যখন তনুর প্রতি অবিচারের এবং বিচারহীনতার হতাশা গ্রাস করে ফেলে সকালটা, গাঢ় করে তোলে রাতের অন্ধকার... ভারতী, ছবি, সবিতার পচন ধরা লাশের গন্ধ এসে নাকে লাগে... মনে পড়ে যায় ইয়াসমীন কিংবা তারো আগের শবমেহেরের কথা... দূর্ণীতি, অব্যবস্থাপনা, লাশের আর রক্তের গন্ধ আসে নাকে... আর অভিজিৎ রায়... হায় রক্ত! হতাশার সেই চূড়ান্ত সময়ে আমার একটি রাতের কথা মনে হয়, মনে হয় একটি ভোরের কথা, যে রাতটি বা ভোরটি কখনো আসেনি আমার জীবনে। তবু আমি কল্পনার চোখে দেখতে চেষ্টা করি এমন একটি রাত, যে রাতে এই শহরের নিরীহ মানুষের ওপর নেমে এসেছিলো ভারি কামানের বিভীষিকা! মুহূর্মুহূ গুলি ছুটেছে নির্বিচারে। ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হয়ে গেছে! শহরের একটি মানুষও জানতো না ঠিক পরমুহূর্তে সে এই পৃথিবীতে আর বেঁচে থাকবে কি না। শহরের প্রতিটি মানুষ যখন জানতো হয়তো পরবর্তী বুলেটটি তার বুকেই এসে বিঁধতে পারে। সেই ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার রাতটি আমি মাঝে মধ্যে কল্পনার চোখে দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। আমি কল্পনায় নিজেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি সেই রাতের সেই জগন্নাথ হলে... এরপর সব শূন্য হয়ে যায়, আমি আর ভাবতে পারি না। আমি বুঝে যাই, আমি ভালো কল্পবাজ না, কিংবা সেই রাতটি এমনই বিভীষিকাময় ছিলো যা আসলে যে কোনো কল্পনাশক্তিকেই হার মানায়।
আমি ভাবতে চেষ্টা করি সেই ভোরটার কথা... সমগ্র রাতের বিভীষিকার পর যে সূর্যটার উদয় হয়েছিলো, তার রং কি ডিমের কুসুমের মতো কমলা ছিলো নাকি অনেক বেশি রক্তিম ছিলো? সেই ভোরে যখন সমস্ত শহরে শুধু কারফিউ আর লাশ, সেই ভয়ঙ্কর অবরুদ্ধ এক লাশের শহরে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি কী ভাবতাম?
অনেক যত্ন করে একবার ২৫ মার্চ রাতে অবরুদ্ধ একটি বাড়িতে একটি পরিবারের উৎকণ্ঠার বিবরণ লিখেছিলাম চিত্রনাট্য আকারে। অনেকবার ঘষে মেজে যখন মনে হলো হয়তো কিছুটা হয়েছে, তখন সেটা পড়তে দিয়েছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। যিনি ঐ রাতে এই শহরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি পড়ে বলেছিলেন, যে সেই রাত কাটায়নি, সে কখনোই কল্পনাও করতে পারবে না কতোটা ভয়ঙ্কর ছিলো সেই রাত।
আমি সত্যিই জানি, আমি কখনোই পারবো না।
তারপর আমি ভাবি সেই মুহূর্তে বেঁচে থাকা তরুণেরা যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভারতে গিয়ে অপেক্ষা করতো মুজিবনগর সরকার তাদেরকে স্বাধীনতা এনে দেবে, অতঃপর তাহারা দেশে ফিরে সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিবে? অথবা 'শেখের বেটা ক্যান নিজে না পলায়া ধরা দিলো' বলে বঙ্গবন্ধুকে একচোট গালি দিয়ে কলকাতা নিউমার্কেটের পাশে চায়ের কাপে ঝড় তুলতো? ‘তাজউদ্দিনরে দিয়া কিসসু হইবো না, অরে সরায়া মুশতাকরে বা ভাসানীরে বসা’ বলে জ্ঞান ঝাড়তে ঝাড়তে রাজা উজির মারতো তাহলে কী হতো? অথবা তখনকার অসংখ্য মানুষ যেরকম ভাবতো ‘এইসব চ্যাংড়া চাষাভূষার পোলাপান পাকিস্তান বাহিনীর লগে যুদ্ধ করতে গেছে? পাগল না মাথাখারাপ?’ সেরকম ভেবে শুধু বসেই থাকতো... কী হতো তাহলে?
যা হতো তা সবাই জানেন...
আমি নিজে মনে করি মানুষ তাঁর নিজস্ব সময় এবং বাস্তবতার চাহিদা মেটানোর কিছু দায়িত্ব কাঁধে নিয়েও জন্মগ্রহণ করে, শুধু বেঁচে থাকার বা খেয়ে পরে টাকা বানানোর যন্ত্র হওয়ার জন্য নয়। এই জনপদের সবচেয়ে কঠিন সময় আর পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষ নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকঠাকমতো পালন করেছিলো বলেই আমরা আজ ওড়াতে পারছি লাল সবুজের পতাকা। নিজের হাতে তুলে নিতে পেরেছিলাম আমাদের নির্ভরতার চাবি। কিন্তু আজকের দিনে আমরা কি আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করছি?
তাহলে কি এখন আমাদের অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামতে হবে? না, সচেতন হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরী, করণীয়টা তখন আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যায়। সুন্দরবনকে ধ্বংস করার সবগুলো রাস্তা বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ে যা হচ্ছে তা জেনেও না জানার ভান করে থাকলে চলবে না, চিৎকার করে বলতে হবে তাঁদের পক্ষে। আমার স্বজনদের মধ্যে যেন কোনো ধর্ষকামী না থাকে, আমাকে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে বন্ধুত্বের নির্মল হাসিঠাট্টার আড্ডায় সানী লিওনিকে নিয়ে রসালো আপাতনির্দোষ জোকসের সূত্রেই আমার কোনো বন্ধু হয়তো মনের অজান্তে ভেতরে ভেতরে ধর্ষক হয়ে উঠছে, আমি বা সে কেউ-ই বুঝতে পারছি না। আমাদের সচেতন হতে হবে। তেমনিভাবে আমাকেই সচেতন হতে হবে আমার আশেপাশে আমি কোনো জঙ্গী লালন করছি কি না। আমাকে এবং আমাদেরকে সচেতন হতে হবে সচেতনতার নামে কেউ আমাকে নিয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠছে কি না। আমাকে সচেতন হতে হবে, অনেক সচেতন হতে হবে, অনেক বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
আর এই সবকিছুতে সচেতন হওয়ার জন্য সবচেয়ে কোনটা জরুরী? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাকে ভালোভাবে জানা। ত্রিশলক্ষ মানুষকে কেন প্রাণ দিতে হলো আর চারলক্ষ নারীকে কেন বিসর্জন দিতে হলো সম্ভ্রম তা বুঝতে হবে। শুধু যদি মুক্তিযুদ্ধটাকে আমরা লাল সবুজ প্রোফাইল পিকচার থেকে মুক্ত করে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, বুঝতে পারি এর মর্মার্থ, তাহলেই আমরা বর্তমানকালে নিজের দায়িত্বটুকু বুঝতে পারবো। সচেতন হতে পারবো। সচেতন করতে পারবো। তাহলেই আমরা এই দেশে কোনো ধর্ষকের হয়ে কথা বলবো না, পক্ষ হয়ে লড়বো না কোনো খুনীর। মুক্তিযুদ্ধকে উপলব্ধী করতে পারলেই আমরা ঝড় এলে বালিতে মুখ গুঁজে সুখি থাকার অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে পারবো।
মুক্তিযুদ্ধের কথাই যদি বলি, তখনো যে সব তরুণ বা সব মানুষ ভেসে গিয়েছিলো সচেতনতার জোয়ারে, তা না। কিন্তু একটা বড় অংশ নিজেদের দায়িত্বটা বুঝতে পেরেছিলো আর যার যার জায়গা থেকে কোনো প্রাপ্তির লোভ ছাড়াই নিজের দায়িত্বটা পালন করেছিলো বলেই আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।
কিন্তু তারপর আমরা মনে করেছি শুধু তাদের দায়িত্বের ঘাড়ে চেপেই আমরা আরামে আয়েশে কর্পোরেটের দাস হতে পারবো, গলায় টাই ঝুলিয়ে ফুর্তি করতে পারবো। আমরা মনেই করেছিলাম আমাদের কোনো দায়িত্ব আর পালন করতে হবে না। আর সেই সুযোগে আমরা পিছিয়ে গিয়েছি প্রায় সাড়ে চার দশক। দেশে এই যে বর্তমানের এই পরিস্থিতি, তার পেছনে আমাদের দায় মোটেই কম নেই, আমাদের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। আমাদের অসচেতনতার ফলেই রাজনীতিকরাও দূর্ণীতিবাজ হতে পেরেছে। দীর্ঘদিন ধরে 'আই হেইট পলিটিক্স'কে এদেশে জনপ্রিয় করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের সামরিক শোষন পঙ্গু করেছে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে। আরো একটা প্রচণ্ড গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে যখন অবশেষে দীর্ঘদিন পরে এদেশে গণতন্ত্র এলো, তখনো খুব সুক্ষ্ম উপায়ে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে অগণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি। আমাদেরকে শেখানো হয়েছে অগণতান্ত্রিক সুশীলরাই কেবল আমাদেরকে দিতে পারে একটি সঠিক নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার!
এখন আমাদেরকেই জানতে হবে, আমরা কি এখনো ‘এই দেশটার কিসসু হবে না’ বলে হতাশ হয়ে দায়িত্ব আড়াল করবো কি না? সিদ্ধান্তটা আমাদেরই... আপনার আমার তোমার তোর আমাদের তোমাদের আপনাদের সকলের...
সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা... এই নিরীহ মাটিতে আবার জন্ম নেবে সচেতনতার ধান... প্রত্যাশায়... জয় বাংলা
মন্তব্য
মনে হয় এরকম একটা লেখার অপেক্ষা করছিলাম স্যার
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মুক্তিযুদ্ধটা ১৯৭১ সালে হয়ে গেছে বলেই যে তা একমাত্র উৎসবের উপলক্ষমাত্র হয়ে গেছে, আমাদের প্রজন্মের কোন যুদ্ধ নেই এই ভ্রান্ত, সুবিধাবাদী ধারনার মূলে আঘাত করে আপনার লেখাটা দারুন দারুন ভালো লাগলো।
অজস্র ধন্যবাদ।
সোহেল ইমাম
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এই সুযোগে একদল মানুষ(?) উচ্চকন্ঠে বলে বেড়িয়েছে, বলে বেড়াচ্ছে- পাকিস্তান আমলে আমরা অনেক ভাল ছিলাম, এইটা একটা দেশ হল? কোন সভ্য দেশে এইরকম হয়? খ্যাতা পুড়ি এই দেশের ..............
এজন্যই তো সবাই মিলে দেশটাকে আবার কিভাবে পাকিস্তান বানানো যায় সেই চেষ্টা চলছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এই নিরীহ মাটিতে আবার জন্ম নেবে সচেতনতার ধান... প্রত্যাশায়... জয় বাংলা
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
জয় বাংলা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। আপনাকেও।
আপনাকেও
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
প্রত্যাশা থেকে জন্ম নিক কাঙ্ক্ষিত ফসল, প্রত্যাশার জয় হোক, ধীরে হলেও হোক।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হবে... একদিন নিশ্চয়ই হবে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দেশে এই যে বর্তমানের এই পরিস্থিতি, তার পেছনে আমাদের দায় মোটেই কম নেই, আমাদের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। আমাদের অসচেতনতার ফলেই রাজনীতিকরাও দূর্ণীতিবাজ হতে পেরেছে। দীর্ঘদিন ধরে 'আই হেইট পলিটিক্স'কে এদেশে জনপ্রিয় করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের সামরিক শোষন পঙ্গু করেছে রাজনৈতিক
সহমত
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
ধন্যবাদ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অজস্র শুভেচ্ছা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনাকেও
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
।।বাংলাদেশের প্রাণ
নতুন মন্তব্য করুন