পহেলা ফাল্গুনের পোস্টে ভেসে যাচ্ছে ফেসবুক। রঙের ছটা চারদিকে, স্ক্রল করে যত নিচে নামুন সর্বত্র রঙের ছড়াছড়ি। আমার এখানে রাত। দেশে দিন। বাইরে তুষারপার আর বাতাস। আর দেশে? জানি না। হয়ত রোদ, হয়ত শীত শেষের হাল্কা ঠান্ডা বাতাস। দিন রাতের এই পার্থক্য ব্যাপার না, কল্পনায় ভেসে আসছে সব- ফাগুনের টিএসসি, চারুকলা আর পরিচিত সব মুখ।
পহেলা ফাগুনের এই রঙ্গিন দিকটা সম্পর্কে কবে থেকে জানি? স্মৃতি হাতড়ে দুই হাজার ছয়ের আগে যেতে পারলাম না। আমার স্মৃতিতে নেই। অবশ্য না থাকা অস্বাভাবিক না। অল বয়েজ স্কুল কলেজের হোস্টেল জীবনে এসবের বালাই নাই। পত্রিকায় কি কিছু পড়েছিলাম? মনে নেই। পড়লেও মনে দাগ কাটে নি। ২০০৬ এর এই দিনটা মনে আছে।
ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবার কথা ছিল। বাসার কাউকে বলা হয় নি। নিজে নিজেই ক্যাম্পাসে চলে এসেছিলাম। তখনো ঢাকায় এক প্রকার নবাগত। প্রায় সব কিছুই নতুন, সব কিছুই বিস্ময়। রেজাল্টের জন্য কলা ভবনের সামনে দিয়ে হেটে হেটে চারদিকে পর্যবেক্ষণ। অন্যদিনের থেকে পার্থক্য চোখে পরেছিল তবে রেজাল্টের চিন্তায় সেটা তখনো মাথায় আস্তানা গাড়তে পারে নি। অপেক্ষা করে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে বইমেলার দিকে হাটা। টিএসসির কাছে আসতেই গান কানে আসে। কারা যেন গাইছিল। টিএসসির বাইরের এই গানের অনুষ্ঠান গুলো তখনো আমার কাছে নতুন। সেই অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনতে শুনতেই ঘোষকের কন্ঠে পহেলা ফাল্গুনের কথা আসে। কেউ দাঁড়িয়ে শুনছে, সামনে পাতা অল্প কয়েকটা চেয়ারে বসা অল্প ক’জন। সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে বের হওয়া হলবাসী, মেলা ফেরত মানুষ, অপেক্ষারত রিক্সাওয়ালা, বেলুন বিক্রেতা শিশু, চা-ওয়ালা মামা, দূরে বসে থাকা প্রেমিক যুগল, গায়কের গলায় উড়াল দেওয়া ডানা ভাঙ্গা পাখি আর মফস্বল থেকে আগত আমি আর সবার উপর চাদর বিছিয়ে নেমে আসে সোডিয়াম সন্ধ্যা। সব মাথায় গেথে যায়। জাদুকর সেই সন্ধ্যায় প্রথমবারের মত মাথায় ভর করে ফাগুন সাথে টিএসসির সেই সোডিয়াম সন্ধ্যা।
দ্বিতীয় ফাগুন? দুই হাজার সাত। প্রথম বর্ষ তখনো শেষ হয় নি। সকাল আটটায় ক্লাস হত তখন-মমতাজ জাহান ম্যাডামের। প্রচন্ড ভয় পেতাম ম্যাডাম কে। ক্লাসে অন্য কোন কথা বলার উপায় নেই। ক্লাসে ঢুকেই বোর্ডে লিখতেন সেই দিনের বিষয়, তারপর এক ঘন্টার ঝড়। মনযোগ হড়কানোর সুযোগ নেই। আমি দূর থেকে আসি। বাস যাত্রী। সাত টা ত্রিশের মধ্যে বাস এসে যায়। ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আসতে থাকে একেকজন। বোঝা যায় আজকে বিশেষ দিন। সাদামাটা সকাল আটটার ক্লাস যেন রঙ্গিন সেদিন। বাসন্তী, হলুদ সব রঙের ছড়াছড়ি চারিদিকে। ঘুম ভেংগে কোন রকমে ছুটে আসা বালকদের ঘুম আজকে ক্লাসের আগেই ভেংগে যায়। ক্লাস করবে না বলে বেরিয়ে যায় তাই একদল। আরে এমন দিনে কি ক্লাস করা যায়? এমন দিনে কারো না কারো হাত ধরে হাটতে হয়, বটতলায় গান শুনতে হয় কিছু না পারলে নিছক লাইব্রেরির সামনে চায়ের সাথে রাজা উজির মারতে হয়। প্রেমহীন, সাদামাটা আর সাহসহীন আমরা অপেক্ষা করি ক্লাসের আর বাকিরা আমাদের না পাওয়া সব নিয়ে বের হয়ে যায়। ফাগুন আবার নাড়া দিয়ে যায় হয়ত তাই ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকেই হাসি দিয়ে বলেন ফাল্গুনের শুভেচ্ছা। ক্লাসের জনসংখ্যার অনুপাত আর আমাদের অনুৎসক দৃষ্টি ম্যাডামের নজর এড়ায় না। তাই আধা ঘন্টা পরেই ছুটি। আমরা বুঝি ফাগুনের সেই হাওয়া মমতাজ ম্যাডামও এড়াতে পারেন না। ফাগুনের হাওয়া বুঝি সেই থেকে আমার ভিতর হিসেব অদল বদলের সূত্র হিসেবে আস্তানা গাড়ে।
সেই যুগে আমাদের একা একা কিছু করার উপায় ছিল না। এককাপ চা খাওয়া থেকে বই ফটোকপি, ক্রাশ থেকে প্রেম সব কিছুই বন্ধুদের না জানিয়ে উপায় নেই। আর না জানালে? মির জাফর, ব্যাটা মির জাফর। বয়সটাই বুঝি সেরকম ছিল। তাই বয়সের দোষে আমরা সেই সময় পহেলা ফাল্গুনে ছুটে বেড়াই একসাথে। সাহসহীন, প্রেমহীন একদল বালক বালিকা। সকালের বটতলা, চারুকলা বাঁ এখনকার সোশ্যাল সায়েন্স চত্তরের গান আর বিকালের টিএসসি। সন্ধ্যার পর বইমেলা আর সারাদিনব্যাপি আড্ডা। এরপর? আংগুলে গুণে গুণে বছর বাড়ে আর আমাদের কার কার সাহস বাড়ে। দলের ভিতরে বাহিরে প্রেমে পড়তে থাকে আস্তে আস্তে কমরেডগণ। হারাধনের মত তাই আমাদের সংখ্যা কমে। সাহসহীন, প্রেমহীন আমরা বাকি কয়েকজন আগের মত তাই ঘুরি, গান শুনি। টিউশনি হারাধনের আর কিছু ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যা চুরি করে নেয়। তাই অল্প কয়েকজন সন্ধ্যার পর ঘুরি। রঙ্গিন চারিদিক দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। আজ এই রাতের বেলা অর্ধ গোলার্ধ দূরে একা একা বসে সেই সময় দলের সদস্য সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে বাকিদের সাথে করা দীর্ঘশ্বাস মনে পরে একচোট হাসলাম। সময়ের সাথে সব কিছুর অর্থ বদলে যায় হয়ত।
অথবা, সব কিছুর অর্থ বদলে যায় না শেষ পর্যন্ত। তাই ফাগুনের হাওয়া পুরাতন শহর আর তার মানুষদের তুলে আনে এই মধ্যরাত্রিতে। হয়ত তাই ১৬৪৩ দিন পর কী বোর্ডে সংশয়ী আংগুল চলে- তুলে আনে সাদামাটা সব অর্থহীন গল্প।
মন্তব্য
তোমার লেখা দেখেই আমার মনে হলো শেষ কবে লিখেছিলে? চেক করে দেখলাম প্রায় সাড়ে চার বছর। লেখার শেষ বাক্যে তুমিও সেটা স্বীকার করে নিয়েছো। আবার লিখতে থাকবে কিনা জানি না তবে এখন লিখেছো সেটা দেখে ভালো লাগলো।
ফাগুনের ব্যাপারটাতে প্রকৃতির ভূমিকা সামান্যই, মনের ভূমিকাটাই সব। মনে রঙ লাগলে মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসেও ফাল্গুন আসতে পারে, বয়স চল্লিশ পার হলেও ফাল্গুন আসতে পারে। কারো জীবনে যদি কখনোই সেই সময় না আসে তাহলে তার মানবজন্ম অপূর্ণ থাকলো।
বাংলাদেশে কেউ অল বয়েজ/গার্লসে পড়ে আর কেউ কো-এড-এ পড়ে, তবে সকল গ্রুপ একই প্রকার শূন্যতায় ভোগে। যাদের প্রেম হয়, এবং যাদের প্রেম হয় না উভয় শ্রেণী কমন শূন্যতায় ভোগে। এটার কারণ সমাজ-সংস্কৃতির গঠনে নিবেশিত। এই শূন্যতা সহসা মেটবার নয়।
'প্রেমহীন' শব্দটাতে আমার আপত্তি আছে। বলবার সাহস নেই অথবা বলবার মতো কেউ নেই হলেই কি একজন মানুষ প্রেমহীন হয়? কক্ষনো না! তার হৃদয় পাত্র প্রেমমদিরায় পূর্ণ হয়ে উপচে পড়তে থাকে - কেউ যদি তা পান না করে তাহলে যে পান করলো না সেটা তার দুর্ভাগ্য।
গতকাল দেখলাম বাজারে হলুদ রঙের ফুলের চাহিদা ব্যাপক। যে কোন ফুলের নূন্যতম মূল্য কুড়ি টাকা - ফুলের ব্যাস অর্ধ্ব সেন্টিমিটার হলেও। আজ সন্ধ্যা থেকে লাল রঙের ফুলের চাহিদা বাড়বে। পয়লা ফাল্গুন বা ভালোবাসা দিবস এখন কয়েক শত কোটি টাকার বাণিজ্যের বিষয়। সুতরাং কতিপয় ব্যবসায়ীদের জীবনে ফাল্গুন প্রবলভাবে এসে হাজির হয়েছে।
সবার জীবনে ফাল্গুন আসুক। বার বার আসুক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তাইতো! এমন করে ভাবিনি কখনো।
........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
নিবিড়, সময় এবং সমসাময়িক বন্ধ হারানো দীর্ঘশ্বাস মনে হয় আমাদের সবার কমবেশী আছে। তোমার লেখা পড়ে অনেক স্মৃতি আমিও খুড়ে বের করলাম। তোমার এক পৃথীবি জুড়ে থাকা সঙ্গিনী আর মধুবন্তি
কে নিয়ে অনেক ভালো থাকো।
ফাগুনের শুভেচ্ছা তোমাদের
........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
স্যারের পুনরাগমন শুভ হোক, টেকসই হোক!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
প্রবাস নিয়ে, প্রেম ও প্রেমিকা নিয়ে, পাঠ্য ও অপাঠ্য পাঠ নিয়ে নিয়মিত পোস্টান।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
এইসব গল্প মন খারাপ করে দেয় বেশ। লেখাটা অনেক আগে পড়েছি, আজ মন্তব্য করতে এলাম।
লিখতে থাকো। মধুবন্তীকে নিয়ে লেখো। মধুবন্তীর মা'কে নিয়েও লেখো।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
নতুন মন্তব্য করুন