প্রকৃতির যন্ত্রণার পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে গত কয়েক মাস। আমি কম্পিউটার বিজ্ঞানে M.Sc করছিলাম ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিন-থেকে। দুই বছরের পরিশ্রমকে দুই মলাটে আবদ্ধ করে গত অক্টোবরে থিসিস জমা দেই রিভিউর জন্যে। এরপর প্রতিক্ষার পালা শুরু হয় ভাইভার তারিখের। কিন্তু হায়, সেদিন আর আসে না। শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গ্রাজুয়েট স্ট্যাডিজ জানায় আমার থিসিস মাত্র রিভিউ করতে ইন্টারনাল এবং এক্সটারনাল এক্জামিনারের কাছে পাঠানো হয়েছে! পরবর্তীতে তাঁরা সেটা রিভিউ শেষ করে মে-এর শেষের দিকে ডিপার্টমেন্টে ভাইভার তারিখ চেয়ে পাঠান। কিন্তু ততদিনে বিশ্বকাপ আর সামারে বেড়ানোর আয়োজনে সবাই এতই ব্যস্ত যে দুই এক্জামিনার, চেয়ার এবং আমার সুপারভাইজারকে একই সময় উপস্থিত করা যায় এমন তারিখ পাওয়া গেলো না ২১ জুলাই-এর আগে। মনে মনে ভাবলাম দেরি যখন হয়েছে তখন আরেকটু হোক। বিশ্বকাপটা শেষ করে তবেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম ভাইভার জন্যে। ইতিমধ্যে ইন্টারনাল এক্জামিনার আমার সুপারভাইজারকে জানালো আমি যেন প্রেজেন্টেশন তৈরি না করি। তারা সরাসরি প্রশ্ন-উত্তর পর্বে চলে যেতে চান। বিষয়টা নিতান্তই উদ্ভট লাগলো আমার। তবে সুপারভাইজার বলল এক্জামিনারদের ঘাটানোর দরকার নেই। যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই হোক।
ভাইভার দিন ভয়ে ভয়ে গিয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সেমিনার হলে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ইন্টারনাল এক্জামিনার এলো। হাই-হ্যালোর পর সে আমাকে টেবিলগুলোকে “ফ্রেইন্ডলী ওয়ে”-তে সাজাতে তাকে সাহায্য করতে বলল। আমি উঠে যেই হাত লাগালাম, দেখি সে চোখদুটো গোল গোল করে কী যেন দেখছে বাইরে। তারপর ছুটে বাইরে চলে গেলো এবং একটু পরই ফিরে এসে আমাকে বলল, “তোমার ভাইভার দারুণ সূচনা হয়েছে। এটা ভুল কক্ষ”। তার বলার ধরণ দেখেই আমার আত্মা শুকিয়ে গেলো। সেমিনার হলের পাশেই ছিল কনফারেন্স রুম। ওখানে চেয়ার, এক্সটারনাল এবং আমার সুপারভাইজার অপেক্ষা করছিল। আমি এতটাই নার্ভাস ছিলাম যে লক্ষ্যই করি নি তারা কখন হেঁটে ওখানে গিয়েছে।
তখনও দশটা বাজে নি, তাই দুই এক্জামিনার সিগারেট খেতে বাইরে যায়। আমার সুপাইভাইজার খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। এই ফাঁকে সে দৌড় দিয়ে সবার জন্যে প্লাস্টিকের গ্লাস এবং মিনারেল ওয়াটার কিনে নিয়ে আসে। এরকম সময় চেয়ার আমাকে বলে আমি যেন প্রেজেন্টেশন সহ প্রস্তুত হতে শুরু করি। আমি একটু অস্বস্তির সাথে জানালাম আমার কাছে কোন প্রেজেন্টেশন নেই। চেয়ারের চোখ গোল হয়ে গেল। সাথে সাথে আমার সুপারভাইজার ব্যাকআপ দিয়ে বলে, “এক্জামিনাররা জানিয়েছে কোন প্রেজেন্টেশন না আনতে”। দেখা গেলো চেয়ারের চোখ আবার স্বাভাবিক হলো। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ঠিক দশটার সময় চেয়ার ঘোষণা করলো দুপুর চারটা পর্যন্ত রুম বুকিং দেয়া আছে। একটার সময় বিরতী নেয়া হবে। ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে সবার জন্যে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরপর চাইলে আবার ভাইভা চলতে পারে। এই কথা শুনে প্রথমবারের মত আমার শীরদাড় বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো। মনে হলো যেন আজ আমি শহীদ হতে চলেছি!
দুই এক্জামিনারের হাতে স্পাইরাল বাউন্ডিং করা আমার থিসিস। আমার হাতে একটা। চেয়ারের ল্যাপটপে PDF সংস্করণ খোলা। আমরা মুখোমুখি বসা। আমার সুপারভাইজার আমার পাশে বসা। তারপর শুরু হলো ভাইভা। পরবর্তী ২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট প্রশ্নবাণে ভেসে গেলাম। তিনটা প্রশ্নে উত্তর আমি দিতে পারি নি – এক. TCP ফাস্ট রিট্রান্সমিশনে যাওয়ার আগে কেন ঠিক তিনটা ডুপ্লিকেট এ্যাক পর্যন্ত অপেক্ষা করে (দুইটা বা চারটা নয়, কেন ঠিক তিনটা!)? দুই. শুধু IEEE 802.11-এ না, ইথারনেটেও নাকি ইন্টারফিয়ারেন্স হয়ে থাকে। এটা কী ধরণের ইন্টারফিয়ারেন্স এবং সেটা কেন হয়? তিন. TCP-এর রিট্রান্সমিশন টাইমার ক্যালকুলেশনে জ্যাকবসনের ইকুয়েশনের ভেরিয়েন্স ব্যবহার করা একটা ভার্সন আছে। সেই ইকুয়েশনটা কী? (এই ইকুয়েশনটা আমি অনেকবার পড়েছি। কিন্তু কোনদিন হুবহু মুখস্ত করার চেষ্টা করি নি)। যাইহোক, এই তিনটা প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করেছিলাম কিন্তু এক সময় দেখি সুবিধা করতে পারছি না। তাই “আমি উত্তর জানি না” বলে হার স্বীকার করে নেই। এগুলো ছাড়া অন্য প্রায় সব উত্তরেই এক্জামিনাররা খুশি হয়। তাদের কিছুকিছু সমালোচনা আমি বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নেই। এক সময় শেষ হয় ভাইভা। কিছু ছবি এবং লেখালেখীর কারেশন সাপেক্ষে তারা থিসিস এ্যাকসেপ্ট করে। আমিও নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচি – ১০টায় শুরু হওয়া ভাইভা শেষ হয় ১২টা ৩৮ মিনিটে। ৪টা পর্যন্ত যে চলে নাই তাতেই আমি ব্যাপক খুশি। আমার সুপারভাইজার গুটিগুটি অক্ষরে ১২ পৃষ্ঠা (৬ পাতার এদিক-ওদিক) নোট তুলেছেন। এছাড়া দুই এক্জামিনার মেইল করে এবং ফরমাল ভাবে তাদের কমেন্ট এবং কারেশনের রিকম্যান্ডেশন পাঠিয়েছেন পরে সপ্তাহেই। এখন আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কারেশকনগুলো করে, এক্জামিনারদের দেখিয়ে থিসিসের হার্ড কপি জমা দিলে তবেই নামের পরে M.Sc (Computer Science), Trinity College Dublin লেখার যোগ্যতা অর্জন করবো।
(অফটপিক: এই লেখা যখন শুরু করেছিলাম, তখন বাইরে বেশ ঝকঝকে আবহাওয়া ছিল। কিন্তু এখন ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। হায়রে আইরিশ ওয়েদার!)
অনেক টেকনিকাল কথা-বার্তা লিখে পাতা ভরিয়ে ফেলেছি। এবার একটু অবেগের কথায় আসি। আমি এখন যেই বাসায় থাকি সেটা ভাড়া নিয়েছি একবছর আগে, গত সামারে। প্রথম যখন বাসা দেখতে আসি তখন এক বৃদ্ধের সাথে আমার পরিচয় হয়। ঠিক পাশের বাসায় থাকেন। একাকী জীবন কাটান। একটা কুকুর আছে - লেইডী। সেই তাঁর জীবনের একমাত্র বন্ধু। প্রথম দিনই আমি লক্ষ্য করি বৃদ্ধের বয়স অনেক হলেও বেশ শক্ত সমর্থ। তারপর এই বাসায় উঠে আসার পর থেকে তার সাথে আমার সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাগান করা, লেইডীর সাথে খেলা আর প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করাই তার কাজ। মাঝেমাঝেই আমি জিজ্ঞেস করতাম, “স্যার কেমন আছেন? কেমন কাটছে জীবন?” ইত্যাদি। কুকুর আমি খুব ভয় পাই। কিন্তু তাঁর কুকুর লেইডীর সাথে আমার দারুণ সখ্যতা। লেইডীও আমাকে বেশ পছন্দ করে। এভাবে কেটে যায় একটা বছর। ভাইভার কারণে আমি কিছুদিন ব্যস্ত থাকায় তার সাথে কথা হয় নি। গতকাল হঠাৎ শুনি আগের রাতে তিনি মারা গিয়েছেন। অনুভূতিটা কেমন হলো ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। বিকেলের মধ্যে আত্মিয়রা সব জড়ো হতে শুরু করলো। যার বাড়ির লনটা সব সময় ফাঁকা থাকতো, সেখানটা লোকে লোকারণ্য। সবার কালো পোষাক। লাশের গাড়ি এলো পড়ন্ত বিকেলে। সেটায় চড়ে মি. প্যাট চলে গেলেন। আর কোন দিন তিনি ফিরে আসবেন না।
এখনও তাঁর বাড়ির সামনে অনেক অনেক গাড়ি। একটু আগে বৃষ্টি ভেঙ্গে সবাই কোথা থেকে যেন ফিরে এলো। গাড়ি থেকে ফুল নামালো। হয়তো শেষকৃত্যের পরও আজ আবার কোন অনুষ্ঠান ছিল, সেখান থেকেই ফিরলো। নাতি-নাতনীরা হাইস্কুল-কলেজ পড়ুয়া। ওরা খিলখিল করে হাসছে আর গল্প করছে। এক তরুনীকে কাঁদতে দেখলাম। বয়ফ্রেন্ড বা হাসবেন্ড ধরণের কেউ মাথায় ছাতা ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। অদ্ভুত লাগছে বাড়িটাকে। বেঁচে থাকতে যার বাড়িতে কোন মানুষ দেখি নি, আজ তার ঘরে জনতার ভীড়! লেইডীকে দেখলাম একটু আগে। অসহায়ের মত রাস্তায় আর মাঠে হাটছে। এখন লেইডীর সাথে কে খেলবে? কে বল ছুড়ে দেবে আর সেটা লেইডী ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গিয়ে মুখে করে নিয়ে আসবে? জীবনটা খুব অদ্ভুত। খুব অল্প সময়েই বদলে যায় সবকিছু।
মন খারাপ লাগছে খুব। চারদিকে কেমন যেন অবসাদ। কয়েকজন মিলে ঠিক করেছি সবকিছু থেকে একটা ব্রেক নেব। অগাস্টের ২ তারিখ সোমবার “অগাস্ট ব্যাঙ্ক হলি ডে”। ফলে পরিকল্পনা করেছি আগামীকাল যাবো আয়ারল্যান্ডের উল্টা দিকে রিং অব কেরি এবং ডিঙ্গেল দেখতে। ডিঙ্গেল হচ্ছে ইউরোপের একদম পশ্চিমতম সীমানা (দূরের দ্বীপ আইসল্যান্ডকে বাদ দিলে)। এরপর উন্মুক্ত আটলান্টিক মহাসাগর; যার পর আবার পাড়ের দেখা পাওয়া যায় ক্যানাডার নিউফাওন্ডল্যান্ডে।
জীবনটা অনেক ভারী লাগে ইদানিং। একে হালকা করা দরকার। ডিঙ্গেলের সেই সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে কিছু সঞ্জীবনী শক্তি নিয়ে আসবো ভাবাছি, যা দিয়ে আগামী কিছু দিন চলার শক্তি পাবো হয়তো।
ডাবলিনের ডায়েরী সিরিজ - এখানে রয়েছে আগের পর্বগুলো
মন্তব্য
লেইডীর জন্য খারাপ লাগলো।
...........................
Every Picture Tells a Story
আজ বিকেলে দেখলাম একজন তার দুটো কুকুরকে নিয়ে খেলছিল। লেইডী গিয়ে তাদের সাথে মিশে খেলছে। দেখে মনটা আরো খারাপ হলো।
টুইটার
পরীক্ষা খারাপ জিনিস বড় ...
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
একদম সত্যি কথা। যে কোন ধরণের পরীক্ষা এলেই আমি চরম নার্ভাস হয়ে পড়ি। শেষে দেখা যায় পারা জিনিসও ভুল করে আসি!
টুইটার
আপনি ডাবলিন কী করেন?
লন্ডন চলে আসেন...
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
লন্ডন থেকে PhD করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কোথাও স্কলারশীপ পেলাম না। ইমপেরিয়ালে ইলেক্ট্রিকালের প্রফেসার কিন-এর আন্ডারে হোম রেটে একটা ফান্ড পেয়েছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রোজেক্টটাই আর শুরু হয় নি। আমি যেখানে যাই সেখানেই সম্ভবত নদী শুকিয়ে যায়!
টুইটার
নতুন মন্তব্য করুন