স্বল্প দূরত্বের দৌড় যেমন জনপ্রিয়, তেমনই লম্বা দূরত্বের দৌড়েরও একটা অন্যরকম আবেদন আছে। এই দৌড়ে শুধু ক্ষিপ্রতা থাকলেই চলে না। সাথে থাকতে হয় স্ট্র্যাটেজি। ৫০০০ এবং ১০০০০ মিটার দুটো দৌড়ের বিশ্বরেকর্ড, অলিম্পিক রেকর্ড, ২০১২ রেকর্ড কোন কিছুতেই নাম ছিল না ব্রিটেনের মোহাম্মদ ফারাহর। এ দৌড়গুলোতে মূলত ইথিওপিয়া এবং কেনিয়া রাজত্ব করে। কিন্তু এবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই ব্রিটিশ জিতে নেয় এ দুটো সোনা। তবে ম্যারাথনটা এখনও আফ্রিকানদের দখলে আছে। কিন্তু কতদিন থাকে কে জানে। মো ফারাহ ইতিমধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ম্যারাথনের জন্যে। ঘোষণা দিয়েছে, আগামীতে ৫০০০ ও ১০০০০ এর সাথে ম্যারাথনেরও দৌড়াবে সে!
(বিবিসির সৌজন্যে বোল্ট এবং মো ফারাহকে মেডেল সহ এক সাথে নাচতে দেখতে পাবেন এই ভিডিওতে।)
অলিম্পিকের আরেকটা খুব আকর্ষণীয় ইভেন্ট রয়েছে; তা হলো বক্সিং। এবার বক্সিং থেকে সবচেয়ে বেশি সোনা জিতেছে ব্রিটেন – তিনটা। এছাড়া ইউক্রেন এবং কিউবা জিতেছে ২টা করে সোনা। ছেলেদের দশটা ইভেন্টের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট হচ্ছে সুপার হেভিওয়েট। এটার ফাইনালে লড়ছিল ব্রিটেনের এন্টোনি জশোয়া এবং ইটালির রবার্টো ক্যামারেলে। মূলতঃ প্রথম দুই রাউন্ডেই রবার্টো ফাইটটা শেষ করে দিয়েছিল ৬-৫ এবং ৭-৫ এ জিতে। জশোয়াকে বেশ নার্ভাস লাগছিল তখন। শেষ রাউন্ডে যখন রবার্টো শুধু টিকে থাকলেই হয়, এমন অবস্থা; তখন জশোয়া হয়ে উঠলো উন্মাদ। জশোয়া বুঝে গিয়েছিল মার খেলে খাবে, কিন্তু ওকে মারতে হবে। প্রয়োজনে দেখে অথবা না দেখে। লাইভ না দেখলে লিখে বোঝানো সম্ভব না সেই রাউন্ডটা কেমন ছিল। তারপর ফল ঘোষণায় এলো দুর্দান্ত সংবাদ। শেষ রাউন্ডে জশোয়া ৮-৫ এ হারিয়েছে রবার্টোকে। ফলে দুজনেরই পয়েন্ট সমান হয় ১৮-১৮ কিন্তু বিচারকদের রায়ে সেরা নির্বাচিত হয়ে জশোয়া জিতে নেয় সোনা। এছাড়া ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের তিনটা ইভেন্ট ছিল বক্সিং-এ। সেখানে ফ্লাইওয়েটে ব্রিটেনের নিকোলা এ্যাডামস, লাইটওয়েটে আয়ারল্যান্ডের কেটি টেইলর এবং মিডলওয়েটে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ল্যারেসা শিল্ডস সোনা জেতে।
(জশোয়ার শেষ রাউন্ডের কিছু পাঞ্চ দেখতে পারবেন বিবিসির সৌজন্যে এখানে প্রথম ভিডিওতে।)
অলিম্পিকে বিভিন্ন খেলার মাঝে একটা খেলা – যা কিনা নিজে কোন খেলাই নয় বরং কয়েকটা খেলার সমন্বিত রূপ – হচ্ছে মডার্ন পেন্ট্যাথলন। নাম শুনেই অনেকে হয়তো বুঝতে পারছেন যে এটা ‘পাঁচ খেলার সমাহার’। গ্রীক ‘পেন্টা’ অর্থ পাঁচ এবং ‘এ্যথলন’ অর্থ ইভেন্ট। প্রাচীনকালে সৈন্যদের জন্যে এই খেলার প্রচলণ করা হয়েছিল যা কালক্রমে আধুনিক হয়েছে। বর্তমানে যে পাঁচটা ইভেন্ট রয়েছে তা হলো – ২০০ মিটার সাতার, ৩ কিলোমিটার দৌড়, ফেন্সিং, পিস্তল স্যুটিং এবং রাইডিং। মজার ব্যাপার, এই অলিম্পিকেই প্রতিটা ইভেন্ট আলাদা আলাদা ভাবে রয়েছে। কিন্তু পেন্ট্যাথলনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এখানে প্রতিটা খেলায় একজনকেই সেরা হতে হবে। ছেলেদের ইভেন্টে চেক রিপাবলিকের ডেভিড সভোবোডা সোনা জিতেছে। প্রথম ইভেন্ট ছিল ফেন্সিং যেখানে ডেভিড সবচেয়ে বেশি পেন্ট্যাথলন পয়েন্ট পায়। কিন্তু পরের ইভেন্টেই সাতারে সে ১৭তম হয়। পেন্ট্যাথলনের সাসপেন্সটাই এখানে। একটা ইভেন্টে খুব খারাপ করে ফেললেও পরে অন্য একটা দিয়ে সেটাকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা যায়। যেমন রাইডিং-এ ও ডেভিড গড়পড়তার পারফর্ম করে কিন্তু দৌড় এবং স্যুটিং-এ সে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পয়েন্ট তুলে সোনা জেতে। অন্যদিকে মেয়েদের পেন্ট্যাথলনের সোনা ছিল এবারের অলিম্পিকের সবচেয়ে শেষ সোনা। ইতিমধ্যে ব্রিটেন তখন ২৯ সোনা জিতে ফেলেছে। আর একটা সোনা হলেই ৩০ পূর্ণ হয়ে যায় – এমন অবস্থা। পুরো ব্রিটেন তখন পেন্ট্যাথলনের দিকে তাঁকিয়ে। তাদের সামান্থা মারি ফেন্সিং-এ ১৬তম হলেও সাঁতারে যৌথ ভাবে প্রথম হয়ে ব্রিটিশদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। এছাড়া শুনছিলাম যে স্যুটিং-এ ও নাকি সে বেশ ভালো। কিন্তু রাইডিং ইভেন্টে এসে ইউক্রেনের ইরিনা (১২০০ পয়েন্ট) এবং লিথিওনিয়ার লরা (১১৮০ পয়েন্ট) অসাধারণ পারফর্ম করে যেখানে সামান্থা তোলে ১১৪০ পয়েন্ট। তখনও বিবিসির ধারাভাস্যকাররা দেখলাম ব্যাপাক আশাবাদী। ইরিনা না পারলেও লরা ঠিকই তাদের আশায় পানি ঢেলে দেয় শেষ পর্যন্ত। আসলে পেন্ট্যাথলনের বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ান লরা সাঁতারে এত বেশি খারাপ করেছিল (১১৩৬ পয়েন্ট, অন্য দিকে সামান্থা তোলে ১২৬৪ পয়েন্ট) যে ওকে গোনা থেকেই বাদ দিয়ে ফেলেছিল অনেকে। রাইডিং দিয়ে পয়েন্ট খানিকটা তোলে সে এবং শেষ রাউন্ডে (যৌথ ইভেন্ট) স্যুটিং ও দৌড়ে সামান্থাকে টপকে সোনা জিতে নেয়। অন্যদিকে রূপা নিয়েই ব্রিটেনের সামান্থাকে খুশি থাকতে হয় এবং ব্রোঞ্জটা জেতে ব্রাজিলের ইয়েন।
দলগত খেলাগুলোর মধ্যে ফুটবলের ফলাফল এসেছে চরম অপ্রত্যাশিত। অনেকেই হয়তো জানেন, ফুটবলে অনূর্ধ্ব ২৩ দল খেলে অলিম্পিকে। ছেলেদের কাছাকাছি (অনূর্ধ্ব ২১) বয়ঃভিত্তিক এই দলের বর্তমান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন স্পেন। অথচ তারাই চরম শোচনীয় ভাবে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে টুর্নামেন্ট থেকে। একটা ম্যাচও না জিতে এবং একটা গোলও না করে তারা নিজ গ্রুপে সবচেয়ে নীচের অবস্থান পেয়ে গ্রুপ পর্যায়েই বাদ পড়ে। অয়োজক ব্রিটেনও তেমন একটা ভালো করে নি। এই সিরিজের প্রথম পর্বেই জানিয়েছিলাম হাতে গোনা কয়েকজন ওয়েলশ ফুটবলার বাদে ব্রিটেন দলটা মূলত ইংল্যান্ড দল। আর এই ইংল্যান্ডের জন্যে টাইব্রেকার মোটেও সুখকর অনুভূতি নয়। অলিম্পিকেও তাই দেখা গেলো। জুনিয়াররা তাদের জাতীয় দলের সিনিয়রদের ২০১২ ইউরোর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঠিক কোয়ার্টার ফাইনালেই দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয়। তবে ফেভারিট ব্রাজিল কিন্তু বেশ ভালো ভাবেই ফাইনালে যায়। পুরো টুর্নামেন্টে তারা হোঁচট একবারই খেয়েছে এবং সেটা ফাইনালে। মেক্সিকোর কাছে ২-১ গোলে হেরে রূপা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ব্রাজিলকে। মেয়েদের ফুটবলের সোনা যেটা ধারণা করা হচ্ছিল, তাই হয়েছে – যুক্তরাষ্ট্র সেটা হাতছাড়া করে নি।
অলিম্পিকে হকিটা বেশ উত্তেজনাপূর্ণ হয় কারণ এখানে মূল জাতীয় দলগুলো খেলে। তবে ফলাফলে তেমন কোন অঘটন দেখা যায় নি। ছেলেদের হকিতে জার্মানি সোনা, নেদারল্যান্ডস রূপা এবং অস্ট্রেলিয়া ব্রোঞ্জ জেতে আর মেয়েদের হকিতে নেদারল্যান্ডস সোনা, আর্জেন্টিনা রূপা এবং ব্রিটেন ব্রোঞ্জ জেতে। অন্যদিকে বাস্কেটবলে ছেলে-মেয়ে দুটো সোনাই যুক্তরাষ্ট্র জিতেছে এবং ভলিবলে ছেলেদের সোনা যুক্তরাষ্ট্র এবং মেয়েদেরটা ব্রাজিল জিতেছে। এছাড়া ওয়াটার পোলোতে ক্রোয়েশিয়া ছেলেদের সোনা এবং যুক্তরাষ্ট্র মেয়েদের সোনা জিতেছে।
সবশেষে একটা ভিডিও দেখাচ্ছি। ইকুয়েস্ট্রিয়ানের সবচেয়ে আকর্ষনীয় ইভেন্ট হচ্ছে ড্র্যাসাশজ বা সোজা বাংলায় ‘ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোড়াকে নাচানো’। মাত্র ১৮ মাস আগে শার্লটি ডুজার্ডিন নামের কাউকে ব্রিটেন চিনতো না। এর কোন আন্তর্জাতিক অতীত ট্র্যাক রেকর্ড নেই, এমন কি নেই কোন বড় ঘরোয়া অর্জনও। সেই মেয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে পুরো ব্রিটেনকে নাচিয়ে দিয়েছে অলিম্পিক রেকর্ড সহ একক ও সাথে দলগত ইভেন্টে দুটা সোনা জিতে।
(ভিডিওটা ইউটিউব থেকে শেয়ার দেয়া। কপিরাইট evenag114-এর)
(বিবিসির সৌজন্যে ফরমাল ভিডিও (৩ মিনিটের) দেখতে পাবেন এখানে।)
এই হলো মূলতঃ অলিম্পিকের খেলাগুলোর আপডেট। গত পর্বে অলিম্পিক চলাকালিন আমার তোলা ছবি শেয়ার দেয়ার কথা বলেছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম ছবির সাথে কিছু কথা সহ (যেমনটা অলিম্পিক মশাল ভ্রমণ নিয়ে এই ছবি ব্লগ পোস্টে দিয়েছিলাম) আলাদা পোস্ট দেব। ওটাই হবে এই সিরিজের শেষ পোস্ট। তবে ওখানে কোন খেলার আলোচনা থাকবে না, কেবলই গল্প থাকবে।
মন্তব্য
আপনার সিরিজটা ভালো লাগে।
আমি নিজেও চিন্তা করছিলাম অন্তত গোটা চারেক অলিম্পিক নিয়ে কিছু লেখার। মূলত উদ্বোধনী আর সমাপনী নিয়ে। সাথে পুরো গেমসের ওভারভিউ, সাথে কিছুটা তুলনামূলক তথ্যাবলী। কিন্তু, শালার সময়ই করতে পারি না। সময় হলেও শরীরে তাকত পাওয়া যাচ্ছে না! বয়স হলে এই এক সমস্যা হয় বোধ'য়!
আপনি সুযোগ করতে পারলে লিখে ফেলেন।
এই ভিডিওটা দেখেন। অলিম্পিকের বিদায় মুহূর্তে হাসিকান্নার ভিডিওগুলো কম্পাইল করে বানানো একটা ভিডিও। [আরেকটা আছে, 'রানিং আপ দ্যাট হিল']। অ্যাথলেটদের, অলিম্পিকের সাথে জড়িত-অজরিত সবার, একটা শহরের অধিবাসীদের নিয়ে এমন হাসিকান্নাহাহাহিহি সম্বলিত 'যখন ভাঙে মিলন মেলা' টাইপের একটা লেখা খাড়া করায়ে ফেলেন ম্যান। অলিম্পিককে তো কাছ থেকে দেখছেন। শুরু করে দেন।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধুগো-দা আমারও একই অবস্থা। সময় করতে পারছি না। এই সিরিজটা শুরু করাতে শেষ করার দায়ে পড়ে গেছি। না হলে আগেই পালাতাম। সামনে পিএইচডি-র ফার্স ইয়ার ভাইভা। সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। শেষ পর্বটা লিখেই অলিম্পিককে আলমিরায় তুলে রাখবো। তবে আপনি লিখলে অবশ্যই পড়বো। (এই রিপ্লাই লিখেই ভিডিওটা দেখবো)
টুইটার
পরর পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
নতুন মন্তব্য করুন