আজ সকালটা কেমন যেন এলোমেলো। রোববার। তেমন কোন কাজ নেই। শুয়ে-বসে-স্কাইপে কথা বলেই কাটানো। একটু আগে শাওয়ার নিয়ে এসে ল্যাপটপের সামনে বসতেই বন্ধু দিবসের পোস্টগুলো চোখে পড়লো ফেইসবুকে। সাথে সাথে সা. ইন ব্লগ থেকে ২০০৮ সনের এই লেখাটা বের করে পড়লাম। তারপর কিছু সময় চুপচাপ বসে রইলাম। কেমন যেন স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলাম।
ডায়েরী লেখা হয় না কত দিন! আসলে কিছুই লেখা হয় না। অথচ এক সময় কত লিখতাম। আয়ারল্যান্ড আসার পর আমার ব্লগ লেখা শুরু। একাকিত্ব থেকে মূলতঃ সূচনা। লিখতাম, নিজের কথা। ঘটে যাওয়া ঘটনা। মজার কিছু। জীবনটা অন্যরকম ছিল তখন। একটা অন্যরকম আবেগ, অন্য চোখে পৃথিবীকে দেখা। তারপর ধীরেধীরে পাশ্চাত্যের সভ্যতায় মিশে যাওয়া এবং এক সময় যাযাবরের বলা সেই কালজয়ী কথাটাই সত্য হলো। আবেগের স্থলে কেবল বেগকে খুঁজে পেলাম। ছোটা, জীবনের পেছনে ছোটা। অহর্নিশ দৌড়াতে লাগলাম। মাস্টার্সের পড়াশোনা, পিহেইচডি'র আবেদন, রিজেকশন, আবেদন, আবার রিজেকশন, থিসিস সাবমিশন, ভাইভা, আবার পিহেইচডি'র আবেদন, স্কলারশিপ পাওয়া....। আমি দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছিই। হঠাৎ আজ সকালে থমকে দাঁড়ালাম। তারপর লক্ষ্য করলাম জীবন থেকে চারটি বছর হারিয়ে গিয়েছে। ২০০৮ সনে লিখেছিলাম “নয় মাস হয়ে গিয়েছে অথচ মনে হচ্ছে এইতো সেদিন এসেছি”। আজ তিন বছর নয় মাস পর মনে হচ্ছে আমি যেন চার শতাব্দী পার করে এসেছি!
বিদায়ের ঘণ্টা শুনতে পাই বাতাসে। মনটা কেমন যেন করে। শহরটার প্রতি একটা মায়া পড়ে গিয়েছে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যাই অফিসে যাবার উদ্দেশ্যে। ট্রামগুলো আমার পাশ দিয়ে অলস শরীর নিয়ে বিকট শব্দে চলে যায়। আমি হাঁটতে থাকি। তাকিয়ে দেখি দোকানগুলো তখনও পুরোপুরি খোলে নি। কিছু খুলেছে। কিছু আধ খোলা; আবার কিছু তালাবদ্ধ। দৃশ্যটা অদ্ভুত সুন্দর। জীবনে কখনও মুভি বানালে এই ডাবলিন শহরে শুটিং করবো অবধারিত এবং তখন আমার দেখা এই সকালগুলোকে গল্পে তুলে ধরবো। লিফি নদীর উপরের একেকটা ব্রিজ, ও'কনেল স্ট্রিটের স্পায়ার, ডাবলিন বাস, মেট্রো রেইল ডার্ট – সবকিছু আমাকে টেনে ধরে তাদের সাথে আমার জড়িয়ে থাকা স্মৃতি দিয়ে। তবুও আমি মনকে শক্ত করে বলি, আমায় যেতে হবে। অনেক অনেক দূরে কেউ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। তার প্রতিক্ষাকে আমি আর দীর্ঘতা দিতে চাই না।
এই আয়ারল্যান্ডে আসার পেছনে আমার একটা প্রেমের সম্পর্ক আছে। ২০০৭ সনে উইকিপিডিয়াতে কাজ করতে গিয়ে আমি ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের আর্টিকেলটা দেখতে পাই। তারপর গুগল ঘেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটা দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধে হয়ে যাই। প্রথম দর্শনে প্রেম যাকে বলে ঠিক তাই। সাথে সাথে আমি নিজেকে বলি আমি এখানে পড়তে চাই। তারপর আবেদন করা, স্কলারশিপ পাওয়া এবং পড়তে আসা। সব যেন স্বপ্নের মত একে একে সত্য হয়ে গেলো। প্রথম যেদিন আমি এসে ক্যাম্পাসের সামনে বাস থেকে নামি, তখন ভোর সাড়ে ছয়টার মত বাজে। অন্ধকার চারদিকে। সেই অন্ধকারে আমি ট্রিনিটির ফ্রন্ট গেইটে দাঁড়িয়ে অন্য রকম একটা অনুভূতি পেয়েছিলাম। অনেকটা যেন লং ডিসটেন্স রিলেশনের পর প্রেমিকার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার মত। তারপর ধীরেধীরে মিশে গেলাম এই ক্যাম্পাসে। চোখের সামনে প্রকৃতির রং বদলাতে লাগলো। শীত গিয়ে বসন্ত এলো। রঙে রঙে রঙ্গিন হয়ে উঠলো ট্রিনিটি। তারপর এলো সামার। তারপর আবার কনকনে শীত এবং স্নো। একেকবার ট্রিনিটিকে একেক রকম লাগতো। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসে ক্যাম্পাসটা দেখতে। সম্প্রতি ফ্রোবস ম্যাগাজিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে তারা বিশ্বের সুন্দর ক্যাম্পাসগুলোর একটা তালিকা করেছে। সেখানে ট্রিনিটি এসেছে ৬ষ্ঠ।
ট্রিনিটি বিষয়ক আরেকটা বিষয় এখানে লিখে রাখি। গত সপ্তাহে একটা মেইল পেলাম আমাদের কলেজ ইমেইল-এ। তারা জানালো, ইয়াশরাজ ফিল্ম স্যুটিং-এ আসবে ডাবলিনে। তাদের মূল স্যুটিং স্পট ট্রিনিটি। সালমান খান এবং ক্যাথরিনা কাইফ ট্রিনিটির ছাত্রছাত্রী হিসেবে “এক থা টাইগার” মুভিতে অভিনয় করবে। ছবির স্যুটিং করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এক শর্তে। সালমান-ক্যাথরিনাকে ট্রিনিটির ওরিয়েন্টেশনে অংশ নিতে হবে এবং কিছু ক্লাস করতে হবে (অন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্যে পরিচিতি মূলক ক্লাস)। কিন্তু আফসোস, ট্রিনিটির পরবর্তী ওরিয়েন্টেশন হবার ঠিক আগের সপ্তাহেই আমি আয়ারল্যান্ড ছেড়ে চলে যাবো। হয়তো শেষ পর্যন্ত মুভিতেই দেখতে হবে ওদের। কাবুল এক্সপ্রেস, নিউ ইয়র্ক ইত্যাদি মুভির ডায়রেক্টর কবির খানের মুভি। আশা করছি হাস্যকর একটা বলিউড ফিল্ম হবে না শেষ পর্যন্ত।
রোজা চলছে এখন ইউরোপে। ১৮ ঘণ্টার রোজা। রীতিমত প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। নিয়মিত রোজা করতাম না তাই। তবে এবার রোজা রাখতে শুরু করলাম এবং একটা দুর্দান্ত রেকর্ড গড়ে ফেললাম। ইফতার হয় রাত নয়টা বিশের কাছাকাছি সময়। তাই ডিনারের আর প্রয়োজন পড়ে না। একবারে রাত তিনটায় সেহেরী খেয়ে ফেলি। একদিন রাতে সেহেরীতে খাবার জন্যে গরুর মাংশ, ভাত ইত্যাদি রেডি করে রেখে ঘুমোতে গেলাম। গরুর মাংসগুলো দেখতে খুব সুস্বাদু লাগছিল। মনেমনে তাদের দেখে কল্পনা করে নিয়েছিলাম কী করে ভোররাতে তাদের চর্বণ করবো! কিন্তু হায়। মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় আর এ্যালার্ম বাজে নি। ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি কটকটে রোদ। বিরস বদনে কিচেনে গিয়ে দেখি মাংসগুলো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সাথে সাথে জেদ চেপে গেলো। নিজেকে বললাম আজ ২৪ ঘণ্টার রোজা রাখবো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। এক ইফতার থেকে আরেক ইফতার পর্যন্ত কিছু না খেয়ে আমি দিব্যি দিন পার করে দিলাম। অবাক করা হলেও সত্য, তেমন কষ্ট হয় নি। পরদিন যখন সেহেরীর সময় এ্যালার্ম বাজলো, তখন আর উঠতে ইচ্ছে করছিল না। ফলে আবার একটা ২৪ ঘণ্টার রোজা রাখলাম। কিন্তু এর পরই বঙ্গদেশ থেকে আমার প্রিয়তমার হুঙ্কার শুনতে পেলাম, “তুমি যদি আরেকবার এই কাজ করো, তাহলে কিন্তু আমিও ২৪ ঘণ্টার রোজা রাখা শুরু করবো।” অতঃপর ব্যাক টু রেগুলার রুটিন। সেহেরী খেয়ে রোজা রাখা শুরু।
আজ তথাকথিত বন্ধু দিবস। সবাই একে অপরকে উইশ করছে। দেখতে ভালই লাগে, কিন্তু আমার একটা ছোট্ট সমস্যা আছে। আমি বাবা-মা-ভালোবাসা-বন্ধুত্বকে দিবসের মধ্যে আটকে ফেলাকে সমর্থন করতে পারি না। আমার কাছে এই দিবসগুলো নিতান্তই মিডিয়া এবং কর্পোরেটদের সৃষ্টি মনে হয়। একবার চিন্তা করুন, আপনার এবং আপনার বন্ধুদের পাঠানো টেক্সট ম্যাসেজ থেকে বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের কাল কত টাকা অতিরিক্ত মুনাফা হয়েছে। হল-মার্ক এবং আর্চিজের কতগুলো কার্ড বিক্রি হচ্ছে। পিজ্জাহাট বা কেএফসিতে কতগুলো অর্ডার অতিরিক্ত পড়েছে! অথচ এই একদিনের উইশে কি আপনি বন্ধুত্বকে অনেক মহান করে ফেললেন? ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলের ড্যান্স ফ্লোর মাতিয়ে এসে কি ভালোবাসাকে অমরত্ব দিলেন? নাহ, কোনটাই না। এই দিবসগুলো বন্ধু বা ভালোবাসা দিবস বটে, তবে সেটা আপনার আমার পকেটের সাথে কর্পোরেটদের একাউন্টের ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসাও আবার এক তরফা। আমাদের পকেট থেকে টাকাটা তাদের একাউন্টে যাওয়া। তাদের থেকে আমরা কিছুই পাবো না। পিজ্জা হাট বলবে না বন্ধু দিবসে যত পিজ্জা খাও সব ফ্রি কিম্বা গ্রামিনফোন বলবে না এই দিনে তোমার বন্ধুকে যত ফোন করো সব কল ফ্রি। একুশ শতকের চরিত্রহীন মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে তারা আপনাকে আমাকে নাচাবে এবং দিন শেষ আমাদের নিঃস্ব করে ছেড়ে দিবে। আসুন, তাদের কথায় কান না দিয়ে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে আমরা স্থান দেই সবার উপরে এবং ৩৬৫ দিন।
৭ অগাস্ট ২০১১
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
মন্তব্য
স্লট নিয়ে রাখলাম। পরে এসে কমেন্ট করব
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম।
টুইটার
শেষ প্যারাটার সাথে দারুণ সহমত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
হ্যা, ৩৬৫ দিন। আমার কাছেও তাই মনে হয়, অবাক ব্যাপার আমি মনে হয় ৩০ মিনিট আগে ফেইসবুকে এইরকম একটা ষ্ট্যাটাস দিয়েছি। মিলে গেছে লেখা চলুক
লেখাটা দারুণ লাগলো
শেষ প্যারাটার জন্য
ডাবলিন খুব যেতে ইচ্ছে করে, ট্রামে ঘুরতে ঘুরতে সারা দিন জয়েস আর ইয়েটস পড়ার জন্য হলেও আসছি খুব তাড়াতাড়ি---
facebook
অনেক ভালো লাগলো। কেমন যেন মিশে যাচ্ছিলাম লেখার সঙ্গে!
ডায়েরীর আগের পাতাগুলো চোখ বুলানোর লোভ সংবরন করতে পারছি না; কিন্তু সকালে অফিস, ঘুমাতে যেতে হবে।
নিশ্চিত অনেকগুলো পর্ব পড়ব কালকে, পড়বই।
ভালো থাকবেন।
আপনার প্রিয় মানুষের হুঙ্কারে বেশ মজা পাইছি। তবে একটু আপ্সুসও লাগছে। আমারে তো কেউ অদ্যবধি আমি যেই যেই আকামগুলা করি, সেগুলা করার হুমকি দিলো না! অবশ্য, আমি যে পাবলিক সুবিধার না, এইটা মনেহয় আমার খোমার মধ্যেই খোদাই করা আছে। চব্বিশ ঘন্টা রোযার হুমকি দিলে যদি আবার কয়া বসি, "আইচ্ছা, রাখ গিয়া মাতারি। কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করিস না!"
যান গা, এইসব ইহূদি নাছারার দেশে থাকা ভালো না। গরমের দিনে ঈমান আকিদা নিয়া চলার অবস্থা রাখছে এরা আমাগো মতোন মুমিন বান্দাদের জন্য!
একটা গান শোনেন, বহুকাল আগের যদিও, তাও ভালো লাগবে আশা করা যায়...
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নিউ ইয়র্ক বেশ হাস্যকরই ছিল, শেষটা... :|
তবে মার্কেটিং স্কিমের সাথে একমত। প্রতিবছর তাই সিমিলার ফেসবুক স্ট্যাটাস যায়, এবার আর দেইই নাই, শ্বাস বন্ধ করে কি ৩৬৫ বাঁচা যায়? তাহলে বন্ধুত্ব ছাড়াও বাঁচা যাবে হয়তো, না হলে রবিনসন ক্রুসোর মত নির্জন দ্বীপে আটকা পড়তে হবে... হুদাই সব 'বিশেষ' দিন পালন।
ডাবলিন ছেড়ে দেশে আসছেন? সেখানে দিনগুলো আর এখানের ভবিষ্যত দিনগুলো আনন্দের হোক। ভালো থাকুন।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
রোজা রাখা কঠিন, খুব কঠিন।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
চমৎকার লাগলো পড়তে। শেষ প্যারায় তীব্র সহমত।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
বন্ধুত্ব আসলেই ৩৬৫ দিনের বিষয়....................
_____________________
Give Her Freedom!
আমি তো টানা তিনঘন্টা না খেয়ে থাকতে পারি না... যারা রোজা রাখে তাদের দিকেই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। আর ২৪ ঘন্টা! ভাইরে, মরে যাবো একেবারে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজরুল ভাই, আপনে ঘুমান না, নাকি মাত্র তিনঘণ্টা ঘুমান?
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
কোন এক শহরে বেশিদিন থাকলে এমনিতেই সেটার উপরে মায়া পরে যায় আর তার উপর যদি সেটা ছবির মত সুন্দর হয় তাহলেতো কথাই নেই।
আমিও রাখতেছি প্রায় ২৪ ঘন্টার রোজা, খুব বেশি কষ্ট অবশ্য হচ্ছে না।
বন্ধু দিবস অথবা আরো যেসব দিবস আছে সেটা নিয়া আমারো একই মত।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
নতুন মন্তব্য করুন