নটীমাতৃক: একটি উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর (তারিখ: শনি, ০২/০৭/২০১১ - ৬:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
ছোটবেলায় গ্রামে বেড়াতে গিয়ে শব্দটা প্রথম শুনি... একজন আরেকজনকে গালি দিচ্ছে "নডীর পুত" বলে। তখনো জানি না নডী বা নটী কী। তারচেয়ে শহুরে ভার্সনটাই বেশি বোধগম্য, "খানকীর পোলা"। ততদিনে এর অর্থ জেনে গেছি, চিনে ফেলেছি "খানকী"দের।
নটী আর বেশ্যায় তবু তফাত আছে। বেশ্যা শুধুই দেহ ব্যাবসায়ী, নটী শিল্পীও অবশ্য। বাবুসমাজের সম্ভ্রান্তরা খুব করে নটী পুষতেন, শুধু দেহে তৃপ্তি ছিলো না, চাই নাচ গান জানা নটী। নটীসম্ভোগ তখন কোনো গোপন ব্যাপার ছিলো না। ছিলো সম্ভ্রান্তপনা প্রকাশের হাতিয়ারও। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর "রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ" বইতে লিখেছেন- "সে সময়ের যশোহর নগরের বিষয়ে এরূপ শুনিয়াছি যে, আদালতের আমলা, মোক্তার প্রভৃতি পদস্থ ব্যক্তিগণ কোনোও নবাগত ভদ্রলোকের নিকটে পরস্পরকে পরিচিত করিয়া দিবার সময়ে- ‘ইনি ইহার রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকা বাড়ি করিয়া দিয়াছেন, এই বলিয়া পরিচিত করিতেন। রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকাবাড়ি করিয়া দেওয়া একটা মান-সম্ভ্রমের কারণ ছিল"।
নটীদারের অনেক মান সম্ভ্রম থাকলেও কোনো মান সম্ভ্রম ছিলো না নটীর! নটী নটীই... তাকে ভোগ করা চলে, কিন্তু তবু সে ঘৃণ্য পরিত্যজ্য।

তেমনি এক নটী নূরজাহান, তাঁকে গুলনাহার নামে আঁকেন স্বকৃত নোমান, তাঁর "রাজনটী" উপন্যাসে।

২.
বর্তমানে কুমিল্লার শহর গোমতীর পাড়ে আছে এক মসজিদের ধ্বংশাবশেষ। কিছু স্তম্ভ এখনো দাঁড়িয়ে আছে... সাপ খোপের আস্তানা। লোকজন দেখতে যায়, কিন্তু প্রায় দুইশত বছর আগে স্থাপিত এই মসজিদে কখনো কেউ নামাজ পড়েনি। সম্ভবত এটাই পৃথিবীর একমাত্র মসজিদ যেখানে কোনো নামাজ আদায় হয়নি কোনোদিন!

কেন?

কারন এটা নটীর মসজিদ। এই মসজিদ তৈরি হয়েছিলো নূরজাহানের টাকায়। যে নূরজাহান ছিলেন একজন নটী। নটীর দান গ্রহণ করা চলে, সম্ভোগ চলে, কিন্তু নটীর অর্থে তৈরি মসজিদে নামাজ আদায় করা চলে না। পাপ হয়। নটী যে পাপীস্য পাপী! নিজস্ব পাপ ঢাকতে আমরা তো সর্বদাই অন্যের পাপ জাহির করি, তাই না?

৩.
এই নটী নূরজাহান আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদের গল্পই স্বকৃত নোমান তুলে ধরেছেন তাঁর চতুর্থ উপন্যাস "রাজনটী"তে। এর আগে স্বকৃত নোমান লিখেছেন তিনটি উপন্যাস- "নাভি", "ধুপকুশী" আর "জলেস্বর"। এছাড়া "প্রাচ্যের ভাব আন্দোলনের গতিধারা" আর "খ্যাতিমানদের শৈশব" নামেও তাঁর দুটি বই আছে। এগুলোর কোনোটাই আমার পড়া হয়নি।
বিশ্বস্ত পাঠকের কাছে প্রচুর শংসাবাক্য শুনে এই বইটা পড়তে বসলাম। পড়ে বুঝলাম প্রকৃত পাঠক কখনো ভুল বলে না।

৪.
ঘটনা যা জানা যায় তা খুবই সামান্য। মসজিদটা এখনো অস্তিত্ববান। শহর গোমতীর পাড়ে গেলে একটু জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করলেই খোঁজ পাবেন মসজিদটার। দেখতে পাবেন কিছু স্তম্ভ শুধু দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এর ভেতরকার কান্না হয়তো শুনতে পাবেন না। যে "আল্লাহর ঘর" নটীর কারণে পরিত্যক্ত, সেই আল্লাহর ঘর এখন সাপের আস্তানা।
সেই মসজিদের কাছেই বাড়ি কবি পিয়াস মজিদের। এই উপন্যাসের তথ্য সংগ্রহেও আছে তাঁর অবদান। পিয়াসের কাছেই জানলাম নূরজাহান সম্পর্কে বেশি কিছু জানার উপায় আর নেই। তাঁর নটী পরিচয় ছাড়া আর কোনো পরিচয় খুব একটা জানা যায় না। তবু স্বকৃত নোমান নামেন তাঁর পরিচয় উদ্ধারে। লোকপুরাণ সংগ্রহ করেন, সীমান্ত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পৌঁছে যান ত্রিপুরায়, রাজপ্রাসাদে... যেখানে নূরজাহান একদা ছিলেন রাজনটী।
ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে বের করেন ত্রিপুরা রাজ্য... এককালে যার নাম ছিলো জাজিনগর। সেই রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় রাজধরমাণিক্য... শহর কুমিল্লা... একসময় যার নাম ছিলো কমলাঙ্ক... খুঁজে খুঁজে বের করেন। যতোটুকু জানা যায়... সেগুলোর পাশে যোগ করতে থাকেন নিজস্ব চিন্তা আর কল্পনার জগত। নূরজাহানকে তৈরি করেন গুলনাহার চরিত্রে। আশেপাশে যোগ হয় সেই সময়ের আর্থ সামাজিক চিত্র। একে একে যোগ হয় উপন্যাসের অন্য অন্য চরিত্রগুলো... দোদেল হামজা, হায়াত, ইমাম, জালাল মির্জা, অজয় পণ্ডিত... গুলনাহারের মা বাবা তিন বোনরা...
সবই কল্পনা। স্বকৃত নোমান এখানে কথক বই কিছু না। সত্যটাকে মূলে রেখে তিনি বয়ান করে যান সোয়া দুইশত বছরের প্রাচীন এক গল্পগাঁথা। কিন্তু পদে পদে বলে যান ঘটনাটা সোয়া দুইশত বছরের প্রাচীন হলেও বাস্তবতাটা এখনো বর্তমান।

৫.
বাংলা উপন্যাস নির্মাণের প্রাচীণ সেই স্বর্ণযুগের পর বেশ হতাশাময় পরিস্থিতি ছিলো... কিন্তু আড়ালে আবডালে কেউ কেউ চেষ্টা করে যাচ্ছেন জনপ্রিয় ধারার বাইরে নতুন কিছু নির্মানের। হরিশংকর জলদাসের "জলপুত্র" পড়ে মুগ্ধ হয়ে ভাবি এবার বুঝি কাটবে আঁধার। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক "কসবি" পড়ে হতাশ হই। সেই হতাশা কাটিয়ে দেয় ইমতিয়ার শামীমের উপন্যাস "আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক"। আমাদের প্রিয় সচল হাসান মোরশেদের "শমন শেকল ডানা" পড়ে আশাটা চাগিয়ে ওঠে। পাঠক আমি অপেক্ষা করে থাকি তাঁর পরবর্তী উপন্যাসের জন্য।
আমার ভালো লাগে... নতুন সুন্দর দিন আসছে... আসছে... স্বকৃত নোমান যোগ হয় আমার তালিকায়

৬.
স্বকৃত নোমানের কল্পনার ঢঙটা আমার ভালো লেগেছে। উপন্যাসটা শুরু হয়েছে একটা ঝলমলে চরক মেলার পর থেকে
গুলনাহার হেঁটে ফিরছেন সেই মেলা থেকে, একাকী... যার নির্দিষ্ট একটা গন্তব্য আছে কিন্তু গন্তব্যের হদিস সে জানে না। যেন উৎসবের শেষ থেকে শুরু এই উপন্যাস। গুলনাহার অথবা নূরজাহানের উজানপর্ব শেষ হয়ে যা ভাটির দিকে যায়... গুলনাহার চেষ্টা করে অতীত ভুলে প্রায়শ্চিত্ত [!] করতে। দান সেবা মসজিদ গড়েও নটী পরিচয় মুছতে পার না। সমাজে সে মানুষ না... নটীই থাকে। উপন্যাসের শেষ হয় আবার উজানে... শিল্পী নটী গুলমেহের আবার পথ হাঁটে পানামনগরের উদ্দেশে... যেখানে সে নটীই হবে আবার...

৭.
এটা কোনো রিভিউ বা সমালোচনা না... পাঠক হিসেবে উপন্যাস পাঠের সামান্য প্রতিক্রিয়া মাত্র। স্বকৃত নোমান আমাকে বাধ্য করেছেন তাঁর পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলো পড়তে... আর নতুন উপন্যাসের জন্য অপেক্ষা করতে


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, নতুনের সন্ধান পেলাম।

মাসুদ সজীব এর ছবি

বই নিয়ে দারুণ আলোচনা। নজরুল ভাই বইটি কোন প্রকাশনীর?

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

নিজস্ব পাপ ঢাকতে আমরা তো সর্বদাই অন্যের পাপ জাহির করি, তাই না?

কোন প্রকাশনী, নজু ভাই?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে দারুণভাবে আগ্রহী হলেম বইটার ব্যাপারে।
যদিও এই লেখকের নাম শুনিনি আগে!
কত যে না পড়া মানুষ, আর বই, আড়ালে আবডালে থেকে গেছে।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর "রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ" বইতে লিখেছেন- "সে সময়ের যশোহর নগরের বিষয়ে এরূপ শুনিয়াছি যে, আদালতের আমলা, মোক্তার প্রভৃতি পদস্থ ব্যক্তিগণ কোনোও নবাগত ভদ্রলোকের নিকটে পরস্পরকে পরিচিত করিয়া দিবার সময়ে- ‘ইনি ইহার রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকা বাড়ি করিয়া দিয়াছেন, এই বলিয়া পরিচিত করিতেন। রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকাবাড়ি করিয়া দেওয়া একটা মান-সম্ভ্রমের কারণ ছিল"।

সেই সময়ের একটি প্রচলিত বচন, "আজব শহর কলকেতা, রাঢ়ি-বাড়ি-জুড়িগাড়ি অন্য কিছু নেইকো তা
এটা ক্ষ্যামা খানকির কোঠাবাড়ি আর ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা।৷"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।