১৯৭২ সনের ৩০ জানুয়ারি। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ছিমছাম শহর ডেরী। স্বাধীনতাকামী আইরিশ রিপাবলিকানদের ঘাটি বলে পরিচিত এই শহর। ১৯২২ সনে আইরিশ স্বাধীনতার সময় এক থাবায় আয়ারল্যান্ডের মানচিত্র থেকে এক ষষ্ঠাংশ ভূখণ্ড ইংল্যান্ড কেন্দ্রীক বৃটেনের শাসকরা ছিনিয়ে রাখে। স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল থাকলেও সেই অংশে পড়ে যায় ডেরী। এর পর থেকে বৃটেনের চোখ সব সময় এই শহরটাকে নজরবন্দী করে রাখতো। ব্রিটিশ সরকার জানতো তাদের বিরুদ্ধে জনরোস যদি উঠতে শুরু করে, তবে সেটা ডেরী থেকেই হবে। আর সেজন্য “দ্যা ট্রাবল” শুরুর পর থেকে এখানে সেনাবাহিনী নিযুক্ত থাকতো নিয়মিতই। ১৯৭২ সনের ৩০ জানুয়ারী এই সেনাবাহিনীই ঘটায় যুক্তরাজ্যের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় ঘটনা। এদিন ডেরী শহরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ নিভিয়ে দিয়েছিল ২৭-২৯ টি তাজা প্রাণ। দিনটিকে আইরিশ ইতিহাসে বলা হয় “ব্লাডি সানডে”। এত দিন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বলে আসছিল তারা সন্ত্রাসীদের উপর গুলি চালিয়েছিল। তবে ৩৮ বছর তদন্তের পর গত কাল ১৫ জুন প্রকাশিত নিরপেক্ষ তদন্তের রিপোর্টে জানানো হয় ব্লাডি সানডেতে মারা যাওয়া সবাই ছিলেন নিরীহ।
কী হয়েছিল এই ব্লাডি সানডেতে? একটু বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা যাক। ১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারি ছিল রবিবার। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে উপেক্ষিত নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের মানুষ এদিন ডেরী সিটি কাউন্সিলের কাছে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশের জন্যে সমাবেত হতে শুরু করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান এবং নাগরিক অধিকারগুলো সংরক্ষণের দাবি জানানো। যেহেতু বন্ধের দিন, তাই অনেকেই তাদের ছেলেমেয়ে নিয়েও বের হয়েছিল। উল্লেখ্য যে সে সময় নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা চাচ্ছিল, তাই তাদের এই দাবির সাথে স্বাধীনতার দাবিও প্রচ্ছন্নভাবে মিশে ছিল। তবে এই মুভমেন্ট ছিল শান্তিপূর্ণ এবং কারো কাছে কোন অস্ত্র ছিল না।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এই জনতার ঢলকে সাধারণ চোখে দেখতে ব্যর্থ হয়। তারা ভারি অস্ত্রে সজ্জিত বহর প্রেরণ করে জনতাকে রুখে দিতে। তাদের বাধার মুখে পড়ে জনতাও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর এক পর্যায়ে কিছু তরুণ সেনাবাহিনীর উপর ঢিল নিক্ষেপ করতে শুরু করলে সেনাবাহিনী ঢিলের জবাবে পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করে। সেদিনের এই বিশেষ ঘটনাগুলো টিভি মিডিয়ায় ধারণ করে রাখা আছে। সেখানে দেখা যায় নিরীহ মানুষ হাত তুলে জীবন ভিক্ষা চাচ্ছে অথচ তাদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। পরবর্তিতে প্রমাণিত হয় নিহতদের একজনের কাছেও অস্ত্র ছিল না। কীভাবে একেকজন মানুষ মারা গিয়েছিল সেটার বর্ণনা এখানে পাওয়া যাবে – ক্লিক করুন।
ব্লাডি সানডে আইরিশ সংস্কৃতিতে মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে ভাবে। ২০০২ সনে পল গ্রিনগ্রাস পরিচালিত ব্লাডি সানডে মুভিতে খুব নিরপেক্ষ ভাবে সেদিনের ঘটনাগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় আইরিশ রক ব্যান্ড U2-এর গাওয়া ব্লাডি সানডে গানটাও এ বিষয়ে রীতিমত “ঐতিহাসিক” খেতাব পেয়ে গিয়েছে। গানটার মিউজিক ভিডিওতে সেদিনের অনেকগুলো ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেয়া আছে। আগ্রহী পাঠক নিচের ভিডিও থেকে সেগুলো দেখতে পাবেন।
সুদীর্ঘ ৩৮ বছর নিহতরা কোন বিচার বা স্বীকৃতি পায় নি। যদিও সবাই জানতো তারা নিরীহ ছিল, কিন্তু “অফিশিয়ালি” তাদের কাঁধে সন্ত্রাসীর কলঙ্ক লেগে ছিল তিন যুগের বেশী সময় ধরে। তদন্ত চলতে থাকে বছরের পর বছর। এরপর ২০১০ সনের ১৫ জুন তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যেখানে জানানো হয় সেদিনের হত্যাকাণ্ডের সবাই ছিল অস্ত্রহীন এবং নিরীহ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পার্লামেন্টে তদন্তের রিপোর্টটা পড়ে শোনান এবং ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন (বিবিসির ভিডিও)। তবুও আফসোস, বৃটেনের মত একটা দেশে জাস্টিস আসতে সময় লাগলো ৩৮ বছর!
পুনশ্চ: ২০০৮ সনে ডেরী ভ্রমনে গিয়ে কিছু ছবি তুলেছিলাম। সেগুলো এই লিঙ্ক থেকে আগ্রহী পাঠক দেখতে পাবেন।
১৬ জুন, ২০১০
ডাবলিন, আয়াল্যান্ড।
মন্তব্য
Better late than never.
নিরপেক্ষ তদন্তে আসল সত্য বেরিয়ে এসেছে । ক্ষতি গ্রস্থরা কি ক্ষ তি পু রণ পে য়ে ছে ? জড়ি তরা কি বি চারে র মুখো মুখি হবে ? বৃটিশদের হাতে অনক রক্ত !
সুন্দর লেখা !
ওলি
oli
বিচারের বিষয়টি রিপোর্টে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে এই রিপোর্ট কোন আদালতের রায় নয়। তাই তারা কোন বিচার সুপারিশ করতে পারে না। তারা কেবল কী ঘটেছিল সেটাই বলছে। এখন দেখার বিষয় এর ফলে সামরিক কোন ট্রাইবুনাল হয় কিনা।
লেখাটা আপনার ভালো লাগায় খুশি হলাম। যদিও এখানে খুব সংক্ষেপে লিখেছি। ৩০ জানুয়ারি ২০১১ সনে "ব্লাডি সানডে" নিয়ে বড় পরিসরে এবং বিশ্লেষণ সহকারে পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে রয়েছে।
শুভেচ্ছা রইলো।
টুইটার
আপনার লেখার অপক্ষোয় রইলাম । কিন্তু, তারিখটা কি হবে ৩০ জুন ২০১১ ?
ধন্যবাদ
ওলি
oli
৩০ জানুয়ারী, অর্থাৎ সে দিন ঘটনাটা ঘটেছিল সেদিন লিখবো। ২০০৯ এবং ২০১০ সনে পর পর দুই বছর লিখতে বসে লেখা হয় নি। আশা করছি ২০১১তে লিখে ফেলবো।
টুইটার
ভালো লেখা।
সেদিন বিবিসি বাংলার নিউজে শুনলাম...
বিবিসি বাংলার নিউজে বিষয়টাকে কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল? অর্থাৎ তাদের প্রচারের ভঙ্গিটা কেমন ছিল?
শুভেচ্ছা রইলো।
টুইটার
লেখা ভালো লাগলো! বিশেষ করে ইউ টু এর গানটা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ!
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
টুইটার
খবরটা পেপারে পড়েই প্রথম মনে পড়েছিলো U2'র গানটার কথা ...
বৃটেনের মত একটা দেশে জাস্টিস আসতে সময় লাগলো ৩৮ বছর!
- হ্যাঁ তাই, আমরাও তাদের কাছ থেকে জাস্টিস পেতে অপেক্ষা করেছিলাম প্রায় ২০০টি বছর ... ... ...
===============================================
ভাষা হোক উন্মুক্ত
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
যথার্থ বলেছেন। (থাম্বস আপ)
টুইটার
ভাল লাগল লেখাটা। তবে একটা সংশধোনী আছে, প্রথম লাইনে সম্ভবত টাইপোর কারণে ১০ জানুয়ারী ৩০ জানুয়ারী হয়ে গেছে। একটু চেক করে দেখুন।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
আমি দুঃখিত। দিন দুটো আসলে এক নয়। বিষয়টা লেখার সময় নজর এড়িয়ে গিয়েছে। সংশোধন করিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা রইলো।
টুইটার
ব্লাডি সানডের ক্ষমা প্রার্থনায় আমার কাছে একটি বিষয় সবচেয়ে অনুকরণীয় মনে হয়েছে। এই যে সত্য উদঘাটনের একটা সুস্থ্য মানষিকতা আর দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইবার প্রবনতা যে এটি যে কোন দেশের জন্য অত্যন্ত সুসংবাদ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
এই প্রবণতাটা সবার মাঝে জন্মানো উচিত। ক্ষমা স্বীকার করলে যে কেউ ছোট হয়ে যায় না, সেটা অনেকেই বোঝে না। ৭১'এর জন্যে আজও ক্ষমা চাইতে পাকিস্থানের বাঁধে। অথচ তাদের অপরাধের ক্ষমা আরো অনেক আগেই চাওয়া উচিত ছিল।
টুইটার
লেখা ভালো লেগেছে...গানটার জন্যও ধন্যবাদ।
++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আপনাকেও অনেক শুভেচ্ছা।
টুইটার
চমৎকার লিখেছেন.. ধন্যবাদ
______________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ
শুভেচ্ছা রইলো।
টুইটার
অথচ আমরা এখনো একাত্তরের গণহত্যার জন্য...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজরুল ভাই, ক্ষমা চাওয়ার জন্যে একটা উদার মানসিকতার প্রয়োজন। পাকিস্থানের সেটাও নেই। ক্ষমা চাওয়া এখন আর তাদের থেকে প্রত্যাশা করি না। শুধু একটা চাওয়া মনে, যদি কোন দিন অন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচার করা যেত!
টুইটার
আপনার লেখাটি খুব ভালো লাগলো। এধরনের ঘটনা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, সময় গেলেও সত্য উন্মোচন দরকার।
"বৃটেনের মত একটা দেশে" এভাবে ৪০-৫০ বছর পর পর পূর্বের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া একটা স্বাভাবিক বিষয়। এরা আজকের অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত না হয়ে, চার-পাঁচ যুগ আগের কিছু একটা নিয়ে ক্ষমা চায়... কিন্তু আগামী চার-পাঁচ যুগ পর ক্ষমা চাইতে হবে, এমন কাজ বর্তমানে ঠিকই চালিয়ে যায়।
কিছুদিন আগেই তো ব্রিটেন তাদের ভুলে যাওয়া প্রজন্মের কাছে ক্ষমা চাইলো। ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পযর্ন্ত সময়ে প্রায় পাঁচ লক্ষ দরিদ্র মানুষকে ব্রিটেন জোর করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিভিন্ন কলোনীতে পাঠিয়েছে-- যাদের অনেকের বয়সই ছিল ছয় থেকে পনের বছর। এইসব শিশু অস্ট্রলিয়া বা কানাডার পালক-পরিবারে ভালো থাকবে, এটাই ছিল তাদের কথিত উদ্দেশ্য। কিন্তু ঐ পঞ্চাশ বছরেও ব্রিটেন তদন্ত করে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি যে পরিবার ছেড়ে আসা শিশুগুলো পালক-পরিবারের হাতে নিয়মিত কী অমানুষিক শারীরিক আর মানষিক নিপীড়ন সহ্য করেছে। এদের জীবন ছিল ক্রীতদাস=ক্রীতদাসীর চেয়েও ভয়াবহ। চল্লিশ বছর পর ব্রিটেন দু:খিত!
অস্ট্রেলিয়াও অনুরূপ ব্যবহারের জন্য আদীবাসীদের নিকট ক্ষমা প্রার্থী। এটা হলো একটা অন্যায়-ক্ষমা-অন্যায় চক্র।
-----------
"সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে"
-----------
চর্যাপদ
মন্তব্যে একমত। মূললেখার জন্য লেখককেও ধন্যবাদ।
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
নতুন মন্তব্য করুন