ড. সম্পদ পান্ডে ও আমি উন্দাভাল্লি গুহার ভেতরে অনেকগুলো ছবি তুললাম। আমি প্রৌঢ়, পৃথুল শরীর। সে তুলনায় সম্পদ বেশ শক্ত-সমর্থ। তবু এখানে বেড়াতে এসে আমাদের দু’জনার মনই এখন তুখোড় তারুণ্যে উদ্ভাসিত।
ঢাকা থেকে দিল্লী হয়ে বিজয়ওয়াড়া। উড়বার ক্রমে অপেক্ষমাণ থাকায় বাংলাদেশ বিমান ছাড়তে ৪৫ মিনিট দেরী করল। সংযোগকারী বিমান এয়ার ইন্ডিয়ার। যাত্রার সময় যাতে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত হয়, তাই দেখেশুনে ভিন্ন দু’টি এয়ারলাইন্সের টিকেট পাঠিয়েছেন কে এল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিক ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ডেপুটি ডাইরেক্টর ড. অরবিন্দ কিলারু। “দিল্লী বিমানবন্দরে নেমে তোমাকে লাগেজ সংগ্রহ করে চটজলদি ডোমেস্টিক টারমিনালে গিয়ে আবার লাগেজ স্ক্যানিং করাতে হবে"। সুতরাং বাংলাদেশ বিমানের যাত্রাবিলম্ব আমার কপালে চিন্তার মৃদু রেখা আঁকে। ল্যান্ডিং এর আধঘন্টা আগে বিমানের স্টুয়ার্ডকে সে কথা জানাতেই তিনি আমাকে সামনের সারির একটি ফাঁকা আসনে নিয়ে বসালেন যাতে করে আমি অন্যান্য যাত্রীদের চাইতে খানিক আগেই বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিজ সেরে ফেলতে পারি। যাহোক পথিমধ্যে তেমন কোন সমস্যা হলো না। আমি নির্ধারিত সময়ের আগেই এয়ার ইন্ডিয়ার বিজয়ওয়াড়াগামী অভ্যন্তরীণ বিমান ধরতে পারলাম।
আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছে অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার ভাদ্দেশ্বরমে অবস্থিত কোনেরু লক্ষ্মাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে। আমি এখানে ২০২৩ ইংরেজি বর্ষের ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহ কাটাচ্ছি। ড. সম্পদ পান্ডে আমার পূর্ব পরিচিত – ঘনিষ্ট বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। আমরা দু’জন সাইপ্রাসের ফ্রেডেরিক ইউনিভার্সিটিতে ড. হ্যারিস হরলম্বুসের তত্ত্বাবধানে নভোবিজ্ঞানের ওপর একই সাথে কাজ করেছি।
ড. সম্পদই প্রথম আমাকে বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লাইটনিং লোকেশন নেটওয়ার্কের একটি সেন্সর স্টেশন স্থাপনের পথ বাতলে দিয়েছেন। কিউ এস র্যাংকিংয়ে ভারতে প্রথম স্থান অধিকারী আইআইটি বোম্বে থেকে পাস করেছেন তুখোড় মেধাবী নভোবিজ্ঞানী ড. সম্পদ। এবার তিনি অন্ধ্রপ্রদেশে একইরকম একটি সেন্সর স্টেশন স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আমাদের যেহেতু বাংলাদেশে লাইটনিং সেন্সর স্টেশনটি চালানোর দু’বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে, স্বভাবতই তিনি চাচ্ছিলেন, অন্ধ্রপ্রদেশে সেন্সর স্টেশনটি স্থাপনের সময় আমি তাঁর পাশে থাকি। আমিও ঋণ পরিশোধের এমনই একটি মওকা খুঁজছিলাম।
আমন্ত্রকদের সাথে পথিমধ্যে আর যোগাযোগ হয়নি। বিজয়ওয়াড়া বিমানবন্দরের বাইরে বেরুতে না বেরুতেই দূর থেকে ড. সম্পদের উৎকণ্ঠিত মুখখানি নজরে এলো। আমি হাত উঁচিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে তাঁর মুখে স্বস্তির হাসি ফোটালাম। ইউনিভার্সিটির একটি জমকালো মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছেন ড. সম্পদ। সেখানে চড়ে বসবার পর তিনি আমাকে নিয়ে তাঁদের আশঙ্কার কথা জানালেন। নিজেকে আমার তখন ছেলেবেলার ভূবনডাংগার মাঠে হারিয়ে যাওয়া কিশোর মনে হচ্ছিল।
আমাকে যে অতিথিশালায় রাখা হয়েছে তা বিজয়ওয়াড়া শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। ডি ভি মানর একটি চার তারকা হোটেল। ফ্রান্স থেকে আরো একজন অধ্যাপক এসেছেন। পাশাপাশি রুমে আমরা একই হোটেলে থাকছি। হোটেলের লবিতে ড. মাহামৌদা সালৌহৌর সাথে পরিচয় হলো। অধ্যাপক সালৌহৌ ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর লিডারশীপ এণ্ড এন্টারপ্রেনরশীপের ডিরেক্টর। তিনি এসেছেন কে এল ইউনিভার্সিটির ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আমন্ত্রণে।
উন্দাভাল্লি্র গুহাগুলো অজন্তা, ইলোরা, এলিফান্তার মতো অত বিদিত নয়। এগুলো বিজয়ওয়াড়া থেকে প্রায় ৪ কিমি দূরে অবস্থিত। এবড়ো-থেবড়ো পাহাড়ি পথ, তবু পাহাড়ের পাদদেশ উর্বরা সমতল। ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের জন্য একটি টাটা নিক্সন বরাদ্দ করেছে। সেই গাড়ির পেছনের সীটে ড. সম্পদ ও আমাকে বসিয়েছেন গাড়িচালক প্রশান্ত কুমার। ড্রাইভিং সীটের পাশের সীটটাতে বসেছে ড. সম্পদের পিএইচডি ছাত্র রাম কুমার। অতীব আনন্দের সাথে তিনি ক্রমাগত আমাদের ফটো তুলেই যাচ্ছেন। সরাইখানা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে অমরাবতীর রাস্তা ধরে কৃষ্ণা নদীর ওপর ব্যারেজ পেরিয়ে ছুটে চলে প্রশান্ত কুমার। প্রশান্ত তাঁর মুখাবয়ব। এ সময়ে ভবানী দ্বীপের দিকে জেট স্কিইং করে ছুটে যাওয়া একদল পর্যটককে এক ঝলক দেখে নিজের প্রয়াত তারুণ্যের কথা মনে পড়ে গেল।
ভরন্ত যৌবনা কৃষ্ণা নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে পানি আটকে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই ব্যারেজের ওপর দিয়ে চলে গেছে চার লেনের রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলে। যতদূর চোখ যায় আমি দু'ধারের দৃশ্যাবলী দেখি। একদিকে ভরন্ত নদী, অন্যদিকে ধু ধু বালিয়াড়ি। কত রকমের যানবাহন ছুটে চলেছে এই রাস্তা দিয়ে! বামের লেন দখল করে ছুটে যাচ্ছে একঝাঁক স্কুটি। কোনটাতে দু'জন রুক্ষ চেহারার ঝুলে পড়া পুরু গোঁফের দশাসই শ্যামলা পুরুষ। কোনটাতে গিন্নীকে পেছনে বসিয়ে ছুটিয়ে নেয়া গৃহস্থ স্বামী। এই জীবনে হেলমেট পড়ার কোন তাগিদ নেই তাদের। এইসব খেটে খাওয়া মানুষের দিকে চোখ পড়তেই সম্পদ বলে, "এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কৃষিজীবী ও মোটামুটি স্বচ্ছল। ইউনিভার্সিটিতে সন্তানদের পড়ানো তাদের কাছে অনেকটাই মান-মর্যাদার বিষয়"।
পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা উন্দাভাল্লির দিকে এগিয়ে যাই। পাকদণ্ডী ঠিক নয় – কিছুটা সমতল, কিছুটা ঢালু আঁকাবাকা রাস্তা। দু'পাশে নিস্প্রভ আনাড়ি হাতে গড়ে তোলা একতলা বাড়িঘর দেখতে দেখতে সাইপ্রাসের ছোট ছোট শহরতলীতে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভগ্নদশা স্তূপের মত পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর কথা মনে পড়ে। মানুষের মস্তিষ্ক এক অদ্ভুত যন্ত্র। সে যে কখন, কোথা হতে কোন স্মৃতি এনে তোমার সামনে হাজির করবে, তার কোন নিশানা নেই। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে একসময় আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাই।
কঠিন পাথুরে শিলা কেটে তৈরি করা হয়েছে এই স্থাপত্য। অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়ার গুন্টুর জেলায় অবস্থিত এই গুহাগুলো ভারতের শিলা কেটে তৈরি করা স্থাপত্য ঐতিহ্যের সেরা নমুনা। এগুলো খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে বিষ্ণুকুন্ডি শাসকদের দ্বারা নির্মিত বলে মনে করা হয়। সাধারণ বিশ্বাস অনুসারে, গুহাগুলো ভগবান নরসিংহ এবং ভগবান অনন্ত পদ্মনাভকে উত্সর্গীকৃত। এদেশে পা ফেলবার আগে উইকিপেডিয়া ঘেঁটে জানতে পেরেছি, এই গুহাগুলো মূলত জৈন ধর্মের অনুসারীদের আশ্রম ছিল, পরবর্তীতে এগুলোকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। চার তলা মূল গুহাটি ছাড়াও পুরো চত্ত্বরটিতে ছোট ছোট আরো তিনটি গুহা চোখে পড়ল। এগুলোর ওপর একটি আয়তকার প্রস্তরফলকে হাতি ও সিংহের মূর্তি খোদাই করা আছে। তার ওপরে ডানপাশে চিলেকোঠার মতো একটি বর্ধিতাংশ, সেখানে একটি বিষ্ণুমূর্তি খোদাই করা। অন্যপাশের বর্ধিতাংশটি অসমাপ্ত।
প্রবেশমুখে টিকেট কাটবার ঘর। আমাকে কিছু বুঝে উঠবার সুযোগ না দিয়েই ড. সম্পদ ঝটঝট ৩ খানা টিকেট কেটে ফেললেন। আমরা চত্বরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। সবুজ চত্ত্বরের বুক চিরে গুহা অব্দি শান বাঁধানো পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে। পথের শুরুতেই স্থাপিত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর আমাদের চোখে পড়ল। সেখানে গুহাগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া আছে। পাশাপাশি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উন্দাভাল্লি গুহাকে প্রটেকটেড মনুমেন্ট ঘোষণা দিয়ে তেলেগু, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় লেখা ভারত সরকারের এলান।
আমরা চার তলা মূল গুহার পাদদেশে চলে এলাম। উপরে হাতির পিঠের মতো কিংবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত আরমার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ারের মতো কঠিন প্রস্তরীভূত শিলাময় পাহাড়। হাতি অবশ্য এখানে বহু ব্যবহৃত মোটিফ। এই মূলগুহাটির উপরের অংশটিকে সম্প্রতি পেইন্ট করা হয়েছে বলে মনে হলো। পাহাড়ের পাদদেশ সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা। কৃষ্ণা নদী বিধৌত গুনটুর জেলার মাটি খুবই উর্বর ও ফলবতী। এখানের মানুষেরা খুবই পরিশ্রমী। বছরে তিন থেকে চারটি ফসল ফলায় তারা। এক ফসল ওঠার সাথে সাথেই ক্ষেতে বুনে দেয় অন্য ফসল। গুহার রহস্যময়তা আমাকে টানছে তবু চারপাশের নিম্নভূমির সবুজকে আমি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছি না। সেখানে শান্তভাবে প্রবাহিত কৃষ্ণা নদী। অন্তহীন তার বয়ে চলা। কী মন্ত্রমুগ্ধকর এই দৃশ্য! চোখের শ্রান্তির নিরাময় আনে।
দু’জনে গল্প করতে করতে মূল গুহার সবচেয়ে নিচের তলায় এসে দাঁড়িয়েছি। মানুষের তেমন একটা ভিড় নেই – দোতলায় কিছু কপোত-কপোতী জোড়ায় জোড়ায় মধুনীড় পেতে বসে আছে। আমরা কঠিন শিলা কেটে বানানো চারতলা উন্দাভাল্লি গুহার সবচেয়ে নিচের তলায় প্রবেশ করলাম। এটি সম্ভবত অনেকগুলো খিলানের ওপর দাঁড়ানো একটি অসমাপ্ত হলরুম। সম্পুর্ণ হলরুমটি বিশাল আকৃতির একটি নিরেট পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। কতজন বিশ্বকর্মার হাতুড়ি ও ছেনীর আঘাতে আঘাতে এই স্থাপত্য অবয়ব পেয়েছে তা আমি জানি না। কিন্তু সভ্যতার আদি নিদর্শনের সাথে বর্তমান প্রযুক্তির অভূতভাবিত বিকাশের তুলনা করে বিস্মিত হই। আজকাল হয়ত বছরের পর বছর ধরে শিলা কেটে এমন স্থাপত্য আর তৈরি করা হবে না। এই কঠিন শিলার খিলানকে প্রতিস্থাপন করবে রিইনফোর্সমেন্ট কংক্রীট স্ট্রাকচার, তবু মানুষের এই এগিয়ে যাওয়ার পথে কত শত মনীষীর অবদানকে শ্রদ্ধা না করে কি কোন উপায় আছে?
এরপর পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ট্রিনিটিতে উঠবার পালা। সিঁড়িও বানানো হয়েছে হাতুড়ি-ছেনী চালিয়ে পাথুরে শিলা কেটে। মেপে মেপে। দোতলায় উঠে নজরে এলো শিব ও বৈষ্ণবের ভাস্কর্য। আরো কয়েকটি ভাস্কর্য দেখে মনে হলো এগুলো পরবর্তীকালে তৈরি করা হয়েছে। সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি নজরে এলো। বেশক’টি দেব-দেবী মূর্তি দেখলাম। এদের একটি স্পষ্টতই ‘নৃসিংহ’; জানুতে রেখে হিরণ্যকশিপু বধ করছেন। আরেকটি ত্রিমূর্তি; অর্থাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এক দেহে। সাধারনত অত্রি মুনির সন্তান ঋষি ত্রিনাথ দত্তত্রেয়কে এরকম রূপে ধরা হয়। আরো একটি মূর্তি দেখে দন্ডপাণি ভৈরব মনে হলো।
তারপর একটি আয়তাকার মন্দির। উপরের তলাটি অসমাপ্ত। কিছু ভাস্কর্যের নমুনা চালুক্য যুগের। কঠিন স্তম্ভগুলো কতটুকু শক্ত, ঘুষি মেরে তা পরীক্ষা করার অভিনয় করছি, এমন সময় রাম কুমারের ক্যামেরা ঝলসে উঠলো। এই স্তম্ভগুলির শৈলীর সাথে বিজয়নগরের একটি শৈলীগত মিল আছে। তবে কথিত আছে যে, এই গুহাগুলি মহাবালিপুরম গুহাসমূহের খননকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় আমি কিছু সুপরিচিত চৈত্য নকশা দেখতে পাই। কোনো এক সময়ে এগুলো যে বৌদ্ধ গুহা ছিল, এসব নকশা তারই ইঙ্গিতবাহী। কোন কোন প্রত্নতত্ত্ববিদ মনে করেন যে, এগুলি মূলত জৈন গুহা যা পরবর্তীতে বৌদ্ধদের আশ্রয় দিয়েছিল, এবং কালক্রমে হিন্দু বৈষ্ণব গুহায় পরিণত হয়েছিল।
অন্ধ্রে নরসিংহ পূজার ঐতিহ্য বহুদিনের। ভাইজাগের কাছে সিংহাচলমের মতো অন্ধ্রের অনেক বড় মন্দির বিষ্ণুর এই অবতারকে উৎসর্গীকৃত। আর যেখানে আছে, তা হলো সারাহানের মতো হিমাচল প্রদেশের কিছু অংশে। তাই নরসিংহের ভাস্কর্যটি এখানে বহুবার দেখা যায়। এখানে নরসিংহের একটি স্থির ভাস্কর্য রয়েছে এবং স্তম্ভের উপর ফলকগুলিতেও নরসিংহ খোদাই করা আছে। হিমাচল প্রদেশের কিছু অংশেও নরসিংহের উপাসনা করা হয়।
এখানে স্তম্ভে খোদিত মহাকাব্য রামায়ণের কয়েকটি দৃশ্য রয়েছে। সেখানে একাধিক হনুমান মূর্তি নজরে এলো। এমনকি রামায়ণের যে দৃশ্যগুলো আমি সেখানে দেখলাম, সেগুলোও ছিল এই মহাকাব্যের হনুমান পর্বের অন্তর্গত। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অশোক ভাটিকায় হনুমানজীর সাথে সীতার সাক্ষাতের খোদাই করা এই দৃশ্যটির ছবি জুড়ে না দিলেই নয়।
চলে এলাম তিনতলার বারান্দায়। সেখানে বসে থাকা ৪ জন ধ্যানরত সাধুর প্রমাণ মাপের মূর্তি খুব কাছে থেকে নেড়েচেড়ে দেখা গেল। ওঁদের মধ্যে একজন একটি তানপুরার মতো যন্ত্র বাজাচ্ছে। পাশে দু’টি সিংহের ভাস্কর্য। সিংহ দু’টির মোটেই বিশ্রাম নেই। তাদের পিঠে সওয়ার হয়ে ছবি তুলবার ভিড় লেগে আছে। তুমি যখন রোমে, তখন রোমান হও। আমরা সবাই তাই একে একে সিংহাসনে বসে ছবি তুলে নিলাম। এই সাধু মূর্তিগুলো জৈন বা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মত নয়, তবে সম্ভবত ঋষি মুনির মতো। মনে হলো, এঁদের একজন গুরু আর তিনজন শিষ্য।
সবশেষ আকর্ষণ অর্ধশায়িত ভগবান বিষ্ণুর প্রায় ১৬০০ বছরের পুরানো ৪ মিটার দীর্ঘ এক শিলামূর্তি - শেশশায়ী বিষ্ণু। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর দিকে গ্রানাইটের একটি ব্লক খোদাই করে গড়া হয়েছে এই ভাস্কর্য। এটি উন্দাভল্লি গুহার একটি প্রাথমিক ভাস্কর্য। সে সূত্রে এই ভাষ্কর্যটি উন্দভাল্লিকে একটি বৈষ্ণব গুহামন্দির বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একটি বিশাল গরুড় মূর্তি ঘুমন্ত বিষ্ণুর শিয়রে বসে নিঃছিদ্র বিশ্রাম নিশ্চিত করতে প্রহরারত। আর দৈত্য নাগা কাজ করছে সিথানের বালিশ হিসেবে। অন্ধকার এই গুহায় দু’ধারে দু’টি পিদিম জ্বেলে রাখা হয়েছে। সেই মৃদু আলোয় কালো গ্রানাইটের ঘুমন্ত বিষ্ণুকে আমার চোখে এক নিবিড় শান্তির ঘুম হিসেবেই প্রতিভাত হলো।
ড. সম্পদ ও আমি অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলায় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লাইটনিং লোকেশন নেটওয়ার্কের একটি সেন্সর স্টেশন স্থাপন করছি।
বিজয়ওড্ডা বিমানবন্দরে লেখক
উন্দাভাল্লি্র আয়ত চিত্র।
চার তলা মূল গুহাটি ছাড়াও ছোট ছোট আরো তিনটি গুহা। উপরে আয়তকার প্রস্তরফলকে হাতি ও সিংহের মূর্তি খোদাই করা।
প্রথম তলার ছবি
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর।
উন্দাভাল্লি গুহাকে প্রটেকটেড মনুমেন্ট ঘোষণা দিয়ে তেলেগু, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় লেখা ভারত সরকারের এলান।
পাহাড়ের পাদদেশ সুজলা-সুফলা-শস্য শ্যামলা।
নিচতলার সম্পুর্ণ হলরুমটি বিশাল আকৃতির একটি নিরেট পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে।
সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি।
নৃসিংহ অবতার জানুতে রেখে হিরণ্যকশিপু বধ করছেন।
ত্রিমূর্তি অর্থাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এক দেহে।
দন্ডপাণি ভৈরবের মূর্তি।
শ্রীলঙ্কার অশোক ভাটিকায় হনুমানজীর সাথে সীতার সাক্ষাতের খোদাই করা দৃশ্য।
৪ জন ধ্যানরত সাধুর প্রমাণ মাপের মূর্তি।
অর্ধশায়িত ভগবান বিষ্ণুর প্রায় ১৬০০ বছরের পুরানো ৪ মিটার দীর্ঘ এক শিলামূর্তি
অর্ধশায়িত ভগবান বিষ্ণুর পাশে দণ্ডায়মান লেখক
গরুড় প্রহরারত বিষ্ণু
মন্তব্য
বহু বছর আগে জুন মাসের এক অগ্নিগর্ভ দিনে খুব অল্প সময়ের জন্য বিজয়ওয়াড়া থেমেছিলাম। যে অতি সামান্যটুকু দেখেছি সেটা খুব রুক্ষ্ম এক দেশ। গোটা রাজ্যটা নিশ্চয়ই এমন নয়। নয়তো তারা ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ রাজ্য হতে পারতো না।
দ্রাবিড়নাড়ুর এসব আস্ত পাথরের স্থাপনাগুলো আমাকে বিস্মিত করে। বিশাল বিশাল সব কাজ, তাতে সূক্ষ্ম সব কারুকাজ। অমানুষিক কাজকারবার। আশা করি তার কিয়দংশ হলেও উপভোগ করতে পেরেছেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কাজকারবার অমানুষিক বটে। তবে পাথরের বুকের কারুকাজগুলো তেমন সূক্ষ্ম নয়। সূক্ষ্ম কারুকাজ আছে বিশালাকৃতি সুউচ্চ মন্দিরগুলোতে। আছে প্রতিসমতার সাথে বৈচিত্র্যের অনন্য মিশ্রন। এখানে আমি যা লিখেছি, তার চাইতে দেখেছি অনেক বেশী। হয়রান সূর্য যখন জীবনের পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে, তখন মানুষ প্রতিমুহূর্তেই তৃষ্ণার্ত চোখ ভরে আরো কিছু দেখে নিতে চায়। লিখতে বসলে সেই দেখার সময়টা ছোট হয়ে আসে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
অনেক বছর পর লিখলেন।
অজন্তা ইলোরার আদলে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা সম্পর্কে জানা ছিল না। আপনার কল্যাণে কিছুটা আলোকিত হলাম। বিস্ময়কর একেকটা ভাস্কর্য। ছবি দেখেই এত মুগ্ধ হয়ে আছি, সামনাসামনি কেমন লাগতো সেটাই ভাবছি।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
হ্যাঁ, অনেক বছর পরে লেখা হলো। জীবনানন্দের ভাষায়, "জীবন চলিয়া গেছে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার"। আর রবীন্দ্রনাথের কথায়, "তোমায় আমি দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে"। লেখালেখির উচ্ছ্বাস একসময় স্তিমিত হয়ে আসে। তখন শুরু হয় দেখাদেখির সময়। আমার এখন সেই সময়টা যাচ্ছে। সেই সময় থেকে একটি দুটি সোনাবীজ কিংবা ধুলো বালি ছাই তুলে আনি মাঝে মাঝে। ওগুলো রোজনামচার পর্যায়ে পড়ে, কিছুতেই লেখা নয়। আপনার মন্তব্য পেয়ে ভাল লাগলো। সামনা-সামনি দেখা হলে আরো ভালো লাগতো।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
দারুণ রোমেল ভাই!
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
কেমন আছেন?
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নতুন মন্তব্য করুন