চারিদিকে ঝরাপাতা। হেমন্তের শুরু। অঘ্রানের শীত অনায়াসে দাঁত বসায় মধ্যবয়সী হাড়ে। অজানা আশঙ্কার দাপট নিঃসঙ্গ মুহূর্ত জুড়ে। শীতের হৃদয়হীন হাওয়া এসে থেকে থেকে জানালা কাঁপায়। দরজা ভেঙে-চুড়ে কেড়ে নিয়ে যেতে যায় অচেনা বরফ-শীতল দেশে। ইদানীং দিন ছোট হয়ে এসেছে অনেক। কাজ সেরে ফেরার আগেই সন্ধ্যা নামে। ল্যাবরেটরি থেকে বাড়ি ফেরার অল্প খানিকটা পথ। হিমেল সন্ধ্যার অন্ধকারে সেই পথটুকু হাঁটতে হাঁটতে এক ধরণের অজানা আশঙ্কার শৈত্যপ্রবাহ মনে টের পাই। ল্যাবের কর্ম-কোলাহল থেকে নির্জন ঘরের নিস্তব্ধতায় ফেরা; তারপর বন্ধ ঘরের তালা খুলে আলো জ্বালা। একটু বিশ্রাম; কফির মগে চুমুক; কখনো কখনো জীবনানন্দ খুলে বসা।
আজ পড়ছি 'অঘ্রান প্রান্তরে'। খুব ঠেকে না গেলে আমি আন্তঃজালে কখনো জীবনানন্দ পড়ি না। যতিচিহ্নের ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন, কুশলী ও বহুপ্রজ ছিলেন জীবনানন্দ। আন্তঃজালে চয়িত কবিতাগুলোতে প্রায়শই যতিচিহ্নের স্থানান্তর চোখে পড়ে। ভুলগুলি এমনই যে কখনো কখনো তা অর্থকেই নিরর্থ করে তোলে। 'অঘ্রান প্রান্তরে' কবিতাটিও তাই খুব চোখ খোলা রেখে পড়ছি।
কবিতার শুরুতেই ব্যর্থ প্রেমিক প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
'জানি আমি তোমার দুচোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর প'রে—'
আমরা বুঝতে পারি, বিচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেক আগেই, তারপরও হয়ত (কিম্বা না) কিছুকাল প্রেমিকার দু'চোখ এই পৃথিবীতে খুঁজেছিল প্রেমিককে, এখন সেসবেরও অবসান হয়েছে। কথাগুলি হয়ত সামনা-সামনি বলা, অথবা বিজনে প্রেমিকাকে কল্পনা করে নিয়ে একাকি প্রেমিকের স্বগতোক্তি, আমরা যে কোন একটি ভেবে নিতে পারি। এরপর আমরা পাই হৃদয় কাঁপিয়ে তোলা হেমন্তের প্রকৃতির বর্ণনা,
কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে
শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;—অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে :
এটি কি শুধুই হেমন্তের প্রকৃতির বর্ণনা? এই পাতা শুধুই কি পাতা? এই ঘাস? মুহূর্তে যেন মনে হয় এরা অন্য কিছু। এই পাতা যেন চিরন্তন অবসানের প্রতীক। তাই বুঝি সে 'শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া'। এই ঘাস যেন চিরন্তন না ফেরার দেশ। তার বিশাল সবুজ বুক পেতে সব ঝরে পড়াদের পরম আশ্রয়। 'শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া' এরপর সেমিকোলনের ব্যবহার দেখে বিস্মিত হই। সেমিকোলন, কারণ বাক্যটি এখনও শেষ হয় নি। কবির সবটুকু অনুভূতি বাক্যটি এখনও ধারণ করেনি। কবি কি তবে বাক্যটিকে টেনে নিতে চান ভাব সমুদ্রের আরো গভীরে? কোথায়? বাক্যের পরবর্তী অংশে তিনি লিখেন,
'অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে :'
সেমিকোলন সহযোগে এই যে অন্বয়, এটির পর আমরা সাধারণ পাঠকেরা একটি পূর্ণ যতিচিহ্নের ব্যবহার অনুমান করেছিলাম। কিন্তু আমরা ব্যবহার দেখি একটি কোলন চিহ্নের। তবে কি কবি বলছেন, "একটু জিরোও আমার আরো কিছু বলার আছে বাকি"। কবি কি তবে আমাদের নিয়ে যেতে চান অন্য, অন্য কোনখানে? তিনি লিখেন,
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু;
এ কথা পড়ে মুহূর্তে বনের জগত থেকে আমাদের দৃষ্টি ফেরে মনের জগতে। কবিতার প্রথম পংক্তিতে নিরুত্তাপ হয়ে যাওয়া প্রেমের কথা পুনরায় আমাদের মনে পড়ে যায়। আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই, হেমন্ত মানেই নিরুত্তাপ হয়ে যাওয়া। যুগপৎ প্রকৃতিতে ও মনে। আমরা কবিতাটিতে হেমন্তের প্রতীকে একটি মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাই। এই বৈশিষ্ট্যই কবিতাটিকে অনন্য করে তোলে।
এরপর প্রেমিকার মগ্নোক্তিতে আবার প্রকৃতির বর্ণনা,
বললে সে, 'ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার
মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে----সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়েছে জলে'
দু'টি পৃথক দৃশ্যপটের মধ্যে কী দারুণ প্রতিতুলনা! বিছানো পাতার মুখ,— সেই মুখে লেপ্টে থাকা মৃতসদৃশ নিস্তব্ধতার সাথে সন্ধ্যের আবছা অন্ধকার জলে ছড়িয়ে পড়ে যে শীতল-ম্লান-পাংশু দৃশ্যপট রচনা করেছে তার তুলনা আমাদের অভিভূত করে।
এরপরের বর্ণনাটিকে গদ্যের ঢঙে পড়ে অনুধাবন করা যায়। চিত্ররূপময়, মুগ্ধকর এক অসাধারণ বর্ণনা,
—কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে—কুয়াশার প্রান্তরের পথে দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝাড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;
আবার মনোজগতে প্রত্যাবর্তন এবং যাদুর কাঠির মত একটি পঙক্তি,
আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে
এমন পঙক্তির কারনেই কিছু সাধারণ শব্দের সমাহার কোন যাদুবলে আচমকা পরিণত হয় চিরন্তন কবিতায়। ধারণ করে কাব্য-দর্শন, কবির বোধ ও বোধন। বস্ততঃ মানুষ তো এক স্মৃতিভূক পিপীলিকা। পিপীলিকার শীতের খাদ্-যসঞ্চয় আর অতিক্রান্ত বয়সে মানুষের অতীত স্মৃতি আঁকড়ে ধরা। তাই অতীত ব্যাপ্তিই যেন জীবনের পরতে পরতে লেপ্টে থাকে সবসময়। এটাই চিরন্তন।
দেখি, কোথায় লেগে আছে অতীত ব্যাপ্তি?
ঐ সব পাখিদের বহতা পাখায়
ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে
ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়
এরপর কবি আমাদের বনজগত ও মনোজগতের মধ্যে পুনঃ পুনঃ স্থানান্তর ও বিচরণ করান। অসাধারণ, বিস্ময়কর, করুন-সুন্দর সে বিচরণ।
নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরের বুকে আজ … হেঁটে চলি… আজ কোনো কথা নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল পড়ে আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শাড়ির ভিতরে, সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়ে-চড়ে; পতঙ্গ পালক জল—চারিদিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ; আলোয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কী রকম অবাধ আকাশ হয়ে যায়;
প্রেম, আশা, চেতনা আছে বলেই কি সময় এত মূল্যবান? কবি একবার বলেন,
সময়ও অপার---তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা
ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;
তাই কি? নাকি অন্যকিছু? পরের পংক্তিতেই ভিন্নতর কিছু বলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দেন কবি,
—কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা সরিয়ে মেয়েটি তাঁর আঁচলের চোরাকাঁটা বেছে প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে—তাই-ই ঠিক;—ওখানে স্নিগ্ধ হয় সব।
এমন দোলাচলে পাঠককে নিক্ষিপ্ত করে অবশেষে কবি নিজেই তার সিদ্ধান্ত দেন,
অপ্রেমে বা প্রেমে নয়— নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব।
শেষ সিদ্ধান্তটি এতই অভাবনীয় যে, আমরা ভাবি, কেবলি ভাবি, অথচ কোন কূল পাই না। মহৎ কবিতা তো এমনই, বারবার নতুন অর্থের জনম দেয়, নতুন করে ভাবায়।
মন্তব্য
কতদিন পর আপনার দেখা পেলাম! এক্কেবারে খুঁটে খুঁটে পড়া! ভালো থাকুন।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ বোন, ভাল থাকুন!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
তারিয়ে তারিয়ে কবিতার স্বাদ নেওয়া, তাও জীবনানন্দের কবিতা!! ভালো লাগলো, সুন্দর লাগলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ ভাই, ভাল থাকুন!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নতুন মন্তব্য করুন