ল্যাপটপে তড়িৎ সংযোগ লাগাতে লাগাতে বাবর আমার কাছ থেকে জানতে চায়: “আর ইউ গোয়িং টু লিমাসল কার্নিভ্যাল?” আমি ধীরে চোখ তুলি। স্থির দৃষ্টি ফেলি ওর চোখের তারায়। বাবরের স্নিগ্ধ মুখ জুড়ে কিছু শঙ্কা, কিছু প্রত্যাশা আর কিছুটা দ্বিধার মিশ্রণ টিভি পর্দায় স্থির হয়ে যাওয়া ফ্রেম-ছুট ডিজিটাল ছবির মত আটকে থাকে। ইচ্ছে করেই আরো কয়েকটা সেকেন্ডকে থমথমে নীরবতা দিয়ে স্থাণু করে রাখি। মানুষের তাৎক্ষণিক প্রত্যাশাকে মাপবার এটা একটা যুতসই কৌশল। একটা অপ্রস্তুত বোধ বাবরের ভেতর অঙ্কুরিত হতে থাকে। সেটি বিরক্তিতে পরিণত হবার আগেই আমি স্মিত হাসির সাথে গম্ভীর কণ্ঠস্বর মিশিয়ে বলি: “ওয়েল, আই ক্যান গো টু দ্য কার্নিভ্যাল, বাট দ্য কার্নিভ্যাল হ্যাজ টু গো উইথ মাই আইডলজি!”
আদর্শই বা কাকে বলি— যখন আমরা সবাই কত রকমেরই না মুখোশ পড়ে থাকি। বহু আগে পড়া কৃষণ চন্দরের ‘কার্নিভ্যাল’ মনের কোণায় উঁকি দিয়ে যায়। “কার্নিভ্যালে যাব আমি”, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, “তবে তোমাদের সাথে নয়, ভিড়ে মিশে আমি হেঁটে যাব একা একা”। যখন অনেক রথযাত্রা হবে, বর্ণিল শোভাযাত্রার বহুবর্ণা পোশাকের চারপাশ সহস্র সূর্যের বল্লমে বিদ্ধ হয়ে আরো বেশি উজ্জ্বলতা বিলাবে, ভুজুভেলা বাজবে, হুইসেলের সমবেত কোরাসে কোরাসে শাসনের মুখোশেও ফুটে উঠবে বান্ধব মুখরতা, নেচে গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করবে কাতারে কাতারে অনেক মানুষের ঢল, তখনও কি সেইসব আনন্দিত মানুষের ভিড়ে মিশে থাকবে কোন একজন, সবক'টি ইন্দ্রিয়ের পরতে পরতে যার আনন্দের গান,— অথচ চোখের কোণে কোন এক বিজন বেদনা কেঁদে কেঁদে নীল হয়ে আছে?
সলোমন স্কোয়ারে এসে বাস ধরতে হবে। মোটামুটি ৩৫ মিনিটের হাঁটা পথ। পথের ধারেই চোখে পড়বে একটি মিউনিসিপ্যাল পার্ক, ভেনেটিয়ান ওয়ালের ধার দিয়ে বুনে রাখা সবুজ ঘাসের কার্পেট, ফ্লামাগুস্তা গেট, মিডস্টেড আটা কল, ওহাইয়ো স্কোয়ার। পা’দুটো যখন ফুটপাতের উপর দিয়ে সুশৃঙ্খল সৈন্যের মত এগিয়ে যাবে, চোখ দু’টো তখন চারপাশটার উপর আলতো করে দৃষ্টির তুলি বুলবে, আর মনটা— মনটা তখন এই বিভোর, এই আনমনা, আলোয়-হাওয়ার মেতে মেতে এই বা ছটফটে খঞ্জনা। যখন গিয়ে পৌঁছুব,— হয়তোবা ঠিক ঠিক নদীর বাকের মত বাঁকা বেঞ্চিটায় কোন এক বিষণ্ণ বালিকাকে বসে থাকতে দেখবো। দৃষ্টি তার জানে বুঝি একদুপুর নির্জনতার হু হু ডাক, পেছনে তার অপেক্ষমাণ ১৫৭ নম্বর বাস, উদাসী প্রহর কিছু— নিস্তব্ধ-নির্বাক।
নন-ইউরোপিয়ান বলে একটা নতুন শব্দ ইদানীং মাথার ভেতরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সদ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হলেও সাইপ্রাস এখনও মনে-প্রাণে ইউরোপীয় হয়ে উঠতে পারে নি। যুগে যুগে নানান সংস্কৃতির অসংখ্য স্রোতধারা এদেশকে প্লাবিত করে গেছে। এখানে এই মুহূর্তে তুমি ‘পাশা’ হও, পরের মুহূর্তে আফ্রোদিতির সাজে সাজো। কুছ পরোয়া নেহি। ছুটির দিনে এখানের স্কোয়ারগুলি অসংখ্য সুবেশী ফিলিপিনো গৃহপরিচারিকার আনন্দে-হাসিতে-ছুটোছুটিতে মুখরিত হয়ে উঠে। কেউ হয়তোবা সেলফি তুলছে, কেউ সঙ্গীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুখের পরিষ্কার চত্বরে শব্দহীন হাসি লেপে নিয়ে তুলছে গ্রুপ ফোটো। বুল্গেরিয়ান, রুমানিয়ান, শ্রীলংকান, ভিয়েতনামী, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী— কত মানুষের সমাহার। রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁর বাইরের দিকটায় গ্যাস জ্বেলে তৈরি করা অনেকটা বেঁটে আকারের পেটমোটা ল্যাম্পপোস্টের মতো ফায়ার প্লেস। তার নীচে পেতে রাখা সারি সারি টেবিল। টেবিলের দু’ধারে দু’টো করে চেয়ার। চেয়ারের কোনটি ফাঁকা, আবার কোনটিতে আয়েশি ভঙ্গিমায় নিজেদের বিছিয়ে দিয়েছে সিপ্রিয়ট যুবক-যুবতীর দল। আলগোছে চোখের সামনে মেলে ধরছে মেন্যু-কার্ড। রিলাক্সিং ইন দ্য ডেলিসাস ইন্ডোলেন্স! গ্রিলের-কাবাবের-লেহমুজিনের-হালুমির-সেফটালিয়ার মনমাতানো গন্ধের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নানান দেশের, নানান বয়সের, নানান বর্ণের, নানান পোশাকের, নানান মেজাজের মানুষের ঢল। কেউবা প্রেমিক-প্রেমিকা, কেউবা বন্ধু-বান্ধব, কেউবা স্বামী-স্ত্রী। প্যারাম্বুলেটারে শিশুকে সাজিয়ে নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে যাচ্ছে মা। গলায় ফাঁস পড়ানো ইয়াব্বড় আলসেসিয়ান কুকুরকে হাঁটাতে হাঁটাতে এগিয়ে যাচ্ছে প্রৌঢ় গৃহকর্তা। এইসব কাকলীমুখর কলতানের ভেতর থেকে সরু এক ছিদ্র গলিয়ে ভেসে আসছে বিষণ্ণ ভিখিরির বিনম্র ভায়োলিনের সুর। ম্যাক ডোনাল্ডসের সুলভ কফি আর স্টারবাকের অপেক্ষাকৃত দামী কফির পেয়ালায় আনন্দের ধোঁয়া কি সমান তালে কুণ্ডলী পাকিয়ে সোনালি কিম্বা কালো চুলের কুন্তলে একই রকম বাষ্প হয়ে আটকে যেতে চাইছে? আমার মাথার ভেতরে নন-ইউরোপিয়ান বলে একটা নতুন শব্দ আবার এসে হাতুড়ি পেটায়।
“স্টুডেন্ট আইডি?”, ভ্রু কুঁচকে যায় বাসের চালকের। ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। আমার চোখের কোণে বেড়ে ওঠা বলিরেখার আজব ত্রিকোণমিতি আর জুলফির নিচে গুচ্ছ গুছ বেলি ফুলের মত শাদা চুলের রঙ পড়তে পড়তে বিরস বদনে এগিয়ে দেয় হাফ টিকেট। সেটি দেখে ১৩ নম্বর সীটে বসে থাকা সুন্দরীটি হেসে গড়িয়ে পড়ে। তবুও নিজেকে গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের বিমান ভ্রমণের গল্পের নায়কের মতো সৌভাগ্যবান বলে মনে হতে থাকে।
আমি যখন লিমাসলে এসে পৌঁছুই কার্ণিভাল জমেনি তখনও। ভূমধ্যসাগরের পারে বসে থাকি। আমার প্রসারিত দৃষ্টি দূরে-বহুদূরে নীল দিগন্তের গায়ে আছড়ে পড়ে। সেখানে,—যেখানে সাগরের গায়ে অতি সূক্ষ্ম করে কে জানি আকাশটাকে বুনে দিয়েছে দীঘল শূন্যতায়। আমি একাকীত্বের গাঢ় চাদর বিছিয়ে শূন্যতায় প্রতীক হয়ে বসে থাকি। ধ্যানমগ্ন ঋত্বিকের মত অতীতের খাঁজে খাঁজে স্মৃতির জীবাশ্ম খুঁজে খুঁজে ফিরি। মাঝে মাঝে উল্লসিত ললনার দল চোখের সামনে দিয়ে সাগালের ছবির ধরণে ছুটে যায়। কোমল ভূমধ্যভাগের চিলতেটুকু উন্মুক্ত হতে দেখি। ক্ষণিক মোহের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসে ফের ডুবি নীল আয়নায়। চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন। আমাকে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল জীবনানন্দের বনলতা সেন!
সাগরের এই বালুকাবেলায় অজস্র কফিশপের আর রেস্তোরাঁর নানাবিধ আহার্য ও সুপেয়র গন্ধে বিভোর হয়ে হেঁটে যেতে যেতে পৃথিবীটাকে একটা বিশাল কফিনের ভেতর শেষকৃত্যের জন্যে ভরে ফেলা হয়েছে বলে মনে হতে থাকে। আমি যেন সীমাহীন নিঃস্পৃহতাকে সঙ্গী করে আলবেয়ার ক্যামূর উপন্যাসে পড়া মায়ের কফিনের সামনে এক অনাহুত অচ্ছুৎ বহিরাগত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি নৈর্ব্যক্তিক মহিমায়। এই কফিন খুলে আমি তার মুখখানি কেন যে দেখতে চাই না!
সব শুরুর একটা পূর্বলগ্ন থাকে। প্রস্তুতিপর্ব। এখন সেটাই চলছে। আমি ঘুরে ঘুরে প্রস্তুতি পর্বই দেখছি। কেউ সেজেছে, কেউ সাজছে, কেউ সাজাচ্ছে। টেনে নেয়া শকটের সাথে ইঞ্জিন জোড়া-জুড়ি চলছে। এই ফুসরতে আমি ক্যামেরার সাথে লেন্স জুড়ে নিতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে করে না। খালি চোখে দেখবার কি কোন তুলনা হয়? চোখের গভীর রেটিনায় ফুটে ওঠা প্যানারোমায় দৃশ্যমান-অদৃশ্য কত কিছুই না ধরা পড়ে!
শীতকে ঝেটিয়ে বিদায় দেবার জন্য এই কার্ণিভাল। শিশু-ছেলে-মেয়ে-কিশোর-কিশোরী-যুবক-যুবতী-প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া-বুড়ো-বুড়ি সবাই যেন আনন্দের খেলায় মেতেছে। আনন্দের মৃত্যু নেই, জরা তাকে ছুঁতে পারে না, নবীন মোরগের মত প্রতিটি নতুন সকালে সে স্বর উঁচু করে মৃত্যুঞ্জয়ী ঘোষণায় অবারিত করে আরেকটি সূর্যোদয়ের শুভাগমন। বেলা বেড়ে চলে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে জনসমাগমও বাড়তে থাকে। শীতের শীতল চোখকে উপেক্ষার ভ্রুকুটি হেনে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ পুষ্পরাগের মতো। কত বিচিত্র এই জনতার রূপ, কত বৈচিত্র্য তার সাজ-পোশাকে! বৈচিত্র্যের ভেতরে সুন্দরের উদার ময়ূখখানি মূর্তিমান হয়ে উঠে। এই উজ্জ্বল আলোর বন্যায় অনুজ্জ্বলতা ঝেড়ে ফেলে আমি আলোকিত হই বাহিরে-অন্তরে। আবার অন্ধকারে লুকোই। সাইপ্রাসের আকাশে বিক্রমী সূর্য মেঘে ঢাকা পড়ে গেলে এমন হিমই তো ছড়িয়ে পড়তে দেখি এখানের চৌদিকে।
(বহু লেখাই তো শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠেনি । তাই আগামী পর্বে সমাপ্য একথাই বা কেমন করে বলি!)
মন্তব্য
আগামী পর্বের আশায় ছিলাম রোমেল ভাই, সেটা যেহেতু পাওয়া গেলো না তাই শেষমেশ একখান করেই ফেললাম
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
এই পর্বটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল, সময় মিলিয়ে দেখুন, ঠিক তার পরপরই আমরা একটা চরম দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। কলম স্থবির হয়ে গিয়েছিল।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নতুন মন্তব্য করুন