সাভারের ব্যাঙ্ক কলোনির দেয়ালগুলো ভরে গেছে 'সন্ধান চাই' বিজ্ঞপ্তিতে। অসংখ্য ছবি, নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর...। বৃষ্টিতে কতগুলোর লেখা মুছে গেছে, ছবি ঝাপসা হয়ে গেছে। রঙিন ছবি, সাদাকালো ছবি... পাসপোর্ট সাইজের ছবি, স্টুডিওতে কোট টাই পরা হাস্যোজ্জ্বল ছবি, পিকনিকে বন্ধুদের ছবি থেকে কেটে আলাদা করা ছবি... কতগুলো প্রাণ, হাসি, আনন্দ, উচ্ছ্বলতা, সম্ভাবনা...
আমরা মানুষ গুনি, কেউ গোনে ভোট!
এনাম মেডিক্যাল আর অধরচন্দ্র স্কুলের দেয়ালে এরকম বিজ্ঞপ্তি সবচেয়ে বেশি। একটায় চোখ আটকে গেলো, সন্ধান চাই এর নিচে লেখা 'জীবিত অথবা মৃত'! পাশ দিয়ে একজন কাঁদতে কাঁদতে ফোনে স্বজনের মৃত্যুর খবর দিলেন অন্য স্বজনকে।
রানার গ্রেপ্তারের খবরটি এনাম মেডিক্যাল প্রাঙ্গনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির মনকে বিন্দুমাত্রও ছুঁতে পারেনি।
মৃতের চেয়ে জীবিত উদ্ধারের সংখ্যা অনেকগুন বেশি দেখে আমরা খুশি হই। কিন্তু যাঁদের স্বজন হারিয়েছে, যাঁদের অঙ্গহানি হয়েছে, তাঁদের কাছে এই পরিসংখ্যান পরিহাস ছাড়া আর কিছু না। বরঞ্চ যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁরা একরকম বেঁচেই গেছে। যাঁরা বেঁচে গেছেন, অথর্ব হয়ে, পঙ্গু হয়ে... তাঁদের মরতে হবে সারাজীবন ভরে... প্রতি মুহূর্তে... একটু একটু করে... সপরিবারে!
রানা গ্রেপ্তার হয়েছে, গার্মেন্টস মালিকরাও গ্রেপ্তার হয়েছে। হয়তো বিচার হবে, বিচারের পর কী হবে জানি না, জানে না কেউ। হয়তো রানার গডফাদার মুরাদ জংরা আবারো খুঁজে নেবে নতুন কোনো রানাকে। বিজিএমইএ-র বাণিজ্য আগলে রাখবে অন্য পোশাক ব্যাবসায়ীরা। আমরা অপেক্ষা করবো নতুন কোনো 'দুর্ঘটনা'র জন্য!
গার্মেন্টস মালিকরা ভাবে তাদের জন্যই এই সেক্টরটি টিকে আছে, বাংলাদেশকে এনে দিচ্ছে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু তারা ভাবে না এই সেক্টরটি টিকে থাকার পেছনে মালিকদের অবদান স্রেফ 'শুন্য'। পোশাক শিল্পে ইনভেস্ট করার জন্য অন্যান্য দেশে অনেক বড় বড় ইনভেস্টর বসে আছে। তবু এই শিল্পের দখল তারা নিতে পারছে না শুধু সস্তা শ্রম কিনতে পারছে না বলে। বাংলাদেশে যা খুব সহজে পাওয়া যায়। এই অভাগা শ্রমিকেরা অমানবিক পারিশ্রমিকে কাজ করে বলেই বাংলাদেশে এখনো টিকে আছে গার্মেন্টস শিল্প, আর কোটিপতি হচ্ছে মালিকেরা।
এই শ্রমিকরা মালিকদের মতো কোটিপতি হতে চায়নি, গাড়ি বাড়ি চায়নি। অথচ নিরাপত্তা এদের অধিকার। বিজিএমইএ তা দিতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে, হচ্ছে। একের পর এক ঘটনায় গার্মেন্টস মালিকরা নিজেদের অমানুষত্বই প্রতিষ্ঠা করছে কেবল। তাদের লোভের আগুনে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে সহস্র শ্রমিক, প্রতিষ্ঠিত শিল্প, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি।
হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর বিনিময়ে গড়ে ওঠা ভাবমূর্তি আমরা চাই না। অমানুষিক ভাবমূর্তি আমরা গড়তে চাই না। আমাদের ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে মানুষকে কেন্দ্র করে। বিশ্ব অবাক চোখে দেখুক, এই দেশে মানুষের পাশে মানুষ কিভাবে দাঁড়ায়। দুপুরে রক্ত চেয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে বিকেলেই আমরা স্ট্যাটাস দিতে বাধ্য হই 'অনেক রক্ত জমে গেছে, আর লাগবে না' বলে। তবুও মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে রক্ত দেওয়ার জন্য! বিশ্ব আজ দেখুক কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া সাধারণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিভাবে এতো বড় একটি দুর্যোগ মোকাবেলা করে। জীবন বাজী রেখে হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধার করে, একটি প্রাণ বাঁচাতে না পেরে কিভাবে অঝোরে কাঁদে! কিছু অমানুষিকতার বিপরীতে যে অসাধারণ মানবিকতার ইতিহাস রচিত হয়েছে সাভারে, সেই মানবিকতার পাহাড় গড়ে তুলবে নতুন ভাবমূর্তি। ধ্বংশ হবে অমানুষিক ভাবমূর্তি। হবেই।
মুক্তিযোদ্ধা অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদের কাছে গল্প শুনেছিলাম, একাত্তরে তাঁরা মেলাঘরে যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছিলেন, ট্রেনিং আর শেষ হয় না। অথচ তাঁরা অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চান, তর সইছে না। ওদিকে ভারতীয় অফিসাররা ট্রেনিং শেষ না করে আসতে দেবে না। এক পর্যায়ে তাঁরা বিদ্রোহ করে বসলেন, ট্রেনারদের সঙ্গেই যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলেন যুদ্ধে যাবার জন্য। সমঝোতা হলে ভারতীয় কমান্ডার বলেছিলেন, তোমাদের মতো তরুণ, যারা মাতৃভূমিকে বাঁচাতে এতো বেপরোয়া, নিজের জীবন দিতে এতো ব্যাকুল... তাদের বিজয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
বাংলার তরুণরা এখনো এরকমই আছে। শাহবাগ থেকে সাভার... তারুণ্যের জয়গাঁথা চলছেই, চলবেই। কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। কেউ না।
মন্তব্য
কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
হ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বাংলার তরুণরা এখনো এরকমই আছে। শাহবাগ থেকে সাভার... তারুণ্যের জয়গাঁথা চলছেই, চলবেই। কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। কেউ না। - শুধুমাত্র এ জায়গাতে নিজেকে 'বিশ্বাসী' মনে হয়
হা হা হা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এতদিন প্রচার মাধ্যমে অমানুষদের দেখে কেবল হতাশ হতাম। বহুদিন পর আবার মানুষের কোলাহল শুনে আশান্বিত হই। মানুষের কন্ঠে আওয়াজ বাড়ুক।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
বাড়ছে, গর্জন হবে একদিন। নিশ্চয়ই।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এর ফলে রানা প্লাজার ঘটনা তাজরীন বা ফিনিক্স বা স্পেকট্রাম বা প্যানটেক্সের ঘটনার মতো হতে পারেনি। একটু একটু করে মানুষ বুঝতে শিখেছে সম্মিলিত উদ্যোগ অথবা গণজাগরণের গুরুত্ব কোথায়। এখন আইওয়াশ করার জন্য হলেও মামলা করতে, গ্রেফতার করতে, রিমান্ড চাইতে বা বিচার করতে বাধ্য করা যাচ্ছে। আগে হলে স্রেফ নীরবে পার পেয়ে যেতো। পরিবর্তন এই পথে আসবে। সচেতনতা এই পথে বাড়বে। অনন্তকাল ধরে সঞ্চিত অমানবিকতা, অন্যায় আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসানও এই পথেই হবে। ১৯৭১-এ আমাদের পিতা-মাতারা যা করে দেখিয়েছেন তাদের সন্তান - আমরাও অমনটা করতে পারবো।
আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত
এই রক্ত কোনদিনও পরাভব মানে না
আপোষ করে না, চোরাগলিতে হারায় না
এই রক্ত কোনদিনও
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই পরিবর্তনটাই সমস্যা। আগে অনেক অপকর্মই বালিশের তলে গুঁজে রাখতে পারতো অনেকে, এখন সবাই এতো বেশি সজাগ হয়ে গেছে যে সেগুলো আর করা যাচ্ছে না।
এই নতুন পরিস্থিতিটা পুরনোদের জন্য যথেষ্টই ভয়ের
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হয়তো আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় কিছু করা সম্ভব হবে, চেষ্টা চলছে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পৃথিবীর কোন দেশের মানুষ এমন করে ভালবাসতে পারে না,আমি গ্যারান্টি দিতে পারি।
সুবোধ অবোধ
আমার কিন্তু মনে হয়, এই ভাবমূর্তি ভেঙ্গে পড়াই ভালো। সস্তা শ্রমিক না বরং পরবর্তী প্রজন্ম পরিচিত হোক বুদ্ধি-শ্রমিক হিসেবে।
ধন্যবাদ। অসাধারণ লিখেছেন!
দেশের জন্য শেষ রক্তবিন্দু নিয়ে আছি। কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না!!
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
হতেই হবে।
কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না
চমৎকার
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
সারি সারি মানুষের লাশ দিয়ে যে "ভাবমুর্তি", তার কোন দরকার নাই। এই লোভের ভাবমুর্তি নিয়া যার যেখানে ইচ্ছা চলে যাক। বাংলাদেশের কোন দরকার নাই ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
নতুন মন্তব্য করুন