তাসকিন ও সানির বোলিং এ্যাকশন নিয়ে আইসিসির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী (তারিখ: রবি, ২০/০৩/২০১৬ - ১২:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

100x

বাংলাদেশের বিপক্ষে যাওয়া আইসিসির বিভিন্ন স্বীদ্ধান্তের ব্যপারে বাংলাদেশের সমর্থকগোষ্ঠি বরাবরই সোচ্চার এবং সেটা ন্যায়সঙ্গত কারণেই। তবুও বিষয়টা নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোডর্ তথা বিসিবি নমনীয়। যেহেতু বিসিবি একটা জাতীয় ক্রিকেট বোর্ড এবং আইসিসির সদস্য, তাই তাদের পক্ষে সরাসরি আইসিসির রিরুদ্ধে যাওয়াটা সহজ নয়। বিশেষ করে যখন কেউ একটা প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তখন সেই প্রক্রিয়ার ভেতরে থেকেই সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। যদি খোদ প্রক্রিয়াতেই সমস্যা থাকে, সেটা পরিবর্তনের জন্যে ভেতরে থেকেই চেষ্টা চালানো বুদ্ধিমানের কাজ। হতে পারে সে কারণে আইসিসির বিভিন্ন সন্দেহজনক আচরণ যা আম্পায়ারিং থেকে শুরু করে ভেনু্য সিলেকশন পর্যন্ত বিসিবি নীতিগত ভাবে একমত না হলেও সরাসরি সোচ্চার হয় নি। কিন্তু তাসকিন এবং সানির বোলিং এ্যাকশন নিয়ে আইসিসি যে নূতন বিতর্ক শুরু করেছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় আজ তাদের দুজনের বোলিং এ্যাকশন অবৈধ ঘোষণা করেছে, এ বিষয়ে বিসিবির শুধু সোচ্চার হলেই চলবে না, তাদের পদ্ধতিগত ভাবে মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুতিও নেয়াও জরুরী। এই লেখাটায় মূলতঃ বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা যা ঘটছে, সেটাকে অতীতের আলোয় মোকাবেলা করার জন্যে কিছু সাজেশন উল্লেখ করা হয়েছে।

তাসকিনের বোলিং এ্যাকশনঃ বিতর্কটা ঠিক কোথায়?

গত ৯ মার্চ নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে খেলার সময় তাসকিন আহমেদ এবং আরাফাত সানির বোলিং এ্যাকশন নিয়ে সন্দেহের কথা জানায় ভারতীয় আম্পায়ার সুন্দারাম রবি এবং অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার রড টাকার। প্রায় সাথে সাথেই আইসিসি তাদের চেন্নাইয়ের একটা পরীক্ষা কেন্দ্রে বোলিং এ্যাকশন শুদ্ধ কিনা তা পরীক্ষা করতে বলে। আরাফাত সানির বোলিং এ্যাকশন নিয়ে ইতোপূবর্ে বাংলাদেশেই তার বিভিন্ন কোচ প্রশ্ন তুলেছিল যা পত্রিকা মারফত জানা যায়। কিন্তু তাসকিন আহমেদকে নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এবারই প্রথম। ফলে বিষয়টার মাঝে সন্দেহের কারণ খুঁজে পায় বাংলাদেশের সমর্থকরা স্যোসাল মিডিয়াতে। কাউকে কাউকে মন্তব্য করতে দেখা যায় এভাবে যে মূলত সানিকে অবৈধ ঘোষণা করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সেখানে তাসকিনের নাম ঢুকিয়ে দিয়ে বিষয়টাকে আড়াল করার একটা প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা শেষে হয়তো তাসকিনকে শুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে সানিকে নিষিদ্ধ করে দেবে এবং সমর্থক ও বোডর্ তাতে সন্তুষ্ট হয়ে সানির স্বীদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আর লড়াই করবে না।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বিষয়টা যতটা সরল মনে হচ্ছিল ততটা নয়। গত ১২ এবং ১৫ মার্চ তাদের পরীক্ষা হয় চেন্নাইয়ের সেই আইসিসির পরীক্ষা কেন্দ্রে। বাংলাদেশের বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক পরীক্ষার আগেই জানায় তিনি নিশ্চিত তাসকিন শুদ্ধ বোলিং-এর সাটর্িফিকেট নিয়ে ফিরবে। তবে বাংলাদেশের কোচ চন্দ্রিকা হাথুরাসিংহ এ বিষয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন মিডিয়ার কাছে। সাধারণত ১৪ দিন পর ফলাফল জানানোর কথা থাকলেও মাত্র ৪ দিনের মাথায় ফলাফল ঘোষণা করে তাসকিন এবং সানিকে অবৈধ ঘোষণা করা হলো।

এ বিষয়ে যাঁরা বিসিবিকে আইনী পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁদের অন্যতম মোস্তাফিজুর রহমান খান তাঁর ফেইসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে কিছু অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, আইসিসির রেগুলেশনের ২.২.৬ ধারায় বলা রয়েছে যে এই পরীক্ষায় বোলারকে ঐ বলগুলোই আবার করতে বলা হবে যা নিয়ে আম্পাররা অভিযোগ করেছেন। ঐ ম্যাচে আম্পায়াররা সামগ্রিকভাবে সবগুলো বলের উপর তাদের সন্দেহের কথা জানিয়েছিল কিন্তু কোন বিশেষ বলের ব্যাপারে আপত্তির কথা বলে নি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ঐ ম্যাচে করা সবগুলো বলকেই সন্দেহের চোখে দেখার সুযোগ রয়েছে এবং ঐ ধরনের বলগুলো তাসকিনকে করতে বলা হবে। বিতর্কটা তৈরি হয়েছে ঠিক এখানেই। তাসকিনকে সাধারণ সব ডেলিভারির জন্যে শুদ্ধ ঘোষণা দিলেও ৯টা বাউন্স দিতে বলা হয়েছিল যার মধ্যে তিনটা বাউন্সে তাসকিনের হাত ১৫ ডিগ্রীর বেশি বেঁকে যায়। মজার ব্যাপার, ঐ ম্যাচে তাসকিন কোন বাউন্স দেয় নি অর্থাৎ পরীক্ষায় তাসকিনকে বাউন্স করতে বলাটাই অবৈধ। তাছাড়া তাসকিনকে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে ৯টা বাউন্স দিতে বলা হয় যা কোন ক্রিকেট ম্যাচে সাধারণ অবস্থায় কখনওই সম্ভব না। ফলে এই পরীক্ষার বৈধতা কতটুকু এ প্রশ্ন তুলেছে বিসিবির আইনী পরামর্শকরা এবং তাঁরা বিসিবিকে অনুরোধ করেছে এ বিষয়টা দ্রুত আইসিসির কাছে তুলে ধরতে।

আরাফাত সানির ক্ষেত্রে যথারীতি পরীক্ষার ফল নেতিবাচক এসেছে এবং তাকে সামগ্রিক ভাবে সব বলের জন্যেই ১৫ ডিগ্রির বেশি হাত বাকিয়ে বল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

কেইস স্ট্যাডিঃ মুত্তিয়া মুরালিধরন

তাসকিন আহমেদকে নিয়ে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বিসিবির জন্যে অনুপ্রেরণা হতে পারে মুত্তিয়া মুরালিধরনের কেইসটা। আজকের প্রজন্ম জানেই না সর্বকালের সেরা বোলার মুত্তিয়া মুরালিধরনকে কতটা বাজে রকম ভাবে আইসিসি এবং অস্ট্রেলিয়া অপদস্থ করেই চলেছিল তার জীবনের সোনালী দিনগুলোর সূচনা লগ্নে। ১৯৯৫ সনের বক্সিং ডে-তে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার প্রথম মুরালিধরনকে নো বল ডাকে হাত অত্যধিক বাঁকা হয়ে যাওয়ার কারণে। ঐদিন হেয়ার মোট ৭ বার নো বল ডাকে মুরালিধরনকে। এ বিষয়ে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃত স্যার ডন ব্র্যাডম্যান বলেছিলেন, "worst example of umpiring that [he had] witnessed, and against everything the game stands for. Clearly Murali does not throw the ball"। দশদিন পর ব্রিজবেনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সিরিজের ওয়ান ডে ম্যাচে আরেক অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার রস এ্যামারসন মুরালিধরনকে প্রথম ওভারেই তিনবার এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওভারে দুইবার করে হাত বেঁকে যাবার অভিযোগে নো বল ডাকে।

১৯৯৬ সনের বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে আগে মুরালিধরন হংকং ইউনিভাসর্িটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনলোজিতে পরীক্ষা দিতে যায়। সেখানে প্রফেসার রাবিন্দ্র গুনেটিলেকে পরীক্ষা শেষে জানায় মুরালিধরনের হাত জন্মগত ভাবে বাঁকা তাই সে পুরোপুরি সোজা করতে পারে না। কিন্তু যেহেতু ক্রিকেটে হাত সম্পূণর্ সোজা করার বাধ্যবাধকতা নেই, তাই মুরালিধরনের বোলিং বৈধতার সীমার মধ্যেই রয়েছে।

সেই বছরই বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে শ্রীলঙ্কা নূতন রূপে আবিভূত হয় এবং সবার চোখে তারা অপছন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের সেরা বোলার হিসেবে তাই মুরালিধরনকেই টাগর্েট করা হয় এবং ১৯৯৮-৯৯ এর অস্ট্রেলিয়া টু্যরে রস এ্যামারসন আবারও মুরালিধরনকে এডিলেড ওভালে চলমান একটা ওয়ান ডে ম্যাচে হাত বাঁকানোর অভিযোগে নো বল ডাকে। শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা এই স্বীদ্ধান্তের কারণে ম্যাচ খেলতে অপারগতা জানালে ম্যাচ প্রায় পণ্ড হবার দশা হয়। কিন্তু পরে শ্রীলঙ্কান বোর্ডের প্রেসিডেন্ট অনুরোধ করে শ্রীলঙ্কাকে মাঠে নামায়। এই আচরণের জন্যে রানাতুঙ্গাকে আর্থিক জরিমানা এবং এক ম্যাচের জন্যে সাসপেন্ডও করা হয় এবং মুরালিধরনকে পাঠানো হয় আবার পরীক্ষা দিতে। তবে এবার আর হংকং নয়, সরাসরি ইংল্যান্ডে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঐ সময় মুরালিধরন মূলত অফব্রেক এবং টপ স্পিন বল করতো। তার ক্যারিয়ার সেরা দুসরা ডেলিভারি তখনও সে আবিষ্কার করে নি! ইংল্যান্ড থেকে ঐ দুইধরনের ডেলিভারির জন্যেই মুরালিধরনকে বৈধতার সাটর্িফিকেট দেয়া হয়। এরপর আম্পায়ার রস এ্যামারসন শারীরিক অসুস্থতা এবং স্ট্রেসের কথা বলে ঐ সিরিজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়।

২০০৪ সনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মুরালিধরন টেস্টে ৫০০ উইকেট নেয় শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে। ততদিনে মুরালিধরন ব্যাটসম্যানদের জন্যে এক অভিশাপ। তার দুসরার কবলে পড়ে ব্যাটসম্যানরা অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করছে। এরকম পরিস্থিতিতে ৫০০ উইকেট নেয়ার পরপরই মুরালিধরনের দুসরাকে অবৈধ বলে মতামত দেয় ইংলিশ আম্পায়ার ক্রিস বাডর্। ফলে মুরালিধরনকে আবার যেতে হয় পরীক্ষা দিতে। এইবার একেবারে অস্ট্রেলিয়াতে। ইউনিভাসর্িটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া মুরালিধরনের বাহু পরীক্ষা করে বের করে যে তার হাত ১৪ ডিগ্রী বেঁকে যায় দুসরা করার সময়। যদিও বিভিন্ন ট্রেনিং-এর মাধ্যমে সেটাকে সংশোধন করে সাড়ে ১০ ডিগ্রি করা হয় তখনই। তবে সময়ে কোন সুনিদর্িষ্ট ডিগ্রি উল্লেখ করা ছিল না বলে চাইলে আম্পায়াররা তখনও নো বল ঘোষণা করতে পারতো মুরালিধরনকে। বিষয়টা এতটাই সাবজেক্টিভ হয়ে যাচ্ছিল যে কে বৈধ এবং কে অবৈধ, সে বিষয়টা স্পষ্ট ভাবে বলে দেয়া জরুরী হয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর শেষে ২০০৫ এর মাচর্ের ১ তারিখ থেকে ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হাত বাঁকানোকে বৈধ বলে আইসিসি আইন করে। এরপর ২০০৬ সনে মুরালিধরনকে আবারও পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় হাত বেশি বাঁকাচ্ছে না। এবার দেখা যায় সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ ডিগ্রী পর্যন্ত হাত বাঁকাচ্ছে যা বৈধ সীমার মধ্যেই রয়েছে। ফলে মুত্তিয়া মুরালিধরন মুক্তি পায় বারবার পরীক্ষা দেয়ার যন্ত্রণা থেকে।

ড্যারেল হেয়ারের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিতর্কটায় সে সময় বাজে রকম সমালোচনায় জড়িয়েছে পড়েছিল তৎকালিন এবং সাবেক ক্রিকেটাররা। এমন কি অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড, যিনি কিছু দিন পরই আইসিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট হবার কথা ছিল, সেই সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে। বডি লাইন সিরিজ এবং ওয়ান ডে ক্রিকেটের জন্ম সংক্রান্ত বিতকর্ অর্থাৎ ওয়াল্ডর্ সিরিজ ক্রিকেট আয়োজনের ঘটনার পরপরই ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিতকর্ হিসেবে হ্যান্সি ক্রনিয়ের বাজিগরদের সাথে সম্পৃক্ততার সাথে মুরালিধরনের নো বল বিতর্ককে স্থান দিলে হয়তো কেউ আপত্তি করবে না, এতটাই বড় ঘটনা ছিল বিষয়টা ঐ সময়ে। অথচ তখন খুবই কঠিন ভাবে প্রধানত অস্ট্রেলিয়া এবং তারপর আইসিসির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল শ্রীলঙ্কান বোডর্ এবং তাদের অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। বোডর্ের এই শক্ত অবস্থানের কারণেই মুরালিধরন তাসকিনের মতই পরীক্ষা দিয়ে এবং বিজয়ী হয়ে ফিরে এসে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিল। আজ তার নামের পাশে ৮০০ টেস্ট এবং ৫৩৪ ওয়ানডে উইকেট — দুটাতেই সে সবার উপরে এবং কোন রকম সন্দেহ ছাড়াই সর্বকালের সেরা বোলার। আর কালের স্রোতে হারিয়ে গিয়েছে ড্যারেল হেয়ার ও রস এ্যামারসন এবং আইসিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায় জন হাওয়াডর্ের।

বিসিবির অনুপ্রেরণা ও করণীয়

মুরালিধরনের উদাহরণটা উল্লেখ করার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে বিসিবির কিংকর্তব্যবিমুঢ় আচরণ। অবস্থা বিচার করে মনে হচ্ছে বিসিবি ঠিক করতে পারছে না তারা কী করবে, বা তাদের কী করা উচিত। এ কথাও সত্য বিসিবির জন্যে কাজটা বাস্তবিকই কঠিন। ফেইবুক বা ব্লগে বসে আপনি-আমি অনেক বড় বড় কথা লিখে ফেলতে পরবো। কিন্তু বিসিবিকে প্রতিটা পদক্ষেপ নিতে হবে ভালো ভাবে ভেবে এবং ভবিষ্যতে এর ফলাফল কী হতে পারে চিন্তা করে। তবে তার অর্থ এই না যে কেউ আমাদের সাথে ক্রমাগতই অবিচার করে যাবে আর আমরা মেনে নিতেই থাকবো। আর এ কারণেই শ্রীলঙ্কান বোডর্ের অবস্থানটা গুরুত্বপূণর্ ছিল। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের আগ মুহূতর্ থেকেই তাদের সাথে অবিচার শুরু হয়। সেটা তারা বিভিন্ন সময়ে সোচ্চার হয়েই সমাধান করেছে। এমন কি ইংল্যান্ড যে তাদের সাথে খুবই অল্প সংখ্যক টেস্ট ম্যাচের সিরিজ খেলতো, সেটা নিয়েও ইংল্যান্ডে গিয়েই হৈচৈ করে বিশ্বকে জানান দিয়েছিল। আর মুরালিধরনের কেইসে রীতিমত হার্ড লাইনে চলে গিয়ে বিষয়টাকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল যা আমরা উপরেই পড়েছি। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা নিজেদের অন্যতম পরাশক্তিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে, শুধু মাঠেই না, মাঠের বাহিরে অধিকার আদায়েও। আর এ কারণেই তাদের থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রচুর সুযোগ রয়েছে বিসিবির।

তাসকিন এবং সানি বর্তমানে যে কোন ধরনের ক্রিকেট থেকে বহিষ্কৃতের মতই আচরণ পাবে বিশ্ব থেকে। কোন আন্তর্জাতিক অথবা ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে পারবে না, শুধু বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট ছাড়া। এরকম পরিস্থিতিতে তাসকিন এবং সানিকে নিয়ে যত ধরনের পরীক্ষাই হোক না কেন, সেটা বিসিবিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে করতে হবে অথবা পরীক্ষার ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা তা খুবই ভালো ভাবে নজরে রাখতে হবে। উপরেই উল্লেখ করেছি যে আইনী পরামর্শকরা ইতিমধ্যে পরীক্ষার ত্রুটিগুলো বিসিবিকে জানিয়েছেন। এই ত্রুটিগুলো কেন হলো তা জানার জন্যে চাপ দেয়াটা বিসিবির প্রধান এবং প্রথম কাজ হওয়া উচিত। একই সাথে এর পর ভারতে চেন্নাইতে আর কখনই তাসকিনদের পরীক্ষার জন্যে পাঠানো উচিত হবে না। এ ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ ল্যাব নির্বাচন করা জরুরী। মুরালিধরন কিন্তু তিনবার তিনটা ল্যাবে পরীক্ষা দিয়েছিল। অতএব একই জায়গায় বারবার যাবার প্রয়োজন দেখি না।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ হচ্ছে বিসিবির তাসকিন এবং সানির পাশে থাকাটা যেটা শ্রীলঙ্কান বোডর্ দারুণ ভাবে মুরালিধরণের পাশে থেকে দেখিয়ে দিয়েছে। বোর্ড যদি শক্ত অবস্থানে থাকে তাহলে বাংলাদেশের এই তরুণ প্রতিভাদের অকালে ঝরিয়ে দেয়ার যে চক্রান্ত শুরু হয়েছে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সাথে দরকার রানাতুঙ্গার মত একজন অধিনায়ক যিনি ইতিমধ্যে আমাদের রয়েছেন। বিশ্ব ক্রিকেটে মাশরাফির ব্যক্তিত্ব এবং প্রভাব রানাতুঙ্গার থেকে কোন অংশে কম নয়। আশা করবো অধিনায়ক তার সতীর্থদের আগলে রাখবেন তারা সম্পূণর্ রূপে বৈধ হয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত।

এছাড়াও এ বিষয়টা নিয়ে ঐ সময় প্রচুর বৈজ্ঞানিক রিসার্চ হয়েছে। গবেষকদের সাথে কথা বলে এবং তাদের মতামত নিয়ে বিসিবি তাদের অবস্থান আরো সুসংগঠিত করতে পারবে। কিছু গবেষণাপত্রের তালিকা এখানে দেয়া হলো যা চাইলে বিসিবির কর্মকর্তারা পড়ে দেখতে পারেন অথবা যোগাযোগের প্রথম সূত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

১) Elliot, B.C., Alderson, J., Reid, S. and Foster, D. (2004). Bowling Report of Muttiah Muralitharan.
Ferdinands, R.E.D. (2004). Three-dimensional biomechanical analysis of bowling in cricket. PhD Thesis, University of Waikato.

২) Ferdinands, R.E.D. and Kersting, U.G. (2004). Elbow Angle Extension and implecation for the legality of the bowling action in Cricket. In A McIntosh (Ed.), Proceedings of Australasian Biomechanic Conference 5 (9 December – 10), University of New South Wales, Sydney, pp. 26–27.

৩) Ferdinands, R.E.D. and Kersting, U.G. (2007). An evaluation of biomechanical measures of bowling action legality in cricket. Sports Biomechanics, Volume 6, Issue 3 September 2007, pages 315–333
Goonetilleke, R.S. (1999). Legality of bowling actions in cricket. Ergonomics, 42 (10), 1386–1397.

৪) Lloyd, D. G., Alderson, J. and Elliot, B.C. (2000). An upper limb kinematic for the examination of cricket bowling: A case study of Muttiah Muralitharan. Journal of Sports Sciences, 18, 975–982.

৫) Marshall, R. and Ferdinands R. (2003). The effect of a flexed elbow on bowling speed in cricket. Sports Biomechanics, 2(1), 65–71.

৬) Pathegama, M., Göl, Ö, Mazumdar, J., Winefield, T. and Jain, L (2003) 'Use of imprecise biomedical image analysis and anthropometric assessment in biomechanics with particular reference to competitive cricket', UniSA Scientific Study, SEIE, University of South Australia, Australia.

৭) Pathegama, M. and Göl, Ö (2004) 'Special Report on the Controversial doosra bowling action based on UniSA scientific study: As per the invitation made by David Richardson, General Manager, ICC), EIE, University of South Australia, Australia.

৮) Portus, M., Mason, B., Rath, D. and Rosemond, C. (2003). Fast bowling arm actions and the illegal delivery law in men's high performance cricket matches. Science and Medicine in Cricket. R. Stretch, T. Noakes and C. Vauhan (Eds.), Com Press, Ports Elizabeth, South Africa, pp. 41–54.

শেষ কথা

ক্রিকেট এক অদ্ভুত খেলা। মাত্র দুইটা প্রধান দল আগে ক্রিকেট খেলতো। ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া। তারপর যোগ্যতা দিয়ে সেই দলে ঢুকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর অনেকটা সময় ক্রিকেটে এই তিন শক্তিই বিরাজ করতো। রাজনীতিটা তবুও ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার হাতেই থেকে যায়। তারপর আসে ভারত। টাকার মূল্যটা তখন বিশেষ গুরুত্বপূণর্ হয়ে উঠে। ক্রিকেটও বদলে যেতে থাকে। সেই সময়টায় অনেক কষ্ট করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বড়দের কাতারে ঢুকতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কার গল্পতো উপরেই বললাম। নিউজিল্যান্ড আজও পারে নি সেই কাতারে ঢুকতে অথচ তারা বরাবরই দুর্দান্ত দল নিয়ে বিশ্বকাপগুলোতে পারফমর্ করেছে। পাকিস্তান আজও ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত ঘোরে। এরকম তীব্র রাজনীতির মধ্যে জিম্বাবুয়ে নামক দলটা টিকতেই পারলো না, আর কেনিয়া তো হারিয়ে গিয়েছে শুরুর আগেই। এরকম বৈরি একটা খেলায় বাংলাদেশকে যদি টিকে থাকতে হয় তাহলে সেটা শুধু মাঠের খেলাতে আর হবে না বলেই মনে হচ্ছে। বোর্ডকে রাজনীতির মাঠে সাকিব-তামিমদের মত পারফর্ম করতে হবে। একন দেখার পালা বাংলাদেশ সেই খেলাটায় কীভাবে নামে এবং কত দূর যায়।

আইসিসিকে শুধু এতটুকুই বলার, 'শেইম অন ইউ'!

১৮ মার্চ ২০১৬
মিল্টন কিন্স, ইংল্যান্ড।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

আরাফাত সানির কেসটা খতিয়ে দেখা হয়েছে কি? নাকি তার জন্যে আইনজীবীর বিশ্লেষণ চাওয়া হয় নি?

বিসিবির উচিত হবে সর্বশক্তি দিয়ে তাসকিনের জন্যে লড়া। নইলে আজ তাসকিন, কাল মুস্তাফিজ, পরশু সাকিব এভাবে চলতে থাকবে।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

তাসকিনের বোলিং অবৈধ ঘোষণা এতটাই বিস্ময়কর ছিল যে আরাফাত সানির কেইসটা আড়ালে চলে গেছে। দুইটা কেইসকেই সিরিয়াসলি নেয়া দরকার, সমান না হলেও কাছাকাছি রকমের গুরুত্ব দিয়ে।

দিগন্ত এর ছবি

মুরলীর সময়ে কিন্তু আইসিসি মুরলীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল বলে মনে পড়ে। আম্পায়াররা নো বল ডাকার পরে আইসিসি বরং পরীক্ষাগারে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিল। সমস্যাটা তখন উপমহাদেশীয় গোষ্ঠী বনাম অস্ট্রেলিয়া-ইংলন্ড ছিল। এইবারে আমার ধারণা ছিল শ্রীনির পরের আইসিসি চেয়ারম্যান মনোহর সহ অন্যান্য দের সাথে বিসিবির সম্পর্ক ভাল। তাসকিনের বিষয়টা নিয়ে আগে চেন্নাই ছেড়ে অন্য কোথাও টেস্ট করানো দরকার। মুরলীর মত সমস্যা এখন আর হবার কথা নয়।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

হ্যাঁ, এখানেই সমস্যাটা হয়েছে। আগে আইসিসির একটা নিজস্ব মত থাকতো যা তিন বড় দেশের নিয়ন্ত্রণের কারণে এখন অনেকটাই 'তাদের মতই আইসিসির মত' - এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে প্রথম পদক্ষেপ চেন্নাই ছেড়ে অন্য কোথাও টেস্ট করানোই হওয়া উচিত এবং আমার ধারণা আইনী পরামর্শকরা সেটাই বলবে বিসিবিকে।

নজমুল আলবাব এর ছবি

বিসিবি এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিয়েছে?

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

গতকাল পর্যন্ত কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নি। আজকের খবর এখনও জানি না, মাত্রই অনলাইনে বসলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

বিসিবি তাসকিনের ব্যাপারে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্ভব হলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেই চায়। খবরটা পড়ে ভাল লাগলো। বিসিবির কাছ থেকে আমরা এমন দায়িত্বশীলতাই আশা করি। (লিঙ্ক এড হচ্ছে না তাই ইউআরএল কপি করে দিলাম।)
http://www.prothom-alo.com/sports/article/804619/%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%B2-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BF

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

খবরটা শেয়ার করার জন্যে ধন্যবাদ। মনে-প্রাণে চাইবো অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই যেন তাসকিন ফিরে আসে। দেখা যাক বিসিবি এবং তাদের আইনী পরামর্শকরা কত দূর নিয়ে যায় বিষয়টা।

Rased bin jafar এর ছবি

ভালো লাগল

Rased bin jafar এর ছবি

tnx

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ধইরা ঠুয়া দিয়া দিমু...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।