ট্রেনের নাম একতা এক্সপ্রেস, ঢাকা থেকে ছুটছে ময়মনসিংহের দিকে। ছুটছে কি আসলে? ১৯৮০ সাল, জীবন তখন এতোটা গতিশীল হয়ে ওঠেনি, ট্রেনেরও। এমনই ধীরগতি তার। দুষ্টু ছেলেরা মিষ্টি ছড়া কাটে, 'ঝিক্কিরঝিক্কির ময়মনসিং, ঢাকা যাইতে কতোদিন?'
সেই ট্রেনে বসে আছেন এক তরুণ। পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন পাড়ি দিচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সুন্দর সময়টা। রেনেসার সময়টা, গান কবিতা আড্ডা আন্দোলনে ভরপুর সেই উত্তাল সময়টা... তখন তিনি বিকেলের তুমুল আড্ডা পেছনে ফেলে ধীরগতির ট্রেনে চেপে যাচ্ছেন ময়মনসিংহ।
ময়মনসিংহে তাঁর প্রথম গন্তব্য তাজমহল রেস্টুরেন্ট। সেখানে রাত এগারোটা পর্যন্ত ভরপুর আড্ডা। একসময় আড্ডার বাতি নিভে যায়। মফস্বল শহরের সব বাতিও তখন নিভু নিভু, তরুণ এগিয়ে যান কবরখানা রোডের একটা বাড়ির সামনে। সেই ঘরের দরোজা বন্ধ। কখন খুলবে জানা নেই কারো। তরুণ অপেক্ষা করেন অন্ধকার রাতে।
একসময় সেই ঘরের মালিক বদরু ভাই ফেরেন। তালা খুলে অতঃপর প্রবেশ। টেবিলে কিছু খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা আছে, দু'জনে মিলে সেটুকু খেয়ে নেন। তারপর চুরোট (সিগারেট) ধরিয়ে শুরু হয় তালিম। বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর, বেজে ওঠে সেতার। যতটুকু রাত অবশিষ্ট, তালিম চলে। গৌরীপুর রাজসভার সেতারী বিপিন দাসের শিষ্য বদরুল হুদা তাঁর জীবনের শিক্ষা দিয়ে যান তরুণ আনিস মাহমুদকে। তালিম শেষে ভোরের ফিরতি একতায় আবার ঢাকায় ফেরা। সপ্তাহে অন্তত তিন চারদিন এই রুটিন। বছরের পর বছর।
সুরের সাধনায় মগ্ন সেই তরুণ আনিস মাহমুদ, আমাদের আনিস ভাইয়ের ছিলো জন্মদিন। গতকাল। ঝড় আর জ্যামের ফজিলতে গোটা দেশ যখন পিছিয়ে গেছে, আমার একদিনের দেরীতে কি আর অসুবিধা হবে? বাসী জন্মদিনের শুভেচ্ছা আনিস ভাই!
সচলায়তন তথা বাংলা ব্লগেরই অন্যতম প্রিয় ব্যাক্তি জুবায়ের ভাই, আর সচলায়তনের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক সংসারে এক সন্ন্যাসী... এই দুই ভাইয়ের মধ্যমনি হচ্ছেন আমাদের আনিস ভাই।
সচলায়তনের একটা বড় আড্ডা করেছিলাম একবার। উত্তরাতে আস্ত একটা বাড়ি একদিনের জন্য ভাড়া নিয়ে সারাদিন আড্ডা। আর খাওয়া। সঙ্গে গান। সেখানেই প্রথম আনিস ভাইয়ের গান শোনা। অন্য ভালো শিল্পীদের নিয়ে সমস্যা হলো এরা শুরুতে খুব হ্যাপা দেয়, 'না না আজ ত গলা ব্যাথা টাইপ' আর আনিস ভাই হলো উল্টো, তাঁকে গান গাইতে বলতে হয় না... বরঞ্চ থামতে না বললে সারারাত পার করে দেন গান শুনিয়ে। 'বুঝলেন, কন্ঠ তো খোলে আসলে গোটা পঞ্চাশেক গান গাওয়ার পর থেকে...' এই হলেন আনিস ভাই। আমরা অপেক্ষা করি পঞ্চাশেক গান শেষ হওয়ার, তারপর যা হয় তা সত্যিই অসাধারণ। বাংলা কীর্তন এতো দারুণ আর কাউকে গাইতে শুনিনি। ব্যাপারটা আরো মুগ্ধকর হয়ে ওঠে যখন তিনি গাইতে শুরু করেন ভাওয়াইয়া কিংবা গোয়ালপাড়িয়া গান... আহা...।
দুনিয়ার দুইজন গায়কের উপর আমার অনেক রাগ। একজন যুবদা, মানে খালেদ খান, আরেকজন আমাদের আনিস ভাই। উনারা দু'জনেই বেশ অমায়িক, মাইকের সামনে গান না। গান রেকর্ড করতে মানা। এক কথা, গান হলো সামনে বসে শোনার বিষয়... সামনে বসেন, রাতের পর রাত গান গেয়ে শোনাতে রাজী আছি।
তবে গানে আসলে আসল আনিস ভাইকে চিনি নাই... চিনেছিলাম কথায়। চিনেছিলাম জীবনে, জীবন বোধে...
দেশের অন্যতম শীর্ষ চাকরী স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে মুহূর্তে বেকার হয়ে পরদিন রাস্তায় মাইলের পর মাইল পদব্রজে পার হতে পারেন। নিজের পকেট প্রায় যখন শূন্য, তখন একগাদা আদিবাসী শিশুর থাকা খাওয়া লেখাপড়া ইত্যাদি সমস্ত কিছুর দায়িত্ব নিতে ছুটে যেতে পারেন চন্দ্রঘোনায়। সব যোগ্যতা আর সুযোগ থাকার পরেও এই কেনাপতি দুনিয়াকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে জীবনকে দু'হাত ভরে উপভোগ করতে পারেন। এটসেটরা এটসেটরা এটসেটরা... সেগুলো লিখতে গেলে রাত কাবার। আসল সত্যটাও আনিস ভাইয়ের গানের মতোই। দূর থেকে যন্ত্র মারফত শুনে যার কিছুটাও উপলব্দি করা যায় না, আনিস ভাইকে জানতে হলে যেতে হবে তাঁর কাছে, মিশতে হবে, আড্ডা দিতে হবে প্রাণ খুলে।
ভাবছেন সে বড় কঠিন কর্ম? কোথায় পাবেন তারে?
কঠিন নয় মোটেই। কঠিন এক রোগ, যাকে অন্য সকলে বলেন দূরারোগ্য ব্যাধি, সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি এখন আরামে সারাদিন রাত আড্ডার জন্য প্রস্তুত আছেন। ভাবছেন এরকম ভয়ানক ব্যাধি নিয়ে কেউ আরামে আড্ডা দিতে পারে? পাগল?
হু পারেন, আনিস ভাই পারেন। এটাই আনিস ভাই। দুনিয়ার সব প্রতিকূলতাকে চোখের পলকে উড়িয়ে দিয়ে গান গেয়ে উঠতে পারেন নতুন জীবনের...
এবছর জন্মদিনে দেখা হলো না, আগামী বছর নিশ্চিত দেখা হবে আনিস ভাই। কেক কেটে গান শুনে ফুর্তি করে...
[আনিস ভাইয়ের ছবিটি তুলেছেন আরেক শ্রদ্ধেয় এবং গুণী সচল মুস্তাফিজ ভাই]
মন্তব্য
এবছর জন্মদিনে দেখা হলো না, কোন একসময় নিশ্চিত দেখা হবে আনিস ভাই। শুভ জন্মদিন।
...........................
Every Picture Tells a Story
কোন একদিন ভাই ভাই মিলে আবার আড্ডা হবে সারাদিনমান।
শুভ জন্মদিন
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আনিস ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা উত্তরার সেই নাটক বাড়ীতে যার কথা নজরুল বলেছেন। সেখানেই তাঁর গান প্রথম শোনা। তার পর আরও কয়েক বার এখানে সেখানে - সব বারই কোন না কোন আড্ডাতে। সর্বশেষ শুনেছিলাম বোধ করি আনন্দীদের বাসায়। এর পরে আরও একবার সুযোগ হয়েছিল আমার এক প্রতিবেশীর বাসায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেদিন বাইরে কাজ থাকায় আর তাঁর গান শোনা হয়ে ওঠেনি। প্রাণের সখাদের ভালোবাসার চোটে আনুষ্ঠানিক সচলাড্ডা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে অপূরণীয় ক্ষতিগুলো হয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে আনিস ভাইয়ের গানের আড্ডা হতে না পারা।
খুব কঠিন পরিস্থিতিকে খুব সহজ ভাবে নিয়ে তার মোকাবেলা করা, খুব কঠিন বিষয়কে খুব সহজে অল্প কথায় প্রকাশ করা, খুব কঠিন সিদ্ধান্তকে খুব সহজে গ্রহন করার মতো মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষের সংখ্যা খুব কম - আনিস ভাই তাঁদের একজন। তবে এই সব কিছুর বাইরে যে অনন্য সাধারণ গুণের জন্য আনিস মাহমুদ একজন 'আনিস ভাই' সেটা হচ্ছে তাঁর ভালোবাসার ক্ষমতা। সদ্যোজাত শিশু থেকে নব্বই বছরের বুড়ো পর্যন্ত সবার তিনি বন্ধু হতে পারেন। এই বন্ধুত্ব শুধু মুখের কথায় নয়, তিনি সুখের দিনে দুঃখের দিনে পাশে থেকে সেই বন্ধুত্বের প্রমাণও দিয়ে যান।
খুব ভালো থাকুন আনিস ভাই! শারিরীক কষ্টগুলো দূর হয়ে যাক। সদা আনন্দে থাকুন। পরের বার দেখাতে এস্রাজ বাজিয়ে শোনানোর আবদার রেখে গেলাম।
শুভ জন্মদিন!!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সেইসব আড্ডাগুলো আবার চালু করা যায় না?
আজকে খানিক আগে রুবা মামীর সাথে ফোনে কথা হলো, আনিস মামার ফোন কোন কারণে লক হয়ে যাওয়ায় ফোন যাচ্ছে না। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু রুবা মামীর কাছ থেকে জানলাম তার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে হুট করে। ২১ জুলাই থেকে হসপিটালাইজড আছেন।
মামী প্রায় একা সামাল দিচ্ছেন হাসপাতাল। গত জুন থেকে শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে আসলে। আমার মনে হলো সন্ন্যাসীদা'র শোকটা অনেক বড় ফ্যাক্টর।
ঢাকায় যারা শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, একটু সময় করে মামার সাথে পারলে দেখা কোরেন। মামী অনেক শক্ত মানুষ, কিন্তু মনে হলো এ মুহূর্তে তেমন কেউ নাই সবসময়ে পাশে থাকার মতো।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
বুড়ার আরেক বিশেষ ব্যপার হচ্ছে তার আশেপাশে সবসময় সুন্দরী বালিকারা ঘুরঘুর করে! তাতে আমার পেটভর্তি হিংসা হয়। আমি সিদ্ধান্ত নিছি আমি বড় হয়া আনিস বুড়া হমু!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
হ। তিনি আমাগো আনিস ভাই...
আনিস ভাই! ভালবাসি মানুষটাকে ---
উনারে জলদি ব্লগিংয়ে ব্যাক করতে বলেন।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
শুভ জন্মদিন প্রিয় আনিস ভাই!!!
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
শুভ জন্মদিন আনিস ভাই!
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
শুভ জন্মদিন! আনিস ভাই।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আপনি সুস্থ হয়ে উঠেন জলদি। এবার যদি আপনাকে নিয়ে আরেকটা আড্ডার আয়োজন হয়, আমি নিশ্চিত সেখানে হাজির হবো।
বিলম্বিত শুভ জন্মদিন আনিস ভাই!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নতুন মন্তব্য করুন