বিজাতীয় নামকরণ করা হলেও, ঘটনাগুলোর পরিণতি একটাই- মৃত্যু। একই প্রেসনোট নাম আর চরিত্র বদলে ছাপা হতে থাকে দিনের পর দিন, কাগজে কাগজে। আমাদের কাছেও এগুলো এখন পত্রিকার অসংখ্য সংবাদের ভীড়ে আরেকটা সংবাদ কেবল। যেমন খেলার নিউজ থাকে, থাকে প্রভুদের গুণকীর্তন, কিংবা নায়িকার রসালো সংবাদ। আমাদের কাছে এখন আর এগুলো ভিন্নতা তৈরি করে না।
কিন্তু কিছু কিছু বোকা মানুষ আদতেই বোকা। এরা এগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এমনকী যখন খোদ প্রভুরাই ক্ষমতায়।
তেমনই একজন তানিম। এই উপন্যাসের অন্যতম একজন "মানুষ।" নায়ক না, মানুষ।

৫.
তানিমের বউ আছে, বাচ্চা আছে। নির্বিবাদী জীবন বেছে নেওয়ার আছে সুযোগ। তবু কেবল বোকা বলেই কোথাকার কোন আদিবাসী নেতার মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড ঠাউরে বসে। তত্ত্ব তালাশ করে, ছাপতে চায় পত্রিকায়। কিন্তু সম্পাদক যেহেতু তার মতো বোকা কিংবা মানুষ না... তাই এগুলো পত্রিকায় ছাপা হয় না। ব্লগে ছড়িয়ে যেতে থাকে।
প্রভুদের চোখে পড়ে যথারীতি। এটাও তেমন কিছু না। অনেক বড় বড় বিপ্লবীকেই সাইজ করে দেওয়া গেছে, আর এ তো এক পুঁচকে ছোঁড়া...
কিন্তু ও যে বোকা এবং মানুষ... তাই হুমকী ধমকীতেও দমে না। এই ডিস্টার্বিং এলিমেন্টটাকে নিয়ে তাই প্রভুদের তখন সুযোগ হয় একটু হাত মকশো করে নেওয়ার। তুলে নেওয়া হয় তাকে...
তারপর?
তারপর এক অন্ধকার জগত... চোখ বাঁধা জগত...

চোখ খোলা রাখলে সবকিছুই দৃশ্যমান হয়, কিন্তু দেখা যায় কতটুকু? আমরা চোখে দেখা মানুষগুলোকে মনে রাখি চুল নাক কান হাত পায়ের গঠন দেখে। কিন্তু আরিফ জেবতিক একজন মানুষকে প্রভুদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন চোখ বেঁধে। বাধ্য করেন প্রভুদের ভেতরের আসল রূপটি দেখতে।

আমরা যারা আপাত নিরাপদ শহরে বাস করি হরতাল ছাড়া, খুশি হই মিছিলহীনতায়... তাদের সামনে খুলে দেন এক অবিশ্বাস্য জগত।

৬.
একটি একেবারেই বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস। মনগড়া কোনো কাহিনী না। প্রায় সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশেষ করে ছদ্ম সামরিক শাষণ নিয়ে এরকম একটি উপন্যাস লেখা শুধু সাহসের কাজ না, যোগ্যতাটাও খুব দরকার।
আরিফ জেবতিকের দুটোই আছে। তাই উপন্যাসটি হয়ে যায় প্রামাণ্য দলিল। দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা আর অসাধারণ লেখার হাত... সব মিলিয়ে আরিফ জেবতিকের পক্ষেই এরকম একটি উপন্যাস লিখে ফেলা সম্ভব।
দায়বোধ, জুজুর ভয়, আপোষকামীতা অথবা কাল্পনিক ভাবনার যে কোনো একটি উপাদানই এরকম একটি উপন্যাসের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। আরিফ জেবতিকের পরিমিতি বোধ যা হতে দেয়নি। ১/১১র পরবর্তী বিশেষ সময়টুকু অস্থিমজ্জাসহ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে মেদহীন।

৭.
সবশেষে আরিফ জেবতিককে কেবল সাধুবাদই দিতে হয় এরকম চমৎকার একটি উপন্যাসের জন্য। তবে পরবর্তী সংস্করণের আগে বানানগুলো আরেকবার দেখে নিতে অনুরোধ করবো।


মন্তব্য

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

উপন্যাসটা পড়ার জন্যে অপেক্ষা করছি। প্রবাসে থাকায় পড়ার সুযোগ হয় নি। প্রচুর সুনাম শুনেছি সমালোচকদের কাছ থেকে। আশা করি দেশে গেলে পড়ার সুযোগ হবে।

....রিভিউটা সুন্দর হয়েছে।

তাসনীম এর ছবি

দারুন রিভিউ।

উপন্যাসটা পড়া হয়নি, আমিও অপেক্ষায় আছি।

++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

কল্পনা আক্তার এর ছবি

বইটি কেনার পর পরই পরেছি এবং তাসনীমরে ক্যাম্পেইন এর সাথে জড়িত ছিলাম বলে বইয়ের প্রত্যেকটি শব্দ আমার কাছে পরিচিত মনে হয়েছে। তবে আমি বলবো আরিফ জেবতিক ভাই অত্যন্ত সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন এই বইটি লিখে।

ধন্যবাদ নজু ভাইকে দেরীতে হলেও বইটি সম্পর্কে লেখার জন্য।
........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা


........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

মামুন হক এর ছবি

আরিফ ভাই আমার প্রিয় গদ্যকারদের একজন। বইটা পড়তেছি। নজুকে ধন্যবাদ দারুণ একটা রিভিউয়ের জন্য

মেহবুবা জুবায়ের এর ছবি

নজরুল, রিভিউটা এতো সুন্দর হয়েছে যে এখন বইটা পড়তে ইচ্ছে করছে! আরিফ জেবতিক,এখন না হলেও পড়বো, অবশ্যই পড়বো বইটা

--------------------------------------------------------------------------------

অনিন্দ্য এর ছবি

"জাফর জয়নাল দিপালী সাহাদের নাম মনে রাখার হয়তো আমরাই শেষ প্রজন্ম।"-তা হবে না।আপনারা সবাই ব্লগে এত সুন্দর সব লেখা দিচ্ছেন,এগুলো তো document হিসেবে রয়ে যাবে।এই সেদিনও হিমু ভাই এরশাদকে নিয়ে দারুণ একটা লেখা দিলেন।

দ্রোহী এর ছবি

বইটি পড়ার জন্য হাতে পাইনি। রিভিউ পড়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম!!

বোহেমিয়ান এর ছবি

রিভিউ ভাল্লাগসে । বইটা পড়ছি । পান্থদার রিভিউতেই আমি যা বলছিলাম আপনার রিভিউ এর সাথে কিছু মিল পাইলাম ।
সাহসিকতায় , সাহসী কথায় চলুক

_________________________________________

_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

রিভিউ ভালো হয়েছে।

উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে একটি ব্যাপার আমার মনোযোগে ব্যাঘাত করেছে তা হলো, লেখকের অতি বেশি স্টেটমেন্ট।
অনেকগুলো ঘটনা নিয়ে লেখক নিজেই ধারা বিবরণীতে কলম ধরেছেন, আমার মনে হয়েছে - এগুলো পাঠকের বোধ এবং কল্পনার উপরে ছেড়ে দেয়া যেতো...

মাসুদ সজীব এর ছবি

চলুক নজু ভাই বইটা কোন প্রকাশনার?

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

জাগৃতি প্রকাশনী

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।