চৈত্র মাসের “কাট ফাটা গরম” কথাটা ব্যবহার করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না। এই দেশে চৈত্র মাস আসে না। এখানে আসে “সামার”। শীতের শেষে যখন গরম ওভারকোট থেকে শরীরকে বের করে আনতে শুরু করে সবাই, যখন সূর্যের তাপ জানিয়ে দেয় সে মধ্য গগনে রাজত্ব করতে মাস কয়েকের জন্যে হাজির হতে যাচ্ছে, যখন বিকিনি পরিহিতা সুতন্বীরা সমুদ্র সৈকতে তাদের শরীরের বক্ররেখাগুলো উন্মুক্ত করে লাস্যময়ী হাসি দিয়ে ছেলে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে গড়িয়ে পড়ে, আর সেই দৃশ্য দেখে যখন উপমহাদেশের ছেলেরা সুনীলের কবিতার মত ভাবে “একদিন আমরাও...”, তখন শাহেদ বুঝে নিতে শুরু করে এদেশের চৈত্র মাস বুঝি এসেই গেলো।
ডাবলিনের জনসমুদ্রে চৈত্র মাসের গরমে সে হাঁটছিলাম। রাস্তা গিজগিজ করছে মানুষে। শনিবারের ভর দুপুরে এত মানুষ কোথা থেকে এলো সেটা একটা প্রশ্ন বটে। কিন্তু আপনি যখন জেনে যাবেন এই দেশের অন্যতম প্রধান আয় পর্যটন তখন আর বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় এদের সিংহভাগই পর্যটক, এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। স্থানীয়রাও কম যায় না। দুই বছরের “ইনফ্যান্ট” থেকে শুরু করে পঁচাশি বছরের “গ্র্যানি”, সবাই দল বেঁধে সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ে গড়ে ওঠা এ শহরে অর্ধবৃত্তাকারে ছড়িয়ে আছে নাম করা অনেকগুলো সৈকত – ব্রে, হোথ, মালাহাইড, গ্রেস্টোন, ডন'লয়েরী, ক্লনটার্ফ ইত্যাদি। সেসব সৈকতে সামার মানেই যেন চৈত্র বিলাস।
শাহেদ শহরের প্রাণকেন্দ্রের মূল রাস্তা ধরে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল। গিজ্গিজ্ করা ভিড়ে গরমের মধ্যে ঘর্মাক্ত শরীরের বোটকা গন্ধ থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টা। মেয়েদের শরীরের পারফিউমের গন্ধে মম করছে ভিড় গুলো। মাঝে মাঝে শাহেদ ভাবে, এদের শরীরের গন্ধের যেন একটা বলয় আছে। ঠিক যেমনটা তারহীন যোগাযোগের ছাত্ররা বলে “ট্রান্সমিশন রেইঞ্জ”। একটা মেয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও তার গন্ধের অস্তিত্ব নাকে লাগতে থাকে। আজকের দিনটাও ব্যতিক্রম নয়। শাহেদ বোঝে, চৈত্র বিলাসে বেরিয়ে প্রিয়দর্শিনীরা সমুদ্রের লবণাক্ত জলে নামার আগে ফরাসি পারফিউমের সুগন্ধি জলে নেয়ে এসেছে।
শাহেদের তাড়া ছিল। তাই হন হন করে ভিড় ঠেলে হেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সে বাধা পেল। চলমান জনসমুদ্র একযোগে থেমে গিয়েছে। সামনে ট্রাফিক লাইট চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। শাহেদ দেখতে পায় ওর ডান পাশের গাড়িগুলো অলস ভাবে থেমে আছে, অথচ সামনের গুলো সাই সাই করে চলে যাচ্ছে চৌরাস্তাকে আড়াআড়ি বরাবর কেটে। এ যেন জীবনেরই এক প্রতিচ্ছবি - কেউ থেমে থাকলেই কেউ এগিয়ে যাবার সুযোগ পাবে!
দার্শনিক হবার মোক্ষম সময় ছিল তবুও সে হতে পারলো না। হঠাৎ ওর চিন্তায় ছেদ পড়ে এক ভদ্রলোকের অনুনয়ে। ভিড়ের মাঝে শাহেদ শুনতে পায় সাদা ছড়ি হাতে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর, “আমাকে দয়া করে রাস্তা পর হতে সাহায্য করুন”। ভিড়ের কারণে ভদ্রলোককে খানিকটা দিশেহারা মনে হচ্ছিল।
যদিও ঠিক সামনেই দাঁড়ানো, তবুও প্রথমতঃ গরম, তার উপর এই ভিড়ের মধ্যে তাকে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে ইচ্ছে করছিল না ওর। তাই অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো যেন কিছুই শুনতে পায় নি। ভেবেছিল হয়তো অন্য কেউ সাহায্য করবে। কিন্তু একটু পর যখন ভদ্রলোক একই কথা করুণ স্বরে আবার বললেন, তখন এগিয়ে যেতে গিয়েও শাহেদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। ব্রে বিচে যাওয়ার ট্রেনটা মিস হলে পাক্কা বিশ মিনিট স্টেশনে বসে থাকতে হবে। সে বোঝে এরকম সময় পরোপকারী হতে যাওয়া নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা।
আরো কিছু সময় কেটে যায়। ঠিক যেই মুহূর্তে সিগনালের আলো লাল থেকে সবুজ হলো, পুরো জনসমুদ্র যেন ভেঙ্গে পড়লো রাস্তার উপর। শাহেদ সাদা ছড়ি হাতে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে দ্রুত পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। তখন সে অনুভব করছিল পুরো ভিড় যেন ওর পেছনে ধেয়ে আসছে। ফলে হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেই গতি শ্লথ হয়ে যায়। পেছন থেকে তখন সে শুনতে পাচ্ছে ভদ্রলোক করুণ ভাবে আবার বলছেন, “আমি একজন অন্ধ মানুষ। দেখুন আমার হাতে সাদা ছড়ি। আমাকে দয়া করে রাস্তা পার করে দিন। আমি দিক হারিয়ে ফেলেছি।”
মুহূর্তে শাহেদ দাঁড়িয়ে যায়। ওর মনে হয় ওর পৃথিবী যেন কেঁপে উঠলো কয়েক পলকের জন্যে। ভদ্রলোকের বলা কথাগুলো ওর বিবেকের গালে প্রচণ্ড এক চড়ের মত অনুভব করলো সে। চৈত্র বিলাসে মগ্ন মানুষগুলোর মাঝে স্থির দাঁড়িয়ে সে ভাবে, এতগুলো “দেখতে পাওয়া” মানুষকে ভদ্রলোকের হাতে সাদা ছড়ি আছে এটা কেন মুখে বলে দিতে হলো? কেন তাকে বলে বোঝাতে হলো তিনি একজন অন্ধ? নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে শাহেদের বুক থেকে। সে বুঝে উঠতে পারে না আসলে প্রকৃত অন্ধ কে সেখানে। সাদা ছড়ি হাতে দাঁড়ানো মানুষটি নাকি চৈত্র বিলাসে মগ্ন ওরা।
ততক্ষণে বেশ কয়েকজন ভদ্রলোককে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছে। অন্তত বধির হয়ে যায় নি, যেন তারই প্রমাণ স্বরূপ। শাহেদ আর দাঁড়ায় না, মিশে যায় ভিড়ের মাঝে। হয়তো এক সময় ভুলেও যায় এই ঘটনা। কিন্তু এমন ঘটনা অন্য কোন শাহেদের সাথে অন্য কোন শহরে আবার ঘটে। অন্য কোন লেখক সেটা নিয়ে গল্পও লেখে, পাঠকরা সেই গল্প পড়েও। তারপর আবার সবাই ভুলে যায়। যেন আমরা এটাই প্রমাণ করে চলেছি যে আমাদের অন্ধত্ব আজ দৃষ্টি থেকে হৃদয়ে গিয়ে ঠেকেছে। (সত্য ঘটনা)
১২ এপ্রিল ২০১০
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
মন্তব্য
চমৎকার একটা মেসেজ। আপনার লেখাও ঝরঝরে, আবার অলঙ্কারও আছে।
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। গল্পটা আমি রিরাইট করেছি। পোস্ট এডিট করার ক্ষমতা পেলে নূতন ভার্সনটা এখানেই আপলোড করবো।
টুইটার
লেখা ভাল্লাগলোরে ছুটু ভাই! দুই বছরের 'ইনফ্যান্ট' দেইখা ভাব্লাম যে ভুল লিখসিস, হওয়া উচিৎ 'টডলার', পরে গুগল মামা জানাইলো যে ৩ বছর পর্যন্ত 'ইনফ্যান্ট' কওয়া জায়েজ আছে!
আমার মনে হয় শিক্ষক হওনের শখ হইসে...আজকাল শুধু জ্ঞান দিতে মঞ্চায়!
-----------------------------------------------------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
আপু, লেখার সময় আমি নিজেও একটু সন্দিহান ছিলাম। ইনফ্যান্টতো সাধারণত নড়তে পারে না। দুই বছরেতো রীতিমত দৌড়ায় বাচ্চারা। তবুও যে কোনক্রমে উৎরে গেলাম এই রক্ষা।
শিক্ষক হওয়া কিন্তু ভালো। মাঝে মাঝে ভুল ধরিয়ে দেবেন। তাতে পরে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবো।
টুইটার
মন্তব্য এতো কম কেন?
আপনার লেখার হাত দারুণ।
"অনুভব করলাম পুরো ভিড় যেন আমার পেছনে ধেয়ে আসছে।" বাক্যটা এখানে অসংলগ্ন ঠেকলো।
শেষ প্যারাটা একটু অন্যরকম হলে ভালো হতো। গল্পের মেসেজটা লেখক নিজমুখে বলে দিলে আমার কেন যেন মনে হয় গল্পটা দুর্বল হয়ে গেলো।
ঃ
টাইপোঃ ভীড়ে > ভিড়ে, হাটতে > হাঁটতে
বানানঃ সাই সাই > সাঁই সাঁই
প্রবাদঃ কাট ফাটা গরম > কাঠ ফাটা রোদ
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
গল্পটা কাজের ফাঁকে সময় কাটানোর জন্যে লিখেছিলাম। পরে বেশ কিছু পরিবর্তণ করেছি। নূতন ভার্সনটা পড়ে দেখলে খুশি হবো।
চৈত্র বিলাস এবং তিনি (ছোটগল্প)
চৈত্র মাসের “কাট ফাটা গরম” কথাটা ব্যবহার করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না। এই দেশে চৈত্র মাস আসে না। এখানে আসে “সামার”। শীতের শেষে যখন গরম ওভারকোট থেকে শরীরকে বের করে আনতে শুরু করে সবাই, যখন সূর্যের তাপ জানিয়ে দেয় সে মধ্য গগনে রাজত্ব করতে মাস কয়েকের জন্যে হাজির হতে যাচ্ছে, যখন বিকিনি পরিহিতা সুতন্বীরা সমুদ্র সৈকতে তাদের শরীরের বক্ররেখাগুলো উন্মুক্ত করে লাস্যময়ী হাসি দিয়ে ছেলে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে গড়িয়ে পড়ে, আর সেই দৃশ্য দেখে যখন উপমহাদেশের ছেলেরা সুনীলের কবিতার মত ভাবে “একদিন আমরাও...”, তখন শাহেদ বুঝে নিতে শুরু করে এদেশের চৈত্র মাস বুঝি এসেই গেলো।
ডাবলিনের জনসমুদ্রে চৈত্র মাসের গরমে সে হাঁটছিলাম। রাস্তা গিজগিজ করছে মানুষে। শনিবারের ভর দুপুরে এত মানুষ কোথা থেকে এলো সেটা একটা প্রশ্ন বটে। কিন্তু আপনি যখন জেনে যাবেন এই দেশের অন্যতম প্রধান আয় পর্যটন তখন আর বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় এদের সিংহভাগই পর্যটক, এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। স্থানীয়রাও কম যায় না। দুই বছরের “ইনফ্যান্ট” থেকে শুরু করে পঁচাশি বছরের “গ্র্যানি”, সবাই দল বেঁধে সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ে গড়ে ওঠা এ শহরে অর্ধবৃত্তাকারে ছড়িয়ে আছে নাম করা অনেকগুলো সৈকত – ব্রে, হোথ, মালাহাইড, গ্রেস্টোন, ডন'লয়েরী, ক্লনটার্ফ ইত্যাদি। সেসব সৈকতে সামার মানেই যেন চৈত্র বিলাস।
শাহেদ শহরের প্রাণকেন্দ্রের মূল রাস্তা ধরে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল। গিজ্গিজ্ করা ভিড়ে গরমের মধ্যে ঘর্মাক্ত শরীরের বোটকা গন্ধ থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টা। মেয়েদের শরীরের পারফিউমের গন্ধে মম করছে ভিড় গুলো। মাঝে মাঝে শাহেদ ভাবে, এদের শরীরের গন্ধের যেন একটা বলয় আছে। ঠিক যেমনটা তারহীন যোগাযোগের ছাত্ররা বলে “ট্রান্সমিশন রেইঞ্জ”। একটা মেয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও তার গন্ধের অস্তিত্ব নাকে লাগতে থাকে। আজকের দিনটাও ব্যতিক্রম নয়। শাহেদ বোঝে, চৈত্র বিলাসে বেরিয়ে প্রিয়দর্শিনীরা সমুদ্রের লবণাক্ত জলে নামার আগে ফরাসি পারফিউমের সুগন্ধি জলে নেয়ে এসেছে।
শাহেদের তাড়া ছিল। তাই হন হন করে ভিড় ঠেলে হেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সে বাধা পেল। চলমান জনসমুদ্র একযোগে থেমে গিয়েছে। সামনে ট্রাফিক লাইট চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। শাহেদ দেখতে পায় ওর ডান পাশের গাড়িগুলো অলস ভাবে থেমে আছে, অথচ সামনের গুলো সাই সাই করে চলে যাচ্ছে চৌরাস্তাকে আড়াআড়ি বরাবর কেটে। এ যেন জীবনেরই এক প্রতিচ্ছবি - কেউ থেমে থাকলেই কেউ এগিয়ে যাবার সুযোগ পাবে!
দার্শনিক হবার মোক্ষম সময় ছিল তবুও সে হতে পারলো না। হঠাৎ ওর চিন্তায় ছেদ পড়ে এক ভদ্রলোকের অনুনয়ে। ভিড়ের মাঝে শাহেদ শুনতে পায় সাদা ছড়ি হাতে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর, “আমাকে দয়া করে রাস্তা পর হতে সাহায্য করুন”। ভিড়ের কারণে ভদ্রলোককে খানিকটা দিশেহারা মনে হচ্ছিল।
যদিও ঠিক সামনেই দাঁড়ানো, তবুও প্রথমতঃ গরম, তার উপর এই ভিড়ের মধ্যে তাকে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে ইচ্ছে করছিল না ওর। তাই অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো যেন কিছুই শুনতে পায় নি। ভেবেছিল হয়তো অন্য কেউ সাহায্য করবে। কিন্তু একটু পর যখন ভদ্রলোক একই কথা করুণ স্বরে আবার বললেন, তখন এগিয়ে যেতে গিয়েও শাহেদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। ব্রে বিচে যাওয়ার ট্রেনটা মিস হলে পাক্কা বিশ মিনিট স্টেশনে বসে থাকতে হবে। সে বোঝে এরকম সময় পরোপকারী হতে যাওয়া নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা।
আরো কিছু সময় কেটে যায়। ঠিক যেই মুহূর্তে সিগনালের আলো লাল থেকে সবুজ হলো, পুরো জনসমুদ্র যেন ভেঙ্গে পড়লো রাস্তার উপর। শাহেদ সাদা ছড়ি হাতে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে দ্রুত পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। তখন সে অনুভব করছিল পুরো ভিড় যেন ওর পেছনে ধেয়ে আসছে। ফলে হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেই গতি শ্লথ হয়ে যায়। পেছন থেকে তখন সে শুনতে পাচ্ছে ভদ্রলোক করুণ ভাবে আবার বলছেন, “আমি একজন অন্ধ মানুষ। দেখুন আমার হাতে সাদা ছড়ি। আমাকে দয়া করে রাস্তা পার করে দিন। আমি দিক হারিয়ে ফেলেছি।”
মুহূর্তে শাহেদ দাঁড়িয়ে যায়। ওর মনে হয় ওর পৃথিবী যেন কেঁপে উঠলো কয়েক পলকের জন্যে। ভদ্রলোকের বলা কথাগুলো ওর বিবেকের গালে প্রচণ্ড এক চড়ের মত অনুভব করলো সে। চৈত্র বিলাসে মগ্ন মানুষগুলোর মাঝে স্থির দাঁড়িয়ে সে ভাবে, এতগুলো “দেখতে পাওয়া” মানুষকে ভদ্রলোকের হাতে সাদা ছড়ি আছে এটা কেন মুখে বলে দিতে হলো? কেন তাকে বলে বোঝাতে হলো তিনি একজন অন্ধ? নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে শাহেদের বুক থেকে। সে বুঝে উঠতে পারে না আসলে প্রকৃত অন্ধ কে সেখানে। সাদা ছড়ি হাতে দাঁড়ানো মানুষটি নাকি চৈত্র বিলাসে মগ্ন ওরা।
ততক্ষণে বেশ কয়েকজন ভদ্রলোককে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছে। অন্তত বধির হয়ে যায় নি, যেন তারই প্রমাণ স্বরূপ। শাহেদ আর দাঁড়ায় না, মিশে যায় ভিড়ের মাঝে। হয়তো এক সময় ভুলেও যায় এই ঘটনা। কিন্তু এমন ঘটনা অন্য কোন শাহেদের সাথে অন্য কোন শহরে আবার ঘটে। অন্য কোন লেখক সেটা নিয়ে গল্পও লেখে, পাঠকরা সেই গল্প পড়েও। তারপর আবার সবাই ভুলে যায়। যেন আমরা এটাই প্রমাণ করে চলেছি যে আমাদের অন্ধত্ব আজ দৃষ্টি থেকে হৃদয়ে গিয়ে ঠেকেছে। (সত্য ঘটনা)
টুইটার
- আপনার সিগনেচার লাইনটা দেখলেই আমার এই গানটার কথা মনে পড়ে খালি—
আমরা আসলে অন্ধ না, সময়কে মূল্য দিতে আমাদের বরং আরও কয়েকটা চোখ বেশি খুলে গেছে। যেকারণে আমরা প্রায়ই যেটা দেখার কথা সেটা না দেখে বরং অদেখা অনেক কিছুই দেখে ফেলি।
এক সকালে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। বেশ বয়স্ক একজন বাজার করতে যাবেন হাতে ট্রলি ব্যাগটা টেনে টেনে। কিন্তু পথের মধ্যে নিজের শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে পড়ে গেলেন রাস্তার পাশেই। সিমেন্টের বেঞ্চিতে হালকা আঘাতও পেলেন মনে হলো। তাঁর পাশ দিয়ে অফিস যাওয়া মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিলো না, কম ছিলো না স্কুলগামী বালক/বালিকারাও। অথচ তাদের হাতে অতোটুকু সময় ছিলো না যাতে বৃদ্ধকে ধরে তুলে দিতে পারে। একটাবার মাথা ঘুরিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে যে যার পথে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ নামক তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষ বাকিদের মতো করে সেই দৃশ্যটা পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি। তাড়া তো তারও ছিলো। কিন্তু বিবেকের গালে সশব্দে চপেটাঘাত পড়ার কারণেই বোধ'য় তাকে থামতে হয়েছিলো সেদিন।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
প্রথমেই গানটার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হওয়ায় আমাদের অনেক কিছু না থাকলেও বিবেকটা এখনও আছে। অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিৎ হলে তৃতীয় বিশ্বের মানুষরা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সুনাগিরক হতো।
টুইটার
নতুন মন্তব্য করুন