পর্ব তিনঃ মাইক
নামঃ মাইক
বয়সঃ ৪৮।
জন্মঃ মিসর
নাগরিকত্বঃ মার্কিন
পেশাঃ ক্যাবড্রাইভার
সম্পত্তিঃ পুরো আম্রিকা জুড়ে জুয়েলারি'র বক্স সরবরাহের ব্যবসা, ফ্লোরিডাতে অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবসা, নিউ জার্সিতে বাড়ি (যদিও সেখানে সে থাকে না, থাকে তার এক্স-ওয়াইফ, ছাড়াছাড়ি হলেও নিজেদের ব্যবসার কথা চিন্তা করে কোনরকম আইনি ঝামেলায় যায়নি। বর্তমানে তারা খুবই ভাল বন্ধু)। যখন ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসে তখন সে কল্পনা করতে পারেনি এত কিছু অর্জন করতে পারবে।
মাইকের সাথে পরিচয় চার্চে। মোহাম্মদ মাইক। ওর পুরো নাম এখানকার কেউ জানে না। আম্রিকা এসে তার প্রথম কাজ—নাম বদলে ফেলা। কারণ একাধিক, ধর্মান্তরিত হওয়া সে কারণগুলোর একটা নয়। চার্চে দেখা হলেও ও এবং আমি দুজনের কেউ খ্রিস্টান নই।
মাইক আর দেশে ফেরত যায়নি, মাইক মিসরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন।
মাইকের মতো আরও অনেকের সাথে কথা হয় চার্চে। ছোট শহরে এর চেয়ে ভালো ভাবে সকালটা কাটানো অন্য কোথাও আর সম্ভব না। প্রতিদিন নতুন চার্চ, নতুন মুখের সাথে পরিচয়, মাঝে মাঝে পুরনো চার্চে যাওয়া পুরনো মুখদের সাথে কথা বলা, তাদের সম্পর্কে জানা। জন মাঝে মাঝে আমাকে ঈর্ষা করে, "তোমার মতো হলে আমিও হয়তো প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন চার্চে যেতাম।" ওর প্রেসবেটেরিয়ান সত্ত্বা খুব প্রকট সহজে চার্চ বদলাবে না। যাবেও না।
প্রেসবেটেরিয়ান চার্চে আমার তেমন ভালো লাগে না, একদিন তো বাণী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দীর্ঘ একঘেয়ে বাণী আর আচার-প্রথা।
অন্যদিকে মাইকের সাথে যেখানে পরিচয়, সেখানে অন্য রকম এক পরিবেশ। ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সাধারণত রক্ষণশীল ধরা হয়। কিন্তু এখানে ব্যাপার অন্য। প্রথমদিন যাজক আলোচনা শুরু করেন ফার্গুসেনে ঘটা গোলাগুলি থেকে। দ্বিতীয় দিন সমকামিতা, তৃতীয় দিন নারীর অবস্থান বাইবেলে।
অন্যান্য যারা নিয়মিত চার্চে যান তারাও বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু যাজক তার আলোচনার কারণ ব্যাখ্যা করেন, " আর কতদিন মূল বিষয়ে কথা না বলে বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাবো? এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য চার্চের চেয়ে ভালো জায়গা হয় না।"
এখানে না আসলে হয়তো জানতেই পারতাম না খ্রিস্টানদের ডিনোমিনেসন কি কি এবং তারা কেন কিভাবে বিভক্ত হয়। জন প্রেসবেটেরিয়ান, ও একদিন আমাকে ওর বাবার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। ওর বাবা একজন যাজক। তিনি অনেক কিছু ব্যাখ্যা করেছিলেন।
মাইকের নির্দিষ্ট চার্চ, আমার মতো নয়। ওর সাথে পরিচয় হবার পর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মাঝখানে, ওর স্পীডবোটে চড়ে একদিন লেক ভ্রমনে যাওয়া হয়। লেকের পাশে ওর সুন্দর একটা বাড়ি, সেই বাড়িতে একা থাকে। বছরের ছয় মাস এখানে, বাকি ছয় মাস দেশ বিদেশ।
মাইককে জিজ্ঞেস করেছিলাম এত বয়সে একা থাকতে খারাপ লাগে কিনা, উত্তরে ও বলেছিল, একা থাকাটা আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন কেউ বেশিদিন কাছে থাকলে বরং বিরক্ত লাগে। ওর ধারণা এই একই কারণে ওর বিয়ে বেশিদিন টেকেনি।
মাইকের একটা মেয়ে আছে। বিয়ের অনেক আগে এক মার্কিন রমণীর সাথে ওর প্রেম হয়, এবং তার গর্ভেই মাইকের মেয়ে। মাইক জেনেছিল অনেক পরে। ইদানীং মাইক সেই মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্ট করছে। দায়িত্ব ছাড়া থাকতে ভালই লাগে, তবে মাঝে মাঝে দায়িত্ব নেওয়াটা খারাপ না, ওর মতে।
মাইকের কাহিনী বলার পেছনে কারণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। মাইকের ছোট ভাই কানাডাপ্রবাসী, রসায়নবিদ। মিসর থেকে সেও আম্রিকা এসেছিল, কিন্তু মাইকের অনেক পরে। মিসর থেকে আসার সময় তার সাথে ছিল মাহারা দুই সন্তান। পরে, কানাডা গিয়ে সে বিয়ে করে। সেই সংসারে এক সন্তান হয়, প্রতিবন্ধী।
এপ্রিলের এক সকালে মাইকের ভাই কাজে যাবার পর তার স্ত্রী শিশুটিকে হত্যা করে। মাইকের ভাই এবং তার স্ত্রী দুজনকেই এরপর গ্রেপ্তার করা হয়। মাইক সবকিছু ফেলে চলে যায় কানাডা, ভাইয়ের দুই সন্তানকে আগলে রাখতে।
মাইক ফিরে এসেছে, গত সপ্তাহে। মন খারাপ খুব। কারণ ও আর একটু ভেঙ্গে ব্যাখ্যা করলো, "নিজের মেয়ের পাশে যখন থাকার দরকার ছিলো, তখন থাকতে পারিনি। আমাকে বললেই পারতো ওর বউটা, আমি গিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আসতাম। আমার কাছে রাখতাম।"
এখন অবশ্য সবাই এখানে ছাত্র অবস্থায় বাচ্চা নিয়ে নেয়। সুবিধা অনেক, প্রথমত সরকার থেকে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যায় দ্বিতীয়ত,সন্তান হয়ে গেল আম্রিকার নাগরিক। আমার দেখা প্রায় প্রত্যেকে (যাদের বউ শুধুমাত্র গৃহিণী) ছাত্র অবস্থায় বাচ্চা নিয়ে নিয়েছে।
সন্তান কি জিনিস তা বুঝতে অনেক সময় লাগবে আমার। আমি খালি বিভিন্ন মানুষের বাচ্চা নেবার/না নেবার বিভিন্ন কারণ বোঝার চেষ্টা করি। বাচ্চা নিয়েও হতাশা, না নিয়েও হতাশা — প্রত্যক্ষ করি।
যেমনটা জন। জন ঠিক করেছে, বিয়ে করলেও কোনদিন বাচ্চা নেবে না। ওর মতে, "১০ বছর পর যেসব প্রযুক্তি আসবে, সন্তান নিয়ন্ত্রণে রাখা দুস্কর হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার সন্তান নিশ্চিত থাকো চার্চে যাবে না। আর আমি বাপ হলে প্রেসবেটেরিয়ানের বাপ হবো, অন্য কারো না।"
মন্তব্য
গ্লোবালাইজেশান এবং টেকনলজির এ প্রচন্ড যুগে সন্তানদের ধর্ম, সামাজিক মুল্যবোধ পিতামাতার ঠিক করে দেয়া সম্ভবত বেশ কঠিন।
সন্তান জন্মদানের মূল কারণ অর্থ উপার্জন বা নাগরিকত্ব পাওয়া হলে আসলেই ব্যাপারটা দুঃখজনক।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
জীবন বড়ই অদ্ভুত
পড়ে গেলাম...
ভাল লাগল। আর লিখুন।
-----------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/2015/06/sonnet-1.html
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ভালো লাগলো, আরো পড়ার আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম।
আবদুর
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
নতুন মন্তব্য করুন