আমাদের দীর্ঘদিনের দাবী ছিলো ইতিহাস নিয়ে তামাশা বন্ধে আইন চাই । অনেক দেরীতে হলেও উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। ইতোমধ্যে আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। তার ভিত্তিতেই কিছু ব্যক্তিগত মতামত এখানে থাকলো আলোচনার জন্য। আইন বিষয়ে আমার জ্ঞান শূন্যের চেয়েও কয়েক ডিগ্রী নিচে। ভুল হলে ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।
খসড়া আইনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ অনুযায়ী এর 'ক' ধারায় আছে "১৯৭১ সালের ১লা মার্চ হতে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমূহ অস্বীকার করাকে অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে।"
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তো ১৬ ডিসেম্বর ৭১-এই শেষ হয়ে যায়নি। অনেক জায়গাতেই পাক বাহিনী আত্মসমর্পন করেছে ১৮/১৯ তারিখেও। মিরপুর তো জানুয়ারী পর্যন্তও অবরুদ্ধ ছিলো। সেসবের ক্ষেত্রে কী বিধান হবে তাহলে? জহির রায়হান হত্যাকাণ্ডকে কি তাহলে মুক্তিযুদ্ধ থেকে আলাদা ভাবতে হবে?
আইনে বলা আছে ১ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমূহ অস্বীকার করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু এই সময়কালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে নানাবিধ ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। কোনটা অবিকৃত ইতিহাস সেটার কোনো লিখিত রূপ ছাড়া এই অপরাধ কিভাবে বিচার করা যাবে? কোনো এক কালে জামায়াতপন্থী কোনো দল রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে তারা এই আইনের সুযোগে নিজস্ব ভ্রান্ত ইতিহাসরেই জায়েজ করে নেবে না তার নিশ্চয়তা কী?
এই সময়কালের একটামাত্র ঘটনা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও এখনো মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দেশে স্লোগান হয়, মিছিল হয়, পোষ্টার ছাপা হয়, ফেসবুকে তর্ক হয়। সেটাই ঠেকানো যায়নি। তাহলে যে ইস্যুগুলো আদালতে মিমাংসিত না, রাষ্ট্রকর্তৃক নির্ধারিত কোনো লিখিত রূপ নাই, সেগুলোর বেলায় আইন কিভাবে কার্যকর হবে?
লীগ সরকারের জমানায় নাহয় ঠিক থাকলো, কিন্তু কখনো যদি বৃহত্তর জামায়েত ইসলাম সরকার গঠন করে, কিংবা তাদের মতাদর্শের কোনো সুশীল সরকার... এবং তখন তারা একমাসে সারাদেশে জরিপ চালিয়ে হাতে কলমে প্রমাণ করে দেওয়ার চেষ্টা করে যে মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ২ লাখ মৃত্যু হয়েছে আর হাজারখানেক ধর্ষন হয়েছে এবং এইটাই সঠিক ইতিহাস, এবং এই আইনের আওতাতেই এইটা মানতে হবে। অস্বীকার করলেই মাইর... তখন কী হবে?
এই আইনের অধীনে মামলা হলে সংশ্লিষ্ট থানার পরিদর্শক বা তার উপরের পদমর্যাদার কেউ এই মামলার তদন্ত করবেন। একেবারে সুনির্দিষ্ট আইন গ্যাজেট আকারে থানাগুলোতে পাঠানোর পরেও দেখা গেছে অফিসাররা অনেকেই সেগুলো ঠিকমতো পড়েন না বা জানেন না। সেক্ষেত্রে এই যে 'ঘটনাসমূহ' যা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেই ঘটনাসমূহের বা ইতিহাসের বেসিক কিছু তথ্যের লিখিতরূপ ছাড়া পুলিশ কতটুকু তদন্ত করতে পারবে?
খসড়া আইনে বলা আছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তিবাহিনীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পক্ষে যুক্তি দেখানো যাবে না... কিন্তু অনেক বামপন্থী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো বলে আমরা জানি। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরেছিলো। তাদের বেলায় কী বিচার? তাদের পক্ষে যুক্তি দেখানো যাবে?
এই আইন পাশ হলে তার পরবর্তীতে যে রাজাকারদের বিচার চলমান থাকবে, তাদের পক্ষে উকিলরা কোর্টে যুক্তি দিতে পারবেন? না পারলে বিচারকাজ চলবে কিভাবে?
সবচেয়ে বড় ভয়, অন্যকোনো মতাদর্শের বা 'নিরপেক্ষ' সরকার এলে এই আইন কতটুকু বুমেরাং হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে? এই ব্যাপারটি ভেবে দেখতে হবে সবার আগে।
এমন একটি আইন তৈরি করা দরকার, যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি কখনোই এর সুযোগ নিতে না পারে, ইতিহাস বিকৃত করতে না পারে।
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ইঁটা আর কদ্দিন?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
একটু দৌড়ের ওপর আছি, নজুভাই। নাহলে এই পোস্ট দেখেও বসে থাকা কষ্টকর।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এ্যানি মাসুদ
ধন্যবাদ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
লেখার শিরোনাম দেখে যে প্রশ্ন গুলো মাথায় এসেছিল, পড়তে গিয়ে দেখি সেগুলো লেখার মধ্যেই উচ্চারিত হয়েছে। নজরুল ভাই, লেখাটা ভালো লাগলো। দেখার ইচ্ছা আইনটা শেষে কি চেহারা নেয়।
সোহেল ইমাম
আইনটা ত্রুটিমুক্ত হোক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পাকিস্থানের জন্ম মৃত্যু দর্শন - যতীন সরকার
- এই বইটিতে বামদের মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু তথ্য আছে। শুরুতে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে, অস্ত্র ধরেছে এমনকি চীন পন্থী আর মস্কো পন্থীদের মাঝেও সশস্ত্র লড়াই হয়েছিল।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
বামদের মুক্তিযুদ্ধকালীন তথ্য অনেকখানেই আছে। তাঁরা নিজেরও কিছু লিখেছে। এগুলো নিয়ে কাজ করা দরকার।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দেখেন ভাই, মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন হল আইনটি আপনি কার জন্য করছেন। আপনি যদি ছাগলের জন্য আইন করেন যে অকারনে ম্যা ম্যা করে জনগনের শান্তি ভঙ্গ করতে পারবে না, তাহলে সেই আইন প্রনয়ন করা আর না করা সমান কথা, আইন মানুষের জন্য। চোখের সামনে সব কিছু দেখেও যে সকল বুড়া হাবড়া এখন মুক্তিযুদ্ধের ফ্যাকচুয়াল তথ্যের জন্য শর্মিলা বসু'র দ্বারস্থ হয়, তাদের মধ্যে আবার যদি ডাঃ জাফরুল্লা, কামরুল হাসান ভূঁইয়ার মত মুক্তিযোদ্ধাও থাকে, তাহলে আর আইন করে কি লাভ! মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয় নি, সেটাই আগে শেষ করা দরকার।
আইন করা হয়েছে ভালোর জন্য। কিন্তু এই দেশের মানুষকে আরও বেশি দেশপ্রেমিক হতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সাইয়িদ রফিকুল হক
নতুন মন্তব্য করুন