মোড়লপনার নিয়ম হলো মিলমিশ করিয়ে দেওয়া। পুরাতন গ্যাঞ্জামে যা কিছুই হোক না কেন মিটমাট করিয়ে শান্তিতে বসবাসের বন্দোবস্ত করা। বিচার না, মিটমাটেই শান্তি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর করা গণহত্যা ইস্যুতেও মোড়লপনার ইতিহাস পুরনো। ক'দিন পরে পরেই মিটমাটের উদ্যোগ ওঠে। পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলেন সুশীল মুরুব্বীরা। কোনোরকমে ক্ষমা চাওয়াতে পারলেই মিটমাটের বন্দোবস্ত করে ফেলা যায়। সেই তদ্বির পাকিদের তরফ থেকে যেমন চলে, বাঙালিদের তরফেও চলে।
বিজয় দিবস পার হওয়ার পরপরই প্রথম আলো পুনরায় হাজির করেছে 'ক্ষমা' রেসিপি। এতদিন হামিদ মীর-এর ঘাড়ে চেপে এই রেসিপি চলেছে, কাদের মোল্লা ইস্যুতে মীরের ল্যাজ বের হয়ে যাওয়ায় এসেছে নতুন উজির, উজাইর ইউনুস। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন ভাষ্যকার। অলব্রাইট স্টোন গ্রুপের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক তিনি। আজকের প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছে তার উপসম্পাদকীয় 'পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার এখনই সময়'।
তিনি বলেছেন '১৯৭১ সালের ভূত এখনো তাদের (পাকিস্তানের) ঘাড়ে চেপে রয়েছে। সে সময় তারা যে মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতেও সেই একই মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। তাই তাদের উচিত, বাংলাদেশের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া। আর সে সময় এখনই।'
উজাইর ইউনুস নিজেই লিখছে যে পাকিস্তানের মনোভাব এখনো ঠিক আগের মতোই অর্থাৎ ৭১ সালের মতোই আছে, এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যুতেও। হ্যাঁ উজাইর ইউনুস, পাকিস্তানের মনোভাব এখনো আগের মতোই আছে। তারা বর্বর, তখনো ছিলো, এখনো আছে, বদলায়নি, বদলাবে না। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসীর রায় হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়, জাতীয় পরিষদে নিন্দা জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করে। আমাদের দেশের একটা রাস্তার নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে রাখলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে তার প্রতিবাদ জানানোর সাহস দেখায় এখনো! ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিলো, এখনো পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং এর সরকার ততোটাই ঘৃন্য মনোভাবাপন্ন।
উজাইর ইউনুস আরো লিখেছে 'প্রতিবেশী ও ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে এই অঞ্চলে পাকিস্তান ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।' বিচ্ছিন্ন হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়াই পাকিস্তানের নিয়তি। পাকিস্তান একটা যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র, বর্বর রাষ্ট্র (জাতি বলছি না, কারন পাকিস্তানী বলে কোনো জাতি নেই, এটা শুধু একটা ভৌগলিক পরিচয়। অনেকগুলো জাতি মিলিয়ে একটা রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র সেসব জাতিগোষ্ঠীর ওপরও বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন এবং গণহত্যা চালাচ্ছে)। এর অধিবাসীরাও সেই অপরাধে আংশিক দোষী। কারণ তাদের বড় অংশ এই গণহত্যাকে অস্বীকার করে এখনো, আর কিছু সুশীল ক্ষমার রাজনীতি করে পাকিস্তানকে কিভাবে বাঁচিয়ে দেওয়া যায় সেই চিন্তায় মশগুল। যেমন হামিদ মীর, যেমন উজাইর ইউনুস। কখনোই তারা এই গণহত্যার বিচার দাবী করে না।
কিন্তু আমরা দাবী করি। আমরা বাংলাদেশের নাগরিকেরা এই গণহত্যার বিচার চাই। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে দাঁড় করাতে চাই অপরাধীর কাঠগড়ায়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমাদের ঘরে ঘরে এখনো জ্বলজ্বল করছে ৭১ এর ক্ষত। ক্ষমা চাইলেই আমরা করবো না। যদি বাংলাদেশের কোনো সরকার পাকিস্তানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার কথা ভাবে, আমরা এমনকি আমাদের সেই সরকারের বিরুদ্ধেও পথে নামবো। যেভাবে আমরা নেমেছিলাম ২০১৩ সালে। প্রয়োজনে আবার আমরা পথে নামবো, কিন্তু পাকিস্তানকে ক্ষমা করতে দেবো না। কারন পাকিস্তানকে ক্ষমা করা মানে ৩০ লক্ষ শহীদকে অপমান করা, ২ লক্ষ মা বোনকে চূড়ান্ত অপমান করা, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বেঈমানী করা, জাতির সঙ্গে বেঈমানী করা। আমরা তা করতে পারি না, পারবো না, কাউকে করতেও দেবো না।
পাকিস্তান ১৯৭১ সালে কোনো সাধারণ অপরাধ করেনি যে একে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে বা ক্ষমা চাইলেই সম্পর্কের বরফ গলিয়ে গলা জড়াজড়ি করে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে হবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষ খুন করেছে, কয়েক লক্ষ নারীকে নির্যাতন করেছে, কোটি মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে, আরো কোটি মানুষকে বাস্তুহারা করেছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুট করেছে। সবশেষে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদেরকে রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে যাতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কখনোই আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এটা একটা পরিকল্পিত জেনোসাইড। একটি জাতিসত্ত্বাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা। জেনোসাইডের কোনো ক্ষমা হয় না। বিচার হয়, শাস্তি হয়। আমরা আমাদের দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দিচ্ছি। আজ হোক কাল হোক আরো পঞ্চাশ বছর পর হলেও গণহত্যাকারী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের বিচার আমরা করবোই, আমরা না পারি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম করবে, করবেই। রেহাই নেই। ক্ষমা নেই। ১৯৭১ সালের একজন মানুষও জীবিত না থাকলেও গণহত্যাকারী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে এই পৃথিবীর বুকে চিহ্নিত করে যাবো আমরা।
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু
মন্তব্য
কাশেম রাজাকার রেহাই পাবে না এটা নিশ্চিত হয়ে যাবার পর আলু পেপারের "পাকিরাও ভাল" প্রজেক্ট একটু স্তিমিত ছিল। পালা পার্বনে এখনো এইসব দিবাস্বপ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
প্রভূখন্ডে লেখা দেখছি,
হ, বাংলাদেশ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র পাকিস্তান রোহিঙ্গা ইস্যু স্বীকৃতি দেবে এজন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।
আরেকটা জিনিস মাথায় আসলো ক্ষমা চাওয়া বলতে তারা কী বোঝে? ভুট্টো ১৯৭৪ সালে বলেছিল পাকিস্তান অনুতপ্ত আর পাকিস্তানিরা নাকি আল্লাহর কাছে (বাংলাদেশিদের জন্য না) এইজন্য ক্ষমা চাইতে চায়। মারখোরমুলুকের উজাইর ইউনুস বা ভুট্টো কেউই পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে কথা বলে না। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বিষয়ও চুপ। স্বাধীনতার পর ক্ষতিপূরণ বিষয়ও কোন কথা বলে না। এইসব অমীমাংসিত বিষয় এখন রোহিঙ্গা দিয়ে পার করতে হবে!
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের কথা বলা, বিচার চাওয়া, ফাঁসী চাওয়া এগুলো বর্বরতা। শান্তির পৃথিবী গড়তে হবে। ঘৃণার রাজনীতি ভুলতে হবে, অতীত তো আরো আগে ভুলতে হবে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
খোদ হামীদ পাইক্কাই এখন আর ক্ষমার কথা কয় না হেহেহে।
সে তো এইসব ফ্যাসীবাদি বিচার বন্ধ করতে কয়
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
৭১-এর পথে শুনি কার বাণী,
অস্তের পথে দেখি পাকিস্তানি,
মাপ নাই, ওরে মাপ নাই--
নিঃশেষে যতই ঝরাস চোখের পানি
ক্ষমা নাই তোর ক্ষমা নাই।
****************************************
মেললে না মেললে না।
তয় মেললে না তো কী অইলে, ছেললে।
হ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মেহেরজান কেলেংকারীর সময় ফারুক ওয়াসিফ এ ধরনের লেখা অনুবাদ করত। এ লেখাটি দেখলাম রোকেয়া রহমানের অনুবাদ করা। ফারুক ওয়াসিফ কি তাহলে এখন ভিন্ন রকমের পাকি এপলজিস্ট টেক্সট উতপাদনের সাথে জড়িত? নাকি রোকেয়া আপন যোগ্যতা বলে ফারুকের জায়গা দখল করে নিছে? নাকি রোকেয়া রহমান ফারুকেরই ছদ্দনাম?
না ছদ্মনাম না। রোকেয়া রহমান সম্ভবত প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
"এটা একটা পরিকল্পিত জেনোসাইড। একটি জাতিসত্ত্বাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা। জেনোসাইডের কোনো ক্ষমা হয় না। বিচার হয়, শাস্তি হয়। "
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
একদম মনের কথা
---মোখলেস হোসেন
প্রথম আলোর ফেসবুকে মন্তব্য পড়লাম মন্দিয়ে এই অনুবাদের সাথে। খুবই ভালো লাগল। ফেসবুক একটি মহা অভিশাপ। (স্ক্রিনশট দিতে গিয়েও দিলাম না। কী দরকার)
..................................................................
#Banshibir.
নতুন মন্তব্য করুন