পৃথিবীর পথে : চীনের দিনলিপি ০২

রোমেল চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন রোমেল চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২৭/১১/২০১১ - ৪:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পৃথিবীর পথে : চীনের দিনলিপি
http://www.sachalayatan.com/nebula/42101

২০ নভেম্বর ২০১১

লাগেজ চেকিং এর ঝক্কি পোহানোর পর যাত্রীদের আগমনের পথ ধরে বেরিয়ে এলাম। দেখি, সেখানে আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে মিঃ লি অপেক্ষা করছেন। তাঁর হাসিমুখের পরতে পরতে বিনয় লেপটে আছে ছড়িয়ে যাওয়া ক্ষীরের মতো। বিনয়ের মধ্যে কিছুটা অপরাধ বোধের ছায়া দেখতে পেয়ে আমিও লজ্জিত হলাম।

‘অযথা তোমার হেনস্থা হলো’, ভাঙা ভাঙা ইংরেজি উচ্চারণে সৌজন্য প্রকাশ করলেন তিনি।

‘ও কিছু না, চলুন আগে বাড়া যাক’, ওঁকে আশ্বস্ত করি আমি।

‘রাতভর জার্নি করে নিশ্চয়ই তুমি ক্লান্ত, সামনে আছে সড়কপথে আরো পাঁচ ঘণ্টার ড্রাইভ, চলো কিছু খেয়ে নেয়া যাক’, আমাকে অভিমত প্রকাশের কোন অবকাশ না দিয়েই কে এফ সি- তে ঢুকে পড়েন মিঃ লি।

ফ্রায়েড চিকেন, চিকেন বার্গার আর পেপসি কোলায় সাজানো ট্রে আমার সামনের টেবিলে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘হালাল খাবার’। সেই মুহূর্তে আমার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠা মৃদু দুর্বোধ্য হাসিটিকে তিনি কি দেখতে পেয়েছিলেন?

ক্রাইসলারে লাগেজ তুলে জানালার পাশের আসনে চেপে বসলাম। ড্রাইভার মিঃ সুই কেতাদুরস্ত ভাব বজায় রেখে স্টিয়ারিঙয়ে হাত রাখলেন। এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ী সিঝিয়াঝুং সিটির উদ্দেশ্যে।

একটার পর একটা ফ্লাইওভার পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ী আর আমার মনে হচ্ছে রূপকথার দৈত্য কেহেরমান বুঝি আমাকে মাটি থেকে খানিক উপরে শূন্যে তুলে ধরে ছুটছে। ফ্লাইওভারের শেষপ্রান্ত বুঝি আর কিছুতেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, তাহলে কি মাটির নাগালও মিলছে না সহসা ? মাটির সাথে এমন বিচ্ছিন্নতা আমার ভালো লাগে না।

হাইওয়ের দু’পাশ দিয়ে অসংখ্য ন্যাড়া পিপুল গাছের সারি। হেমন্তের এই পাতা ঝরার দিনে তারা যেন সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণ সন্তের মতো। কিছু পাতা ঝরে গেছে, কিছু পাতা আটকে আছে এখনো। কণকণে ঠাণ্ডা বাতাসের সাপ হিলহিলিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে হলদে-সবুজ পাতার বিশুষ্ক দেহ। স্থিতিস্থাপক বৃন্তের উপর এপাশ ওপাশ ফিরে যন্ত্রণার পরিত্রাণ চাইছে পাতার জীর্ণ শরীর। আর সেই শরীরে বিকেলের ম্লান রোদ নেচে উঠছে গোধুলিসন্ধ্যার নৃত্যে।

পাতা ঝরে যায়, পাতা ঝরে যায়, ওই উঁচু থেকে―
সুদূর আকাশে অনেক বাগান মরে মরে যায়।
না পাওয়ার ব্যথা শোকে দুলে উঠে প্রতি পলে পলে।

আজ রাতে ফের পৃথিবী হয়েছে ঠিকানা-বিহীন
হাজার তারার বাঁধন ছিঁড়ে সে একা হয়ে যায়।

আমরাও ঝরি। এই হাত ঝরে, আরটিও দেখো
ঝরেছে এখানে। সকলের প্রাণে ঝরা বকুলের

গান বেজে উঠে। তবু আছে জানি, কোনো একজন
হাত দুটি যার শান্ত কোমল; পতন ঠেকায়।
(রাইনের মারিয়া রিলকে, ‘হেমন্ত’)

এমন ফিকে আলোর ম্লান বিষণ্ণ শীতের দিন আমাকে চকিতে মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। হাইওয়ের দু’ধারের ক্রোশের পর ক্রোশ জুড়ে পড়ে থাকা পতিত চীনে বাদামের খোসার মতো শুষ্ক জমিন মনে করিয়ে দেয় নির্দয় গোরের কথা। আমি হাঁপিয়ে উঠি। চোখ মেলে চারিদিকে তাকিয়ে পাখির কলরব শোনার জন্যে আকুল হয়ে উঠি। গাছে গাছে পাখিদের ফেলে যাওয়া বাসা নজরে আসে। অনেক আগেই ওরা পরিযায়ী হয়েছে একটু উষ্ণতার জন্যে। আমার ভালো লাগে না। এই দেশ আমাকে উষ্ণতা দিয়ে বরণ করেনি। আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। হৃদয়ে পিলসুজে পৃথিবীর আলোর আসা-যাওয়াকে বড়ই আকাঙ্ক্ষিত বলে মনে হয়। দু’দণ্ডের পার্থিব উষ্ণতার জন্য আমি ফটিকজল পাখির মতো ছটফট করি। আমার ক্লান্ত শরীর শীতার্ত মনের ভার নিতে না পেরে ঘুমের অতলে পালিয়ে যেতে চায়।

সময়ের সান্ত্রী এরই মধ্যে কখন যে হাতঘড়ির একঘেয়ে চত্ত্বর পাঁচবার প্রদক্ষিণ করে এসেছে টেরই পাইনি। আমরা পৌঁছে গেছি। চোখ মেলে দেখি আমি পৌঁছে গেছি হেবেই হুইবিন হোটেলের দেউড়িতে। ঝটপট চেক ইন করে ফেলে মিঃ লি। আমার হাতে ডোর কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার সম্মানে আমরা ডিনারের আয়োজন করেছি সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়। বেশ করে একটা শাওয়ার নিয়ে নাও গরমজলে। ততক্ষণে লাগেজ পৌঁছে যাবে তোমার রুমে। আর হ্যাঁ, আমি লবিতেই অপেক্ষা করছি।’

নির্ধারিত স্লটে কার্ড ঢোকাতেই দরজা খুলে যায়। পাশের দেয়ালে সাটা আরেকটি স্লটে কার্ডটি পুরে দিতেই বাতি জ্বলে উঠে। রুমের ঝা-ঝকঝকে ভাব ও আভিজাত্যের কাছে কেন জানি নিজেকে অপাঙতেয় বলে মনে হয় আমার। শাওয়ার নিয়ে ‘ভদ্রলোকের পোশাকে’ সজ্জিত হয়ে লবিতে নেমে এলাম। দেখি ইতিমধ্যে মিঃ লি আমার জন্য জোগাড় করে ফেলেছে মুঠোফোনের সীমকার্ড, আইপি ফোনকার্ড আর পরের দিনের ব্রেকফাস্ট কুপন। এয়ারপোর্টে প্রথম সাক্ষাতেই ওঁর হাতে দু’শো ডলার দিয়ে রেখেছিলাম। কোন ফাঁকে যে মুদ্রা বিনিময়ের পাঠ চুকিয়ে ফেলেছেন টেরই পাইনি। খামে করে ১২৫৬ ইউয়ান হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘চলো, ডিনারের আয়োজন শহরের সেরা মুসলিম রেস্তোরাঁতে’।

প্রায় সাড়ে তিন ফুট ব্যাসার্ধের একটি গোল টেবিল। সেটির উপরে লাগানো দু’ফুট ব্যাসার্ধের স্বচ্ছন্দে ঘুরাতে পারা যায় এমন একটি পুরু কাঁচের গোলাকার চাকতি। চাকতির উপর থরে থরে সাজানো নানারকম খাবারের ডিশ। বেশ ক’টি ডিশ টেবিলের কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে রাখা। চাকতি ঘুরিয়ে পছন্দের ডিশটি চাইলেই অনায়াসে সামনে নিয়ে আসা যাচ্ছে। যাক বাবা, ভদ্রতা বিসর্জন দিয়ে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠে বেইজিং ডাকের তশতরিটা কাছে টেনে নিতে হবে না। ভাবতেই জিভে জল এলো। সবাই বসে পড়লাম। অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে। ছলে বলে কৌশলে আগে থেকেই আমার ভেতো বাঙ্গালীর চরিত্রের সাথে কথাচ্ছলে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলাম মিঃ লি-কে। কিন্তু এখনও ভাত আসছে না কেন? চোরা চোখে মেন্যু কার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি। নানারকম সবজি, ফলের সালাদ, রোষ্ট বীফ, বেইজিং ডাক, সয়া সস বীফ, পীচ টিয়াংকি, শ্রীম্প বল, ল্যাম্ব লেগ, বেকড কড ফিস, বেকড চিকেন উইংস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বীফ রিবস, কুমিন বীফ, চীজ গ্রীন টেন্ডার, ভেজিটেবল স্যুপ, সুইট কেক, ফাঙ্গাস কেক। আইটেমের তালিকায় সবশেষে লেখা আছে ‘রাইস’। অগত্যা একটানে কাঁচের চাকতিটাকে কায়দা মতো ঘুরিয়ে দিলাম। বেইজিং ডাক যেন কাঁচের সরোবরের উপর দিয়ে সাঁতরে এলো আমার কাছে।

সপ্তাহে দু’দিন ছুটি চীনে, শনি ও রবিবার। পরদিন রবিবার, সুতরাং কোন কাজ নেই। এইতো মওকা। কি কি দেখে ফেলা যায় চটজলদি। মিঃ লি বললেন, তিনি ব্যবস্থা করেই রেখেছেন। আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন বাইলিন মন্দিরে আর ঝাও ঝো ব্রিজে। সেইসাথে পথে ঘাটে চীনের সাধারণ মানুষের চালচলনেরও একটা ধারনা পাওয়া যাবে শহর ফেলে শহরতলীর দিকে পা বাড়ালে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। রাজী হয়ে গেলাম। আমাদের ক্রাইসলার ছুটে চললো বেইজিংয়ের হাইওয়ে ধরে।

যেতে যেতে মিঃ লি বাইলিন মন্দিরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসসহ একটা পরিচিতিমূলক বর্ণনা দিয়ে ফেললেন। ‘আমরা এখন যেখানটায় যাচ্ছি সে জায়গাটি বেইজিংয়ের ধারে কাছেই। চীনের রাজধানী, তুমি যাকে ‘বেইজিং’ নামে জানো, ১২৭১ সালে ইউয়ান ডাইনেষ্টির পত্তনকারী মহা পরাক্রমশালী সম্রাট কুবলাই খান সে সময় তার নাম দিয়েছিলেন ‘খানবালিখ’। সে সময়ে বাইলিন মন্দির ছিল খানবালিখের সবচাইতে বড় মন্দির। ইউয়ান ডাইনেষ্টির সম্রাট সুন্ধির শাসনকালে ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় বাইলিন মন্দির তৈরি করার কাজ। সেখানে দাপটের সঙ্গে বাস করতেন তিব্বতের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী শাক্য মুনিগণ। সেখানটায় তাদের মঠ ও আশ্রমও ছিল। কর্তৃত্ব ও রাজত্ব দুই-ই যে কত ক্ষণস্থায়ী তাঁর প্রকৃত উদাহরণ যেন এই বাইলিন মন্দির ও ইউয়ান ডাইনেষ্টি। কালের করাল গ্রাস নয় বরং স্থানীয় ভূস্বামীদের হাতে কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন বাইলিন মন্দিরের শাক্য মুনিগণ, ধ্বংস হয়েছিল মন্দিরটি। তার মাত্র ১৩ বৎসরের মাথায় বিদ্রোহী সেনাদের হাতে পতন হয়েছিল ইউয়ান ডাইনেষ্টির।

কথার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যেই চোখ চলে যাচ্ছিল রাজপথের দিকে। বিশাল রাজপথ। মধ্যখানে ভ্রুতগামী গাড়ির আসা-যাওয়ার জন্য তিনটি করে মোট ছয়টি লেন। রাস্তার দু’ধার ঘেঁষে প্রশস্ত ফুটপাত। ফুটপাত আর ভ্রুতগামী গাড়ির লেনের মাঝে প্রায় পাঁচ ফুট ডিভাইডার দিয়ে পৃথক করে তৈরি করা হয়েছে যন্ত্র বিহীন গাড়ির আসা ও যাওয়ার নির্বিঘ্ন পথ। আজ ছুটির দিন। অসংখ্য বাইসাইকেল আরোহী সেই লেন ধরে যেন দঙ্গল বেঁধে ছুটে চলেছে। আরোহীদের বেশিরভাগই নারী। চকিতে আমার মনে পড়ে যায় কলেজ জীবনের কথা। গণিতের নীরোধ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়া শেষ করে আমরা ক’জন বন্ধু ঠিক এমনিভাবেই দল বেঁধে সাইকেল চালিয়ে ফিরতাম। আমাদের শহরতলীর সেই পথ এতো মসৃণ ও নির্বিঘ্ন ছিলো না হয়ত, কিন্তু সেখানে লুকিয়ে ছিল বাঁধভাঙ্গা যৌবনের দুরন্ত উচ্ছ্বাস।

গাড়ি থেকে নামতেই বাইলিন মন্দিরের উঁচু প্যাগোডার চুড়োটা যেখানে আকাশ ছুঁয়েছে সেখানটায় চোখ আটকে গেলো। স্তম্ভের মতোই নির্বাক দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ‘একশো একত্রিশ ফুট উঁচু ওটা, সাততলা, দাঁড়িয়ে আছে পাথরের ভিত্তির উপর’, মিঃ লি-এর কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। অজান্তেই ক্যামেরার চোখ উঠে এলো চালশে দু’টি চোখের উপর, ফ্লাশ লাইট জ্বললো।

লালচে ইটের দালানের উপর কমলাটে প্রতিসম ছাদ বাইলিন মন্দিরের, অনেকটা নৌকোর মতো দেখতে। ভেতরে ও বাইরে অনেকগুলো ঝাউ গাছের সুঁচালো মাথা দেখা গেল।

সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সাদা গ্রানাইট পাথরের বদখৎ দুটি চাইনিজ সিংহ। বাইরে টিকেট কালেক্টরের সুবিধার্থে লাগানো হয়েছে লোহার গ্রিল দেয়া গেইট। মাঝে মাঝেই একসাথে দশজন করে দর্শনার্থীর প্রবেশের জন্য সেই গেট খুলে দেয়া হচ্ছে। লোহার গেটের বাইরে থেকে সিংহ দু’টিকে খাঁচায় বন্দী গর্জন সর্বস্ব প্রাণীর মতো দেখায়।

গেট খুলে গেল। এবারে আমরা নির্বাক সিংহের মুখোমুখি হলাম।

সিঁড়ির পেছনে লালচে রংয়ের লম্বাটে ঘরটিই হলো মূল মন্দিরের দেবরাজা হল। ভেতরে গেলে আমরা খুঁজে পাবো এমন পর পর সাজানো আরো চার চারটি মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের বিশেষত্ব হলো, একটি কেন্দ্রিয় অক্ষ বরাবর প্রতিসাম্য বজায় রেখে এদের কাঠামোগুলো দু’দিকে প্রস্থে বেড়েছে সমানভাবে। এখান থেকে ভারী লোহার পাতের মূল গেট দিয়ে সোজা নাক বরাবর হেঁটে গেলে দেবরাজা হল পেরিয়ে পাওয়া যাবে পরিপূর্ণতা অর্জনের প্রকোষ্ঠ। তারপর মহাবীরা হল পেরিয়ে বিমলাকীর্তি হল এবং সবশেষে বোধিসভা বা বিশুদ্ধতা লাভের প্রকোষ্ঠ।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেবরাজা হলের সামনের পাথুরে চত্ত্বরের দেয়ালে চোখ রাখতেই নানারকম দেবমূর্তির শস্ত্রপাণিরূপ নজরে এলো।

ঝটপট দেখে নিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ছাদের অপরূপ কারুকাজের দিকে।

লম্বাটে এক ড্রাগনের সামনে বসে আছে নানা পশু। এরমধ্যে সেই কদাকার চাইনিজ বাঘের ক্ষুদ্র সংস্করণকেও সুবোধ বালকের মতো বসে থাকতে দেখতে পেলাম।

আমরা এবার ভেতরে ঢুকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেবরাজা হলের পেছনের দিকটা দেখছি।

ভেতরে কাঁচে ঘেরা বুদ্ধমূর্তির সামনে করজোড়ে অর্চনারত এক চাইনিজ তরুণী। প্রার্থনায় সঁপে দিয়েছে প্রাণমন। কোন অমরাবতী নিঃশব্দে ভেসে আসে তাঁর প্রার্থনায়? বিশ্বাসের বেদীমূলে বাসা বাঁধে কোন সান্দ্র অভীপ্সার লতিয়ে উঠা আকুতি?

দেবরাজা হল দেখা শেষ করে পরিপূর্ণতা অর্জনের প্রকোষ্ঠের দিকে পা বাড়ালাম। পথ আগলে দাঁড়ালো প্রমাণ সাইজের পোস্ট বক্সের মতো লোহার তৈরি স্তুপ (stupa)।

পরিপূর্ণতা অর্জনের আশা আপাতত শিকেয় তুলে রেখে অগত্যা বাঁয়ে মোড় নিই। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখি বিশাল আকৃতির ঝাউগাছ ছুঁয়ে বিশুদ্ধতা লাভের চেষ্টায় নিবেদিত ভক্তদের দেখতে পাই। ‘এত কালি মেখেছি দু’হাতে, এতকাল ধরে’, ভাবছি নিজেকে কি করে শুদ্ধ করবো আমি? ‘ঝাউগাছ’ নয় ওগুলো ‘সাইপ্রেস ট্রি’, মিঃ লি শুধরে দেন আমাকে।

অপূর্ণতার পাত্রে শুন্যতার কিছু হু হু দীর্ঘশ্বাস পুরে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাই। খানিক সামনে ভিড় করে আগরবাতি পোড়াচ্ছেন একদল ভক্ত। অদূরে মন্দিরের প্রতিসম প্রকোষ্ঠের আদলে গড়া একটা ক্ষুদ্র আয়তাকার প্রতিকৃতি পেটে আগুন নিয়ে চারপায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে চলছে আগরবাতি আর মোমবাতি জ্বালানোর ধুম উৎসব। সামনে প্রণাম করবার সময় মাথা লাগাবার জন্য রেখে দেয়া আছে পিঁড়ির চাইতে বা একটু বেশী উঁচু একটি ফোম লাগানো টুল। কেউ একলা এসেছেন প্রণাম করতে, কেউ সাথে নিয়ে এসেছেন নবজাতক শিশুটিকে, প্রেমিক যুগল এসেছেন স্বপ্নকে সঙ্গে করে, বৃদ্ধ এসেছেন জরাকে অতিক্রম করে। তাঁদের বিশ্বাসের পিলসুজে ঘৃতাহুতির ফলাফল আমাকে এমুহূর্তে মোটেও ভাবিত করে না। বহুযুগ আগে মৃত মানুষের করোটির স্বগত ভাবনার মতো আমার মস্তিস্কের বিশুষ্ক কোষে উল্টোপথে হিল হিল করে বয়ে যায় সময়ের শীতল স্ত্রোত। আমি সেই স্ত্রোতে কিছু মরণশীল জীবের অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এলোমেলো সন্তরণ দেখি।

ততক্ষণে সাততলা প্যাগোডার একদম গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমার পাপী আত্মার খাঁজে খাঁজে না জানি কত এবড়ো থেবড়ো কাঁটার পাহাড় দাঁত বের করে সদাই পরিহাসরত। মুক্তির সাতটি স্তরে কতই না খাড়া চরাইয়ের বান্ধবহীন নির্মম পথ মরীচিকার মতো ছলনার ছায়া ফেলে। মুক্তি থাক, আসুন আপাতত চোখ রাখি প্যাগোডার চূড়ো ছাপিয়ে শুভ্র নীলাকাশে।

(চলবে...)


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

আহা! চলুক , কয়েকটি ছবি একটু হেলে তুলেছেন মনে হল !

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ছবি তোলায় আমি খুবই অপটু। তবুও প্রচুর ছবি তোলা হয়েছে। শ্লথ গতির আন্তঃজালে আটকে আছি। চিন্তা করছি পরের পোষ্টগুলো দেশে ফিরে তারপর দেব। রোজনামচা লেখা চলছে প্রতিদিন।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

দিগন্ত বাহার* এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, দিগন্ত ভাই।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চমৎকার রোমেল ভাই ... অবশ্যই চলুক ... তবে মাঝে মাঝে কবিতা দিতে ভুলেন না কিন্তু

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

আচ্ছা।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কল্যাণF এর ছবি

চলুক হাততালি গুরু গুরু পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

চলবে, কৃতার্থ হলাম!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

তাঁর হাসিমুখের পরতে পরতে বিনয় লেপটে আছে ছড়িয়ে যাওয়া ক্ষীরের মত।

উপমাটি কাব্যিক।
ইতিহাস ও উপাসনালয়ের স্তর সম্পর্কে কিছু জানা হল। ছবিগুলো হৃদয়ে অন্যধরনের এক অনুভূতি সৃষ্টি করে।
লেখার উপর মন্তব্যে বলতে হয়, আপনি শুধু কবি নয় গদ্যকারও বটে।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

গদ্য লেখা বড়ই কঠিন
গদ্য ওজনদার
ছন্দ পাখায় ভরটি করে
করে আকাশ পার...

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

হাততালি গুরু গুরু উত্তম জাঝা!

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, প্রখর রোদ্দুর, স্নিগ্ধ মন্তব্যের জন্য।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

দ্যা রিডার এর ছবি

পড়তে খুব ভাল লাগছে ... চলতে থাকুক। হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ দি রিডার, পথের ধারে কুড়িয়ে পাওয়া কাগজের গায়ে আড়ম্বরের চাইতে ধূলিকণাই যে বেশী লেগে থাকে!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তাপস শর্মা এর ছবি

আমিও চিনে গিয়ে সব চিনে নেবো এই বলে রাখনুম হুম চোখ টিপি

দ্যা রিডার এর ছবি

চলুক

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

গোমতী নদীতীরের মানুষটিকে গোমনাতী গ্রামের এই গাড়িয়াল সাদরে অভ্যর্থনা জানায়। তবে চীনে নয়, এই বাংলায়। হয়তো মানুষ নয়, হয়তোবা শঙ্খচিল, শালিখের বেশে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আশালতা এর ছবি

বাহ্‌, বেশ। হাসি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, সুকথিকা!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আকামের আবদুল এর ছবি

আমিও চিনে গিয়ে সবকিছু চিনে নিতে চাই, কিন্তু পেটে যে চিনচিনে ব্যাথা !

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ইউনান প্রদেশে প্রথমে পা ফেলুন। পেট ব্যথার ইউনানী দাওয়াই নিয়ে তবেই চীন চিনুন।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

উচ্ছলা এর ছবি

কারুকার্জময় ছাদের ছবিদুইটা এতই সুন্দর আর জীবন্ত যে ওই ছাদে আমার ঢিল মারতে ইচ্ছা করছে হাসি

লেখা খুব ভাল লেগেছে হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

দস্যি মেয়ে! ভালো থেকো বোন।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

মন মাঝি এর ছবি

হাইওয়ের দু’পাশ দিয়ে অসংখ্য ন্যাড়া পিপুল গাছের সারি। হেমন্তের এই পাতা ঝরার দিনে তারা যেন সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণ সন্তের মতো। কিছু পাতা ঝরে গেছে, কিছু পাতা আটকে আছে এখনো। কণকণে ঠাণ্ডা বাতাসের সাপ হিলহিলিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে হলদে-সবুজ পাতার বিশুষ্ক দেহ। স্থিতিস্থাপক বৃন্তের উপর এপাশ ওপাশ ফিরে যন্ত্রণার পরিত্রাণ চাইছে পাতার জীর্ণ শরীর। আর সেই শরীরে বিকেলের ম্লান রোদ নেচে উঠছে গোধুলিসন্ধ্যার নৃত্যে।

দারুন! চলুক

ও হ্যাঁ, প্রতি পর্বে কবিতা দিতে ভুলবেন না যেন - অনুবাদ বা নিজের যাই হোক। রিলকের অনুবাদটা দারুন হয়েছে।

****************************************

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, খোকন ভাই।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

বন্দনা এর ছবি

এতগুলা ছবি দেখলাম শুধু আপনারই কোন ছবি দেখলামনা, আসলেই গিয়েছিলেন নাকি সেটা তো প্রমানিত হোলনা রোমেলদা।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বোন রে,
এখানে হাজারো ডাইনেষ্টির বিলুপ্ত নগরীর ধুসর প্রাচীন প্রাসাদগুলির ভগ্ন গম্বুজের বেদনাময় রেখার দিকে তাকিয়ে আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময় মনে জাগে। নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ বড় তুচ্ছ বলে মনে হয়।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ক্রাইসলারের একটা ছবি দিয়েন। গর্জিয়াস মাল একটা।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

দ্রিমু, আইজকা তুমার গাড়িয়াল ভাই বুইক চড়ছে। কিন্তুক হ্যার বুড়া আঙুলের গোড়ায় ধানক্ষেতের মাটি আগে যেমুন লাইগ্যা ছিল অহনভি তেমনই লাইগ্যা আছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

পরেরটার অপেক্ষায়। গুরু গুরু

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, লিখছি!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।