ম্যারিয়েটা, জ্যাক এবং অতঃপর ভ্যালেরী

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর (তারিখ: শনি, ২০/১০/২০০৭ - ৪:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের লাখো শরণার্থীর করুন জীবন কাঁদিয়েছিলো বৃটিশ তরুনী ম্যারিয়েটাকে। শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ এবং বাংলাদেশের পে আন্তর্জাতিক প্রচারণায় তিনি তখন আত্মনিয়োগ করলেন। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করে বাংলাদেশের জন্য তহবিল আর সমর্থন জোগার করে চললেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এমনকি নিজের বাড়িটিকেই ‘একশন বাংলাদেশ’ এর অফিস বানিয়ে তিনি করেছিলেন বাংলাদেশের জন্য অন্যরকম এক যুদ্ধ। এমনকি ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদ যখন পাকিস্তানীদের হাতে বন্দি তখন তাঁকে উদ্ধার করে লন্ডনেও নিয়ে যান এই ম্যারিয়েটাই।
যুদ্ধ শেষ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। তিনি তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে এলেন। কিন্তু দেখলেন ভিন্ন এক বাংলাদেশ। দেশজুড়ে তখন লোভ আর কামড়াকামড়ি। যে দেশটার জন্য, যে মানুষগুলোর জন্য তিনি এতকিছু করলেন সেই মানুষগুলোর কুৎসিত রূপ তিনি দেখতে পেলেন। প্রতিবাদ করায় তাকেও নানাবিধ অপবাদ দেওয়া হলো। লজ্জায় অপমানে ঘৃণায় তিনি দেশে ফিরে গিয়ে নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।
ম্যারিয়েটার মৃত্যু নিয়ে আমরা কখনোই অনুতপ্ত হতে পারিনি। এমনকি তাঁর স্মরণে এবং তাঁর নামে একান্তই ব্যাক্তিগত উদ্যোগে যে বইয়ের দোকানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো- শাহবাগের আজীজ সুপার মার্কেটের নিচতলার সেই ‘ম্যারিয়েটা’ দোকানটিতেও স¤প্রতি লেগেছে নতুন সাইনবোর্ড। আহ্ শান্তি... এবার আমরা তার নামগন্ধও মুছে ফেলতে পেরেছি। বিদায় ম্যারিয়েটা।

২.
১৯৭২ সালে সাহায্য সংস্থা কনসার্ণের হয়ে বাংলাদেশে আসেন জ্যাক প্রেগার। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে তখন অসহায় মানুষের অভাব নেই। অভাব নেই অনাথ বাচ্চার। জ্যাক এদের সেবা করতে করতে মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে দেশে ফিরে গেলেন। কিন্তু থাকতে পারলেন না, বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষকে ভালোবেসে আবার তিনি ফিরে এলেন এবং সম্পূর্ণ নিজ উদ্যেগে কমলাপুরে একটা শিশু হাসপাতাল করলেন। তৎকালীন সরকার তার কাজে মহাখুশি হয়ে তাকে অনুরোধ করলো অভাবী ও অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র তৈরির। এনায়েতপুরে জমিও বরাদ্দ করলো সরকার, আশ্রয় কেন্দ্রও হলো, অনাথ শিশুরা সেখানে সহি সালামতে বেড়েও উঠতে লাগলো।
আর এই করতে গিয়েই জ্যাক টের পেলেন যে অভাবী শিশুদের দত্তক দেওয়ার নামে এদেশের প্রচুর শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে ইউরোপে। এবং ব্যাবহার করা হচ্ছে পর্ণোগ্রাফিতে। জ্যাক এর প্রতিবাদ করলেন এবং এই শিশু পাচার ঠেকাতে উঠে পরে লাগলেন। কিন্তু হায়, তিনি যে একা এক বিদেশী। আর পাচারচক্রের লোকজনের হাত যে খোদ সরকারেও প্রভাব বিস্তারী তা তো তিনি জানতেন না। আইনি সহায়তার জন্য তিনি গেলেন ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদার কাছে, তিনি পরামর্শ দিলেন এসব ব্যাপারে নাক না গলাতে। কিন্তু জ্যাক নাক গলানো বন্ধ করতে পারলেন না। ফল যা হবার তাই হলো- তাঁকেই শিশু পাচারকারী ও ইহুদি চর আখ্যা দিয়ে দেশছাড়া করা হলো।
জ্যাক এখনো নাকি বেঁচে আছেন, কলকাতার হাওড়া ব্রিজের নিচে ও আশপাশের বস্তিতে তিনি নাকি এখনো বিনাপয়সায় রোগীর সেবা করে যাচ্ছেন। সারা ভারতে তিনি ডাক্তার জ্যাক নামে জনপ্রিয়। কেউ কেউ তাকে মাদার তেরেসার সাথেও তুলনা করে।
আমরাই কেবল তাকে চিনতে পারলাম না... হা কপাল।

৩.
তুলনায় তো ভ্যলেরী টেলরের অনেক সৌভাগ্য। তাকে দেশ থেকে তাড়ানো হয়নি, গুপ্তচরের অপবাদ দেওয়া হয়নি, তাঁকেও আত্মাহুতি দিতে হয়নি। বদলে দেওয়া হয়েছে সন্মানসূচক নাগরিকত্ব। বছরের পর বছর কাজ করার স্বাধীনতা। সিআরপির মতো একটা আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান তিল তিল করে গড়ে তোলার সুযোগ। তাঁর তো ধন্য হয়ে যাওয়া উচিত। এবং সরেই যাওয়া উচিত, সুবিধাবোগীরা নাহলে ফায়দা লুটবে কিভাবে ?

৪.
ভ্যালেরীকে অকর্মন্য করে দেওয়া হয়েছে, কেন করা হয়েছে তা খুব স্পষ্ট। সিআরপি এখন আর ছোটখাট কোনো বিষয় না... অনেক বড় ব্র্যান্ড। কিছু পাঘাতগ্রস্ত লোকের পিছনে সময় ব্যায় না করে বরঞ্চ সিআরপি এখন হরিলুটের কাজে ব্যাবহৃত হতে পারে। পাঘাতগ্রস্তদের দিয়ে কি হবে ? তারচেয়ে লোভীদের ভান্ডার পূর্ণ হউক।
এবং এই কাজে ভ্যালেরী টেলর এক বড় বাঁধা, তিনি যে ম্যানেজমেন্ট বোঝেন না (ম্যানেজমেন্ট শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ কি ধান্ধাবাজী ?) ! অতএব তাকে সরাও।

৫.
ম্যারিয়েটা এবং ডক্টর জ্যাকের পরিনতি আমাকে ভাবিত করে, ভয় জোগায়। ভ্যালেরীকে এখনো তাও দেশে থাকতে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি শোপিস হিসেবে সিআরপিতেও রাখা হচ্ছে। কিন্তু যদি ভ্যালেরী বা তার পে আমরা যারা আমজনতা তারা বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করি তাহলে ? তাহলে কি ভ্যালেরীকেও অপমান করে দেশছাড়া করা হবে ? যেমনটি করা হয়েছে ম্যারিয়েটা বা ডক্টর জ্যাকের েেত্র ?
করতেই পারে, তারা যে ভীষণ শক্তিমান, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে তাদের অনেক লম্বা লম্বা হাত। তুলনায় ভ্যালেরী যে নিতান্তই শিশু... শিশুতোষ।

৬.
ভ্যালেরী আদতেই একেবারে শিশুদের মতো। গতবছর একটা টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণকাজে প্রায় সারাদিন তাঁর সাথে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। তখন দেখেছি একটা পূর্ণবয়স্ক শিশুমন। কি নিষ্পাপ। আমার জীবনে এমনতরো মানুষের দেখা আগে আর পাইনি কখনো। মজা করেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- বিয়ে করবেন না ? তিনি বলেছিলেন- ‘আমি সিআরপিকে বিয়ে করেছি, আর কিছু চাইনা।’ এরকম একজন মানুষের সাথে এরকম অমানবিক কাজ কোনো মানুষ করতে পারে ? জানিনা। যারা করছে তারা কি মানুষ ?

৭.
ম্যারিয়েটা বা ডক্টর জ্যাকের বেলায় কিছুই করা যায়নি... ঠেকানো যায়নি তাদের অসহায় পরিণতি। আমাদের জাতিগত লজ্জার পরিমান অনেকই বেড়েছে কেবল। কিন্তু আর বাড়াতে চাইনা। ভ্যালেরী টেলরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখতে আমরা আমাদের ুদ্র সাধ্য নিয়ে যা কিছু সম্ভব তাই করবো। জনে জনে বলে বেড়াবো। ১৪ কোটি মানুষ আমরা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ালে যে সাগরের ঢেউ ঠেকিয়ে দেওয়ার শক্তি রাখি।

বি: দ্র: এই লেখাটি বেশ অনেক আগে অন্য একটি ব্লগ সাইটে প্রকাশিত। সচলায়তনে স্রেফ সংরক্ষনের জন্য আনলাম। তাই প্রথম পাতায় দিলামনা। নিজের ব্লগে রাখলাম।


মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

আবরও পড়লাম, আবারও একটা ঝাঁকুনি খেলাম ,,, ধন্যবাদ নজরুল
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

হাসান মোরশেদ এর ছবি

এরকম লেখা প্রথম পাতায় দিতে পারেন । অনেক নতুন সচলের হয়তো এই লেখাটা পড়া হয়নি ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

টপিকটা পুরনো তো তাই প্রথম পাতায় দিতে কেমন জানি লাগতেছে। তাছাড়া অন্য ব্লগে প্রকাশিত লেখা এইখানে আবার প্রথম পাতায় দিবো কি না সেইটা নিয়াও সংশয়ে। অবশ্য আপনার পরামর্শটা কাজে লাগাইতেও ইচ্ছা করতেছে। অন্তত ম্যারিয়েটা বা জ্যাক প্রাদার কথা কিছু লোকে জানুক সেইটাও চাওয়া। দেখি।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বিপ্লব রহমান এর ছবি

অনেক দেরীতে হলেও লেখাটি পড়লাম। খুবই ভালো লাগলো।

ছোট্ট একটি দৃষ্টি আকর্ষন: ম্যারিয়েটা বুক ডিপো আজিজ সুপার মার্কেট প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই শাহবাগের পিজি হাসপাতাল মার্কেটে 'সিনোরিটা'র পাশে ছিলো। আমি ছাত্র জীবনে, সেই ৯০ এর দশকে ওই বইয়ের দোকানটি দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ থাকার পর একদিন উঠে যেতে দেখেছি। ধন্যবাদ।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

কিছুই বলার নাই... এইরকম একটা পোস্টে কী-ই বা বলার থাকতে পারে! খালি বলি, এই ধরণের পোস্ট সচরাচর চোখে পড়ে না, আর সেদিন যা শুনসিলাম এই পোস্ট সম্পর্কে, তা মোটেও বেশি ছিলো না। চলুক

রানা মেহের এর ছবি

এই লেখাটা তখনো পড়েছিলাম।
পরেও পড়েছি।
এখনো পড়ছি।

প্রতিবারই লজ্জ্বা আর মুগ্ধতা ছাড়া আর কিছু আসেনা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আমরা সবাই মিলে ওটা ঠেকিয়েছিলাম , তাই না নজরুল ?

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

চলুক
স্যালুট

----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!

কল্যাণF এর ছবি

জাতি হিসাবে অতি কৃতঘ্ন আমরা, কি লজ্জা মন খারাপ

মন মাঝি এর ছবি

ম্যারিয়েটা সম্পর্কে এর বেশি জানা যায় না?

'ম্যারিয়েটা বুক ডিপো' (?) আজিজে ছিল/আছে কিনা মনে পড়ছে না, তবে এটা অনেক আগে থেকেই বায়তুল মোকররম স্টেডিয়াম মার্কেটের দোতলায় আর সম্ভবত পিজির নিচে ছিল। অনেক বই কিনেছি এখান থেকে একসময়। নামের উৎস সম্পর্কে সব সময়ই একটা কৌতুহল ছিল - আজকে জানলাম। হৃদয়বিদারক!

****************************************

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।